ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে সম্মত রাশিয়া
Published: 18th, February 2025 GMT
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে বৈঠক করেছেন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার শীর্ষ কর্মকর্তারা। সাড়ে চার ঘণ্টা চলা এ বৈঠক অত্যন্ত ইতিবাচক ও গঠনমূলক হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। বৈঠকে দু’পক্ষ ওয়াশিংটন ও মস্কোতে নিজ নিজ দূতাবাসে কর্মীদের পুনর্বহাল, ইউক্রেন শান্তি আলোচনা এগিয়ে নিতে একটি উচ্চ পর্যায়ের দল তৈরি এবং উভয় পক্ষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা অন্বেষণ করতে সম্মত হয়েছে। মস্কো ইউক্রেন যুদ্ধের ন্যায্য ও স্থায়ী সমাপ্তি টানতে একটি গুরুতর প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে ইচ্ছুক বলে জানান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। খবর নিউইয়র্ক টাইমস ও আলজাজিরার।
আলোচনা শেষে পুতিনের পররাষ্ট্রনীতি উপদেষ্টা ইউরি উশাকভ বলেন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সাড়ে চার ঘণ্টার আলোচনা সফল হয়েছে। উভয় পক্ষ পুতিন ও ট্রাম্পের মধ্যে বৈঠকের শর্তগুলো নিয়ে আলোচনা করেছে। তবে পরবর্তী বৈঠকের জন্য কোনো তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি।
ইউক্রেন সংঘাতের অবসান হলে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্কের জন্য ‘অসাধারণ সুযোগ’ তৈরি হবে বলে মনে করেন মার্কো রুবিও। রিয়াদে রুশ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকের পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, দু’পক্ষ তিনটি লক্ষ্য অর্জনে সম্মত হয়েছে। ওয়াশিংটন ও মস্কোতে তাদের নিজ নিজ দূতাবাসে কর্মীদের পুনর্বহাল এবং ইউক্রেন শান্তি আলোচনা এগিয়ে নিতে একটি উচ্চ পর্যায়ের দল তৈরি করা হবে। পাশাপাশি তারা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়টিও অন্বেষণ করবে।
তবে এ আলোচনায় ইউক্রেন ও ইউরোপকে আমন্ত্রণ না করার বিষয়টি তাদের পাশ কাটানো নয় বলে দাবি করেন তিনি। রুবিও বলেন, ইউক্রেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন আলোচনার এক পর্যায়ে যুক্ত হবে। আজকের বিষয়টি দীর্ঘ যাত্রার প্রথম একটি ধাপ মাত্র।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভও উভয় পক্ষ নীতিগতভাবে বেশ কয়েকটি বিষয়ে একমত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। পুতিন-ট্রাম্প বৈঠকের ভিত্তি স্থাপন করতে আলোচনা হওয়ার কথাও নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, আলোচনা কার্যকর এবং গঠনমূলক ছিল।
আলোচনার বিষয়ে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেন, ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ মস্কোর কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিয়েভকে জোটে নিতে কেবল অস্বীকৃতিও রাশিয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। জোটকে ২০০৮ সালের বুখারেস্টের প্রতিশ্রুতি অস্বীকার করতে হবে। ২০০৮ সালের এপ্রিলে বুখারেস্টে ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনের প্রতিশ্রুতি ইঙ্গিত দেয়, জর্জিয়া ও ইউক্রেন প্রতিরক্ষা জোটের সদস্য হবে।
সৌদি আরবে মস্কোর আলোচক দলের সদস্য পুতিনের একজন সহকারী ইউরি উশাকভ বলেছেন, আগামী সপ্তাহে ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কম। এর আগে কয়েকটি গণমাধ্যম জানায়, দুই নেতা আগামী সপ্তাহে দেখা করবেন।
যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার আলোচনায় কোনো আশা দেখতে পাচ্ছে না বলে জানিয়েছে ইউক্রেন। তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারা থেকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, ইউক্রেনকে ছাড়াই ‘ইউক্রেন সম্পর্কে’ আলোচনা হচ্ছে।
জেলেনস্কির দলের একজন সদস্য এবং দেশটির পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির প্রধান ওলেকসান্ডার মেরেঝকো বলেন, এটা একেবারে কিছুই নয়। এর কারণ হলো, ইউক্রেন ও রাশিয়ার লক্ষ্য সম্পূর্ণরূপে অমীমাংসিত এবং তারা তাদের অবস্থানের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত। এটি কেবল ট্রাম্পের বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তব্য।
এদিকে, বছরের পর বছর ধরে ইউরোপীয় নেতারা সবকিছুতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে এসেছেন। দীর্ঘদিনের মিত্র দেশটি হঠাৎ করেই যেন প্রতিপক্ষের মতো আচরণ শুরু করেছে। দেশটির সাম্প্রতিক আচরণে হতবাক হয়ে পড়েছেন ইউরোপীয় নেতারা। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে মঙ্গলবার সৌদি আরবে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে বৈঠকে বসার পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপ-মার্কিন উত্তেজনা তীব্র হয়ে উঠেছে। চলমান সংঘাতটি ইউক্রেন ও ইউরোপীয় নিরাপত্তার জন্য অস্তিত্বগত বিষয় হলেও সেই আলোচনায় তাদের কাউকেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এর আগে গত সোমবার প্যারিসে তাড়াহুড়া করে আয়োজিত বৈঠকে ইউরোপীয় নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমানো নিয়ে আলোচনা করেছেন।
এ পরিস্থিতি তাদের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে। এরই মধ্যে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানিসহ অন্যান্য দেশ শান্তিরক্ষী হিসেবে ইউক্রেনে কয়েক হাজার সেনা মোতায়েন করার আলোচনা করেছে। ইউরোপজুড়ে ইউক্রেনের প্রতি জনসমর্থন শক্তিশালী হলেও এটি নেতাদের কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে। ইউক্রেনের মাটিতে সম্ভাব্য বিপজ্জনক দায়িত্ব পালনে সেনা পাঠানো দ্রুত একটি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধে রূপ নিতে পারে। শান্তিরক্ষী বাহিনীর আকার সম্পর্কে এখনও ধারণা পাওয়া না গেলেও বাজেট সংকটের এই সময়ে এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল কাজ হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইউক র ন ইউক র ন য দ ধ পরর ষ ট র ইউক র ন ও ইউক র ন র ইউর প য় র জন য সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
রাখাইনে করিডোর কি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আশার আলো দেখাবে
রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে নতুন আলোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর সূত্রপাত হয় সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তে হিউম্যানিটারিয়ান বা মানবিক করিডর গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যের মাধ্যমে, যেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এ বিষয়ে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গত দুই মাসে রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে ক্রমাগত নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলমান। রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয় মার্চ মাসে, যখন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে পবিত্র রোজার মাসে তাদের সঙ্গে ইফতার করেন।
এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাদের মেহমান উল্লেখ করে বলেন, তিনি প্রত্যাশা করেন আগামী রোজা রোহিঙ্গারা নিজ দেশে করতে পারবেন।
পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে একটি পার্শ্ব আলোচনার পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত।
এ নিয়েও জনসাধারণের মধ্যে একধরনের ধোঁয়াশা কাজ করে। কেননা, আরাকান আর্মিকে উপেক্ষা করে এ ধরনের মন্তব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে খুব বেশি আশার আলো দেখাবে না। এর বেশ কিছুদিন পরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সঙ্গে যে সহিংস দ্বন্দ্ব চলমান, সে প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনই সম্ভব নয়।
এই চলমান আলোচনায় নতুন বিতর্ক তৈরি হয় রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার আলোচনার মাধ্যমে, যদিও এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, এ বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে তাঁদের এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। এমন নানামুখী আলোচনায় জনমনে বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার প্রধান যুক্তি হলো, এতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর সাহায্যার্থে ত্রাণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনের সামগ্রী পাঠানো সম্ভব হবে।
মানবিক করিডর ও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে আলোচনার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক মানবিক করিডর বলতে আসলে কী বোঝায়।
জাতিসংঘের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সশস্ত্র সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সংঘাত বা যুদ্ধ পরিস্থিতির সাময়িক বিরতির জন্য অনেক ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়, তার মধ্যে একটি হলো মানবিক করিডরের প্রস্তাব।
এই মানবিক করিডরের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এমন একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়, যেখানে সশস্ত্র সংঘাত যেন না ঘটে। সে বিষয়ে দুই পক্ষ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একমত হয়। মানবিক করিডরের পরবর্তী ধাপে সেই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের অধিবাসীদের একটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় অথবা সেখানে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা হয়।
এ ধরনের মানবিক করিডরের উদাহরণ আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই। এখানে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হবে, সেটাই প্রত্যাশা করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান রেডক্রস এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মধ্যে অন্যতম হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর, নব্বইয়ের দশকে সারায়েভো সংকট, ২০১৮ সালে সিরিয়ার জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা এবং সর্বশেষ দেখতে পাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে।
যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা।রাখাইনকে ঘিরে মানবিক করিডর গড়ে তোলার এই নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে গবেষক, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন, আশঙ্কা ও দ্বিধা তৈরি হয়েছে।
তবে শঙ্কার পাশাপাশি কোনো কোনো গবেষক মনে করছেন, মানবিক করিডরের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার চলমান সংলাপ আরও জোরদার হবে, যা ভবিষ্যতে এই সংকট মোকাবিলায়, বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তবে এই ইতিবাচক প্রত্যাশা ছাপিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে যে দ্বিধা রয়েছে, সেটি হলো এই মানবিক করিডরের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে, নাকি আরও বিলম্বিত হবে, নাকি আরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ পাবে।
ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, এক লাখের ওপরে রোহিঙ্গা শরণার্থী আবারও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ এই দায় যেমন এড়িয়ে যেতে পারছে না, তেমনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার ভারও বহন করতেও হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ তাদের অন্যান্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মানবিক করিডর কতটা বাস্তবসম্মত হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কেননা, কোনো বিস্তারিত দিকনির্দেশনা আমাদের সামনে নেই।
অতীতের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, মানবিক করিডরের অন্যতম প্রধান ব্যবহার হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীকে সংঘাতপূর্ণ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা। যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে চলমান অনুপ্রবেশ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেখানে মানবিক করিডরের মাধ্যমে আরও বৃহৎ অংশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়ায় শুরু অস্বাভাবিক নয়।
এ প্রেক্ষাপটে যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা।
এর বাইরে আরেকটি চিন্তার জায়গা হলো সীমান্ত এলাকা বাংলাদেশ কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, সেটি। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখলে বোঝা যায়, সীমান্ত প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান প্রচেষ্টা খুব যে সুখকর, সেটি বলা যাবে না।
এ ছাড়া এই অঞ্চল বিভিন্ন কারণে মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, সহিংসতা ও অন্যান্য নিরাপত্তাঝুঁকির জন্য একটি অন্যতম হটস্পট, যা নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের নানাভাবে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয় কি না, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মানবিক করিডরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে, সে বিষয়েও যথাযথ পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে এবং নিজেদের স্বার্থেই আমাদের স্বচ্ছ থাকতে হবে।
এর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোসহ অন্য অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করারও বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা, এর পরবর্তী পরিণতি ও ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারকেই গ্রহণ ও বহন করতে হবে। যদিও জাতিসংঘের মানবিক করিডরের প্রস্তাব বেশ পুরোনো, কিন্তু তড়িঘড়ি করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হিতে বিপরীত হতে পারে। শরণার্থী বিষয়ে একটি টেকসই রূপরেখা এবং পরিকল্পনানীতি না থাকার কারণে সরকারকে অ্যাডহক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যাজনক হয়।
এসব বিবেচনায় নিয়ে একজন গবেষক হিসেবে আমি বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাবিষয়ক একটি জাতীয় রোডম্যাপ বা রূপরেখা এবং শরণার্থীবিষয়ক নীতি প্রণয়ন করার পক্ষে কথা বলে আসছি। আমাদের সে ধরনের কোনো দৃশ্যমান পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি বিগত সময়ে ছিল না। বিশেষ করে যদি প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয় এবং জাতিসংঘের প্রস্তাবিত মানবিক করিডর আমাদের প্রত্যাশামতো কাজ না করে, তাহলে বিকল্প কী হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি আমাদের থাকা উচিত। সেটি না হলে রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে এবং তাদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন একটি ‘মিথ’ হিসেবে থেকে যাবে, যা আমাদের ও রোহিঙ্গা উভয়ের জন্যই হতাশার একটি বিষয় হবে।
● বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়