ঘটাং ঘট, রাতের ট্রেন। ছুটে চলছে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম। কেবিন–যাত্রী শিশির মোড়ল, সহযাত্রী সে কি ভূত! মধ্যরাতে আঁধার কেবিনে সহযাত্রীর হঠাৎ প্রশ্ন, ‘আপনি কখনো ভূত দেখেছেন?’ আচমকা প্রশ্নে বিরক্ত শিশির মোড়ল।

অনেক ভূতের গল্প শুনেছি দাদি, নানি, নানার মুখে। দারোগাভূত, গেছোভূত, বাঁশভূত, ব্যাঙভূত, চ্যাংভূত আরও কত নামের ভূত! ছড়া কেটেছি বন্ধুরা তালে তালে, ‘তেঁতুলগাছের তলা/ রাত্রিদুপুর বেলা/ ভূতে মারে ঠেলা।’ কিন্তু ‘নিশি ট্রেনের ভূত’ উপন্যাসের লেখক কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক আমাদের, মানে পাঠকদের জন্য নিয়ে এসেছেন এক প্রাপ্তবয়স্ক ভূতের জীবনভিত্তিক এক তরজমা। লেখকের এই ভূত বাংলা নিয়ে লেখাপড়া করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। জীবনটা শুরু হয়েছিল তার স্বপ্ন বুনে। বিয়ে করে ব্যবসায় থিতু হয়েছিল গল্পপটু এই ভূত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আনুকূল্যে গল্পবন্ধুও জুটে গিয়েছিল মেসেঞ্জারে। তা-ও আবার এই নারীবন্ধুর স্বামী থাকে প্রবাসে। বেশ সময় কাটত মেসেঞ্জারে গল্প বলে অবসরে। বউয়ের সন্দেহের তালিকায়ও নাম উঠেছিল। রাতের ট্রেনের আঁধার কেবিনে বসে এই ভূতপ্রেম, নীতিনৈতিকতা, সন্তানবাৎসল্য, শিশুমনের স্বপ্ন, লড়াকু জীবন আর নেতা নামের নির্মম লেবাসের আড়ালের ক্রূরতার গল্প বলে যায়। নিষ্ঠুরতার আগুন কী করে নিমেষে সব স্বপ্নের যবনিকাপাত ঘটিয়ে দেয়, তার মর্মস্পর্শী বর্ণনা কাঁদিয়ে দেয় সামাজিক বিবেককে। ভূতটি যখন মানুষ ছিল, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিল ব্যবসার কাজে। সেই সঙ্গে আকাঙ্ক্ষাও ছিল মেসেঞ্জার-প্রেমিকার সঙ্গে মধুর সময় কাটানোর। শিশির মোড়ল গল্পের মধ্যে এতটাই লীন হয়ে গিয়েছিলেন যে তাঁর তাড়া ছিল গল্পের যবনিকায় পৌঁছানোর, কিন্তু ভূত নামের আত্মাটি সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে বলে যেতে থাকে পরতের পর পরত তার দেখা মানুষজীবনের গল্প। শিশির মোড়লের তাগাদার পরিপ্রেক্ষিতে ভূতটি ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ পত্রিকায় ছাপা হওয়া এক রসাত্মক ধারাবাহিক উপন্যাসের কিয়দংশের অবতারণা করে। ওই অংশ ছিল এমন: ‘নায়ক ও নায়িকা ঘরে ঢুকল। তারা দরজা বন্ধ করল। রাতের বেলা। তারা বাতি বন্ধ করল। বিছানায় গিয়ে বসল দুজন পাশাপাশি।’ তারপর লেখা: ‘বাকি অংশ পরের লেখায়।’ পরের সংখ্যায় লেখা শুরু হলো, ‘নায়িকা গোসল সেরে এসেছে। তার চুল বেয়ে পানি ঝরছে। সে একটি গামছা দিয়ে চুলে বেণি বানাচ্ছে।’ এরপর পাঠকদের কাছ থেকে প্রচুর চিঠি আসতে লাগল, ‘দুই সংখ্যার মধ্যবর্তী সময়ে কী হলো?’ উপায়ান্তর না দেখে সম্পাদক নোট দিলেন, ‘এই দুই সংখ্যার মধ্যবর্তী সময়ে কী ঘটিয়াছে, তাহার জন্য সম্পাদক দায়ী নহেন।’ ভূতের জবানিতে গুরুগম্ভীর একটি লেখা লিখতে গিয়ে পাঠকদের এমন একটি রসাত্মক অনুষঙ্গ উপহার দেওয়া কি সব লেখকের পক্ষে সম্ভব!

আসলে ট্রেনে আগুন কারা দেয়? কে তাদের নির্দেশ দেয়? কী লাভ তাদের? যাঁরা আমাদের এই সমাজকে চালান; স্কুলে বা কোনো অনুষ্ঠানে যাঁরা শিশুদের সুন্দর সুন্দর উপদেশ দেন; তারাই যদি রাতের আঁধারে ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী কিংবা দলীয় স্বার্থে অগ্নিসন্ত্রাস চালান বিপথগামী কিছু তরুণকে সামান্য কিছু টাকার লোভ দেখিয়ে, তাহলে দেশ-সমাজ-রাষ্ট্র কে চালায়? মানুষ, নাকি ভূত?

যে শিশুর স্বপ্ন ছিল পাইলট কিংবা অ্যাস্ট্রোনট হবে, হিংসার আগুন তাকে মুহূর্তে বোকা বানিয়ে দেয়। যে শিশুটি ট্রেনের দুলুনির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছবি এঁকে চলে, নিমেষে সে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, ভেবেছিল কি শিশুটি, কিংবা তার মা-বাবা-স্বজন! কষ্ট মোচড় দিয়ে ওঠে যখন দেখা যায়, শিশুটি মারা গেলেও তার স্কুলব্যাগটি অক্ষত রয়েছে। হয়তো সে পুড়ে মরার আগে ব্যাগটি ছুড়ে ফেলেছিল দূরে।

আসলে ট্রেনে আগুন কারা দেয়? কে তাদের নির্দেশ দেয়? কী লাভ তাদের? যাঁরা আমাদের এই সমাজকে চালান; স্কুলে বা কোনো অনুষ্ঠানে যাঁরা শিশুদের সুন্দর সুন্দর উপদেশ দেন; তাঁরাই যদি রাতের আঁধারে ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী কিংবা দলীয় স্বার্থে অগ্নিসন্ত্রাস চালান বিপথগামী কিছু তরুণকে সামান্য কিছু টাকার লোভ দেখিয়ে, তাহলে দেশ-সমাজ-রাষ্ট্র কে চালায়? মানুষ, নাকি ভূত? কে দেবে এর জবাব? এই প্রশ্নটা দেহ থেকে আত্মা আলাদা হয়ে যাওয়ার আগের ভূতের, নাকি আপনার, আমার—সবার?

আনিসুল হক.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ন দর

এছাড়াও পড়ুন:

এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।

জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।

মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ