অফিসের রুটিন কাজে আটকে পড়ে প্রায় হাঁপিয়ে উঠেছি। বহুদিন কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি। বেশ কিছুদিন ধরে ভাবছিলাম মনের ক্লান্তি দূর করতে কোথাও ভ্রমণে যাওয়া দরকার। ভ্রমণ শরীর আর মন দুইয়ের জন্য সেরা দাওয়াই। ভ্রমণের স্বপ্ন ভাবনায় দানা বাঁধলে ভাবতে থাকি- যদি পাখির মতো মুক্ত জীবন থাকতো, পৃথিবী চষে বেড়ানোর মতো টাকা থাকতো, তাহলে ঘুরে বেড়াতাম সবুজ পাহাড়ে, গাংচিলের মতো নীল জলের সমুদ্রের উপর। স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন ব্যাপার!
এবার ভ্রমণের স্থান নির্বাচন করেছি ইন্ডিয়ার এমন একটি রাজ্য, যার আশেপাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা বা হিমালয়ের সৌন্দর্য নেই। যেখানে নেই সাদা বরফের গায়ে সোনালি রোদের কিরণ লেগে দ্যোতনা সৃষ্টির দৃশ্য, নেই শ্বেত বরফের শীতলতা। যাচ্ছি কবিগুরুর শহর, জীবনানন্দের শহর, শীর্ষেন্দু, সুনীল, সমরেশের শহর কলকাতায়।
১০ জানুয়ারি ২০২৫, রাত ১২টা ৩০ মিনিট। তল্পিতল্পা বলতে একটা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে ঢাকার আরামবাগ থেকে দাদাদের দেশের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছি। ভ্রমণসঙ্গী সহকর্মী লিটু ভাই আর সঞ্জয়দা। আমরা যখন বাসে বসে আছি তখন বাইরে প্রচুর শীত। ধোঁয়ার মতো হয়ে কুয়াশা পুরো দিগন্ত ঢেকে রেখেছে। সারাদিন অফিস করার পর রাতে ক্লান্তিতে শরীর অবসন্ন হয়ে আছে। মধ্যরাতে বাসে বসে চোখের পাতা বুজে আসছে। তবুও চোখের পাতা এক হতে দিচ্ছি না, যাত্রাপথে স্বপ্নের পদ্মা সেতু প্রথমবার দেখব বলে।
রাত দেড়টা, আমাদের বাস পৃথিবীর অন্যতম খরস্রোতা পদ্মা নদী পার হচ্ছে। পদ্মা সেতুতে আছে দুই স্তরবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিটে নির্মিত চার লেনের সড়ক ও রেলপথ। ঢাকার সাথে এই সেতু দক্ষিণ বঙ্গকে এক সুতায় গেঁথেছে। সন্ধ্যাবেলা অফিস শেষে দিগন্তে যখন চোখ রেখেছিলাম, তখন আকাশ ছিল অপুষ্টিতে ভোগা অর্ধাকৃতির চাঁদ আর হাজার তারার দখলে। বাসের কাচের জানালা দিয়ে মধ্যরাতে তাকিয়ে দেখছি, কুয়াশার কুণ্ডলী চাঁদ-তারা ঢেকে রেখেছে। পদ্মা নদীর বুকে ধুধু অন্ধকার তার চাদর বিছিয়ে রেখেছে। ভেবেছিলাম, যখন পদ্মা পার হবো তখন চাঁদ-তারার যৌথ আলো পদ্মার জলের বুকে রুপালি আভা সৃষ্টি করবে।
দু’পাশের জ্বলন্ত সড়কবাতির ধবধবে আলোয় সেতুর সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পাড়ি দিলাম, ২১টি জেলার সাথে সংযোগকারী পদ্মা সেতু। রাত যতই গভীর হতে থাকল শীতের তীব্রতা ততই বাড়তে থাকল। সকাল ছ’টায় যখন বাস থেকে বেনাপোল নামিয়ে দেয়া হলো তখন তীব্র শীতে কেঁপে উঠলাম। শীতেও আমরা উদ্বিগ্ন হলাম না। সারারাত বাস ভ্রমণে শরীরে ক্লান্তি এলেও তিনজন চেয়ার বসে ঘণ্টাদেরেক ঘোড়ার মতো ঘাড় উঁচিয়ে ঘুমিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে নিলাম। যাতে কলকাতা পৌঁছানোর পর ক্লান্তি ঘিরে ধরতে না পারে।
সকাল নয়টায় নাস্তা সেরে ইমিগ্রেশনের জন্য প্রবেশ করলাম। কলকাতা দেখার নেশায় ভাবনার রাজ্যে ভেসে উঠছে নতুন স্বপ্ন। মনের আয়নায় ভেসে উঠছে শহরের একটা কল্পিত চিত্র। ইমিগ্রেশনে হঠাৎ এলাকার ছোট ভাই সাব-ইন্সপেক্টর তুষারের সাথে দেখা। ও ইমিগ্রেশনে যতটা সম্ভব সহায়তা করে বলল, দুই দেশের গন্ডগোলের কারণে এখন সীমান্ত একেবারে শান্ত, কোনো ভিড় নেই। আগের সময় হলে এতক্ষণ বেনাপোল বন্দর রূপান্তরিত হতো মেলা প্রাঙ্গণে।
আমরা যখন বিদায় নিয়ে ওপারে চলে যাচ্ছি। এমন সময় কানের কাছে এসে তুষার আবার বলল, ভাইয়া, এই শীতে কাশ্মীরের বাঁকে বাঁকে শীতল বরফ জমে থাকে। পর্বত চূড়ায় বরফ ঢাকা গুহার মুখ দিয়ে ধোঁয়ার মতো কুয়াশার কুণ্ডলী বের হয়। আপেল গাছ থেকে হাত দিয়ে সতেজ আপেল পেড়ে খাওয়ার মজাই আলাদা। দুই পা দুইদিকে ঝুলিয়ে ঘোড়ায় চড়ে পৃথিবীর ভূস্বর্গ দেখার স্বপ্ন পূরণ করে নিন। প্রস্তুতি থাকলে কলকাতা পৌঁছে কাশ্মির চলে যান।
তুষারের কথা শুনে হঠাৎ মনে পড়ল সহকর্মী মামুন, তুষার কান্তি ও আরাফাতের কথা। মাসখানেক আগে ওরা কাশ্মির ঘুরে এসে বলেছিল, কাশ্মিরে এবড়োথেবড়ো পাথুরে পাহাড়ি পথের চূড়া পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে অনেকবার ঘোড়ার রাশ টেনে ধরতে হয়েছিল। ঘোড়ার হ্রেষা ধ্বনি, বরফে খুরের আওয়াজ আর লাগামের টুংটাং শব্দ ওদের অনেক শিহরিত করেছিল। ওদের দেহের প্রতিটি পেশি গুণটানা ধনুকের মতো টানটান হয়ে গিয়েছিল উত্তেজনায়। ওরা ভয়মিশ্রিত খুশিতে শিহরিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল অনেকবার। বলেছিল, অনেক উঁচু আর খাঁজকাটা বরফের পর্বতে ওঠা এত সহজ নয়! বরফের শীতল মিছিলে যোগ দেওয়ার শিহরণ নাকি, না গিয়ে অনুভব করা সম্ভব নয়! ওরা ফিরতি পথের বিরতিতে ঘোড়াগুলোকে যথেষ্ট দানাপানি দিয়েছিল, যাতে ফিরতি পথে ঘোড়াগুলো শরীরের ওজন বহন করতে পারে।
সহকর্মীদের মুখে কাশ্মিরের সৌন্দর্যের গল্প শুনে স্থির করে রেখেছি। পৃথিবীর স্বর্গ যদি কাশ্মির হয়, তাহলে অনন্তকালের অপেক্ষায় না থেকে, জীবদ্দশায় কিছু পয়সা খরচ করে একবার পৃথিবীর স্বর্গ ঘুরে আসব। ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া শেষ করে আমরা পেট্রাপোল সীমান্তে এপারে এসে দাঁড়ালাম। এশিয়ার বৃহত্তম স্থল শুল্ক-স্টেশন বেনাপোল-পেট্রোপোল । পেট্রাপোলকে কেন্দ্র করে এখানে বিশাল অর্থনীতিক কর্মকাণ্ড গড়ে উঠেছে। দিগন্তে তাকিয়ে দেখলাম, আকাশের বুকে ঝুলে থাকা উদিত সূর্যটা দেখা যাচ্ছে না কুয়াশার কারণে।
কলকাতা এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পুরাতন শহর। এই শহরকে ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়। এই শহর তার মাটিতে সাহিত্যিক, শৈল্পিক ও বৈপ্লবিক চেতনার অনেক গুনীজনের জন্ম দিয়ে বিশ্ববিদিত হয়েছে। মনে হচ্ছে, ভারতের শিল্প ও সাহিত্য চেতনার মনীষীদের জন্মস্থান কলকাতা আমাদের ঠকাবে না! কলকাতার ঐতিহ্য, খাবার এবং প্রাণবন্ত পরিবেশ এক অনন্য অভিজ্ঞতা দেবে! এসব ভাবতে ভাবতে হরিদাসপুর পৌঁছে কাশ্মিরের ভাবনার রেশ কেটে গেল।
সঞ্জয়দা হঠাৎ বলল, আমরা বাসে না গিয়ে লোকাল ট্রেনে বনগাঁ থেকে শিয়ালদহ হয়ে কলকাতা যাব। ট্রেন ভ্রমণে ইন্ডিয়ার মানুষের সঙ্গে মিশে ওদের সংস্কৃতিটা জানতে পারব। আমরা হরিদাসপুর থেকে অটোতে রওনা হলাম বনগাঁর পথে। বনগাঁয় পৌঁছে পরিস্থিতিটা বুঝার চেষ্টা করলাম। বুকের মাঝে ভয়ের একটা আতঙ্ক শিরশির করে উঠছে। ভাবলাম, দুই দেশের চলমান রাজনৈতিক উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে উটকো ঝামেলায় আবার না পড়ে যাই!
বনগাঁ থেকে ২০ রুপি করে টিকেট কেটে শিয়ালদহের ট্রেনে বসে পড়েছি। প্রথম স্টেশন হওয়ায় যাত্রীর আনাগোনা খুব কম। টিকিটের গায়ে লেখা সময় ধরে ট্রেন ১০.
কিছুক্ষণ পর চোখে পড়ল সবুজ গাছপালা সমতল এলাকাটিকে ঘিরে আছে। কৃষকের বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে হলুদ শর্ষে ফুলের অবারিত সৌন্দর্য লুটোপুটি খাচ্ছে। হলুদের গালিচা মোড়ানো বিস্তীর্ণ প্রান্তর দেখে মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। যেদিকে চোখ যায়, সেখানেই প্রকৃতি হলুদ চাদর বিছিয়ে রেখেছে। এ যেন আমাদের দেশের মতো আরেক রূপসী বাংলা। অন্য যাত্রীরা আমার মতো শর্ষে ফুলে মুগ্ধ হচ্ছেন কিনা বুঝতে পারছি না। আমাদের দেশে আমন ধান উঠে যাওয়ার পর বোরো আবাদের আগের সময়টুকুতে চাষ হয় শর্ষের। অনেক কৃষক দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলি করার চেষ্টা করে হলুদ শর্ষে ফুলের চাষে। এই সময় মৌমাছিরা ফুল থেকে ফুলে উড়ে ঘটায় প্রাকৃতিক পরাগায়ন। ফসল ভালো হয় মৌমাছির কারণে।
আমাদের ট্রেন শিয়ালদহের দিকে যত এগিয়ে যাচ্ছে যাত্রী আর হকারের আনাগোনা তত বাড়ছে। হকার ঝুড়ি ভর্তি কমলালেবু, আপেল বিক্রির সময় বলে যাচ্ছে একশ রুপিয়া কেজি। কখনো কাঠির ডগায় পতাকার মতো আমড়া উড়িয়ে হাজির হচ্ছে হকার। কেউ পেয়ারা, আচার, শনপাপড়ি। কেউ উচ্চস্বরে বলছে, ভাল বাদাম, ছোলা, ঝুরি ভাজা খেলে বলবেন। পাশেই এক ফেরিওয়ালা রেশমি চুড়ি, চিরুনি, রুমাল, পুঁতিরমালাসহ হরেক রকমের জিনিস বিক্রি করে চলছে। দমদম স্টেশনে ট্রেন থামতেই চোখে পড়ল, জানালার বাইরে এক হকার শিশুতোষ বইয়ের পাতা মেলে ধরেছে, তাতে রঙিন জিরাফ গলা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর বানর ঝুলে আছে গাছের ডালে। মনে হচ্ছে দুনিয়ায় যত রকমের ফেরিওয়ালা আর হকার আছে তাদের সবার দেখা মিলছে বনগাঁ ট্রেনে।
ট্রেন যখন বারাসাত স্টেশনে আসল তখন অগণিত যাত্রীর স্রোত ট্রেনে। তিল পরিমাণ জায়গা ফাঁকা নেই বগিতে। ট্রেনে এতো লোক দেখিনি আমি। গোনা সম্ভব নয়। যাত্রীরা মৌমাছির ঝাঁকের মতো গুনগুন আওয়াজ তুলছে। যাত্রীদের গায়ের উত্তাপে ট্রেনে শীতের তীব্রতা কমে এসেছে। অনেক ঘুরিয়ে-পেচিয়ে বারাসাত স্টেশন, বামন গাছির গোলকধাঁধার পথ পেরিয়ে ট্রেন থামল শিয়ালদহ। আমরা যখন শেষ স্টেশনে পৌঁছালাম, তখন সূর্যটা মধ্য আকাশের বুকে চলে এসেছে।
শুনেছি, জব চার্নকের হাতে গড়া কলকাতা শহরকে নিয়ে অহঙ্কার করার মতো অনেক কিছুই আছে! ৩৩৩ বছরের পুরোনো এই শহরের অলিগলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শতবর্ষী সব স্থাপনা, কয়েকশ বছরের ইতিহাস। ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেওয়া পুরোনো স্থাপনা মানুষকে মুগ্ধ করে! কিন্তু শিয়ালদহ রেল স্টেশন থেকে ট্যাক্সির জন্য যখন হেঁটে পথ চলছি তখন জনবহুল এলাকাটির হৈচৈ আর অপরিচ্ছন্ন নোংরা রাস্তাঘাট দেখে হতাশ হলাম। মূল শহরে প্রবেশের আগেই পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা সম্পর্কে বিরূপ ধারণা বদ্ধমূল হলো।
চলতি পথে ফুটপাতের দোকানিরা ফলের দাম হাঁকছে। বড় দানার আনার ১৫০ রুপিয়া, কমলালেবু ১০০ কেজি। বাংলাদেশের তুলনায় এখানে ফল খুবই সস্তা। ট্যাক্সি খুঁজতে খুঁজতে চলতি পথে চোখে পড়ছে ঐতিহ্যবাহী ট্রাম লাইন। কিন্তু ট্রামগাড়ি চলার দৃশ্য চোখে পড়ছে না। কিছু লাইন পিচ দিয়ে চাপা দেওয়া হয়েছে, আবার কোথাও বুক উঁচিয়ে আছে লাইন। লাইনের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে কলকাতার ট্রাম গাড়ির ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। ভাবনার অতলে ডুবে ট্রাম লাইন পার হওয়ার সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
নিউ মার্কেটের কাছেই মারকুইস স্ট্রিট। অবশেষে আমরা ট্যাক্সি যোগে চলে আসলাম মারকুইস স্ট্রিট। মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় বাংলাদেশিরা মারকুইস স্ট্রিটের হোটেলে বেশি থাকে। রাত্রি যাপনের জন্য তিন তারকা মানের একটা আবাসিক হোটেলে এলাম। প্রতি রুমের ভাড়া ৩০০০ রুপিয়ার কমে রাজি হলো না ম্যানেজার। আমাদের এক সফরসঙ্গী ম্যানেজারকে বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলো- দাদা, আমি কি ওয়াশরুমটা ব্যবহার করতে পারি? খুব চাপ পেয়েছে! ম্যানেজার সাহেব নীরব হয়ে আছেন। আমি ম্যানেজারকে অনুরোধের স্বরে বললাম, তিনি অস্বস্তিতে আছেন, সুযোগটা দিলে ভালো হতো দাদা। ম্যানেজার ঠোঁটটা বাকিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বলল, রুম ভাড়া না নিলে ওয়াশরুম ব্যবহার করা যাবে না! আমি ত্যাড়া চোখে তাকিয়ে দেখলাম, ম্যানজারের কথা শুনে ঘৃণা আর ক্রোধে জ্বলজ্বল করছে সফরসঙ্গীর চোখ। ম্যানেজারের আচরণে অবাক না-হওয়া সামান্য কিছু মানুষের মধ্যে আমিও একজন। কারণ আগেও এ ধরনের কিছু ঘটনার কথা শুনেছিলাম। টয়লেটের জন্য এদেশে অনেক আন্দোলন হয়েছে। এদের কাছে অন্য যে কোন কিছুর চেয়ে টয়লেট বেশি মূল্যবান! প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার উপায় না থাকায় বাধ্য হয়েই চেপে রাখলেন তিনি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ভালো মানের একটা হোটেল পেয়ে গেলাম। হোটেল ম্যানেজারের সাথে কথা বলে জানা গেল, কয়েক মাস আগেও তাদের হোটেলে ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই অবস্থা ছিল। এখন বাংলাদেশীরা না আসায় হোটেল মালিকসহ সব ব্যবসায়ী মাছি তাড়াচ্ছেন। আমাদের হোটেলসংলগ্ন বিল্ডিংয়ের নিচেই বাংলাদেশের নামকরা বাস কাউন্টার সোহাগ, শ্যামলী এবং অল্প বিস্তর দূরে রয়েল সার্ভিস এবং বিআরটিসির কাউন্টার। তাতে বড় বড় বাংলা অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘কলকাতা-ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ’। কোথাও আবার লেখা রয়েছে ‘কলকাতা-ঢাকা-চট্টগ্রাম’। বাস কাউন্টার দেখে মনটা খুশিতে ভরে গেল। জায়গাটাকে কলকাতার বুকে ‘এক টুকরো বাংলাদেশ’ মনে হলো। মনে হলো যেন আমরা বাংলাদেশের ভেতরেই আছি।
আমরা বিকাল চারটায় কলকাতার ঐতিহ্যবাহী কস্তূরী রেস্তোরাঁয় খাবারের লাইন দিলাম। দুপুরের ভোজে কলাপাতায় দেওয়া হলো চিতলের কালিয়া, খাসির কষা মাংসের তরকারি, আলু কুমড়া করলার তৈরি শুক্তো, মোচার ঘন্টো ও বাসমতী ভাতের সাথে আরও কয়েক পদ। খাবার শেষে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল, প্রিন্সেপ ঘাট, হাওড়া ব্রিজ, পরিদর্শন করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমরা ইন্ডিয়ান সীম ক্রয়ের জন্য একটা দোকানের সামনে অপেক্ষা করছি। হঠাৎ পাশ থেকে কলকাতার এক সাচ্চা মুসলিম ভুরু কুঁচকে একাকী বলে চলেছে– শালীনতা লংঘনেরও একটা সীমা থাকা উচিত! শালা, সাদা চামড়ার শয়তান! নিজেকে সভ্য দাবি করলেও এরাই অসভ্যতার বীজ রাস্তাঘাটে বিলিয়ে বেড়ায়।
কথা শুনে আমি পাশ ফিরে তাকাতেই চোখ পড়ল খাপছাড়া তলোয়ারের মতো এক যুবতী পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত ইউরোপ বা আমেরিকার পর্যটক হবে। ওর সোনালি চুলগুলো ঘাড়ের পিছনে ছড়িয়ে আছে। ঘটনা কি তা জানার জন্য নিচের দিকে আঁড়চোখে তাকালাম। প্রথমে বিদেশিনীর শরীরের নিচের অর্ধাংশ চামড়ার মতো শ্বেত কাপড় মনে হলো। তারপর মনে হলো, কাপড় নয় ওর নিজের শরীরের চামড়া! চোখের পাতা এমনিতেই বন্ধ হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত পর দৃষ্টির দরজা খুলে দেখি বিদেশিনী উধাও হয়েছেন। আমি ঠাওর করতে পারলাম না- ছোট প্যান্ট পরা বিদেশি মেয়েটির সংস্কৃতি নাকি বয়োজ্যেষ্ঠের মনের সংকীর্ণতা! (চলবে)
তারা//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স ন দর য কলক ত র শ য় লদহ আম দ র ন র জন র জন য ভ রমণ বরফ র র উপর র একট যখন ব র সময়
এছাড়াও পড়ুন:
এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।
জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।
জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।
মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।