মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও বৈশ্বিক বাণিজ্যব্যবস্থায় আলোড়ন তুলেছেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, আমেরিকার বাণিজ্য অংশীদারদের ওপর ‘পাল্টা শুল্ক’ আরোপ করা হবে। তাঁর বক্তব্য, ‘যে দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে যে হারে শুল্ক আরোপ করে, আমরাও তাদের ওপর সেই একই হারে শুল্ক আরোপ করব।’

ট্রাম্পের এ অবস্থান নতুন এক অর্থনৈতিক সুরক্ষাবাদী নীতির ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। যদিও মূল লক্ষ্য চীন, তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত, মেক্সিকোসহ অন্য বড় অর্থনীতিগুলোর ওপরও এ নীতি প্রভাব ফেলতে পারে।

ইতিমধ্যে বৈশ্বিক আর্থিক বাজারগুলো এ ঘোষণার প্রভাব অনুভব করছে, শেয়ারবাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, যা বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। অনেক বাণিজ্য বিশ্লেষক মনে করছেন, এই শুল্কব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য–বিরোধ বাড়িয়ে তুলবে এবং পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে, যা আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলতে পারে।

বাংলাদেশও এ পরিস্থিতিতে ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। ২০২৩ সালে ৪৮টি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি ছিল (কমপক্ষে এক বিলিয়ন ডলার), যার মধ্যে চীন ২৭৯ বিলিয়ন ডলার নিয়ে শীর্ষে ছিল। তারপর মেক্সিকো (১৫২ বিলিয়ন ডলার) ও ভিয়েতনামের (১০৪ বিলিয়ন ডলার) অবস্থান।

ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতি ছিল প্রায় ৪৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার এবং ভারতের অবস্থান ১১তম। ২৫তম স্থানে থাকা বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি বাণিজ্যঘাটতি ছিল। যদিও বৃহত্তর অর্থনীতির তুলনায় এটি সামান্য, তবু ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির আকস্মিকতা ও অনিশ্চয়তা, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর রপ্তানিনির্ভরতা এবং আমাদের উচ্চ আমদানি শুল্ক নীতি বাংলাদেশকে সম্ভাব্য পাল্টা শুল্ক আরোপ ও বৃদ্ধির ঝুঁকিতে ফেলেছে।

এই ৪৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়া হলো একমাত্র দুটি স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি)। কম্বোডিয়া ইতিমধ্যে কিছু মার্কিন নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন এবং তার মার্কিন বাজারে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ১১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এই দেশ যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্কের একটি সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারে।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর ২০১৩ সালে জিএসপি মর্যাদা স্থগিত করায় বাংলাদেশ অবশ্য বর্তমানে মার্কিন বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাচ্ছে না। কিন্তু ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ বড় ঝুঁকিতে পড়তে পারে। যদি নতুন করে শুল্ক আরোপ করা হয়, তাহলে এটি বাংলাদেশের রপ্তানির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে, যা দেশের অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ।

সরকারি নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই ব্যবসায়ী সংগঠন, শিল্পমালিক ও রপ্তানিমুখী খাতের অংশীজনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে, যাতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বজায় রাখা যায় এবং নতুন বাজার অনুসন্ধানের পথ উন্মুক্ত হয়। পাশাপাশি নীতি সংস্কার ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশের বাণিজ্যসুবিধা সংরক্ষণ করতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশকে অবশ্যই দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বাণিজ্য আলোচনা জোরদার করতে হবে, যাতে মার্কিন নীতির নেতিবাচক প্রভাব হ্রাস করা যায়।

বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে এবং যুক্তরাষ্ট্র দেশটির অন্যতম প্রধান বাজার। যদি পোশাক রপ্তানিতে নতুন করে শুল্ক আরোপ করা হয়, তাহলে মার্কিন ক্রেতাদের জন্য আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে ক্রয়াদেশ কমে যেতে পারে এবং তারা অন্য বিকল্প সরবরাহকারীদের দিকে ঝুঁকতে পারে।

বৈশ্বিক পোশাকশিল্প ইতিমধ্যে প্রতিযোগিতামূলক হওয়ায় মার্কিন আমদানিকারকেরা এমন দেশগুলো থেকে পণ্য সংগ্রহ করতে পারে, যারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা ভোগ করে। ফলে বাংলাদেশের বাজারে অংশীদারত্ব হ্রাসের আশঙ্কা রয়েছে।

শুধু তৈরি পোশাক নয়, বরং বাংলাদেশের অন্যান্য উৎপাদন ও উদীয়মান শিল্প খাতগুলো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। চামড়া, জুতা ও ওষুধশিল্প সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ বাড়িয়েছে। তবে নতুন করে শুল্ক আরোপ করা হলে এসব খাতের সম্প্রসারণ শ্লথ হয়ে যেতে পারে এবং অন্য প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে, কিন্তু যদি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হয়, তাহলে প্রবেশাধিকার বাধাগ্রস্ত হতে পারে এবং বাজার সম্প্রসারণের সুযোগ কমে যেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতির এই অনিশ্চয়তা বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ও বাণিজ্য অংশীদারত্বের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিনিয়োগকারীরা সাধারণত স্থিতিশীল বাণিজ্য পরিবেশকে অগ্রাধিকার দেয়। যদি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের বিষয়ে অনিশ্চয়তা বাড়তে থাকে, তাহলে অনেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনা করতে পারে, বিশেষ করে রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোর ক্ষেত্রে। ফলে দীর্ঘ মেয়াদে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও শিল্প খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল গ্রহণ করা জরুরি—

প্রথমত, সুনির্দিষ্ট ঝুঁকি মূল্যায়ন: সম্ভাব্য শুল্ক বৃদ্ধির সুনির্দিষ্ট প্রভাব চিহ্নিত করার জন্য একটি তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ জরুরি। ৬ ডিজিট হারমোনাইজড সিস্টেম কোড অনুযায়ী দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বিশদ বিশ্লেষণ করলে কোন পণ্য বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, তা বোঝা যাবে। ব্যবসায়ী ও নীতিনির্ধারকদের যৌথভাবে বিকল্প বাজার অনুসন্ধান এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ বিষয়ে শিল্প সংস্থা ও বাণিজ্যবিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।

দ্বিতীয়ত, কূটনৈতিক সংলাপ: যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক, বাণিজ্য প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে সক্রিয় ও অর্থবহ সংলাপ অপরিহার্য। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের মিশন এবং ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের সঙ্গে আরও কার্যকরভাবে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে, যাতে কোনো প্রতিকূল বাণিজ্যব্যবস্থা আগেভাগেই প্রতিহত করা যায়। এ ছাড়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও আঞ্চলিক জোটগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশকে তার স্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টা করতে হবে। 

তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক ঝুঁকি সামলানোর ক্ষমতা বৃদ্ধি: কর, বাণিজ্যনীতি ও শিল্পকৌশলের ক্ষেত্রে কাঠামোগত সংস্কার ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন। তৈরি পোশাকের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমাতে রপ্তানি বহুমুখীকরণ জরুরি। উচ্চমূল্য সংযোজিত উৎপাদন ও সেবা খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করা এবং বাণিজ্যিক অবকাঠামো উন্নত করার দিকেও জোর দিতে হবে।

বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিবেশ ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে উঠছে, যেখানে নতুন শুল্ক নীতি, ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং সাপ্লাই চেইনের পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী ব্যবসার গতিপথ নির্ধারণ করছে। এ রকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ নিষ্ক্রিয় থাকার ঝুঁকি নিতে পারে না, বিশেষ করে যখন দেশটির অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণভাবে রপ্তানিনির্ভর। ট্রাম্পের ‘পাল্টা শুল্ক’ নীতির ফলে আসন্ন ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকারকে কৌশলগত ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে, যা শুধু স্বল্পমেয়াদি ক্ষতি প্রশমিত করবে না, বরং দীর্ঘ মেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করবে।

সরকারি নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই ব্যবসায়ী সংগঠন, শিল্পমালিক ও রপ্তানিমুখী খাতের অংশীজনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে, যাতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বজায় রাখা যায় এবং নতুন বাজার অনুসন্ধানের পথ উন্মুক্ত হয়। পাশাপাশি নীতি সংস্কার ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশের বাণিজ্যসুবিধা সংরক্ষণ করতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশকে অবশ্যই দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বাণিজ্য আলোচনা জোরদার করতে হবে, যাতে মার্কিন নীতির নেতিবাচক প্রভাব হ্রাস করা যায়।

এ ছাড়া দেশকে দীর্ঘ মেয়াদে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখতে করকাঠামো সংস্কার, বাণিজ্য অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। মার্কিন নীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশকে তার অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় এখনই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যাতে কোনো আকস্মিক সিদ্ধান্ত দেশের রপ্তানি খাতকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে। সময়োপযোগী পদক্ষেপ ও দূরদর্শী নীতি গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে তার অবস্থান শক্তিশালী করতে পারবে এবং বহিরাগত চাপের মধ্যেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হবে। 

সেলিম রায়হান অর্থনীতির অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নির্বাহী পরিচালক, সানেম

[email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন ত ন র ধ রকদ র ক টন ত ক ব শ ষ কর ব যবস থ অবস থ ন অন শ চ গ রহণ অবশ য র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

আঠারো শতকের সুফি কবি ও সংগীতজ্ঞ সৈয়দ খাজা মীর দর্দ

আবদালি মারাঠিদের উৎপাত ও অত্যাচারে অন্য কবিরা যখন একে একে দিল্লি ছেড়ে লক্ষ্ণৌ চলে গিয়েছিলেন, তখনো প্রিয় শহর দিল্লি ছাড়েননি সৈয়দ খাজা মীর দর্দ (১৭২০-১৭৮৪ খ্রি.), বরং আমৃত্যু সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন। লক্ষ্ণৌয়ে অবস্থানকারী কবিদের কাব্যবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাঁর কবিতার যে পার্থক্য ছিল, শুধু সে কারণেই তিনি সেই জায়গায় যাননি তা নয়, তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রখর, কারও তারিফ করে কখনো কসিদা লিখেছেন বলে শোনা যায়নি, সর্বোপরি তাঁর জীবনদর্শনও ছিল সমকালিক অন্য কবিদের থেকে আলাদা। মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন। মির্জা রফী সওদার চেয়েও সাত বছরের অগ্রজ মীর দর্দ এই সবকিছুই নিবিড়ভাবে লক্ষ করেছেন, পারস্য ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভান্ডার থেকে অনেক কিছু গ্রহণও করেছেন, তবু আমাদের ধারণা, পারিবারিক বংশধারার প্রভাবেই তাঁর জীবনদর্শন ও কাব্যচিন্তা শুরু থেকেই ভিন্ন ছিল।

মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন।

মাহমুদ আলী খান জামী তাঁর ‘দর্দ কে সো শের’ (প্রকাশকাল: ১৯৫৫ খ্রি., দিল্লি) গ্রন্থে লিখেছেন, খাজা মীর দর্দের দাদা বাদশাহ আলমগীরের শাসনামলে বুখারা থেকে এ দেশে এসেছিলেন, আর বাবা খাজা মাহমুদ নাসির আন্দালিব ছিলেন ‘শায়েরে উর্দু’ এবং ব্যক্তিগত জীবনে একজন সুফি। ভিন্ন মতে, তাঁর বাবার নাম (মাহমুদ নাসির নয়) মুহাম্মদ, আর তিনি উর্দু ভাষার কবি ছিলেন না, ছিলেন ফারসি ভাষার কবি। এঁরা ছিলেন নকশবন্দী ঘরানার পথিকৃৎ খাজা বাহাউদ্দিনের বংশধর ও অনুসারী। সুফি পরম্পরার মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন বলেই মাত্র বাইশ বছর—ভিন্ন মতে, সাতাশ বছর বয়সে জাগতিক মোহ ত্যাগ করে সুফি শুদ্ধাচারী হয়ে ওঠেন দর্দ এবং সুফি তত্ত্বসংক্রান্ত একাধিক বই লেখেন। ফলে তিনি যখন শের ও গজল লেখেন, তখন সেগুলোতে স্বভাবগত কারণেই সুফি মরমি কবিতার সহজগভীর ভাবের ছায়া পড়েছে। নিচে দর্দ কে সো শের বই থেকে—অন্যত্র গজলরূপে গণ্য এবং গীত—প্রথম ৩টি শের পড়লে এ কথার সত্যতা মিলতে পারে :

তোহমতে চন্দ অপনে জিম্মে ধর চলে
জিস লিয়ে আয়ে থে হম সো কর চলে
জিন্দেগি হ্যয় য়া কোই তোফান হ্যয়
হম তো ইস জিনে কে হাথোঁ মে মর চলে
শমা কে মানিন্দ হম ইস বজম মে
চশম নম আয়ে থে দামন তর চলে

অর্থাৎ :

কত অপবাদ বয়ে নিয়ে আমি চলছি
অথচ যে কারণে এসেছি তা–ই করে গেছি
এ কোনো জীবন, নাকি তুফান
তার হাতেই তো আমি মারা যাব
এই সভার প্রদীপ ছিলাম আমি
এখন আমার চোখের জলে আঁচল ভিজে যায়

[অনুবাদ: লেখক]

অল্প বয়স থেকে যিনি এমন ভাবনায় তাড়িত, তাঁর গজলে এই প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। সুফি কবি ও সাধক হিসেবে স্বীকৃত হলেও গজলকার হিসেবে যেরকম গণ্য হননি খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি, ঠিক একই কারণেই গজলকার হিসেবে কেউ কেউ তাঁর নাম সমকালের মীর তকী মীর ও মির্জা রফী সওদার কাতারে রাখতে কুণ্ঠিত। অবশ্য এ ক্ষেত্রে খোদ মীর তকী মীরের একটি মন্তব্য আছে, যা অনেকেই উদ্ধৃত করেন, তা হলো: তিনি নাকি আড়াইজন কবিকে সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন, যার মধ্যে একজন তিনি নিজে, অন্যজন মির্জা রফী সওদা আর অর্ধজন হলেন খাজা মীর দর্দ।

তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।

শের ও গজলের ক্ষেত্রে মীর তকি মীর শেষমেশ যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন সেই জায়গা থেকে বিচার করে তাঁর এই কথাটিকে সদর্থে ধরে নিলে কবিতায় খাজা মীর দর্দের অবদানকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন না করে উপায় নেই। আসলে পারস্য কবিতার ঐতিহ্য ধারণ করে উর্দু গজলে যখন পরবর্তীকালের জনপ্রিয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নারীর সঙ্গে আলাপের আবহ তৈরি হচ্ছে, খাজা দর্দ তখন একই উৎস থেকে গ্রহণ করেছিলেন সুফি ঐতিহ্য। সমালোচকদের মতে, তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ান-এ উর্দু’, কিন্তু তাঁর ‘শমা-এ মহফিল’, ‘আহ-এ দর্দ’, ‘দর্দ-এ দিল’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের প্রাঞ্জল ভাষা ও সুফিহৃদয়ের ভাব সেই সময় ও পরবর্তীকালের কবিদেরকেও প্রভাবিত করেছে। তাঁর একটি অনবদ্য শের হলো: ‘তমান্না তেরি হ্যাঁয় অগর হ্যাঁয় তমান্না/ তেরি আরজু হ্যায় অগর আরজু হ্যায়’ অর্থাৎ, আকাঙ্ক্ষা যদি থাকে, তা তোমারই আকাঙ্ক্ষা/ আশা তোমার জন্য, আদৌ আশা বলে যদি কিছু থাকে’। প্রেমের এমন একনিষ্ঠ নিবেদন খাজা দর্দের শেরেই পাওয়া সম্ভব। নিচে পড়ে নিতে পারি তাঁর আরও একটি জনপ্রিয় শের:

হাজারোঁ খওয়াহিশেঁ অ্যায়সি কে হর খওয়াহিশ পে দম নিকলে
বহুত নিকলে ম্যারে আরমান ল্যাকিন পির ভি কম নিকলে

অর্থাৎ :

এমন হাজার বাসনা আমার, যার প্রতিটি বাসনার জন্য প্রাণ ওষ্ঠাগত
কিছু আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো বটে; কিন্তু তা খুবই সামান্য

তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।

আরও পড়ুনএকাদশ শতকের সুফি কবি হাকিম সানায়ি গজনভি২৮ আগস্ট ২০২৫

মীর দর্দের এমন উচ্চাসনে পৌঁছার অন্য একটি কারণ হলো, তাঁর জন্মের বহু আগে থেকেই গান শোনা ও তার চর্চা বিষয়ে যে তর্ক-বিতর্ক চলে আসছিল, সে বিষয়ে তাঁর সবিস্তার আলোচনা এবং গানবিষয়ক গান লেখার উদাহরণ। আমাদের অজানা নয়, গান বিষয়ে কওয়ালির প্রতিষ্ঠাতা আমির খসরুর একাধিক বাণী আছে, যেমন: ‘গান হলো আত্মার খোরাক’, ‘দরবেশের কাছে গান হলো ঐশ্বরিক জ্যোতির সমতুল’ ইত্যাদি, আর দর্দ লিখেছেন: ‘অগর ঘিনা নফস কো বড়্কায়ে তো হারাম, অগর দিল কো ইলাহ কি তরফ নরম করে তো হালাল’ অর্থাৎ গান যদি মনকে প্রবৃত্তিতাড়িত হতে উসকে দেয় তাহলে হারাম, আর স্রষ্টামুখী করলে হালাল’। এ বিষয়ে দর্দের যে শের রয়েছে, সেটি আরও সুন্দর :

সামা’ আহলে দিল কো হ্যা সোদমন্দ দর্দ
কে ইস সে নরম হোতা হ্যা পাত্থর কা দিল ভি

অর্থাৎ :

হৃদয়বান মানুষের জন্য গান উপকারী, হে দর্দ
কারণ পাথরের মতো হৃদয়ও তাতে গলে যায়।

উল্লেখ্য যে, গান বিষয়ে আলোচনা করবার সময় এ অঞ্চলের গবেষক ও সুফি-বাউল-ফকিরেরা ইমাম গাজ্জালি, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি ও আমির খসরুর বইয়ের তথ্যের উল্লেখ করেন, কিন্তু প্রকাশ ও প্রচারের অভাবে কোথাও সৈয়দ খাজা মীর দর্দের কথা পাওয়া যায় না। জাভেদ হুসেন দর্দের কয়েকটি গজল অনুবাদ করতে গিয়ে তার ভূমিকায় লিখেছেন: ‘দর্দ ছিলেন একজন বড় সংগীতজ্ঞ। সুফি সাধনায় সংগীতের ভূমিকা নিয়ে হুরমতে ঘিনা নামে পুস্তিকা লিখেছেন। উর্দু গজলের গীতিময়তা আজ দেখা যায় তাতে দর্দের ভূমিকা ব্যাপক ও গভীর।’ এই পুস্তিকাটি দুর্লভ, ভবিষ্যতে এটি অনূদিত হলে শায়ের ও গজলকার মীর দর্দের পাশাপাশি সংগীতচিন্তক হিসেবে তাঁর পরিচয়টাও আমরা জানতে পারব।

অন্য আলো–য় লিখতে পারেন আপনিও। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধসহ আপনার সৃজনশীল, মননশীল যেকোনো ধরনের লেখা পাঠিয়ে দিন। পাঠাতে পারেন প্রকাশিত লেখার ব্যাপারে মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া।
ই–মেইল: [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ