শেখ হাসিনার পতনের পেছনে তাঁর ক্রমাগত দুঃশাসন, প্রহসনের নির্বাচন, ভয় আর বিচারহীনতার সংস্কৃতি দায়ী, এটা সবার জানা। কিন্তু কীভাবে দিনে দিনে এগুলো রপ্ত করেছিলেন তিনি, সম্প্রতি প্রকাশিত শেখ হাসিনার পতনকাল বইয়ে তা–ই তুলে ধরেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক আসিফ নজরুল। শেখ হাসিনার শাসনের অন্তিম সময় এবং তাঁর পতনের প্রেক্ষাপট এখানে মলাটবদ্ধ হয়েছে সহজ ভাষায়।

বইটির লেখাগুলো ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে রচিত। এ বইয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো উঠে এসেছে। সে হিসেবে বলা যায়, এই বইয়ের লেখাগুলো তার অন্যতম। লেখক এই অভ্যুত্থানকে কেবল একটি রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে নয়, বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।

১০টি অধ্যায়ে বিভক্ত বইয়ে লেখক পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের রাজনীতি, নির্বাচন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচার বিভাগের সংকট নিয়ে আলোচনা করেছেন, একইভাবে এ পুস্তকে ধরা আছে শিক্ষাঙ্গনে অরাজকতা, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ও ‘উন্নয়ন’–এর নামে অনৈতিকতার চর্চা, ভারত-নীতি ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা নিয়ে বিশ্লেষণ। প্রতিটি অধ্যায়েই ঘটনা এবং ঘটনার বিশ্লেষণ–পরম্পরায় স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শাসনের আগাপাছতলা তুলে ধরেছেন লেখক। ফলে স্বভাবতই বিগত শাসকের পতনের প্রেক্ষাপট তৈরির কারণগুলো এ বই থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায়।

প্রথম অধ্যায়েই আসিফ নজরুল দেখিয়েছেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সংকট কোথায়। তাদের নীতি ও কৌশল এবং ব্যক্তিপূজা ও সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ‘রাজনীতিহীন রাজনৈতিক দল’ ও ‘কুৎসার রাজনীতি’ শিরোনামের লেখাগুলোয় রাজনৈতিক আদর্শের অভাব এবং ঘৃণার রাজনীতি কীভাবে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট করেছে, তা দেখানো হয়েছে। লেখক আরও দেখিয়েছেন, কীভাবে বাংলাদেশে রাজনীতি ব্যক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে এবং গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে।

‘নির্বাচনী প্রহসন’ নামে দ্বিতীয় অধ্যায়টি বইটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার সংকট, ভোট কারচুপি, প্রশাসনের ভূমিকা এবং বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন যে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, সেসব বিশ্লেষিত হয়েছে। লেখক এ অধ্যায়ে সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কৌশল ও বিরোধী দল দমনের পদ্ধতিগুলো উদাহরণসমেত উন্মোচন করেছেন। দেখিয়েছেন, জনমানুষের মুক্তিযুদ্ধকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে শেখ হাসিনা কোন পদ্ধতিতে কৌশলগতভাবে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতি, দখলদারত্ব ও প্রশাসনের দুর্বল ভূমিকা কেমনভাবে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করছে, বাদ যায়নি সেসব প্রসঙ্গও।

গণতান্ত্রিক সমাজে মানবাধিকার রক্ষার যে মূলনীতি, তা কেমন করে পদদলিত হয়েছে, বইয়ে রয়েছে তার আলোচনা। লেখক ব্যাখ্যা করেছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে গিয়ে কীভাবে তা সংকুচিত করেছে পতিত শাসকদল। সরকারের তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্প, ঋণের বোঝা, বৈষম্য ও প্রকৃত উন্নয়নের অভাব নিয়ে লেখা যেমন এখানে আছে, তেমনি আছে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অসামঞ্জস্যতা, সীমান্ত হত্যা, নদীর পানির বণ্টন এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ব্যর্থতার আলোচনাও। নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের সংকট, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অভাব এবং বুদ্ধিজীবী মহলের নিষ্ক্রিয়তা নিয়েও বইয়ে একটি অধ্যায় বর্তমান। 

তবে বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো শেষ অধ্যায়। ২০২৪ সালের জুলাই মাসের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণ, পরিণতি ও রাজনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়েছে এখানে। পাশাপাশি উঠে এসেছে শেখ হাসিনা পতনের পরবর্তী সময়ের চিত্রও। 

আসিফ নজরুল নির্ভরযোগ্য তথ্য ব্যবহার করে সাম্প্রতিক ঘটনা, পরিসংখ্যান ও গবেষণা উপস্থাপন করেছেন প্রতিটি লেখায়। তাঁর লেখায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও প্রশাসনের ভুল নীতির প্রতি তীব্র সমালোচনা বিদ্যমান, যা অনেক সময় প্রকাশিত হয়েছে ব্যঙ্গাত্মক ভাষায়। বইটিতে তিনি অতীতের রাজনৈতিক ঘটনার সঙ্গে বর্তমানের পরিস্থিতির তুলনা করে নিজের বিশ্লেষণকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন।

আদতে শেখ হাসিনার পতনকাল নিছক একটি রাজনৈতিক বই নয়, এটি একটি অবদমিত সময়ের প্রতিচ্ছবি। বিশেষত ২০২০-২০২৪ সালের ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে এই বই বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে কাজ করবে।  

সৈয়দ মিজানূর রহমান

শেখ হাসিনার পতনকাল

আসিফ নজরুল

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০২৫; প্রচ্ছদ: আনিসুজ্জামান সোহেল; ২৫৬ পৃষ্ঠা; দাম: ৬০০ টাকা।

বইটি পাওয়া যাবে

prothoma.

com এবং বইমেলায় প্রথমা প্রকাশনের প্যাভিলিয়নে (প্যাভিলিয়ন: ৬)

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ খ হ স ন র পতন র পতন র প র জন ত ক র র জন ত ফ নজর ল কর ছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

যশোরে জিআই পণ্য খেজুর গুড় তৈরির রস সংগ্রহে গাছ প্রস্তুতির উদ্বোধন

যশোরের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য খেজুর গুড় তৈরির রস সংগ্রহের জন্য খেজুরগাছ প্রস্তুতের (রস সংগ্রহের উপযোগী করা) আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছে। আজ রোববার দুপুরে চৌগাছা উপজেলার হায়াতপুর গ্রামে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহিনুর আক্তার।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, রস-গুড় সংগ্রহের জন্য গত বছরের তুলনায় এ বছর বেশি খেজুরগাছ প্রস্তুত করা হবে। এ বছর জেলায় অন্তত তিন লাখের বেশি গাছ প্রস্তুত করা হবে। যশোরে খেজুরের রস ও গুড়ের ১০০ কোটির বেশি টাকার বাজার রয়েছে। অন্তত ছয় হাজার কৃষক এই পেশায় যুক্ত।

যশোরের খেজুর গুড় জিআই পণ্য হলো যেভাবে

২০২২ সালে চৌগাছার তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (বর্তমানে যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট) ইরুফা সুলতানা খেজুর গুড়ের ঐতিহ্য সংরক্ষণে খেজুর গুড়ের মেলা, গাছিদের প্রশিক্ষণ, গাছি সমাবেশ, গাছিদের সমবায় সমিতি গঠন, খেজুরগাছ রোপণ ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন। একই বছর জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির জন্য যশোরের খেজুর গুড়ের আবেদন করেন তিনি। তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সেটি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পায়।

শতকোটি টাকার বাজার ধরতে ব্যস্ত গাছিরা

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, যশোরের প্রায় ছয় হাজার গাছি খেজুরগাছের রস থেকে পাটালি গুড় উৎপাদনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে খেজুরগাছ প্রস্তুতির কাজ শুরু হয়েছে। গাছ প্রস্তুতে ব্যস্ত সময় পার করছেন গাছিরা। খেজুরগাছ সংরক্ষণ, রোপণ, গাছিদের প্রশিক্ষণ, প্রণোদনাসহ নানাভাবে সহযোগিতার মাধ্যমে গুড় উৎপাদন বৃদ্ধি ও বাজার সম্প্রসারণে কাজ করছে কৃষি বিভাগ, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যশোর জেলায় খেজুরগাছের সংখ্যা ২৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৯৫টি। এর মধ্যে রস আহরণের উপযোগী গাছের সংখ্যা ৩ লাখ ৭ হাজার ১৩০টি। গাছ থেকে ৩ কোটি ৭১ লাখ ৩ হাজার লিটার রস ও ২ হাজার ৭৪২ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাজারদর অনুযায়ী প্রতি লিটার রসের দাম ৩৫ টাকা ও গুড়ের কেজি ৩৪০ টাকা। সেই হিসাবে রস ও গুড়ের বাজার দর ৯৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।

চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রামের গাছি আবদুল কুদ্দুস বলেন, ‘আমার দাদা খেজুরগাছের রস থেকে পাটালি গুড় বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। দাদার সঙ্গে বাবাও যুক্ত ছিলেন। বাবার পেশায় আমিও যুক্ত হয়েছি। বাবা আর আমি এবার ৩০০টি খেজুরগাছ থেকে রস-গুড় তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছি। গতবছর ভালো দাম পেয়েছি। এবারও ভালো দাম পাব বলে আশা করি।’

গাছিরা জানান, কার্তিক মাস শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই খেজুরগাছ ছেঁটে রস ও গুড় তৈরির প্রস্তুতি শুরু করেন তাঁরা। শীত মৌসুমে এ অঞ্চলের কৃষকদের অন্যতম আয়ের উৎস এটি। এখানকার কারিগরদের দানা পাটালি তৈরির সুনাম রয়েছে। পাটালি ও ঝোলা গুড় তৈরি ছাড়াও চাষিরা শীতের ভোরে ফেরি করে কাঁচা রস বিক্রি করেন। কাঁচা রস প্রতি মাটির ভাঁড় ১৫০-২০০ টাকা, দানা গুড় ৩৫০-৪০০ টাকা আর পাটালি প্রতি কেজি ৪৫০-৬০০ টাকায় বিক্রি হয়।

অনলাইন প্ল্যাটফর্ম কেনারহাটের উদ্যোক্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘গত বছর আমাদের কাছে ভোক্তার চাহিদা ছিল সাড়ে ছয় হাজার কেজি পাটালি গুড়। সরবরাহ করতে পেরেছিলাম দুই হাজার কেজি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অতিবৃষ্টি, শীত কম হওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী পাটালি গুড় সরবরাহ করতে পারিনি। এ বছর ইতিমধ্যে অর্ডার আসতে শুরু করেছে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নের মৃত্যু
  • শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা
  • যশোরে জিআই পণ্য খেজুর গুড় তৈরির রস সংগ্রহে গাছ প্রস্তুতির উদ্বোধন