দুর্নীতির ধারণা সূচক: লাগামছাড়া দুর্নীতি, সামলানো সম্ভব?
Published: 12th, February 2025 GMT
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ২০২৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তাদের বার্ষিক দুর্নীতি ধারণা সূচক–২০২৪ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ এবার ১০০-এর মধ্যে মাত্র ২৩ স্কোর পেয়েছে, যা ২০২৩ সালের চেয়ে ১ পয়েন্ট কম। বাংলাদেশের অবস্থান গত বছরের তুলনায় দুই ধাপ পিছিয়ে এবার ১৫১তম। ২০১২ সালের পর এবার বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে খারাপ। এ থেকে আমাদের জন্য তিনটি উদ্বেগজনক বিষয় উঠে এসেছে।
প্রথমত, বাংলাদেশ এখন সেই দেশগুলোর মধ্যে পড়ছে, যারা দুর্নীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, যেসব দেশ ৫০-এর নিচে স্কোর পেয়েছে, তাদের ‘গুরুতর দুর্নীতিগ্রস্ত’ ধরা হয়। বাংলাদেশ সেই তালিকায় রয়েছে। তৃতীয়ত, আমাদের স্কোর বৈশ্বিক গড় ৪৩-এর তুলনায় ২০ পয়েন্ট কম। ফলে বাংলাদেশকে ‘অত্যন্ত গুরুতর দুর্নীতিগ্রস্ত’ দেশের তালিকায় ফেলা হয়েছে।
এ সূচকে অন্তর্ভুক্ত ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিক থেকে ১৪তম। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ এখনো নিচের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এ অঞ্চলে শুধু আফগানিস্তান আমাদের চেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে। এ ছাড়া পুরো এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমরা পঞ্চম সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছি।
বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার অধীনে থাকা ৫৯টি দেশের গড় স্কোরের তুলনায় ৯ পয়েন্ট পিছিয়ে রয়েছে। এমনকি তা জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে সবচেয়ে নিচের ৩৩টি দেশের গড় স্কোরের চেয়েও ৬ পয়েন্ট কম এবং ২০২৩ সালে ‘নাগরিক সমাজের জন্য সীমিত’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ ২৭টি দেশের গড় স্কোরের চেয়েও ৬ পয়েন্ট কম। আরও লজ্জাজনকভাবে বাংলাদেশের সূচক সাব-সাহারান আফ্রিকার গড় সূচকের চেয়ে ১০ পয়েন্ট কম। অথচ সাব-সাহারান অঞ্চলকে দুর্নীতি সূচকের সবচেয়ে দুর্বল পারফরম্যান্সকারী অঞ্চল হিসেবে ধরা হয়।
২০২৩ সালের তুলনায় এ বছর বিশ্বব্যাপী গড় সূচক আরও খারাপ হয়েছে। বৈশ্বিক গড় হচ্ছে ৪৩। বিশ্বের ১২২টি দেশ ৫০-এর নিচে স্কোর করেছে। ১০১টি দেশ পেয়েছে ৪৩-এর কম। এর অর্থ হলো বিশ্বের ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ বসবাস করছে এমন দেশে, যেগুলো ‘অত্যন্ত গুরুতরভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত’। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভুটান এবারও সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত। অন্য সব দেশ বৈশ্বিক গড় ৪৩-এর নিচে রয়েছে—ভারত ও মালদ্বীপ ৩৮, নেপাল ৩৪, শ্রীলঙ্কা ৩২, পাকিস্তান ২৭ ও আফগানিস্তান ১৭।
ভুটান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশই ২০২৩ সালের তুলনায় খারাপ করেছে। তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরও খারাপ। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দমনমূলক রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত ছিল। এই দুই দেশই ২০১২ সালের পর এ বছর সবচেয়ে খারাপ করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান ছাড়া বাকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো ২০১২ সালের তুলনায় কিছুটা উন্নতি করেছে। পাকিস্তানের স্কোর অপরিবর্তিত রয়েছে। এ সূচক স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে যে দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশই দুর্নীতির বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। বরং অনেকের অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে।
২০২৪ সালের দুর্নীতি ধারণা সূচকের মূল বার্তা হলো দুর্নীতি শুধু একটি উন্নয়নগত চ্যালেঞ্জ নয়। এটা হলো দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে ক্ষমতার অপব্যবহারের ফল। এই অপব্যবহার গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। উচ্চ স্কোর পাওয়া দেশগুলো তুলনামূলকভাবে কম দুর্নীতিগ্রস্ত বলে মনে করা হয়। কিন্তু বাস্তবে তাদের অনেকেই অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে।
এসব দেশের অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর কালোটাকা মজুতের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ এই কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলো অন্য দেশগুলোর দুর্নীতির সুবিধাভোগী হয় এবং সেই অর্থ তাদের অর্থনীতিতে প্রবাহিত হয়।
মজার ব্যাপার হলো বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগীরা এ ধারণা সূচকে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তৃতীয় স্থানে থাকা সিঙ্গাপুর (৮৪), পঞ্চম স্থানে থাকা সুইজারল্যান্ড (৮০), দশম স্থানে থাকা অস্ট্রেলিয়া (৭৭), ১৫তম স্থানে থাকা কানাডা (৭৫), ১৭তম স্থানে থাকা হংকং (৭৪), ২০তম স্থানে থাকা যুক্তরাজ্য (৭১), ২৩তম স্থানে থাকা সংযুক্ত আরব আমিরাত (৬৮), ২৮তম স্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্র (৬৫) এবং ৫৭তম স্থানে থাকা মালয়েশিয়া (৫০)—এই দেশগুলোই বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকার প্রধান গন্তব্য।
এটি স্পষ্ট যে দুর্নীতি দমনকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন নীতির মূলধারায় নিয়ে আসা জরুরি। যদি তা না করা হয়, তাহলে এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়বে উন্নয়ন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের ওপর। বাংলাদেশ গত ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের সময় দুর্নীতির ভয়াবহ পরিণতি প্রত্যক্ষ করেছে। এর ফলে দেশের অর্থনীতি ও সমাজ পড়েছে গভীর সংকটে। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতেও একই ধরনের পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে।
২০২৪-এর সময়কালে লুটপাটনির্ভর স্বৈরশাসন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে দুর্নীতি রক্ষা এবং প্রসারের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। এ সময় সরকারি খাতে দুর্নীতি আরও তীব্র হয়। বিশেষ করে সরকারি কেনাকাটা ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে। উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের স্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো, যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগ কাজ করে গেছে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবের অধীন। এ পরিস্থিতিই দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্বৈরশাসনের পতনের পরও ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির চর্চা অব্যাহত ছিল। বিশেষ করে চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির কেন্দ্রগুলো দখলের জন্য দলীয় গোষ্ঠীগুলোর সংঘাত বিদ্যমান ছিল। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মুক্ত গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রেও ঝুঁকি অব্যাহত ছিল। এসব কারণই হয়তো বাংলাদেশ দুর্নীতি ধারণার সূচকে নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।
এসবের সমাধান কোনো জটিল বিষয় নয়। দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষ করে এর প্রকৃত স্বাধীনতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া এবং তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার মাধ্যমে উদাহরণ তৈরি করতে হবে।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে, যাতে তারা পেশাদারত্ব ও নৈতিকতার মান বজায় রেখে কাজ করতে পারে। বিশেষ করে দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। জনস্বার্থ–সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোকে দখলদারত্ব, স্বার্থের সংঘাত এবং দলীয় রাজনৈতিক বা অন্যান্য প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
এসব খাতের মধ্যে রয়েছে সরকারি কেনাকাটা, ব্যাংকিং, বাণিজ্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ভূমি ও অবকাঠামো। গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে তারা দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ, প্রতিবেদন তৈরির পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কৃতি এমনভাবে পরিবর্তন করতে হবে, যাতে রাজনৈতিক ও সরকারি পদগুলোকে ব্যক্তিগত লাভের সুযোগ হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা বন্ধ হয়।
ড.
ইফতেখারুজ্জামান নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ২০২৩ স ল ব শ ষ কর র জন ত ক র অবস থ ব যবস থ অবস থ ন ব যবহ র র র জন আম দ র র জন য ন ট কম সবচ য় র সবচ সবচ য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
আরও বিস্তৃত হয়েছে শ্রমিকের সংগ্রামের জমিন
মে দিবস। পৃথিবীর খেটে খাওয়া মানুষের দিন। ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরে আট ঘণ্টা শ্রমদিবসের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন শ্রমিকেরা। পুলিশের গুলিতে বহু মানুষ প্রাণ হারান। কিন্তু সেই রক্তের বিনিময়েই কাগজে–কলমে হলেও প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমের মর্যাদা, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা, ন্যায্য মজুরি ও সংগঠনের অধিকার। একসময় এসব দাবিই রূপ নেয় আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের ভিত্তিতে।
কিন্তু ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে আমরা যখন এই দিনে ফিরে তাকাই, তখন প্রশ্ন আসে, এখনো কি সেই সব দাবি প্রাসঙ্গিক? নাকি সময় পাল্টে দিয়েছে সব? এখন তো কাজের ধরনই বদলে গেছে—একদিকে অটোমেশন, অন্যদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয়যাত্রা। উৎপাদনের পদ্ধতি যেভাবে বদলেছে, তাতে পুরোনো ধরনের শ্রমিক যেন ক্রমে অদৃশ্য হয়ে পড়ছেন।
আজকের দুনিয়ায় পুঁজি এক ক্লিকে দেশান্তরিত হয়, কারখানা গড়ে ওঠে যেখানে মজুরি কম এবং আইনের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল। মানুষ এখন আর কেবল শ্রমিক নয়; তাঁদের বলা হচ্ছে ‘ফ্রিল্যান্সার’, ‘কন্ট্রিবিউটর’, ‘পার্টনার’, ‘ডেলিভারি ম্যান’। কিন্তু আসলে, এদের অনেকেই এক নতুন ধরনের দিনমজুর; যাঁদের নেই নিরাপত্তা, নেই সুনির্দিষ্ট অধিকার। কাজ করছেন তাঁরা—কখনো রাস্তায় খাবার পৌঁছে দিয়ে, কখনো কম্পিউটারে চ্যাটবট প্রশিক্ষণ দিয়ে, আবার কখনো অ্যালগরিদম পরিশোধনে; কিন্তু কেউই প্রাতিষ্ঠানিক কর্মী নন। তাঁরা জানেন না যে তাঁদের কাজের ফল কোথায় যাবে, কীভাবে ব্যবহৃত হবে।
এই ব্যবস্থার একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে অ্যামাজন। তাদের গুদাম ও সরবরাহ চেইনে রোবট, ড্রোন ও এআই প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। শ্রমিকেরা সেখানে নির্ধারিত সময়ের বেশি কাজ করতে বাধ্য হন, মেশিনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। অথচ যখন তাঁরা সংগঠিত হতে চান, তখন কোম্পানির বিরুদ্ধে ওঠে লবিং, বিরোধিতা, ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ। ২০২৩ সালে অ্যামাজনের একাধিক গুদামে ইউনিয়ন গঠনের চেষ্টাকে রুখে দিতে কোম্পানিটি কোটি কোটি ডলার খরচ করে আইনি দল গঠন করে।
মে দিবস আজও জীবিত; কিন্তু তার সংগ্রামের মাঠ আরও বিস্তৃত হয়ে গেছে। তা এখন শুধু কারখানার ফটক নয়; সার্ভার রুমে, ডেটা সেন্টারে, কোড লাইনে, ক্লাউড সিস্টেমে। কিন্তু যেখানেই হোক শ্রমিক তো সে–ই, যাঁর শ্রমে পৃথিবী চলে, যাঁকে ছাড়া কিছুই চলে নাশুধু অ্যামাজন নয়, গোটা দুনিয়াতেই শ্রমের এক নতুন রূপ তৈরি হচ্ছে—ডিজিটাল ও প্ল্যাটফর্মভিত্তিক শ্রম। এই ব্যবস্থায় শ্রমিকেরা কাজ করেন উবার, ফুডপান্ডা, আপওয়ার্ক বা ফাইভারের মতো অ্যাপে যুক্ত হয়ে। অথচ তাঁদের নেই কোনো কর্মস্থল, নেই কর্মঘণ্টার নিশ্চয়তা, নেই অসুস্থতার ছুটি বা পেনশনের মতো সামাজিক সুরক্ষা। বাস্তবে তাঁরা একা, বিচ্ছিন্ন। প্রতিযোগিতার চাপে তাঁদের ঠেলে দেওয়া হয় অনিরাপত্তার ভেতর।
২০২৩ সালের একটি আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশের অন্তত ৮০% গিগ-ওয়ার্কার দিনে ১০ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন। অথচ তাঁদের দুই-তৃতীয়াংশ মাস শেষে কোনো নির্দিষ্ট ন্যূনতম মজুরি পান না। গ্লোবাল গিগ ইকোনমির এই বাস্তবতা বাংলাদেশেও দৃশ্যমান। আমাদের শহরগুলোয় এখন হাজারো বাইক বা সাইকেলচালক কাজ করছেন খাবার কিংবা পণ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য, কিন্তু তাঁরা কেউই প্রাতিষ্ঠানিক কর্মী নন।
এর পাশাপাশি আরও একটি বড় পরিবর্তন এনেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থান। প্রশ্ন উঠেছে, এআই কি শ্রমিকের বন্ধু, না প্রতিদ্বন্দ্বী? যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার এক গবেষণা অনুযায়ী, আগামী ৫ বছরে এআই কমপক্ষে ৮০ কোটি মানুষের কাজের ধরন পাল্টে দেবে। এর মধ্যে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ সম্পূর্ণভাবে কাজ হারাতে পারেন। হোয়াইট-কলার পেশাগুলো যেমন হিসাবরক্ষণ, গ্রাহকসেবা, এমনকি সাংবাদিকতার কাজও এই প্রযুক্তির কারণে সংকটে পড়ছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০২৩ সালের ‘দ্য ফিউচার অব জবস’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৮ কোটি ৫০ লাখ কাজ হারিয়ে যাবে প্রযুক্তি ও অটোমেশনের কারণে। তবে একটা মৌলিক প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। যদি উৎপাদিত পণ্যের খরিদ্দার না থাকে, তাহলে উৎপাদন করে কীভাবে মুনাফা আসবে? আর শ্রমিক না থাকলে কিনবে কে? তবে একই সময়ে ৯ কোটি ৭০ লাখ নতুন ধরনের কাজের সৃষ্টি হতে পারে। কাজগুলো হবে ডেটা অ্যানালিটিকস, প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালনা এবং সৃজনশীল ও মানবিক দক্ষতানির্ভর কাজ। এই নতুন শ্রমিকদের অবস্থার কথা ওপরে বলা হয়েছে।
কিন্তু এই নতুন কাজের মালিকানা কার হাতে? শ্রমিকদের নয়, রাষ্ট্রেরও নয়—এই ক্ষমতা এখন করপোরেট অলিগার্কদের হাতে কেন্দ্রীভূত। যুক্তরাষ্ট্রে ইলন মাস্ক, জেফ বেজোস, মার্ক জাকারবার্গদের মতো প্রযুক্তি ধনকুবেররা শুধু প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রকই নন, তাঁরা রাজনীতিতেও সরাসরি প্রভাব ফেলছেন। করপোরেট লবিংয়ের মাধ্যমে আইন তৈরির পেছনে তাঁদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে; যেমন ট্যাক্স ছাড়, শ্রম আইন শিথিলকরণ বা প্রতিযোগিতা নীতির ধ্বংস।
বাংলাদেশেও দৃশ্যপট খুব আলাদা নয়। তৈরি পোশাকশিল্পে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যাঁরা দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতের ভিত্তি। কিন্তু তাঁরা এখনো ন্যূনতম মানবিক মজুরি পান না। গত বছর শ্রমিকেরা ন্যূনতম ২৩ হাজার টাকা মজুরি চাইলেও সরকার তা নামিয়ে ১২ হাজারে নিয়ে আসে। আন্দোলনের জবাবে আসে পুলিশি দমন, ধরপাকড়, ভয়ের পরিবেশ। মালিকেরা নতুন প্রযুক্তি বসিয়ে আরও কম শ্রমিক দিয়ে আরও বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করবেন। আগে–পরে এটা অবধারিত।
এই প্রেক্ষাপটে মে দিবস আজ আমাদের সামনে এক নতুন প্রশ্ন তোলে—শ্রমিক আসলে কে? তাঁর অধিকার কী? আর লড়াইটা কিসের জন্য?
যদি শ্রমিকের সংজ্ঞাই বদলে যায়, তাহলে লড়াইয়ের রূপও কি পাল্টাতে হবে না? একসময়ের আট ঘণ্টার কাজের দাবি এখন হয়তো পুরোনো মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে বহু মানুষ এখনো দিনে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করছেন। কেউ কাজ পাচ্ছেন না, কেউ কাজ করেও মাস শেষে ঠিকমতো পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। কেউ এমন এক ধরনের ডিজিটাল শ্রম করছেন, যার নিয়ন্ত্রণ বা মালিকানা তাঁর নয়, তিনি জানেনই না যে কার জন্য কাজ করছেন।
তাই আজ মে দিবস শুধু অতীত স্মরণের দিন নয়—এটি ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনারও দিন। এটি নতুন ধরনের দাবির জায়গা—ডিজিটাল শ্রমের স্বীকৃতি, গিগ-ওয়ার্কারদের অধিকার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে জনসাধারণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি। আর অবশ্যই আমাদের মতো দেশে গায়ে খাটা শ্রমের ন্যায্য মজুরির দাবি।
মে দিবস আজও জীবিত; কিন্তু তার সংগ্রামের মাঠ আরও বিস্তৃত হয়ে গেছে। তা এখন শুধু কারখানার ফটক নয়, সার্ভার রুমে, ডেটা সেন্টারে, কোড লাইনে, ক্লাউড সিস্টেমে। কিন্তু যেখানেই হোক, শ্রমিক তো সে–ই, যাঁর শ্রমে পৃথিবী চলে, যাঁকে ছাড়া কিছুই চলে না।
এই সত্য যত দিন থাকবে, মে দিবস তত দিন থাকবে; নতুন প্রশ্ন নিয়ে, নতুন লড়াই নিয়ে।
জাভেদ হুসেন প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী