বছর পাঁচেক আগে সহ-সভাপতি হয়ে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে পা রেখেছিলেন বসুন্ধরা কিংসের সভাপতি ইমরুল হাসান। প্রথম মেয়াদে দারুণ কাজ করার পর দ্বিতীয় মেয়াদে আরো বড় পদে তথা সিনিয়র সহ-সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। এমন একটি সময়ে ইমরুল দেশের ফুটবলের সেকেন্ড ম্যান হলেন, তখন সব ক্ষেত্রেই অপেক্ষা করছে চ্যালেঞ্জ। 

সম্প্রতি রাইজিংবিডি ডটকমের মুখোমুখি হয়ে ইমরুল হাসান জানিয়েছেন দেশের ফুটবলের হাল হকিকত। পাঠকদের জন্য তার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।

প্রশ্ন: চ্যালেঞ্জিং এই সময়ে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে আপনি আরো বড় পদে এসেছেন। কেমন যাচ্ছে সময়? কতটা উপভোগ করছেন? 

ইমরুল হাসান: যে কাজে চ্যালেঞ্জ থাকে, সেই কাজ করতে কিন্তু আগ্রহটা বেশি জন্মায়। চ্যালেঞ্জহীন কাজে খুব একটা আনন্দ পাওয়া যায় না। মাস তিনেক হলো আমরা নতুন কমিটি দায়িত্ব নিয়েছি। এর মধ্যে আমরা বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেগুলো আগের বছরগুলোতে নেওয়া সম্ভব হয়নি। আমরা আশা করছি, নতুন সভাপতির অধীনে আমরা যারা আছি, আগামী চার বছরে ফুটবলকে একটা সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যেতে পারব। 

প্রশ্ন: আপনি বলেছেন, এই সময়ে অনেকগুলো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আপনারা, যেগুলো আগে নিতে পারেননি। অর্থাৎ, এখন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন আপনারা, এটাই তো? 

ইমরুল হাসান: অবশ্যই, এখন কাজ করার ক্ষেত্রে অনেক স্বাধীনতা আছে। প্রেসিডেন্ট অনেক কর্মঠ। উনি সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করে থাকেন, সবকিছুতে উনি মতামত দিয়ে থাকেন। এর ফলে আমাদের জন্য কাজ করাটা সহজতর হয়ে যায়। এটা আমরা উপভোগ করি এবং যে যার দায়িত্বে আছি, সেটা পালনে আমাদের সহায়ক ভূমিকা পালন করে। প্রেসিডেন্ট সার্বক্ষণিকভাবে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, কাজ করার ক্ষেত্রে আমাদের অনুপ্রেরণা যোগান। 

প্রশ্ন: চার বছরে ফুটবলকে অনন্য অবস্থায় নিয়ে যেতে চান আপনারা। এই লক্ষ্য পূরণে আপনারা কীভাবে কাজ করছেন? কী কাজ করছেন? 

ইমরুল হাসান: ফুটবল টিমের র‍্যাংকিং যদি আমরা না আগাতে পারি, তাহলে উন্নতি দৃশ্যমান হবে না। সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আছে। আমরা আশা করছি যে, আমাদের এই সময়টাতে যে পরিকল্পনা আছে, তার আংশিকও যদি বাস্তবায়ন করতে পারি, র‍্যাংকিং কিছুটা হলেও আগাবে অন্তত। দক্ষিণ এশিয়াতেও আমাদের অবস্থান তলানিতে। আশা করছি, এ থেকে উত্তরণ ঘটবে। দেশে জেলা লিগ নিয়মিতভাবে হচ্ছে না। জেলা লিগ হচ্ছে ফুটবলের প্রাণ। সেখান থেকে ফুটবলার তৈরি হয়ে আসে। বিগত বছরগুলোতে জেলা লিগ অনুপস্থিত ছিল। আমাদের প্রথম প্রচেষ্টা আছে জেলা লিগগুলো নিয়মিত করার জন্য। এতে যদি আমরা সফলকাম হই, তাহলে জাতীয় দলের পাইপলাইন সমৃদ্ধ হবে। পাইপলাইন সমৃদ্ধ হলে জাতীয় দলের ভালো ফল অবশ্যই আসবে। 

প্রশ্ন: অন্তর্বর্তী সরকার সব ক্রীড়া সংস্থা ভেঙে দিয়েছে। আপনারা জেলা লিগ চালুর ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছেন কি না? 

ইমরুল হাসান: একটা অভ্যুথানের পর, বিপ্লবের পর নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। নতুন সরকার তাদের চিন্তা-চেতনা অনুযায়ী কাজ করবে। পূর্ববর্তী সরকারের সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা বেশি ছিল, তাদের দূরে রেখেই হয়ত করবে। কিছুটা সময় তো লাগবেই সংস্কারগুলো করতে। আমরা বাফুফে থেকেও সেগুলো করছি। বিগত বছরগুলোতে যারা জেলা লিগ করতে পারেনি এবং নিষ্ক্রিয় ছিল, তাদের আমরা কাউন্সিলরশিপ থেকে বাদ দিয়ে দিচ্ছি। একটা ফুটবল সংস্থার মূল কাজ ফুটবল মাঠে রাখা। যারা এটা করতে অক্ষম, তাদের রাখার যৌক্তিকতা আছে বলে আমি মনে করি না। শুরুতে আমাদের কিছুটা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হলেও, কালক্ষেপণ হলেও দীর্ঘমেয়াদের ক্ষেত্রে ভালো কিছু আনতে পারবে। 

প্রশ্ন: হামজা চৌধুরীর মতো ফুটবলারের অন্তর্ভুক্তি কীভাবে দেখছেন? 

ইমরুল হাসান: হামজা চৌধুরীর মতো হাইপ্রোফাইল প্লেয়ার যদি বাংলাদেশ দলে অন্তর্ভুক্ত হয়—ফুটবল কিন্তু দলীয় খেলা, এক জনের অন্তর্ভুক্তিতে দলের শক্তি অনেক বেড়ে যাবে, সেটা আমি বলছি না। কিন্তু হামজার ক্রেজ ব্যবহার করে আমরা ফুটবলের উন্মাদনা কিছুটা ফিরিয়ে আনতে পারি। আমরা সেদিকে চেষ্টা করছি। এর পাশাপাশি আমরা যদি আরো কিছু মানসম্পন্ন প্রবাসী প্লেয়ারকে দলভুক্ত করতে পারি। অনেকে বিশ্বের বিভিন্ন লিগে খেলে থাকে, তাদের মান যথেষ্ট ভালো। তারা যদি খেলতে ইচ্ছুক হয়, অন্তত পাঁচ থেকে ছয় জন প্লেয়ারকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। তাহলে আমার মনে হয়, বাংলাদেশ অন্তত দক্ষিণ এশিয়াকে ডমিনেট করতে পারবে। এশিয়ায়ও একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে ফুটবলে। 

প্রশ্ন: নারী ফুটবলের সংকট উত্তরণের জন্য গড়া তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন আপনি। সবকিছু মিলিয়ে সমস্যা কোথায় বলে মনে হয়েছে আপনার? 

ইমরুল হাসান: যেসব মেয়ে প্রশিক্ষণে আসেনি, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে একে একে কথা বলেছি। কোচের সাথে কথা বলেছি। আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে, এটা বড় কোনো ইস্যু ছিল না, ক্ষুদ্র একটা ব্যাপার ছিল। এটাকে এত দূর পর্যন্ত বাড়তে দেওয়াটা উচিত হয়নি। এটাকে শুরুতেই মিটিয়ে ফেলা যেত। এটা কারো অবহেলায়, কারো দূরদর্শিতার অভাবে এত দূর চলে আসছে। মেয়েরা আমাদের সাফল্য এনে দিয়েছে। এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান শুধু আমাদের নয়, পুরো দেশবাসীর আছে। কিন্তু, একটা কথা বলতে চাই, শৃঙ্খলার ওপর কিছু নেই। কেউ যদি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে থাকে, সে যত বড় খেলোয়াড় হোক না কেন, যত সাফল্য এনে দিক না কেন, শৃঙ্খলাটা সবার আগে। 

প্রশ্ন: মেয়েরা বলেছে, তারা ছুটি কাটিয়ে ফিরবে অনুশীলনে। আবার রিপোর্ট হয়েছে, ৮ জনকে নিয়ে কোচের আপত্তি আছে। 

ইমরুল হাসান: যে ১৮ জন অনুশীলনে অংশ নেয়নি, তারা বলেছে, ছুটির পর ক্যাম্পে যোগ দেবে। ক্যাম্পে যোগ দিলেই যে চুক্তি নবায়ন করা হবে, কেউ সেটা বলতে পারছি না। কারণ, প্রতিবছরই পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করে চুক্তি নবায়ন করা হয়। তাতে কেউ বাদ পড়বে, কেউ নিচের ক্যাটাগরিতে চলে আসবে, কেউ ওপরে যাবে। সবকিছু চুক্তি হলেই বলা যাবে। আমরা আশাবাদী, যারা পারফরম্যান্স দেখাতে পারবে, কোচের দৃষ্টিতে যাদের জাতীয় দলে রাখার যোগ্য, অবশ্যই তাদের চুক্তি নবায়ন করা হবে। যাদের পারফরম্যান্স ভালো না, তারা বিদ্রোহ করেছে কি না, সেটা মুখ্য বিষয় হিসেবে থাকবে বলে আমার মনে হয় না। পারফরম্যান্স না হলে অনুমিতভাবেই সে বাদ পড়ে যাবে। 

প্রশ্ন: উইমেন্স উইংয়ের প্রধান বলেছেন, বাটলারকে রাখা নিয়ে আপত্তি জানানো হয়েছিল। এটার সত্যতা কতটুকু? 

ইমরুল হাসান: আমি উনার বক্তব্য দেখেছি। কোচ নিয়োগের ইমার্জেন্সি কমিটির মিটিংয়ে শুধু অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। উনি বলেছেন, ইমার্জেন্সি কমিটিকে জানিয়েছেন। কাকে জানিয়েছেন, আমি জানি না। আমি অন্তত এ ব্যাপারে কিছু জানি না, উনার কোচ নিয়োগের বিষয়ে কোনো আপত্তি ছিল কি না। আসলে ইমার্জেন্সি কমিটির মিটিংয়ে শুধু কোচ নিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে; কাকে নিয়োগ করা হবে, সেটি পূর্বেই সিদ্ধান্ত হয়ে আছে। প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে সেই মিটিংয়ে শুধু অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। 

প্রশ্ন: বসুন্ধরা কিংস নারী দল গড়ছে না। শোনা যাচ্ছে, টাকা- পয়সার ইস্যুতে মেয়েদের দাবি-দাওয়া ছিল। 

ইমরুল হাসান: এ ক্ষেত্রে কিছুটা বিভ্রান্তি আছে ফুটবল অঙ্গনে। মেয়েরা আমাদের কাছে একটা পারিশ্রমিক চেয়েছে। ক্লাবগুলো বা আমরা যারা সংগঠক আছি, তারা মেয়েদের অভিবাবক। অভিভাবকদের কাছে মেয়েরা পারিশ্রমিক বেশি চাইতেই পারে। আমাদের দল গঠন না করার পেছেন এটা প্রধান কারণ তো নয়, অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে একটা মাত্র কারণ। মূল যে কারণটা ছিল, সেটা আপনারা সাংবাদিক মহল বা ক্রীড়াঙ্গন এড়িয়ে যাচ্ছেন। আমাদের না খেলার পেছনে কিছু অবজারভেশন ছিল। সেগুলো আমরা নারী বিভাগকে জানিয়েছিলাম। সেই দিকগুলোতে তারা কোনোরূপ কর্ণপাত না করাতে আমরা দল গঠন করিনি। দুই-একটা অসঙ্গতি ছিল। আপনারা জানেন, যেসব টিম খেলত, তাদের মধ্যে একটি টিমের প্লেয়াররা বাফুফে ভবনে থেকে বাফুফের কোচদের থেকে ট্রেনিং নিয়ে তারা বাফুফে ভবন থেকে গিয়ে মাঠে ওই দলের হয়ে অংশগ্রহণ করত। যেটা আসলে নৈতিকভাবে ঠিক ছিল বলে আমাদের কাছে মনে হয়নি। আমরা এটা থেকে সরে আসার জন্য বলেছিলাম। কিন্তু সেটা হয়নি বলে আমরা দল গঠন করিনি। পারিশ্রমিক বৃদ্ধির যে কারণ, সেটা ছোট্ট একটা কারণ। 

প্রশ্ন: এই সমস্যার সমাধান কি এবার হতে পারে? 

ইমরুল হাসান:  আমরা দল গঠন করার জন্য সব সময়ই চাই। আমরা তিন বছরের চ্যাম্পিয়ন। যদি পরবর্তীতে নারী লিগ হয়, আমরা অবশ্যই অংশগ্রহণ করব। তবে, আমাদের কিছু অবজারভেশন আছে, যেমন: আমরা চাই না, পুল প্রথা থাকুক। কারণ, পুল প্রথা চালু হলে আমার মনে হয়, মেয়েরা প্রাপ্য প্রারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হবে। ক্লাবগুলো অবশ্যই এই সুযোগে অল্প প্রারিশ্রমিকে খেলিয়ে নেবে। সেটা আমরা চাই না। পুল প্রথা হলে আমরা হয়ত অংশগ্রহণ করব না।

ঢাকা/রফিক

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর প রফরম য ন স ইমর ল হ স ন আম দ র ক ছ ফ টবল র দল গঠন ক জ কর র জন য ন আপন সরক র আপন র সবক ছ

এছাড়াও পড়ুন:

বিদ্যুৎ খাতে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি হয়েছে: পর্যালোচনা কমিটি

বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির নামে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো সরকারের কাছ থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া বাবদ অর্থ নিয়েছে, যেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহের চেয়ে দুর্নীতিই মুখ্য ছিল বলে অভিমত দিয়েছে সরকার গঠিত চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। তারা বলেছে, চুক্তিতে ব‍্যবসায়ীদের কোনো ঝুঁকি নেই, সব ঝুঁকি সরকারের। এটি সরকারের অদক্ষতাজনিত ব‍্যর্থতা নয়, দুর্নীতি জড়িত। তাই চুক্তি বাতিল করা সম্ভব।

বিদ্যুৎ খাতের চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির তিন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তাঁরা বলেছেন, গত সরকারের দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ, খরচ বেড়েছে ১১ গুণ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনটি করাই হয়েছে দুর্নীতির জন্য। এখানে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি হয়েছে। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিগুলো ভাড়া আদায়ের নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে কাজ করেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো জ্বালানি আমদানি করেছে নিজেরা। এতেও দুর্নীতি হয়েছে।

তবে এখন এসব চুক্তি বাতিল করতে হলে অনুসন্ধান করে দুর্নীতির প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন পর্যালোচনা কমিটির সদস্যরা। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের প্রতিবেদন নিয়ে সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করতে পারে। গত সরকারের সময় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একের পর এক একতরফা চুক্তি করা হয়েছে। চুক্তিতে সব সুবিধা দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে, রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করা হয়নি। একটি চুক্তি যেন আরেকটির প্রতিলিপি। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ সংস্থাগুলো এতে জড়িত ছিল। গ্যাস পাওয়া যাবে না, চুক্তি করা হোক—এমন সুপারিশও দেখা গেছে মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে।

পর্যালোচনা কমিটির তিনজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, শুধু চুক্তি নয়, চুক্তির আগের পুরো প্রক্রিয়া যাচাই করে দেখা হয়েছে। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপের নমুনা পাওয়া গেছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। সাবেক দুই বিদ্যুৎসচিব, যাঁরা পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব হয়েছিলেন; তাঁদের সংশ্লিষ্টতা আছে সংঘবদ্ধ দুর্নীতিতে। এই দুজন হলেন আবুল কালাম আজাদ ও আহমদ কায়কাউস।

# চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন
# দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ, খরচ বেড়েছে ১১ গুণ
# ব্যবসায়ী, আমলা, সরকারের শীর্ষ পর্যায় মিলে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি
# চুক্তি বাতিল সম্ভব, দুদকের তদন্ত করতে হবে
# আদানির চুক্তিতে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে

দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনটি বাতিল করা হয় গত বছরের নভেম্বরে। এর আগেই এ আইনের অধীনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে গত সরকারের করা চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আছেন হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী। কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও সহ-উপাচার্য আবদুল হাসিব চৌধুরী, কেপিএমজি বাংলাদেশের সাবেক প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আলী আশফাক, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ফ্যাকাল্টি অব ল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের অর্থনীতির অধ্যাপক মোশতাক হোসেন খান ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক।

জানুয়ারিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন

আজ রোববার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দিয়েছে চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে তারা। এ ছাড়া ভারতের আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে করা চুক্তির অনিয়ম নিয়েও একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তারা। প্রতিবেদন জমার পর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে একটি সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন কমিটির সদস্যরা।

সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, কারণ ছাড়া চুক্তি বাতিল করলে তার ক্ষতিপূরণের বিষয়টি চুক্তিতেই বলা আছে। তবে প্রতিটি চুক্তিতেই স্বীকারোক্তি থাকে যে এই চুক্তিতে কোনো দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়নি। এটা যদি লঙ্ঘিত হয়, তাহলে চুক্তি বাতিল করা যায়। কিন্তু মুখের কথা তো আদালত মানতে চাইবেন না, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে হবে আদালতে। কমিটির সহায়তায় চুক্তির অনিয়ম খুঁজে দেখা হচ্ছে। কারণ, খুঁজে পাওয়া গেলে চুক্তি বাতিলে দ্বিধা করা হবে না।

কমিটির আহ্বায়ক মঈনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, চুক্তি কতটা বাতিল করা যাবে, তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। বিদ্যুৎ খাতের চুক্তিগুলো পুরোপুরি কারিগরি, তাই সময় লেগেছে পর্যালোচনায়। এতে ব্যাপক দুর্নীতি পাওয়া গেছে। আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কমিটির সদস্য জাহিদ হোসেন বলেন, চুক্তি–সম্পর্কিত নথি দেখা হয়েছে। পিডিবি থেকে পরিশোধ করা বিলের তথ্য নেওয়া হয়েছে। এগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে, কী কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে। ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ ছিল, মন্ত্রণালয় সব সময় প্রধানমন্ত্রীর হাতে ছিল। বিদ্যুৎ খাতে যে পরিমাণ বিল পরিশোধ করা হয়েছে এবং এর বিপরীতে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে, এর হিসাব আইনস্টাইনও মেলাতে পারবেন না।

চুক্তি বাতিল করলে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির সদস্য শাহদীন মালিক বলেন, যাঁরা ক্ষতিপূরণ দাবি করবেন, তাঁরা তাঁদের ক্ষতির হিসাব দেবেন। তাই ক্ষতিপূরণের বিষয়টা তো এ কমিটি বলতে পারবে না।

দুর্নীতির কারণে বেড়েছে বিদ্যুতের দাম

সংবাদ সম্মেলনে কমিটির সদস্য মোশতাক হোসেন খান বলেন, ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতির কারণে বিদ্যুতের দাম ২৫ শতাংশ বেশি হয়ে গেছে। ভর্তুকি না থাকলে ৪০ শতাংশ বেড়ে যেত। এ দামে ব্যবসা-বাণিজ্য টিকতে পারবে না। এটা কমাতে হবে। যারা টাকা নিয়ে চলে গেছে, তাদের বোঝাতে হবে, তারা পার পাবে না। তাড়াতাড়ি করলে ভুল হতে পারে, তাই সময় লেগেছে। তবে রাষ্ট্রের সঙ্গে কোম্পানির চুক্তিগুলো সার্বভৌম চুক্তি। চাইলেই এটা বাতিল করা যায় না। বড় জরিমানা দিতে হতে পারে।

আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে মোশতাক হোসেন বলেন, আদানির চুক্তির অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে আদালতে রিট হয়েছে। আদালত প্রতিবেদন চেয়েছেন। মাসখানেকের মধ্যে শক্ত প্রমাণ সামনে আসবে। এসব প্রমাণ নিয়ে দেশে-বিদেশে আইনি প্রক্রিয়া নেওয়া যাবে।

পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশে মূলত ভবিষ্যতে সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যাতে এ ধরনের চুক্তি না করা হয়। চুক্তির আগে স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে যাচাই করে দেখার কথা বলা হয়েছে। পর্যালোচনা কমিটির পরামর্শে গত ২১ জানুয়ারি করা হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ট্যারিফ (বিদ্যুতের দাম) পর্যালোচনা কমিটি। এ কমিটির কাজ চলমান।

চুক্তি অনুসারে প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে নেয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম নির্ধারণে একটি সূত্র দেওয়া আছে চুক্তিতে। এ সূত্র অনুসারে দাম নির্ধারিত হয়। একেক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে একেক দাম। সমঝোতার মাধ্যমে কাউকে কাউকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। দরপত্র ছাড়া বিশেষ বিধান আইনে এভাবে চুক্তি করার সুযোগ নিয়েছে গত আওয়ামী লীগ সরকার।

বিশেষ বিধান আইনটি করা হয় ২০১০ সালে। এরপর দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়। এই আইনের অধীনে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এর কারণে এটি দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত। এ আইনের অধীনে দরপত্র ছাড়া একটার পর একটা চুক্তি করেছিল গত সরকার।

সম্পর্কিত নিবন্ধ