সংবিধান সংশোধন: রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অধিকারের প্রশ্ন
Published: 11th, February 2025 GMT
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিটি সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উত্থাপন করেছে, যেখানে সংবিধানের মৌলিক নীতিগুলোর মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে বহুত্ববাদকে প্রতিষ্ঠিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এই প্রস্তাব নীতিগতভাবে সমাজের বৈচিত্র্য ও বিভিন্ন মতামতকে প্রতিফলিত করার প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
তবে বহুত্ববাদ একটি বহুমাত্রিক ধারণা হলেও এটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অনুপস্থিতির কারণে এর প্রয়োগ বেশ দুরূহ হয়ে উঠতে পারে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, সমাজে প্রকৃত অর্থে বহুত্ববাদী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাষ্ট্রকে মৌলিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করতে হয়। কারণ, ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রের সব নাগরিককে সমান দৃষ্টিতে দেখার নিশ্চয়তা দেয় এবং ধর্মীয় বিভাজন ও পক্ষপাত থেকে মুক্ত থেকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের ভিত্তি রচনা করে।
অন্যদিকে যদি ধর্মনিরপেক্ষতার স্থান বহুত্ববাদ গ্রহণ করে, তবে তার কার্যকারিতা নির্ভর করবে রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামো ও প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। এ প্রসঙ্গে একটি সুস্পষ্ট ও সুগঠিত কাঠামো ছাড়া শুধু বহুত্ববাদকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করা বাস্তবসম্মতভাবে কার্যকর করা সম্ভব না-ও হতে পারে।
বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়ের অন্যতম মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানের প্রাথমিক নীতিগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে গত কয়েক দশকে এই নীতি নানাবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে, যা দেশের ধর্মীয় বহুত্ববাদ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং সামাজিক সম্প্রীতির প্রতি রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতিকে নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিকাশের ধারায় ধর্মনিরপেক্ষতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা শুধু নৈতিক ও আদর্শিক গুরুত্বই বহন করে না, বরং এটি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, সামাজিক শান্তি ও গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার জন্যও অপরিহার্য। রাষ্ট্রের নীতি ও শাসনকাঠামোর মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার সুসংহত প্রয়োগ নিশ্চিত করা হলে তা নাগরিকদের সমান অধিকারের নিশ্চয়তা দেবে এবং বহুত্ববাদী সমাজব্যবস্থার টেকসই অগ্রগতিতে সহায়ক হবে।
বাংলাদেশ তার ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল, যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। ১৯৭২ সালের সংবিধানপ্রণেতারা একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আদর্শ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে সব নাগরিক সমান অধিকার ও স্বাধীনতা উপভোগ করবে।
তবে পরবর্তী রাজনৈতিক পটভূমি এবং নীতি পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা এই ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকে ক্রমে দুর্বল করে দেয়। বিভিন্ন সময়ে সংবিধান সংশোধন ও নীতি পুনর্গঠন, ধর্মনিরপেক্ষতার মূল প্রবক্তা হিসেবে দাবিদার আওয়ামী লীগের নামে মাত্র ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মতো রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বারা ধর্মনিরপেক্ষতার ‘প্রত্যাখ্যান’ ও রাষ্ট্রীয় নীতিতে ধর্মীয় উপাদানের ক্রমবর্ধমান সংযোজন, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর প্রভাব বিস্তার এবং বামপন্থী রাজনীতির ক্রমে সংকুচিত হয়ে পড়া—এসব বিষয় ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতিকে ক্রমান্বয়ে দুর্বল করেছে।
ফলে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক বক্তব্যে ধর্মীয় উপাদানের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে, যা অনেক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার এই ক্ষয় সমাজে বিভাজন বাড়িয়ে দিতে পারে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সামাজিক ঐক্যের ভিত্তিকে দুর্বল করতে পারে।
যদিও ১৯৭২ সালের সংবিধানের অন্যতম মৌলিক স্তম্ভ ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, তারপরও আওয়ামী লীগ গত দেড় দশকে এই নীতির মূল দর্শন থেকে ক্রমে দূরে সরে গেছে। দলটি অনেকাংশেই ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্যকে ভুল ব্যাখ্যা করে একে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে, বিশেষত বিরোধী মত দমন ও ক্ষমতা সংহতকরণের ক্ষেত্রে। এই বিচ্যুতি শুধু দেশের প্রতিষ্ঠাকালের আদর্শকে দুর্বল করেনি, বরং সমাজের বিভিন্ন স্তরে আস্থার সংকটও তৈরি করেছে।
এ প্রেক্ষাপটে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতিকে নতুন করে মূল্যায়ন ও পুনর্ব্যক্ত করার জরুরি প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত দেয়।
আমাদের সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মনিরপেক্ষতা কোনোভাবেই ধর্মকে প্রত্যাখ্যান নয়, বরং এটি প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিজ বিশ্বাস ও ধর্মাচার পালন এবং তাদের প্রতি রাষ্ট্রের সমান আচরণ নিশ্চিত করা এবং রাষ্ট্রকে ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত রাখা নিশ্চিত করার একটি নীতি।একটি সুসংহত ও কার্যকর ধর্মনিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সব নাগরিক, তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসনির্বিশেষে ন্যায়সংগত ও সমান মর্যাদার সঙ্গে আচরণ পাবে, এমন নিশ্চয়তা বিধান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
আমাদের সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মনিরপেক্ষতা কোনোভাবেই ধর্মকে প্রত্যাখ্যান নয়, বরং এটি প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিজ বিশ্বাস ও ধর্মাচার পালন এবং তাদের প্রতি রাষ্ট্রের সমান আচরণ নিশ্চিত করা এবং রাষ্ট্রকে ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত রাখা নিশ্চিত করার একটি নীতি।
এর মূল দর্শন হলো, রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম অন্য ধর্মগুলোর ওপর প্রাধান্য পাবে না, বরং নাগরিকদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অবিশ্বাসনির্বিশেষে সমান অধিকার ও মর্যাদা দেওয়া হবে। এই নীতি বিশ্বাসের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করে, বৈষম্য রোধ করে এবং ধর্মীয় বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি সুদৃঢ় করে।
বাংলাদেশের মতো একটি সমাজে, যেখানে নানা ধর্ম রয়েছে এবং ধর্মীয় সহাবস্থানের একটি দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা কেবল একটি সাংবিধানিক আদর্শই নয়, বরং চরমপন্থা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে একটি কার্যকর রক্ষাকবচ।
এটি নিশ্চিত করে, সব নাগরিক তাদের ধর্মীয় পরিচয়নির্বিশেষে সমান সুযোগ ও অধিকারের অধিকারী হবে। একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা এই নীতিরও প্রতিফলন ঘটায় যে ধর্ম ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয়। রাষ্ট্রের নীতি ও কার্যক্রমে এর কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করা উচিত নয়।
এ ছাড়া ক্রমবর্ধমান বিশ্বায়নের পটভূমিতে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে আরও সুসংহত ও সম্প্রসারিত করতে পারে। যেসব দেশ ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদকে নীতিগতভাবে ধারণ করে, সেগুলো সাধারণত সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল থাকে এবং বিদেশি বিনিয়োগ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য আরও আকর্ষণীয় হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন ও বৈশ্বিক অংশগ্রহণের জন্য ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।
কিছু মত অনুসারে, ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে বহুত্ববাদই বাংলাদেশের জন্য অধিকতর উপযোগী হতে পারে। বহুত্ববাদ এমন একটি ব্যবস্থা, যা বহু ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দেয় এবং পারস্পরিক সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি করে। তবে এটি ধর্মনিরপেক্ষতার মতো কাঠামোগত নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করে না।
যদি বহুত্ববাদ কোনো ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত না হয়, তবে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে ধর্মীয় পক্ষপাত ও প্রভাব ঢুকে পড়ার ঝুঁকি থেকে যায়, যা নাগরিকের সমান অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করার পথে অন্তরায় হতে পারে।
এর পাশাপাশি বহুত্ববাদ ধারণাগতভাবে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এই ভারসাম্য সব সময় বজায় থাকে না। যদি রাষ্ট্র নিজেই ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ না করে এবং সক্রিয়ভাবে ধর্মীয় নিরপেক্ষতা রক্ষা না করে, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠী বা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তিগুলোর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ঝুঁকি থেকেই যায়।
তাই বহুত্ববাদ নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক মূল্যবোধ হলেও এটি বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার মৌলিক নীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিপূরক হওয়া উচিত, এটির বিকল্প নয়।
রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলো সমান মর্যাদা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে। প্রকৃত বহুত্ববাদ কেবল তখনই কার্যকর হতে পারে, যখন তা একটি ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়।
যদিও বাংলাদেশের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি আনুষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে, তবু বাস্তবে দেশটি চরমপন্থা, রাজনৈতিক সুবিধাবাদ ও সামাজিক অসহিষ্ণুতার মতো বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হলে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দ্ব্যর্থহীনভাবে এমন সব নীতিকে সমর্থন করতে হবে, যা ধর্মীয় স্বাধীনতা সুরক্ষিত করে এবং ধর্মীয় ও সামাজিক বৈষম্য প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
এ ক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থায় সহনশীলতা, বহুমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহাবস্থানের মূল্যবোধ অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি; পাশাপাশি সুশীল সমাজ ও নাগরিক সংগঠনগুলোকে বিভাজনমূলক বক্তব্য ও উসকানিমূলক চর্চার বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে, যাতে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদের আদর্শ সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
ধর্মনিরপেক্ষতা শুধু একটি আদর্শিক নীতি নয়। এটি একটি সংহত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অগ্রসরমাণ বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য শর্ত। দেশটি যখন উচ্চমধ্যম আয়ের অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার পথে অগ্রসর হচ্ছে এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করছে, তখন একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও সমতাভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা নিশ্চিত করা টেকসই প্রবৃদ্ধি, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এ ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার প্রশ্নটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে একটি উদার, সহনশীল ও সম্প্রীতিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার মৌলিক শর্ত। ধর্মনিরপেক্ষ নীতির দৃঢ় বাস্তবায়নই নিশ্চিত করতে পারে সব নাগরিক, তাদের ধর্মীয় পরিচয়নির্বিশেষে সমান অধিকার ও সুযোগ ভোগ করবে, যা জাতীয় ঐক্য ও টেকসই উন্নয়নের অন্যতম ভিত্তি।
সেলিম রায়হান অর্থনীতির অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নির্বাহী পরিচালক, সানেম
[email protected] (এই নিবন্ধের মতামত লেখকের নিজস্ব)
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন শ চ ত কর র গণত ন ত র ক র জন ত ক ব যবস থ ক র যকর পর প র র জন য এই ন ত আদর শ র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ‘ফ্যাসিবাদী আচরণের’ অভিযোগ, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বললেন আসিফ মাহমুদ
একজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে কুমিল্লার মুরাদনগরে ‘ফ্যাসিবাদী আচরণের’ অভিযোগ করেছেন একদল ব্যক্তি। আজ মঙ্গলবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘মুরাদনগর উপজেলা সনাতন ধর্মাবলম্বী জনতা’ ব্যানারে এই সংবাদ সম্মেলন হয়। সেখানে মুরাদনগর থেকে আসা সনাতন ধর্মের কয়েকজন কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে যুব ও ক্রীড়া এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার বাবা ও চাচাতো ভাইয়ের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের অভযোগ করা হয়। তা ছাড়া পুলিশকে ব্যবহার করে নির্যাতন চালানোর অভিযোগ তুলে এই উপদেষ্টার পদত্যাগও দাবি করেন সংবাদ সম্মেলনকারীরা। তবে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এলাকার সাবেক একজন সংসদ সদস্যের অনুসারীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব করছেন।
সংবাদ সম্মেলনে ‘সর্ব ধর্ম মিশন’র প্রচারক পরিচয় দিয়ে দুলাল দেবনাথ বলেন, ‘বিগত ১৫ বছর ইউসুফ আবদুল্লাহর (আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন) নেতৃত্বে সন্ত্রাসী কার্যক্রম করা আওয়ামী লীগের দোসরেরা আজ উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বাবার ও ভাইয়ের নেতৃত্বে মুরাদনগরে পুনর্বাসিত হওয়ার চেষ্টা করছে এবং কায়কোবাদ (বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ) সাহেবের সুনামকে নষ্ট করার জন্য তারা বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে। ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে আমরা তার (উপদেষ্টার) পদত্যাগ চাই।’
অভিযোগ করে দুলাল দেবনাথ আরও বলেন, ‘উপদেষ্টা আসিফ ভুঁইয়ার বাবা আজকে আমার বাড়িতে দুজন হিন্দু কমিউনিটির লোক পাঠিয়ে বাধা সৃষ্টি করেছে, আমি যেন এই প্রোগ্রামে না আসতে পারি। এ ছাড়া আমরা মুরাদনগর থেকে ঢাকায় আসার পথে কুমিল্লার দাউদকান্দি টোল প্লাজায় গাড়ির কাগজপত্র চেকের (যাচাই বাছাই) নামে এক ঘণ্টা আটকে রাখা হয়।’
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মুরাদনগর উপজেলা পূজা উদ্যাপন কমিটির সহসভাপতি দীন দয়াল পাল। তিনি বলেন, মুরাদনগর উপজেলায় যানজট নিরসনে সাবেক পাঁচবারের এমপি মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেন। তবে পুলিশকে ব্যবহার করে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বাবা, চাচাতো ভাই ছাত্রলীগ নেতা–কর্মীদের দিয়ে স্বেচ্ছাসেবকদের মারধর করায়। পরে এই স্বেচ্ছাসেবকদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে থানার সামনে বিক্ষোভ মিছিল হয় এবং সেদিন সেনাবাহিনী ও পুলিশের সঙ্গে রাতভর সালিসও চলে। অথচ রাতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সালিসে বসে বিষয়টি সমাধান করতে আসা বিএনপি নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দেয় এবং পবিত্র ঈদ ও রমজানজুড়ে পুরো মুরাদনগরে পুলিশ ও ডিবি আতঙ্ক বিরাজ করে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন মুরাদ নগর ইউনিয়ন পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক রঞ্জন রায়, কামাল্লা দেবপরি মন্দির কমপ্লেক্সের সাংস্কৃতিক সম্পাদক বিপ্লব কুমার সাহা, নিবাস চন্দ্র ঘোষ, দয়ানন্দ ঠাকুর।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন এর আগেও একটি সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছিল। আমার কাছে যে তথ্য রয়েছে, কয়েকজন সনাতন ধর্মাবলম্বী নেতাকে সামনে রেখে এটি করা হচ্ছে, যারা সাবেক এমপি কায়কোবাদের সঙ্গে রাজনীতি করেন। সনাতন ধর্মাবলম্বী অনেককে এসি বাসে করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে এবং তাদের প্রত্যেককে নির্দিষ্ট পরিমাণ একটা অর্থ দেওয়া হয়েছে।’
বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য কায়কোবাদের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বলেছেন, ‘বরং কায়কোবাদ আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক এমপি জাহাঙ্গীরের সঙ্গে থেকে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, বালু উত্তোলন, মাটি উত্তোলনের অবৈধ কাজগুলোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন করছেন এবং সবাইকে নিয়ে রাজনীতি করছেন।’
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘একটা ভিডিওতে দেখেছি, যারা এক সময় কায়কোবাদের ফাঁসি চেয়ে মিছিল করেছিল, তারা এখন কায়কোবাদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করেন। যদি আপনি মুরাদনগরের সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞাসা করেন কী অবস্থা এলাকার? তাহলে তারা চাঁদাবাজ ও মাদক ব্যবসায়ীদের যে অত্যাচার, সে কথা আপনাদের বলবে।’