অবসরের আগেও বিচারকদের সম্পদের হিসাব দিতে হবে
Published: 11th, February 2025 GMT
তিন বছর পরপর এবং অবসর নেওয়ার ছয় মাস আগে বিচারকদের ও তাঁদের ওপর নির্ভরশীল পরিবারের সদস্যদের সম্পদের বিবরণ সংগ্রহ করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্রকাশ করবে। এর পাশাপাশি বিচারিক দক্ষতা, আদালত ব্যবস্থাপনা, মামলা ব্যবস্থাপনা, আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বিচারকদের আচরণ পর্যবেক্ষণ-পর্যালোচনার কাজও করবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এমন প্রস্তাব রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের শৃঙ্খলা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধনী এবং যথাযথ কার্যপদ্ধতি প্রণয়নের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
বিচারকদের শৃঙ্খলা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধনী এবং যথাযথ কার্যপদ্ধতি প্রণয়নের সুপারিশ।বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনসহ ছয়টি সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন গত শনিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে প্রধান করে আট সদস্যের এই কমিশন গঠন করা হয়েছিল গত বছরের ৩ অক্টোবর। ৩৫২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে ৩১টি অধ্যায়ে বিচার বিভাগ সংস্কার নিয়ে নানা সুপারিশ ও প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে।
সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ ও শৃঙ্খলা’ অধ্যায়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সংস্কারের বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কাউন্সিল একটি স্থায়ী অভিযোগ গ্রহণপ্রক্রিয়া পরিচালনা করবে। যেখানে বিচারপ্রার্থী, আইনজীবী, আদালতের সহায়ক কর্মচারী ও অন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিচারকদের ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তা জানাতে পারবেন। কাউন্সিল একটি নিদিষ্ট সময় পরপর প্রাপ্ত অভিযোগগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত পরিচালনা করবে। বিষয়টি কাউন্সিলের কার্যবিধিতে অন্তভুক্ত করতে হবে। তদন্তে কোনো সাবেক বিচারকের বিরুদ্ধে তাঁর জন্য পালনীয় আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয় প্রমাণিত হলে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সতর্ক করা এবং উপযুক্ত ক্ষেত্রে ‘বিচারপতি’ পদবি ব্যবহার থেকে বারিত করা হবে।
বিচারাঙ্গনে দুর্নীতি-অনিয়মের সম্ভাব্য কারণ
প্রতিবেদনে ‘বিচার বিভাগে দুর্নীতি প্রতিরোধ’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, উচ্চ ও অধস্তন আদালত মিলিয়ে মোট বিচারকের সংখ্যা ২ হাজার ৩০০– এর কিছু বেশি। এই স্বল্পসংখ্যক বিচারকের মাধ্যমে ৪৩ লাখ মামলা নিষ্পত্তি করতে গিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হচ্ছে।
বিচারক, আইনজীবী, আদালতের কর্মচারী, আইনজীবীর সহকারী, পুলিশ বা তদন্ত কর্মকর্তাদের দায়িত্বশীলতার ঘাটতি; আদালত প্রাঙ্গণে কোনো তথ্য কেন্দ্র না থাকা; সংশ্লিষ্ট অংশীজনের দৈনিক কর্মঘণ্টার সর্বোচ্চ ব্যবহার না করা; অভিযোগ প্রতিকারের ব্যবস্থাপনা না থাকাসহ কয়েকটি বিষয়কে বিচারাঙ্গনে দুর্নীতি ও অনিয়মের জন্য চিহ্নিত করা যায় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিযোগ বাক্স স্থাপন
তিন বছর পর পর সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন আদালতের বিচারকদের সম্পত্তির বিবরণ সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো এবং তা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রকাশ করার কথা বলেছে সংস্কার কমিশন। তাদের সুপারিশে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ লিখিতভাবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে পৌঁছানোর জন্য সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ বাক্স স্থাপন এবং ই-মেইলের মাধ্যমে অভিযোগ দাখিলের জন্য নির্দিষ্ট ই–মেইল ঠিকানা জনসাধারণকে জানাতে হবে।
অধস্তন আদালতে কর্মরত বিচারকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের সমন্বয়ে তিন সদস্যের প্রাথমিক তদন্ত কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছে কমিশন। তদন্ত কমিটি প্রতি তিন মাস পরপর দাখিল হওয়া অভিযোগগুলো পরীক্ষা করবে এবং অভিযুক্তের বক্তব্য শুনবে। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা আছে কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে অভিযুক্ত বিচারকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের বা অন্যবিধ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেবে তদন্ত কমিটি।
বিচারাঙ্গনে দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য একটি অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থাপনা চালু করার সুপারিশ করেছে কমিশন। এ ছাড়া আইনজীবীদের দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য বার কাউন্সিলের মাধ্যমে দেশের প্রতিটি জেলায় অভিযোগ গ্রহণ এবং তা নিষ্পত্তির জন্য তদন্ত কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে।
‘আদালতের কর্মচারীরা ঘুষ চান’
‘বিচার বিভাগে দুর্নীতি প্রতিরোধ’ অধ্যায়ে বিচারাঙ্গনে দুর্নীতির বিষয়ে সংস্কার কমিশন পরিচালিত অনলাইন জরিপের ফলাফল উল্লেখ করা হয়েছে। নাগরিক, বিচারক ও আইনজীবীদের ওপর এই জরিপ করা হয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারী নাগরিকদের ৮৪ দশমিক ৯০ শতাংশ বলেছেন, আদালতের কর্মচারীরা ঘুষ চান। জরিপে প্রশ্ন ছিল—‘আদালতের কর্মচারী সম্পর্কে আপনার ধারণা কেমন’। মতামত দিয়েছেন ১১ হাজার ২২৫ জন।
একই প্রশ্নে আইনজীবীদের ৯১ দশমিক ৭০ শতাংশ বলেছেন, আদালতের কর্মচারীরা ঘুষ চান। জরিপে ২২৮ জন আইনজীবী মতামত দিয়েছেন।
কোর্ট সাপোর্ট স্টাফ (আদালতের সহায়ক কর্মচারী) সম্পর্কে ধারণা কেমন—এমন প্রশ্নে ১৮৮ জন বিচারক মতামত দেন। আদালতের কর্মচারীরা ঘুষ চান—এমন মতামত দিয়েছেন ১২৪ জন বিচারক, যা মতামত প্রদানকারী বিচারকদের ৬৬ শতাংশ।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য আইনজীবী তানিম হোসেইন শাওন প্রথম আলোকে বলেন, জরিপের ফলাফলে বিচারব্যবস্থায় জবাবদিহি নিশ্চিতে জনআকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পর্যায়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত প্রয়োজন, যাতে বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট অন্যদের ক্ষেত্রেও তা প্রয়োগ করা যায়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র স প র শ কর র ব চ রকদ র মত মত দ তদন ত ক আইনজ ব র জন য সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন, শুনানি হতে পারে রোববার
জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন স্থগিত চেয়ে আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এই আবেদনের ওপর আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আগামী রোববার শুনানি হতে পারে।
চিন্ময় দাসের জামিন প্রশ্নে রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্ট আজ বুধবার রায় দেন। রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে বিচারপতি মো. আতোয়ার রহমান ও বিচারপতি মো. আলী রেজার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। এর ফলে ওই মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাস জামিন পান।
এই জামিন স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করে, যা চেম্বার আদালতের কার্যতালিকায় ওঠে। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফরিদ উদ্দিন খান।
পরে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ প্রথম আলোকে বলেন, আবেদনটি জমা দেওয়া হয়েছে। শুনানি হয়নি। চেম্বার আদালত আগামী রোববার আবেদনটি শুনবেন।
এর আগে ওই মামলায় চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ গত ২ জানুয়ারি চিন্ময়ের জামিন আবেদন খারিজ করে আদেশ দিয়েছিলেন। এ নিয়ে হাইকোর্টে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন চেয়ে গত ১২ জানুয়ারি আবেদনটি করেছিলেন চিন্ময় দাস। এ আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ৪ ফেব্রুয়ারি রুল দেন হাইকোর্ট। আবেদনকারীকে (চিন্ময়) কেন জামিন দেওয়া হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়। চূড়ান্ত শুনানি শেষে আজ রায় দেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্টে চিন্ময় দাসের পক্ষে আইনজীবী জেড আই খান পান্না, প্রবীর হালদার ও অপূর্ব কুমার ভট্টাচার্য শুনানিতে ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুহাম্মদ আবদুল জব্বার ভুঞা, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফরিদ উদ্দিন খান উপস্থিত ছিলেন।
গত বছরের ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ খান বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে ওই মামলা করেন। পরে ফিরোজ খানকে বিএনপি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
চিন্ময় দাসের জামিন নামঞ্জুর হওয়া নিয়ে গত বছরের ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে সংঘর্ষ হয়েছিল। এ সময় আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। জামিন নামঞ্জুর হওয়ার পর চিন্ময় দাসকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন জামিন শুনানির দিন ধার্য থাকলেও আইনজীবী হত্যার প্রতিবাদে কর্মবিরতির ডাক দিলে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকে। পরে আদালত গত ৩ ডিসেম্বর শুনানির দিন রাখেন। সেদিন চিন্ময়ের কোনো আইনজীবী উপস্থিত না থাকায় আদালত শুনানির জন্য ২ জানুয়ারি পরবর্তী দিন রাখেন। সেদিন তাঁর জামিন আবেদন নামঞ্জুর হয়।
আরও পড়ুনরাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় চিন্ময় দাসের জামিন৩ ঘণ্টা আগে