বাংলা ভাষার প্রসার ও সর্বস্তরে ব্যবহার করার কথা প্রায়ই বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে সেটা ঘটছে কি না, সে বিষয়ে খতিয়ে দেখে পর্যালোচনা প্রায় অনুপস্থিত। বাস্তবতা তার বিপরীত বলেই হয়তো সেদিকে অন্ধ হয়ে থাকছি সবাই। কিন্তু অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে! বাংলা ভাষা যে নানাভাবে পশ্চাৎপদতার দিকে যাচ্ছে, সে রকম লক্ষণ অনেক দিকেই সুস্পষ্ট। 

জ্ঞান–বিজ্ঞানের যেকোনো বিষয়ে বাংলায় প্রবন্ধ ও গ্রন্থ রচনা করতে গিয়ে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। তার মধ্যে বড় একটি হচ্ছে উপযুক্ত পরিভাষা। যাঁরা এসব বিষয়ে বাংলায় প্রবন্ধ বা বই লিখছেন, তাঁদের অনেকেই এ সমস্যার কথা উল্লেখ করেন।

অর্থনীতিবিষয়ক ও অন্য বেশ কয়েকটি বিষয়ের ইংরেজি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ–সংবলিত পরিভাষা কোষ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালে সরকারের বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে। তারপর বাংলা একাডেমি সেটার আর কোনো পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশ করেনি। কিছু লেখক বা গবেষক নিজ উদ্যোগে কোনো কোনো বিষয়ে পরিভাষা সংকলন প্রকাশ করেছেন।

গত দু-তিন দশকে বিশ্বজুড়ে সমাজ, অর্থনীতি ও প্রযুক্তিগত দিকে অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটেছে। সেসব পরিবর্তন নিয়ে আলোচনার জন্য অন্যান্য ভাষায়, বিশেষত ইংরেজিতে বহু নতুন শব্দ বা শব্দবন্ধ তৈরি হয়েছে, প্রচলিত হয়েছে। বাংলায় এসব বিষয় আলোচনার জন্য সেগুলোর পরিভাষা সর্বসম্মতভাবে প্রস্তুত করা দরকার। অর্থনীতি ও উন্নয়ন আলোচনায় প্রচলিত কিছু পরিভাষা পরিবর্তন করাও দরকার হতে পারে। এসব বিষয়ে বাংলায় প্রকাশিত কোনো কোনো গ্রন্থে কিছু নতুন পরিভাষা দেওয়া আছে। কিন্তু সেগুলো সব সর্বসম্মতভাবে এক করে প্রকাশ না করলে অন্য লেখকেরা হাতের কাছে পাবেন কীভাবে!

পরিভাষা প্রণয়নের কাজ হাতে নিলে তা বিভিন্ন বিষয়ের জন্য একই সঙ্গে করা সুবিধাজনক হতে পারে। প্রতিটি বিষয়ের জন্য বিশেষজ্ঞদের কয়েকজনকে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেগুলো কোন প্রতিষ্ঠানের আওতায় হবে, সে সিদ্ধান্ত আগে দরকার। অতীতে যেহেতু বাংলা উন্নয়ন বোর্ড এই দায়িত্ব নিয়েছিল, এখন বাংলা একাডেমির নাম মনে আসাই স্বাভাবিক। সেটা হতে পারে অথবা সরকার আলাদা কমিশন গঠন করতে পারে বাংলা ভাষার উন্নয়নের উদ্দেশ্যে। সেখানে শুধু পরিভাষা নয়, বাংলা ভাষা উন্নয়ন ও সর্বস্তরে প্রচলনের সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হবে।

মাতৃভাষা হিসেবে বাংলায় কথা বলে—এমন জনসংখ্যার প্রায় ৭৪ শতাংশ বসবাস করে বাংলাদেশে। সুতরাং এটা মনে রাখতে হবে, বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও স্থায়িত্বের বিষয়ে এ দেশের বিশাল দায়িত্ব থাকলেও অন্যান্য দেশে বসবাসকারীদের কথাও মনে রাখতে হবে পরিভাষা ও অভিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে। অন্যান্য দেশে তাঁরা কোন ধরনের পরিভাষা ব্যবহার করছেন, সেগুলোও বিবেচ্য।

পরিভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত আরেকটি বিষয় হচ্ছে বিদেশি শব্দের অন্তর্ভুক্তি। বহুল ব্যবহৃত ইংরেজি শব্দ, যা বাংলা হিসেবে গৃহীত ও স্বীকৃত, সেগুলোর অভিধান, যা বাংলা একাডেমির তৈরি আছে, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলাতে হবে, সংযোজন-বিয়োজন হবে তাতে। সেখানে বিষয়ভিত্তিক শব্দমালাও থাকা দরকার।

নতুন প্রযুক্তি প্রসঙ্গে অন্য যেদিকে মনোযোগ দিতে হবে, তা হচ্ছে বাংলা টাইপ করার উন্নত মানের ফনেটিক সফটওয়্যার উদ্ভাবন করা দরকার। যাঁরা সাধারণত ইংরেজি ভাষায় টাইপ করেন, তাঁদের তখন সেই একই কি-বোর্ড দিয়ে কাজ চলে যায়। এ ধরনের কিছু মুক্ত সফটওয়্যার আছে। সেগুলোয় নানা সমস্যা আছে, আর বাংলা একাডেমির বানানরীতি সব সময় মানা হয়নি বা মানা হলেও সেটি যেসব সম্ভবপর শব্দতালিকা দেওয়া হয়, তার শুরুতে থাকে না। তখন লেখককে আবার অভিধান ঘেঁটে খুঁজতে হয়।

বাংলা ভাষার কিছু বিশেষত্ব আছে, যেগুলো যথাযথভাবে মানা উচিত গবেষণাগ্রন্থ লেখার ক্ষেত্রে। দু-একটা নিয়ম সমাজবিজ্ঞান বা অর্থনীতির বিষয়ে লেখার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। একটি উদাহরণ দিলে বোঝানো সহজ হবে। বাংলায় সর্বনামে তুমি, আপনি, তাঁরা/তারা, সে/তিনি ইত্যাদি দুই ধরনের ভাগ থাকে। ক্রিয়াপদেও তখন সুর মিলিয়ে সম্মানসূচক রূপ ব্যবহার করার কথা। এগুলো একেবারে নিয়ম করে সব লেখকের ওপর চাপানো হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলে একটা ধরনধারণ বের হয়ে আসবে।

আধুনিক যুগের আরেকটি প্রয়োজনের কথা মনে করাতে হয়। বিশাল দৈর্ঘ্যের বাংলা অভিধান অনলাইনে দিয়ে বাংলা একাডেমি অনেকের ধন্যবাদ পাচ্ছে। সেভাবেই সব পরিভাষা কোষ, অন্যান্য অভিধান, বানানরীতি ইত্যাদি অনলাইনে থাকা দরকার। শেষ করার আগে উল্লেখ না করলেই নয় যে এসব আয়োজন তো শুধু জোগানের দিকে সাহায্য করবে। উন্নত মানের গবেষণাগ্রন্থ বা আকরগ্রন্থ রচনা ও অনুবাদে এগুলো প্রয়োজন। তবে সেই সঙ্গে এসব গ্রন্থের চাহিদাও বাড়াতে হবে ছাত্র-শিক্ষক সবার আগ্রহ তৈরির মাধ্যমে। উৎসাহ থাকতে হবে ব্যবসা-বাণিজ্যে বাংলা ভাষা ব্যবহারের, বাংলায় দক্ষতাকে গুরুত্ব দিতে হবে নিয়োগ-পদোন্নতির ক্ষেত্রে।


ড.

রুশিদান ইসলাম রহমান সাবেক গবেষণা পরিচালক, বিআইডিএস

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অন য ন য ব যবহ র এক ড ম পর ভ ষ র জন য সমস য দরক র ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

লাইটবার খুলে পড়ার আশঙ্কায় টেসলার সাইবারট্রাকের ১০ শতাংশ গাড়ি প্রত্যাহার

আবারও বাজার থেকে সাইবারট্রাক ফিরিয়ে নিচ্ছে টেসলা। এবার এর কারণ সফটওয়্যার নয়, সরাসরি যান্ত্রিক ত্রুটি। যুক্তরাষ্ট্রে ৬ হাজার ১৯৭টি সাইবারট্রাক প্রত্যাহারের বা রিকলের ঘোষণা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

ন্যাশনাল হাইওয়ে ট্রাফিক সেফটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এনএইচটিএসএ) তথ্য অনুযায়ী, এসব গাড়ির সামনের লাইটবার খুলে পড়ে সড়কে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। সংস্থাটি জানিয়েছে, ২০২৪ মডেলের কিছু সাইবারট্রাকে লাইটবার বসানোর সময় ভুল ধরনের ‘সারফেস প্রাইমার’ ব্যবহার করা হয়েছিল। ফলে আঠালো সংযোগ দুর্বল হয়ে পড়েছে। সহজভাবে বললে, টেসলা কিছু গাড়িতে লাইটবার লাগাতে ভুল আঠা ব্যবহার করেছিল। যেসব গাড়িতে এই ত্রুটি রয়েছে, সেগুলোর লাইটবার পরীক্ষা করে দেখা হবে। প্রয়োজনে নতুনভাবে লাইটবার বসানো হবে। সবই গ্রাহকদের জন্য বিনা খরচে। প্রায় ৬ হাজার ২০০টি সাইবারট্রাক প্রত্যাহার মানে টেসলার বিক্রি হওয়া মোট গাড়ির প্রায় ১০ শতাংশই সমস্যাগ্রস্ত।

এর এক সপ্তাহ আগেই আরও একটি বড় ত্রুটির কারণে ৬৩ হাজার ৬১৯টি সাইবারট্রাক প্রত্যাহার করা হয়েছিল। তখন দেখা যায়, গাড়ির সামনের পার্কিং লাইট অতিরিক্ত উজ্জ্বল হয়ে ওঠায় তা সামনের দিক থেকে আসা গাড়ির চালকদের দৃষ্টিকে ব্যাহত করতে পারে। তবে সেই সমস্যা সফটওয়্যার আপডেটের মাধ্যমে সমাধান করা হয়েছিল। টেসলার সাইবারট্রাক নিয়ে একের পর এক প্রত্যাহার এখন প্রায় নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এর অনেক সমস্যাই হার্ডওয়্যার–সংক্রান্ত, যেগুলো দূর থেকে সফটওয়্যার আপডেট দিয়ে সমাধান করা সম্ভব নয়।

সূত্র: ম্যাশেবল

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সিটা প্রকল্প যথাযথ পরিমার্জনের আহ্বান
  • লাইটবার খুলে পড়ার আশঙ্কায় টেসলার সাইবারট্রাকের ১০ শতাংশ গাড়ি প্রত্যাহার