কারখানা খুলে দেয়াসহ বিভিন্ন দাবিতে শহরে শ্রমিক বিক্ষোভ, যানজটে ভোগান্তি
Published: 17th, February 2025 GMT
নারায়ণগঞ্জের শহরের মুল কেন্দ্র চাষাঢ়ায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে ইউরোটেক্স নীটওয়্যার লিমিটেড নামে একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা।
শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, মামলা প্রত্যাহার এবং লে-অফ ঘোষণা করা কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে সোমবার দুপুর ১২ টা থেকে ২টা পর্যন্ত শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে এ বিক্ষোভ করেন।
এসময় শহরে প্রায় দুই ঘন্টা যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। এর ফলে চাষাঢ়া এলাকা সংলগ্ন বিভিন্ন সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়ে ভোগান্তিতে পড়েন শহরবাসী ও যাত্রী সাধারণ।
জেলা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর সূত্রমতে জানা যায়, ফতুল্লার লামাপাড়া এলাকায় অবস্থিত শহিদুল ইসলামের মালিকানাধীন ইউরোটেক্স নীটওয়্যার লিমিটেড নামের কারখানাটিতে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। গত ১০ অক্টোবর থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কারখানাটির শ্রমিকরা নানা দাবি দাওয়া নিয়ে বারবার আন্দোলন করেন।
এর মধ্যে কিছু দাবি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এর মধ্যস্থতায় নিষ্পত্তি হলেও গত ১০ ফেব্রুয়ারি বেতন পরিশোধ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে স্ক্রীনপ্রিন্ট সেকশনের শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়।
কারখানা কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, ওই দিন স্ক্রীন প্রিন্টের ২৭ জন শ্রমিক অন্যান্য শ্রমিককে মারধর ও ভাংচুর করেন। পরে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করার পাশাপাশি কারণ দর্শানো নোটিশ (শোকজ) প্রেরণ করা হয়।
এছাড়া ওই ঘটনায় কারখানার কর্মকর্তা সাজেদুল ইসলাম বাদী হয়ে ওই ২৭ শ্রমিককে আসামি করে ফতুল্লা মডেল থানায় ভাঙচুরের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন।
পরবর্তীতে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২৭ জন শ্রমিকের বিরুদ্ধে আনীত মামলা প্রত্যাহার ও এদের পূনর্বহালের দাবিতে পুনরায় কারখানার সব প্রোডাকশন বন্ধ করে দিয়ে কারখানা প্রাঙ্গনে অবস্থান করে।
তখন মালিকপক্ষ কারখানা শ্রম আইনে লে-অফ ঘোষণা করে। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা মামলা প্রত্যাহার, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ এবং লে-অফ ঘোষণা করা কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে সড়ক অবরোধ করেছেন।
শ্রমিকদের অভিযোগ, তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে আসছিলেন। বহিরাগত লোকজন কারখানা ভাঙচুর করেছেন। শ্রমিকদের হয়রানি করতে ২৭ শ্রমিককে চাকরিচ্যুত ও তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। অবিলম্বে শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, মামলা প্রত্যাহার ও কারখানা খুলে দিতে হবে।
ইউরোটেক্স নীটওয়্যার লিমিটেডের সুইং অপারেটর মিঠু চন্দ্র দাস বলেন, কিছুদিন পূর্বে একটা আন্দোলন হয়েছিলো। এই আন্দোলনে কারণে আমাদের শ্রমিকদের নামে মামলা হয়েছে। শ্রমিকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুলিশ হয়রানি করছে। মাস্তানদের দিয়ে শ্রমিকদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। আমরা মামলা প্রত্যাহার পুলিশি ও মাস্তানদের দ্বারা হয়রানি বন্ধ করতে হবে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা গার্মেন্টস ও সুয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি এমএ শাহীন বলেন, ইউরোটেক্স নীটওয়্যার লিমিটেডের শ্রমিকরা তাদের কর্তৃপক্ষের সাথে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারে না। কথা বলতে গেলেই চাকরিচ্যুত করা হয়। প্রায় ২শতাধিক শ্রমিকের গত মাসের বেতন এখনও দেয়নি।
তিনি আরও বলেন, সেই সাথে ২৭ জন শ্রমিকের নামে মামলা দিয়ে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করছে। এলাকার মাস্তানদের লেলিয়ে দিয়েছে। আজকে হঠাৎ করেই গার্মেন্টস বন্ধ করে দিয়েছে। যার কারণে শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমেছে।
শ্রমিকদের দাবী কারখানা খুলে দিতে হবে। মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে পুলিশ হয়রানি বন্ধ করতে হবে। ঝুট সন্ত্রাসী দ্বারা ভয় ভীতি বন্ধ করতে হবে।
নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নাছির আহমদ বলেন, ইউরোটেক্স গার্মেন্টস ভাঙ্গচুরের ঘটনায় গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ ফতুল্লা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
ওই মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে শ্রমিকরা আজ সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করছে। এর ফলে সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। পরে আমরা বুঝিয়ে তাদের সড়ক থেকে সরিয়ে নেই।
নারায়ণগঞ্জ জেলা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক রাজীব চন্দ্র ঘোষ বলেন, গত ৫ আগস্টের পর থেকেই বিভিন্ন সময় ইউরোটেক্স নীটওয়্যার লিমিটেডের শ্রমিকরা বিশৃঙ্খলা করে আসছিলো। তাদের বিশৃঙ্খলার কারণে মালিকপক্ষ মামলা করে। আর তাই মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আজ তারা রাস্তায় নামে।
উৎস: Narayanganj Times
কীওয়ার্ড: ন র য়ণগঞ জ ন র য়ণগঞ জ গ র ম ন টস হয়র ন
এছাড়াও পড়ুন:
কারখানার বর্জ্যে মরছে নদ
ডাইং কারখানার বর্জ্যে মরছে ব্রহ্মপুত্র নদ। প্রকাশ্যে এ দূষণ ঘটলেও দেখার কেউ নেই। প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ ভুক্তভোগীদের। পরিবেশ কর্মকর্তা চাইছেন সুনির্দিষ্ট প্রমাণসহ অভিযোগ।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার ও নরসিংদী সদর উপজেলায় অন্তত ৬০টি ডাইং কারখানা ব্রহ্মপুত্র দূষণের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। নদের তীরে অবস্থিত এসব কারখানায় এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) থাকলেও তারা বর্জ্য পরিশোধন না করেই প্রতিদিন নদে ফেলছে। এতে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এ নদের সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষজন।
অভিযোগ রয়েছে, নদের তীরে অবস্থিত কারখানাগুলো ইটিপি রাখলেও তারা বর্জ্য পরিশোধন না করেই নদে ফেলছে। অনেক কারখানায় ইটিপি থাকলেও খরচ কমাতে বেশির ভাগ সময় তা বন্ধ রাখা হয়। এ ছাড়া বেশকিছু কারখানার ইটিপি প্রয়োজনের তুলনায় ছোট হওয়ায় সঠিকভাবে বর্জ্য পরিশোধন করা সম্ভব হয় না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, নরসিংদী সদর উপজেলায় রয়েছে ছোট-বড় ৫০টি ডাইং কারখানা। আড়াইহাজারে স্পিনিং মিলসহ ডাইং কারখানা রয়েছে অন্তত ১০টি। নরসিংদীর ডাইং কারখানাগুলোর মধ্যে পাঁচদোনা এলাকার আবদুল্লাহ ডাইং ইন্ডাস্ট্রিজ, বাঘহাটা এলাকার ফাইভ অ্যান্ড ফাইভ ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং, সাজেদা ডাইং, আনোয়ার ডাইং, শতরূপা ডাইং, রুকু ডাইং, মেসার্স একতা ডাইং, কুড়েরপাড় এলাকার ব্রাদার্স টেক্সটাইল, ইভা ডাইং, ভগীরথপুর এলাকার এম এমকে ডাইং, নীলা ডাইং, এইচ এম ডাইং, মা সখিনা টেক্সটাইল, মুক্তাদিন ডাইং, পাঁচদোনা এলাকার তানিয়া ডাইং, সান ফ্লাওয়ার টেক্সটাইল প্রভৃতি।
আড়াইহাজারের কয়েকটি কারখানা হলো– ভাই ভাই স্পিনিং মিলস, ছাবেদ আলী স্পিনিং মিল, রফিকুল ডাইং, দিপু ডাইং ও হাজী হাবিবুর ডাইং।
আড়াইহাজার পৌরসভার চামুরকান্দি এলাকার বাসিন্দা মিয়াজউদ্দিন মিয়া বলেন, দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে নদটি। দেশীয় জাতের মাছের অভয়াশ্রম এ নদ থেকে মাছ হারিয়ে গেছে।
আড়াইহাজারের বালিয়াপাড়া এলাকার ইসমাইল হোসেন জানান, রফিকুল ডাইংয়ের বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে পানির রং কালচে হয়ে গেছে। একই অবস্থা অন্য কারখানাগুলোর। বর্জ্য নদে ফেলার বিষয়ে স্থানীয়রা কথা বলতে গিয়ে উল্টো কারখানা কর্তৃপক্ষের হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। এ ব্যাপারে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
রফিকুল ডাইংয়ের মালিক রফিকুল ইসলাম জানান, তাদের ইটিপি নেই। ডাইংয়ের পানি তারা নির্দিষ্ট পানির ট্যাংকে রাখেন, সরাসরি নদে ফেলেন না। ট্যাংকে জমানো পানি কোথায় ফেলেন জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
নরসিংদী সদর উপজেলার শিলমান্দী ইউনিয়নের গনেরগাঁও গ্রামের বাসিন্দা মাহবুব হাসান শুভর ভাষ্য, কুড়েরপাড় এলাকার ডাইং কারখানাগুলোর রং মেশানো বর্জ্য পরিশোধন না করে ব্রহ্মপুত্রে ফেলায় নদটি এখন মৃতপ্রায়। দূষণের কারণে দুর্গন্ধে এর পারে দাঁড়ানো যায় না। স্থানীয়রা অনেকবার প্রতিবাদ করেও প্রতিকার পাননি বলে জানান তিনি।
গত ১৫ এপ্রিল শিলমান্দী ইউনিয়নের কুড়েরপাড় এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ইভা ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং লিমিটেড নামে একটি কারখানা থেকে বর্জ্য এসে পড়ছে নদের পানিতে। ভিডিও করতে দেখে কারখানা কর্তৃপক্ষ বর্জ্য ফেলা বন্ধ করে দেয়।
ইভা ডাইংয়ের ইটিপি ইনচার্জ রেজাউল করিম জানান, বিভিন্ন মহলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে তারা প্রতিষ্ঠানটি চালাচ্ছেন। অনেক কারখানা সরাসরি নদে বর্জ্য ফেললেও তারা নদ দূষণ করেন না।
একই এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ফাতেমা ডাইংসহ ব্রহ্মপুত্রের তীরে গড়ে ওঠা কারখানাগুলো থেকেও নদে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে এসব কারখানার কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
নরসিংদী পরিবেশ অধিদপ্তরের উপসহকারী পরিচালক কামরুজ্জামান জানান, নদে বর্জ্য ফেলার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন নারায়ণগঞ্জ শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক তারেক বাবু জানান, ব্রহ্মপুত্রে নদে সরাসরি বর্জ্য ফেলছে ডাইংসহ যেসব কারখানা সেসবের অধিকাংশই নরসিংদী জেলার অন্তর্গত। তাই নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে নদ দূষণমুক্ত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
আড়াইহাজারের ইউএনও সাজ্জাত হোসেন বলেন, কখনও কখনও কিছু কারখানা বর্জ্য পরিশোধন না করেই নদে ছেড়ে দেয়। কোন কারখানা নদ দূষণ করছে, স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশবাদী সংগঠন তা জানালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।