যে বইয়ে আছে শেখ হাসিনার পতনের প্রেক্ষাপট
Published: 14th, February 2025 GMT
শেখ হাসিনার পতনের পেছনে তাঁর ক্রমাগত দুঃশাসন, প্রহসনের নির্বাচন, ভয় আর বিচারহীনতার সংস্কৃতি দায়ী, এটা সবার জানা। কিন্তু কীভাবে দিনে দিনে এগুলো রপ্ত করেছিলেন তিনি, সম্প্রতি প্রকাশিত শেখ হাসিনার পতনকাল বইয়ে তা–ই তুলে ধরেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক আসিফ নজরুল। শেখ হাসিনার শাসনের অন্তিম সময় এবং তাঁর পতনের প্রেক্ষাপট এখানে মলাটবদ্ধ হয়েছে সহজ ভাষায়।
বইটির লেখাগুলো ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে রচিত। এ বইয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো উঠে এসেছে। সে হিসেবে বলা যায়, এই বইয়ের লেখাগুলো তার অন্যতম। লেখক এই অভ্যুত্থানকে কেবল একটি রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে নয়, বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
১০টি অধ্যায়ে বিভক্ত বইয়ে লেখক পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের রাজনীতি, নির্বাচন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচার বিভাগের সংকট নিয়ে আলোচনা করেছেন, একইভাবে এ পুস্তকে ধরা আছে শিক্ষাঙ্গনে অরাজকতা, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ও ‘উন্নয়ন’–এর নামে অনৈতিকতার চর্চা, ভারত-নীতি ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা নিয়ে বিশ্লেষণ। প্রতিটি অধ্যায়েই ঘটনা এবং ঘটনার বিশ্লেষণ–পরম্পরায় স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শাসনের আগাপাছতলা তুলে ধরেছেন লেখক। ফলে স্বভাবতই বিগত শাসকের পতনের প্রেক্ষাপট তৈরির কারণগুলো এ বই থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায়।
প্রথম অধ্যায়েই আসিফ নজরুল দেখিয়েছেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সংকট কোথায়। তাদের নীতি ও কৌশল এবং ব্যক্তিপূজা ও সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ‘রাজনীতিহীন রাজনৈতিক দল’ ও ‘কুৎসার রাজনীতি’ শিরোনামের লেখাগুলোয় রাজনৈতিক আদর্শের অভাব এবং ঘৃণার রাজনীতি কীভাবে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট করেছে, তা দেখানো হয়েছে। লেখক আরও দেখিয়েছেন, কীভাবে বাংলাদেশে রাজনীতি ব্যক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে এবং গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে।
‘নির্বাচনী প্রহসন’ নামে দ্বিতীয় অধ্যায়টি বইটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার সংকট, ভোট কারচুপি, প্রশাসনের ভূমিকা এবং বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন যে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, সেসব বিশ্লেষিত হয়েছে। লেখক এ অধ্যায়ে সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কৌশল ও বিরোধী দল দমনের পদ্ধতিগুলো উদাহরণসমেত উন্মোচন করেছেন। দেখিয়েছেন, জনমানুষের মুক্তিযুদ্ধকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে শেখ হাসিনা কোন পদ্ধতিতে কৌশলগতভাবে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতি, দখলদারত্ব ও প্রশাসনের দুর্বল ভূমিকা কেমনভাবে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করছে, বাদ যায়নি সেসব প্রসঙ্গও।
গণতান্ত্রিক সমাজে মানবাধিকার রক্ষার যে মূলনীতি, তা কেমন করে পদদলিত হয়েছে, বইয়ে রয়েছে তার আলোচনা। লেখক ব্যাখ্যা করেছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে গিয়ে কীভাবে তা সংকুচিত করেছে পতিত শাসকদল। সরকারের তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্প, ঋণের বোঝা, বৈষম্য ও প্রকৃত উন্নয়নের অভাব নিয়ে লেখা যেমন এখানে আছে, তেমনি আছে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অসামঞ্জস্যতা, সীমান্ত হত্যা, নদীর পানির বণ্টন এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ব্যর্থতার আলোচনাও। নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের সংকট, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অভাব এবং বুদ্ধিজীবী মহলের নিষ্ক্রিয়তা নিয়েও বইয়ে একটি অধ্যায় বর্তমান।
তবে বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো শেষ অধ্যায়। ২০২৪ সালের জুলাই মাসের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণ, পরিণতি ও রাজনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়েছে এখানে। পাশাপাশি উঠে এসেছে শেখ হাসিনা পতনের পরবর্তী সময়ের চিত্রও।
আসিফ নজরুল নির্ভরযোগ্য তথ্য ব্যবহার করে সাম্প্রতিক ঘটনা, পরিসংখ্যান ও গবেষণা উপস্থাপন করেছেন প্রতিটি লেখায়। তাঁর লেখায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও প্রশাসনের ভুল নীতির প্রতি তীব্র সমালোচনা বিদ্যমান, যা অনেক সময় প্রকাশিত হয়েছে ব্যঙ্গাত্মক ভাষায়। বইটিতে তিনি অতীতের রাজনৈতিক ঘটনার সঙ্গে বর্তমানের পরিস্থিতির তুলনা করে নিজের বিশ্লেষণকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন।
আদতে শেখ হাসিনার পতনকাল নিছক একটি রাজনৈতিক বই নয়, এটি একটি অবদমিত সময়ের প্রতিচ্ছবি। বিশেষত ২০২০-২০২৪ সালের ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে এই বই বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে কাজ করবে।
সৈয়দ মিজানূর রহমান
শেখ হাসিনার পতনকাল
আসিফ নজরুল
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০২৫; প্রচ্ছদ: আনিসুজ্জামান সোহেল; ২৫৬ পৃষ্ঠা; দাম: ৬০০ টাকা।
বইটি পাওয়া যাবে
prothoma.
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ খ হ স ন র পতন র পতন র প র জন ত ক র র জন ত ফ নজর ল কর ছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত
ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ হাইতিতে গত সপ্তাহে একাধিক গ্যাং হামলায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের (আরএনডিডিএইচ) তথ্যানুসারে, সংকটে জর্জরিত দেশটিতে সর্বশেষ ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা এটি।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্যারন’স।
গতকাল সোমবার এএফপিকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আরএনডিডিএইচ জানায়, গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের উত্তর এলাকায় এই হামলাগুলো ঘটে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হওয়া বহু মানুষের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। লাশগুলো এখনও ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে এবং কুকুর লাশগুলো খেয়ে ফেলেছে।’
পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হাইতি। দেশটির একটি অংশ ও রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের বেশিরভাগ এলাকা সশস্ত্র গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে গ্যাংগুলোর একটি জোট লাগাতার হামলা শুরু করলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। যার ফলে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
হাইতির পুলিশকে সমর্থন করার জন্য কেনিয়ার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করার পরও সহিংসতা দমন করা সম্ভব হয়নি।
আরএনডিডিএইচ জানিয়েছে, ভিভ আনসানম গ্যাং জোট, যারা ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে ক্যাবারেট শহরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা গত সপ্তাহে নিকটবর্তী ল্যাবোডেরি শহরে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে। শহরটি রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
সংস্থাটি আরো জানায়, ‘তারা ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বেঁচে থাকা কয়েকজন পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অন্যান্যরা আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নৌকায় করে সমুদ্রে পালিয়ে যায়।’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মাসে সতর্ক করে বলেছেন, হাইতিতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ছে।’
তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, হাইতির রাজধানীর বাইরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার ৯০ শতাংশ অঞ্চলের ওপর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
রবিবার, তিনি ক্যাবারে কমিউনে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ‘সরবরাহ, কর্মী ও তহবিল দিয়ে বহুজাতিক নিরাপত্তা সহায়তা মিশনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে হাইতিতে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৪১ জন নিহত হয়েছে।
ঢাকা/ফিরোজ