বছর পাঁচেক আগে সহ-সভাপতি হয়ে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে পা রেখেছিলেন বসুন্ধরা কিংসের সভাপতি ইমরুল হাসান। প্রথম মেয়াদে দারুণ কাজ করার পর দ্বিতীয় মেয়াদে আরো বড় পদে তথা সিনিয়র সহ-সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। এমন একটি সময়ে ইমরুল দেশের ফুটবলের সেকেন্ড ম্যান হলেন, তখন সব ক্ষেত্রেই অপেক্ষা করছে চ্যালেঞ্জ। 

সম্প্রতি রাইজিংবিডি ডটকমের মুখোমুখি হয়ে ইমরুল হাসান জানিয়েছেন দেশের ফুটবলের হাল হকিকত। পাঠকদের জন্য তার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।

প্রশ্ন: চ্যালেঞ্জিং এই সময়ে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে আপনি আরো বড় পদে এসেছেন। কেমন যাচ্ছে সময়? কতটা উপভোগ করছেন? 

ইমরুল হাসান: যে কাজে চ্যালেঞ্জ থাকে, সেই কাজ করতে কিন্তু আগ্রহটা বেশি জন্মায়। চ্যালেঞ্জহীন কাজে খুব একটা আনন্দ পাওয়া যায় না। মাস তিনেক হলো আমরা নতুন কমিটি দায়িত্ব নিয়েছি। এর মধ্যে আমরা বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেগুলো আগের বছরগুলোতে নেওয়া সম্ভব হয়নি। আমরা আশা করছি, নতুন সভাপতির অধীনে আমরা যারা আছি, আগামী চার বছরে ফুটবলকে একটা সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যেতে পারব। 

প্রশ্ন: আপনি বলেছেন, এই সময়ে অনেকগুলো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আপনারা, যেগুলো আগে নিতে পারেননি। অর্থাৎ, এখন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন আপনারা, এটাই তো? 

ইমরুল হাসান: অবশ্যই, এখন কাজ করার ক্ষেত্রে অনেক স্বাধীনতা আছে। প্রেসিডেন্ট অনেক কর্মঠ। উনি সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করে থাকেন, সবকিছুতে উনি মতামত দিয়ে থাকেন। এর ফলে আমাদের জন্য কাজ করাটা সহজতর হয়ে যায়। এটা আমরা উপভোগ করি এবং যে যার দায়িত্বে আছি, সেটা পালনে আমাদের সহায়ক ভূমিকা পালন করে। প্রেসিডেন্ট সার্বক্ষণিকভাবে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, কাজ করার ক্ষেত্রে আমাদের অনুপ্রেরণা যোগান। 

প্রশ্ন: চার বছরে ফুটবলকে অনন্য অবস্থায় নিয়ে যেতে চান আপনারা। এই লক্ষ্য পূরণে আপনারা কীভাবে কাজ করছেন? কী কাজ করছেন? 

ইমরুল হাসান: ফুটবল টিমের র‍্যাংকিং যদি আমরা না আগাতে পারি, তাহলে উন্নতি দৃশ্যমান হবে না। সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আছে। আমরা আশা করছি যে, আমাদের এই সময়টাতে যে পরিকল্পনা আছে, তার আংশিকও যদি বাস্তবায়ন করতে পারি, র‍্যাংকিং কিছুটা হলেও আগাবে অন্তত। দক্ষিণ এশিয়াতেও আমাদের অবস্থান তলানিতে। আশা করছি, এ থেকে উত্তরণ ঘটবে। দেশে জেলা লিগ নিয়মিতভাবে হচ্ছে না। জেলা লিগ হচ্ছে ফুটবলের প্রাণ। সেখান থেকে ফুটবলার তৈরি হয়ে আসে। বিগত বছরগুলোতে জেলা লিগ অনুপস্থিত ছিল। আমাদের প্রথম প্রচেষ্টা আছে জেলা লিগগুলো নিয়মিত করার জন্য। এতে যদি আমরা সফলকাম হই, তাহলে জাতীয় দলের পাইপলাইন সমৃদ্ধ হবে। পাইপলাইন সমৃদ্ধ হলে জাতীয় দলের ভালো ফল অবশ্যই আসবে। 

প্রশ্ন: অন্তর্বর্তী সরকার সব ক্রীড়া সংস্থা ভেঙে দিয়েছে। আপনারা জেলা লিগ চালুর ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছেন কি না? 

ইমরুল হাসান: একটা অভ্যুথানের পর, বিপ্লবের পর নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। নতুন সরকার তাদের চিন্তা-চেতনা অনুযায়ী কাজ করবে। পূর্ববর্তী সরকারের সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা বেশি ছিল, তাদের দূরে রেখেই হয়ত করবে। কিছুটা সময় তো লাগবেই সংস্কারগুলো করতে। আমরা বাফুফে থেকেও সেগুলো করছি। বিগত বছরগুলোতে যারা জেলা লিগ করতে পারেনি এবং নিষ্ক্রিয় ছিল, তাদের আমরা কাউন্সিলরশিপ থেকে বাদ দিয়ে দিচ্ছি। একটা ফুটবল সংস্থার মূল কাজ ফুটবল মাঠে রাখা। যারা এটা করতে অক্ষম, তাদের রাখার যৌক্তিকতা আছে বলে আমি মনে করি না। শুরুতে আমাদের কিছুটা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হলেও, কালক্ষেপণ হলেও দীর্ঘমেয়াদের ক্ষেত্রে ভালো কিছু আনতে পারবে। 

প্রশ্ন: হামজা চৌধুরীর মতো ফুটবলারের অন্তর্ভুক্তি কীভাবে দেখছেন? 

ইমরুল হাসান: হামজা চৌধুরীর মতো হাইপ্রোফাইল প্লেয়ার যদি বাংলাদেশ দলে অন্তর্ভুক্ত হয়—ফুটবল কিন্তু দলীয় খেলা, এক জনের অন্তর্ভুক্তিতে দলের শক্তি অনেক বেড়ে যাবে, সেটা আমি বলছি না। কিন্তু হামজার ক্রেজ ব্যবহার করে আমরা ফুটবলের উন্মাদনা কিছুটা ফিরিয়ে আনতে পারি। আমরা সেদিকে চেষ্টা করছি। এর পাশাপাশি আমরা যদি আরো কিছু মানসম্পন্ন প্রবাসী প্লেয়ারকে দলভুক্ত করতে পারি। অনেকে বিশ্বের বিভিন্ন লিগে খেলে থাকে, তাদের মান যথেষ্ট ভালো। তারা যদি খেলতে ইচ্ছুক হয়, অন্তত পাঁচ থেকে ছয় জন প্লেয়ারকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। তাহলে আমার মনে হয়, বাংলাদেশ অন্তত দক্ষিণ এশিয়াকে ডমিনেট করতে পারবে। এশিয়ায়ও একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে ফুটবলে। 

প্রশ্ন: নারী ফুটবলের সংকট উত্তরণের জন্য গড়া তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন আপনি। সবকিছু মিলিয়ে সমস্যা কোথায় বলে মনে হয়েছে আপনার? 

ইমরুল হাসান: যেসব মেয়ে প্রশিক্ষণে আসেনি, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে একে একে কথা বলেছি। কোচের সাথে কথা বলেছি। আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে, এটা বড় কোনো ইস্যু ছিল না, ক্ষুদ্র একটা ব্যাপার ছিল। এটাকে এত দূর পর্যন্ত বাড়তে দেওয়াটা উচিত হয়নি। এটাকে শুরুতেই মিটিয়ে ফেলা যেত। এটা কারো অবহেলায়, কারো দূরদর্শিতার অভাবে এত দূর চলে আসছে। মেয়েরা আমাদের সাফল্য এনে দিয়েছে। এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান শুধু আমাদের নয়, পুরো দেশবাসীর আছে। কিন্তু, একটা কথা বলতে চাই, শৃঙ্খলার ওপর কিছু নেই। কেউ যদি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে থাকে, সে যত বড় খেলোয়াড় হোক না কেন, যত সাফল্য এনে দিক না কেন, শৃঙ্খলাটা সবার আগে। 

প্রশ্ন: মেয়েরা বলেছে, তারা ছুটি কাটিয়ে ফিরবে অনুশীলনে। আবার রিপোর্ট হয়েছে, ৮ জনকে নিয়ে কোচের আপত্তি আছে। 

ইমরুল হাসান: যে ১৮ জন অনুশীলনে অংশ নেয়নি, তারা বলেছে, ছুটির পর ক্যাম্পে যোগ দেবে। ক্যাম্পে যোগ দিলেই যে চুক্তি নবায়ন করা হবে, কেউ সেটা বলতে পারছি না। কারণ, প্রতিবছরই পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করে চুক্তি নবায়ন করা হয়। তাতে কেউ বাদ পড়বে, কেউ নিচের ক্যাটাগরিতে চলে আসবে, কেউ ওপরে যাবে। সবকিছু চুক্তি হলেই বলা যাবে। আমরা আশাবাদী, যারা পারফরম্যান্স দেখাতে পারবে, কোচের দৃষ্টিতে যাদের জাতীয় দলে রাখার যোগ্য, অবশ্যই তাদের চুক্তি নবায়ন করা হবে। যাদের পারফরম্যান্স ভালো না, তারা বিদ্রোহ করেছে কি না, সেটা মুখ্য বিষয় হিসেবে থাকবে বলে আমার মনে হয় না। পারফরম্যান্স না হলে অনুমিতভাবেই সে বাদ পড়ে যাবে। 

প্রশ্ন: উইমেন্স উইংয়ের প্রধান বলেছেন, বাটলারকে রাখা নিয়ে আপত্তি জানানো হয়েছিল। এটার সত্যতা কতটুকু? 

ইমরুল হাসান: আমি উনার বক্তব্য দেখেছি। কোচ নিয়োগের ইমার্জেন্সি কমিটির মিটিংয়ে শুধু অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। উনি বলেছেন, ইমার্জেন্সি কমিটিকে জানিয়েছেন। কাকে জানিয়েছেন, আমি জানি না। আমি অন্তত এ ব্যাপারে কিছু জানি না, উনার কোচ নিয়োগের বিষয়ে কোনো আপত্তি ছিল কি না। আসলে ইমার্জেন্সি কমিটির মিটিংয়ে শুধু কোচ নিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে; কাকে নিয়োগ করা হবে, সেটি পূর্বেই সিদ্ধান্ত হয়ে আছে। প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে সেই মিটিংয়ে শুধু অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। 

প্রশ্ন: বসুন্ধরা কিংস নারী দল গড়ছে না। শোনা যাচ্ছে, টাকা- পয়সার ইস্যুতে মেয়েদের দাবি-দাওয়া ছিল। 

ইমরুল হাসান: এ ক্ষেত্রে কিছুটা বিভ্রান্তি আছে ফুটবল অঙ্গনে। মেয়েরা আমাদের কাছে একটা পারিশ্রমিক চেয়েছে। ক্লাবগুলো বা আমরা যারা সংগঠক আছি, তারা মেয়েদের অভিবাবক। অভিভাবকদের কাছে মেয়েরা পারিশ্রমিক বেশি চাইতেই পারে। আমাদের দল গঠন না করার পেছেন এটা প্রধান কারণ তো নয়, অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে একটা মাত্র কারণ। মূল যে কারণটা ছিল, সেটা আপনারা সাংবাদিক মহল বা ক্রীড়াঙ্গন এড়িয়ে যাচ্ছেন। আমাদের না খেলার পেছনে কিছু অবজারভেশন ছিল। সেগুলো আমরা নারী বিভাগকে জানিয়েছিলাম। সেই দিকগুলোতে তারা কোনোরূপ কর্ণপাত না করাতে আমরা দল গঠন করিনি। দুই-একটা অসঙ্গতি ছিল। আপনারা জানেন, যেসব টিম খেলত, তাদের মধ্যে একটি টিমের প্লেয়াররা বাফুফে ভবনে থেকে বাফুফের কোচদের থেকে ট্রেনিং নিয়ে তারা বাফুফে ভবন থেকে গিয়ে মাঠে ওই দলের হয়ে অংশগ্রহণ করত। যেটা আসলে নৈতিকভাবে ঠিক ছিল বলে আমাদের কাছে মনে হয়নি। আমরা এটা থেকে সরে আসার জন্য বলেছিলাম। কিন্তু সেটা হয়নি বলে আমরা দল গঠন করিনি। পারিশ্রমিক বৃদ্ধির যে কারণ, সেটা ছোট্ট একটা কারণ। 

প্রশ্ন: এই সমস্যার সমাধান কি এবার হতে পারে? 

ইমরুল হাসান:  আমরা দল গঠন করার জন্য সব সময়ই চাই। আমরা তিন বছরের চ্যাম্পিয়ন। যদি পরবর্তীতে নারী লিগ হয়, আমরা অবশ্যই অংশগ্রহণ করব। তবে, আমাদের কিছু অবজারভেশন আছে, যেমন: আমরা চাই না, পুল প্রথা থাকুক। কারণ, পুল প্রথা চালু হলে আমার মনে হয়, মেয়েরা প্রাপ্য প্রারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হবে। ক্লাবগুলো অবশ্যই এই সুযোগে অল্প প্রারিশ্রমিকে খেলিয়ে নেবে। সেটা আমরা চাই না। পুল প্রথা হলে আমরা হয়ত অংশগ্রহণ করব না।

ঢাকা/রফিক

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর প রফরম য ন স ইমর ল হ স ন আম দ র ক ছ ফ টবল র দল গঠন ক জ কর র জন য ন আপন সরক র আপন র সবক ছ

এছাড়াও পড়ুন:

ছয় কোটি শ্রমিক রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার বাইরে

দেশের মোট শ্রমিকের ৮৪ দশমিক ১ শতাংশের কোনো দায়দায়িত্ব নেয় না রাষ্ট্র । শ্রমিক হিসেবে তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। কোনো রকম আইনি ও সামাজিক সুরক্ষা নেই। কর্মস্থলের পরিচয়পত্র নেই। কাজের ক্ষেত্রে অন্যায়ের শিকার হলে তাদের শ্রম আদালতে মামলা করার সুযোগও নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী,  অপ্রাতিষ্ঠানিক এই শ্রমিকের সংখ্যা ৫ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার।

বিশালসংখ্যক শ্রমিকের প্রতি রাষ্ট্রের এ রকম অবহেলার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সরকারের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গত ২১ এপ্রিল পেশ করা কমিশনের ২৫ সুপারিশের মধ্যে প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা ও স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। 

দেশের শ্রম খাতের দুর্বলতা চিহ্নিত করা এবং শ্রমিকের অধিকার ও জীবনমান উন্নয়নে সুপারিশ প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গঠিত ১৯ সদস্যের কমিশনপ্রধান ছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ। জানতে চাইলে গতকাল তিনি সমকালকে বলেন, ‘আমরা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছি। শ্রম আইনে অন্য সব শ্রমিকের মতো একই অধিকার এবং সুযোগসুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে তাদের বাড়তি সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছি। সামাজিক সুরক্ষার আওতায় তাদের জন্য ভাতার কথা বলেছি। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের জন্য এ সুবিধার সুপারিশ করা হয়নি। কারণ, তারা চাকরি শেষে কমবেশি কিছু আর্থিক সুবিধা পান।’ 

কমিশনের এ সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে নিয়মিত নজরদারি রাখার কথাও জানান তিনি। 

এ বাস্তবতায় আজ বৃহস্পতিবার মহান শ্রমিক দিবস পালন করা হচ্ছে। আজ সরকারি ছুটি থাকবে। এ দিনও কাজ করতে হবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দিবসটি পালনের বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে’। 

বিবিএসের গত নভেম্বরে প্রকাশিত সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১২ কোটি ৬ লাখ ২০ হাজার। তাদের মধ্যে শ্রমশক্তি ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। মোট শ্রমশক্তির ৮৪ দশমিক ১ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। 

দেশে শ্রমশক্তি বলতে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে যারা কর্মে নিয়োজিত এবং বেকার জনগোষ্ঠীর সমষ্টিকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর মানদণ্ড অনুযায়ী, যারা সাত দিনে কমপক্ষে ১ ঘণ্টার বেতন, মজুরি বা মুনাফার বিনিময় অথবা পরিবারের নিজস্ব ভোগের জন্য পণ্য উৎপাদনের কাজ করেছেন জরিপে তাদের কর্মে নিয়োজিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আবার যারা কর্মক্ষম কিন্তু কোনো কাজে নিয়োজিত নন, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ খুঁজে বেড়ান এবং ওই সময়ে কাজের সুযোগ পেলে সে কাজ করতে প্রস্তুত তাদের বেকার বলা হয়েছে। এ হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৪ লাখ ৬০ হাজার। 

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক কারা 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর আন্তর্জাতিক শ্রম পরিসংখ্যানবিদের সম্মেলন ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব লেবার স্ট্যাটিসিয়ান্স–আইসিএলসির সংজ্ঞা অনুযায়ী, বেসরকারি অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি বা খানামালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, যেগুলোর আইনি সত্তা নেই, পরিপূর্ণ হিসাব নেই, উৎপাদনের হিসাব দিতে হয় না এবং বেসরকারি ও অনিবন্ধিত–এরকম খাতকে অনানুষ্ঠানিক খাত এবং এ খাতের শ্রমিকদের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক বলা হয়। 

মূলত কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক বেশি। কৃষিতে ৯৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক। শিল্প খাতে ৮২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের বড় অংশই গ্রামে থাকেন। 

বিবিএস বলছে, গ্রামের মোট শ্রমিকের ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। সংখ্যায় তারা ৪ কোটি ৬১ লাখ ১০ হাজার। শহরের শ্রমিকদের এ হার কিছুটা কম। ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ। সংখ্যায় এক কোটি ৩৫ লাখ ৭০ হাজার। নারী শ্রমিকদের ৯৫ দশমিক ৭ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে থাকেন।

শ্রম আইনে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকেও অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ কমিশনের 

শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি, গৃহশ্রমিক, অভিবাসী, স্বনিয়োজিত শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের জন্য শ্রম আইনে সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে শ্রমিকদের কাজের স্বীকৃতি, পরিচয়পত্র, নিরবচ্ছিন্ন কাজ এবং আয়ের নিশ্চয়তা, মর্যাদাকর শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। এতে আরও বলা হয়, এসব শ্রমিকের জন্য রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা হিসেবে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সব অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় থেকে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলাদা অফিস অথবা ডেস্ক স্থাপন করতে হবে। শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং কল্যাণে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সব ধরনের তথ্য নিয়ে তথ্যভান্ডার করা, পরিচয়পত্র দেওয়া এবং অবসর ভাতা চালুসহ বেশ কিছু সুপারিশ করে কমিশন। 

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রবীণ শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতার সুপারিশ 

রাষ্ট্রের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের আওতায় বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকেন প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা। অবসরের পরও কিছু সুবিধা পান তারা। তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা সারা জীবন খাটুনির পর প্রবীণ বয়সে আরও কষ্টে থাকেন। কারণ সামান্যতম কোনো সুবিধা পান না তারা। এ বিবেচনা থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতা বা তাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার সুপারিশ করেছে কমিশন। তাদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর নির্ধারণের কথা বলা হয় এতে। দরিদ্র বেকার শ্রমিকদের বয়স্কভাতা এবং তাদের প্রতিদিনের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও অন্যান্য চাহিদা বিবেচনায় বয়স্কভাতার পরিমাণ নির্ধারণের কথা বলেছে কমিশন। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের পেশা ও খাত অনুযায়ী সংগঠিত হওয়া, প্রতিনিধিত্ব করা ও নিয়োগকারী, তাদের সমিতি করার সুযোগ দেওয়ার কথাও বলা হয় কমিশনের সুপারিশে। 

প্রাতিষ্ঠানিকের ৫৫ খাতেও ন্যূনতম মজুরি নেই 

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের চেয়ে কিছুটা ভালো হলেও প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের অবস্থাও খুব বেশি ভালো নয়। এখনও অনেক শিল্প খাতকে ন্যূনতম মজুরি কাঠামোর আওতায় আনা হয়নি। মালিকপক্ষ যা দেয়, তা মেনে নিয়ে কাজ করেন শ্রমিকরা। এরকম অন্তত ৫৫টি খাতে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়নি। 

শ্রম মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের স্বীকৃত শিল্প আছে ১০২টি। 

টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের মজুরি বোর্ড হয় সর্বশেষ ১৯৮৩ সালে। অর্থাৎ, গত তিন যুগ ধরে একই মজুরি চলছে এ খাতে। জানতে চাইলে সরকারের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা ইসলাম গতকাল সমকালকে বলেন, ন্যূনতম মজুরি কাঠামোতে বর্তমানে ৪৭টি শিল্প রয়েছে। নতুন করে দুটি শিল্পকে ন্যূনতম মজুরির আওতায় আনা হবে। আরও ২০ শিল্পকে এর আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। তিনি জানান, পেট্রোল পাম্পের শ্রমিকদের মজুরি পুনঃনির্ধারণে বোর্ড গঠন হয়েছে। মালিক পক্ষ এ-সংক্রান্ত সভায় আসছে না। এ অবস্থায় করণীয় জানতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ চেয়েছে মজুরি বোর্ড। 

টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পে তিন যুগ ধরে একই মজুরির বিষয়ে জানতে চাইলে রাইসা ইসলাম বলেন, টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের আর অস্তিত্ব নেই। খাতটি হয়তো বিলুপ্ত ঘোষণা করা হবে। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ