সিলেটের ভোলাগঞ্জ শুল্ক স্টেশন দিয়ে ভারত থেকে ২০ বছর ধরে আমদানি হয়ে আসছে চুনাপাথর। আমদানি করা পাথর রাখা হতো সেখানকার খালি জায়গায়। স্থানীয় কাস্টমস অফিস সনাতন পদ্ধতিতে বিষয়টি দেখভাল করছে। ভারত অংশে স্টেশন না থাকার পরও ২০১৯ সালে শুল্ক স্টেশনটি ‘ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দর’ হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। দেশের ২৪তম স্থলবন্দর হিসেবে ভোলাগঞ্জ ঘোষণার পর চার বছর চলে জমি অধিগ্রহণ ও মাটি ভরাট নিয়ে টানাপোড়েন। সব ঝামেলা চুকিয়ে গত জুনে ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দর নির্মাণকাজ শুরু হয়।
প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন স্থলবন্দর নিয়ে এখন প্রশ্ন তুলেছেন ভোলাগঞ্জ চুনাপাথর আমদানিকারক গ্রুপের সভাপতি সাহাব উদ্দিন। তিনি অভিযোগ করেন, লুটপাটের জন্যই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ভারত থেকে শুধু চুনাপাথরের জন্য এত বড় বন্দরের প্রয়োজন নেই। ভারতের স্বার্থে লুটপাটের জন্য স্থলবন্দর করা হচ্ছে। তবে বিষয়টি মানতে নারাজ অনেকেই। ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দরের প্রকল্প পরিচালক সারোয়ার আলম সমকালকে বলেন, বন্দর চালু হলে শুধু রাজস্ব বাড়বে না, এলাকার পরিবেশও বদলে যাবে। পাশের সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্রের ঘাট হয়ে উঠবে আরও সুশৃঙ্খল ও মনোরম। বন্দরের ভেতর রেস্তোরাঁ, গেস্ট হাউস, মসজিদসহ অনেক স্থাপনা হচ্ছে। বন্দরে কার লাভ হবে– এ বিষয়ে তিনি বলেন, শুধু চুনাপাথর নয়, পাথর ছাড়া অন্য পণ্যও আসবে। ভবিষ্যতে রপ্তানির পরিকল্পনাও রয়েছে।
সম্প্রতি সরেজমিন দেখা গেছে, ৫২ একর জায়গাজুড়ে কাজ চলছে। বন্দরে স্টিলের তিনটি ভবন ও আরও দুটি স্থাপনা দৃশ্যমান। কোথাও চলছে মাটি ভরাট ও দেয়ালের কাজ। কাস্টমস পাড়ি দিয়ে ভারতের ট্রাকগুলোকে রাস্তার আশপাশের এলাকায় পণ্য খালাস করতে দেখা গেছে। স্থলবন্দরের নির্মাণকাজ করছে অনিক ট্রেডিং করপোরেশন ও মাসুদ স্টিল নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তারা ১৮ মাস মেয়াদে কাজটি পেয়েছে। গত বছরের জানুয়ারিতে কার্যাদেশ পেয়ে কাজ শুরু করলে জমি নিয়ে বিরোধের কারণে জুনে কাজ শুরু করে তারা। তবে গত ৫ আগস্ট স্থলবন্দর থেকে কয়েক কোটি টাকার নির্মাণসামগ্রী ও যন্ত্রপাতি লুট হয়। অনিক ট্রেডিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী আজম জানান, তাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। নতুন করে তারা কাজ শুরু করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ২০০৫ সাল থেকে ভোলাগঞ্জ শুল্ক স্টেশন দিয়ে চুনাপাথর আমদানি শুরু হয়। এতে ভোলাগঞ্জের ওপারে ভারতের খাসি হিলস জেলার মাজাই এলাকার ব্যবসায়ীরা পাথর রপ্তানি করছেন। তারা ১৬০ কিলোমিটার পথ ঘুরে সিলেটের আরেক স্থলবন্দর তামাবিল ব্যবহার না করে সহজে ভোলাগঞ্জ ব্যবহার করতে পারছেন। সে জন্য স্টেশনটি চালু করা হয়। তবে ২০ বছর পর স্থলবন্দর ঘোষণা হলেও ভারত অংশে কোনো স্টেশন বা বন্দর গড়ে ওঠেনি। নিয়ম অনুযায়ী, সেখানেও বন্দর থাকার কথা। চুনাপাথর ছাড়া অন্য কোনো পণ্য আমদানি বা রপ্তানি হয় না ভোলাগঞ্জ দিয়ে। সে ক্ষেত্রে ভারতের ব্যবসায়ীরা একচেটিয়া চুনাপাথর রপ্তানি করছেন। শুধু বাংলাদেশ পাথরের বিপরীতে রাজস্ব পাচ্ছে। চুনাপাথর কিনতে আমদানিকারকদের ডলারে দাম পরিশোধ করতে হচ্ছে। তামাবিল স্থলবন্দরের রাজস্ব কর্মকর্তা দিদারুন নবী সমকালকে বলেন, বন্দর হওয়ার পর সেখানে তারা স্থানান্তরিত হবেন। তখন স্কেলসহ অন্য সুবিধাও থাকবে। এখন আমাদের পণ্যের চালান যাচাই করা ছাড়া কাজ নেই। তিনি জানান, বর্তমানে ২০০ থেকে ৩০০ ট্রাক পাথর নিয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। কোনো দিন আরও বেশিও হয়।
এদিকে স্থলবন্দরের নির্মাণকাজ শুরুর পর সিলেটের আমদানিকারকরা যোগাযোগ করেন ভারতের ইউনাইটেড নিউ মাজাই আমদানি-রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে। সেখানে স্টেশন কেন হচ্ছে না, সে বিষয়ে তারা জানতে চান। ১০ ফেব্রুয়ারি মাজাই আমদানি-রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সি রাজী তাদের লিখিত জানান। এতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘তাদের এলাকায় বন্দর করার জন্য উপযুক্ত জমি নেই। আমদানি অব্যাহত রাখতে তিনি অনুরোধও করেন।’
ভোলাগঞ্জ চুনাপাথর আমদানিকারক গ্রুপের সভাপতি সাহাব উদ্দিন গত ২৯ জানুয়ারি নৌপরিবহন সচিব বরাবর আবেদন করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘স্থলবন্দরের চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান আওয়ামী লীগ নেতাদের স্বার্থে ও ভারতকে খুশি করতে ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে। ভারত অংশে কোনো স্টেশন বা বন্দর না থাকার পরও মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে চুনাপাথর ছাড়া অন্য কিছু আমদানি করা হয় না। তা জানার পরও স্থলবন্দর করতে গিয়ে লোকজনকে উচ্ছেদ ও কর্মসংস্থান ধ্বংস করা হয়েছে।’
স্থানীয় পাথর ব্যবসায়ী নেতা আব্দুল জলিল সমকালকে বলেন, ‘আমাদের চেয়ে ভারতের বেশি লাভ হচ্ছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে কিছু পণ্য রপ্তানির উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা চুনাপাথর খালাসের জন্য তিন কিলোমিটার পর্যন্ত
জমি চেয়েছি। সে বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র আমদ ন র ব যবস র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
প্রথম চালানে ৩৭ হাজার ৪৬০ কেজি ইলিশ গেল ভারতে
দুর্গাপূজা উপলক্ষে যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে প্রথম চালানে ৩৭ হাজার ৪৬০ কেজি ইলিশ মাছ ভারতে রপ্তানি হয়েছে। আজ বুধবার দেশের ছয়টি প্রতিষ্ঠান ১২ দশমিক ৫০ ডলার কেজিতে এই ইলিশ রপ্তানি করা হয়েছে, যা বাংলাদেশি টাকায় ১ হাজার ৫২৫ টাকা।
অথচ এদিন যশোর শহরের মাছের আড়তে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম আকারের প্রতি কেজি ইলিশ মাছ ১ হাজার ৪৫০ থেকে ১ হাজার ৫৫০ টাকায় পাইকারি বেচা–কেনা হয়েছে। খুচরা বাজারে সেই ইলিশ কেজিতে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি দরে ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে; অর্থাৎ দেশের খুচরা বাজারের দামের চেয়ে কম দামে ইলিশ ভারতে রপ্তানি হচ্ছে।
দেশের চেয়ে কম দামে ইলিশ মাছ রপ্তানি কীভাবে সম্ভব হচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে রপ্তানিকারকদের ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং (সিএন্ডএফ) এজেন্ট জুয়েল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘রপ্তানিকারকেরা ইলিশের জাহাজ থেকে সরাসরি মাছ কেনেন। ছোট–বড় মিলিয়ে যখন কেনেন, তখন একটু কম দামে তাঁরা কিনতে পারেন। এ কারণে তাঁদের পুষিয়ে যায়। এর চেয়ে বেশি কিছু আমার জানা নেই।’
যশোর শহরের বড় বাজারের মাছ বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ইলিশ মাছের সরবরাহ কম। যে কারণে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ মাছ ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা কেজি দরে বেচাকেনা হচ্ছে। খুচরা ইলিশ বিক্রেতা লিয়াকত আলী বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এ বছর ইলিশ মাছের দাম বাড়তি। বাজারে সরবরাহ কম। যে কারণে এ বছর ইলিশ মাছের দাম কমার সম্ভাবনা আর দেখছি না।’
যশোর বড় বাজার মৎস্যজীবী আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ পিয়ার মোহাম্মদ জানান, আজ যশোরের বাজারে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম আকারের ইলিশ মাছ ১ হাজার ৪৫০ থেকে ১ হাজার ৫৫০ টাকা কেজি দরে পাইকারি কেনাবেচা হয়েছে। আর কেজি আকারের ইলিশ প্রতি কেজি ৩ হাজার টাকার ওপরে বেচাকেনা হয়েছে। ভারতের রপ্তানির কারণে স্থানীয় বাজারে এখন ইলিশ মাছ সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে, যে কারণে দাম বেশি। অথচ গত বছর এই সময়ে কেজি আকারের ইলিশ মাছের দাম ছিল সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬০০ টাকা কেজি। এবার প্রায় দ্বিগুণ দামে সেই ইলিশ কেনাবেচা হচ্ছে।
বেনাপোল স্থলবন্দরের মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, এ বছর সরকার ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১ হাজার ২০০ টন ইলিশ ভারতে রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। আজ থেকে ইলিশ মাছ রপ্তানি শুরু হলো। গত বছর ইলিশ রপ্তানির অনুমতি ছিল ২ হাজার ৪২০ টন। বেনাপোল বন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়েছিল মাত্র ৫৩২ টন। এবারও অনুমোদনকৃত ইলিশ রপ্তানির কোটা পূরণ হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ৫ অক্টোবরের মধ্যে ইলিশ রপ্তানি শেষ করতে নির্দেশ দিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর।
জানতে চাইলে বেনাপোল স্থলবন্দরের মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের ফিশারিজ কোয়ারেন্টিন সজীব সাহা বলেন, দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অনুমোদিত ইলিশ রপ্তানির প্রথম চালানে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ১২ দশমিক ৫০ ডলার মূল্যে ৩৭ দশমিক ৪৬০ টন ইলিশ রপ্তানি হয়েছে। ছয়টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই ইলিশ ভারতে পাঠানো হয়েছে। রপ্তানি করা ইলিশের একটি বাক্স খুলে দেখা গেছে, ৩৮টি ইলিশ মাছের ওজন ২১ কেজি; অর্থাৎ প্রতিটি ইলিশের ওজন ছিল ৫৫০ গ্রাম। এ ছাড়া ৭০০ থেকে ৮৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশ মাছও রপ্তানি হয়েছে। ৫৫০ গ্রাম থেকে ৮৫০ গ্রাম আকারের মধ্যে ইলিশ মাছ রপ্তানি হচ্ছে।
পদ্মার রুপালি ইলিশ স্বাদ আর গন্ধে অতুলনীয় হওয়ায় দুই বাংলায় এ মাছ বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে দুর্গাপূজায় অতিথি আপ্যায়নে খাবারের প্রধান তালিকায় ইলিশ রাখেন কলকাতার বাঙালিরা। আগে ইলিশ সাধারণ রপ্তানি পণ্যের তালিকায় উন্মুক্ত থাকলেও উৎপাদন সংকট দেখিয়ে ২০১২ সালে দেশের বাইরে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করে দেয় তৎকালীন সরকার। তবে ২০১৯ সাল থেকে বিশেষ বিবেচনায় কেবল দুর্গাপূজা উপলক্ষে আবারও ইলিশ রপ্তানির সুযোগ দেয় সরকার।
আরও পড়ুনদুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতের ‘বিশেষ অনুরোধে’ ইলিশ রপ্তানির অনুমতি: মৎস্য উপদেষ্টা২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪