ধ্বংসস্তূপে তন্নতন্ন করে খুঁজেও অক্ষত কোনো জিনিস পেলেন না থাংয়া লুসাই
Published: 25th, February 2025 GMT
রাঙামাটির বাঘাইছড়ির সাজেকের রুইলুই ভ্যালি পর্যটনকেন্দ্রে ঢুকতেই নাকে পোড়া গন্ধ এসে লাগে। পর্যটনকেন্দ্রের শিবমন্দির এলাকা থেকে গির্জা পর্যন্ত প্রায় আড়াই শ মিটার এলাকায় রিসোর্ট-কটেজ, বসতঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সড়কের দুই পাশে কোনো কিছু অবশিষ্ট নেই। কেবল ছড়িয়ে আছে পোড়া টিন, আসবাব, হাঁড়ি-পাতিল, গ্যাস সিলিন্ডার। রিসোর্টের পাশাপাশি পুড়েছে হেডম্যানসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়িঘর, রেস্তোরাঁ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
হেডম্যানের পুড়ে যাওয়া দোতলা বাড়ির পাশ ঘেঁষেই ছিল স্থানীয় বাসিন্দা থাংয়া লুসাইয়ের বাড়ি। আগুনে তাঁর বাড়ি একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। তবু ধ্বংসস্তূপ তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখছিলেন তিনি কোনো একটা জিনিস অক্ষত রয়েছে কি না। অনেকক্ষণ খুঁজেও কিছুই পেলেন না তিনি। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত এই প্রৌঢ় শূন্য চোখে তাকাচ্ছিলেন চারপাশে। বললেন, কিছুই নেই। সব পুড়ে গেছে।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে রুইলুই ভ্যালিতে দাঁড়িয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। পোড়া বসতঘরের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, তাঁর দুটি রিসোর্ট, দুটি দোকান ও বসতবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তাঁর স্ত্রী, ছেলের স্ত্রী, নাতনিসহ পরিবারের ১৩ জন সদস্য এক কাপড়ে বের হয়ে এসেছেন। আপাতত একটা ঝুপড়িতে উঠেছেন সবাই মিলে। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। এই ক্ষতি কীভাবে সামলে উঠবেন জানেন না তিনি।
থাংয়া লুসাই সব হারালেও মেঘলা ত্রিপুরা কিছু প্লাস্টিকের চেয়ার, হাঁড়ি-পাতিল ও প্লেট-বাসন রক্ষা করতে পেরেছেন। রুইলুই পর্যটনকেন্দ্রের ফটকের পাশেই মেঘপাই নামের তাঁর একটি রেস্তোরাঁ ছিল। সেটিসহ তাঁর বসতঘর পুরোটাই পুড়ে গেছে। সামান্য জিনিসপত্র নিয়ে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন গাছতলায়।
রুইলুই ভ্যালির পূর্ব অংশে চিকনলতা ত্রিপুরা ও তাঁর মেয়ে জুয়েলি ত্রিপুরা পুড়ে যাওয়া বসতঘরে একটা টিন দিয়ে আচ্ছাদনের মতো তৈরি করেছেন। তার আড়ালে মানুষের দিয়ে যাওয়া ভাত খাচ্ছিলেন মা-মেয়ে। গতকালের আগুনে তাঁদের বসতঘরের সঙ্গে একটি রিসোর্টও পুড়ে গেছে। আয়ের উৎস হারিয়ে দুজনই এখন নিঃস্ব।
রুইলুই ভ্যালির সড়কের দুই পাশে আগুনের ধ্বংসস্তূপ। সেখানে পড়ে আছে পোড়া টিন, আসবাব, গ্যাস সিলিন্ডার। আজ দুপুরে রাঙামাটির বাঘাইছড়ির সাজেকের রুইলুই পর্যটনকেন্দ্রে.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সেন্ট মার্টিন ভালো নেই, সেন্ট মার্টিনের মানুষ ভালো নেই
অমাবস্যা ও সমুদ্রের নিম্নচাপ একই সময় হওয়ার কারণে উপকূলজুড়ে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে। সেখানকার জনজীবনে দুর্ভোগ ও ক্ষতির পরিমাপ এতটা বেশি যে অনুমান করাও কঠিন।
প্রতিবছর বর্ষায় মোটামুটি দু-তিনটি ঘূর্ণিঝড় বা নিম্নচাপের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস হয়। কিন্তু এত ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস কখনো হয়নি। এত তাণ্ডব কখনো দেখেননি দ্বীপের মানুষ।
২৬ ও ২৭ জুলাই সমুদ্রের নিষ্ঠুর লীলাখেলা দেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। দ্বীপের প্রায় চারপাশ থেকে হু হু করে ঢুকেছে সমুদ্রের পানি। অনেক দিন এমন পানির তোড় দেখেননি দ্বীপের মানুষ।
দ্বীপে যা সামান্য কৃষিকাজ হয়, বিশেষ করে ধান চাষ ও সবজি চাষে এবার জলোচ্ছ্বাসের থাবা পড়েছে। লোনাপানি ঢুকে চাষাবাদের ব্যাপক ক্ষতি করেছে।
সমুদ্রের পাড়ের বাড়ি ও দ্বীপের মাঝখানের নিম্নাঞ্চলে (স্থানীয় ভাষায় মরং বলে) সাগরের পানি ঢোকার কারণে অনেক এলাকায় পানি লবণাক্ত হয়ে সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
অনেক বাড়ি ও রিসোর্ট সমুদ্রের ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকের সীমানাপ্রাচীর ভেঙে গেছে।
দ্বীপে কোনো বেড়িবাঁধ না থাকায় এবার জলোচ্ছ্বাস পূর্ণমাত্রায় আঘাত করতে পেরেছে! ফলে পুরোপুরি অনিরাপদ দ্বীপটিকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে।
দ্বীপের ভাঙন শুরু মূলত ১৯৯১ ও ১৯৯৪ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে। ওই দুই ঘূর্ণিঝড় দ্বীপের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ আশপাশের পাথরের স্তূপ নড়বড়ে করে দেয়। ফলে দ্বীপের চারপাশের সমুদ্রের স্রোত সমুদ্রগর্ভের পরিবর্তে সৈকত ঘেঁষে প্রবাহিত হয়।
এতে দ্বীপের উত্তর ও উত্তর–পূর্ব পাশে ব্যাপক ভাঙন হয়। উত্তর পাড়া ও ডেইল পাড়া নামের দুটি পাড়া বিলীন হয়ে যায়। বাসিন্দাদের ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় গুচ্ছগ্রাম করে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়।
সেন্ট মার্টিন নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক। নানা রাজনীতি। দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র বলতে মানুষ সেন্ট মার্টিনই বোঝেন। কিন্তু সেই সেন্ট মার্টিনের দুর্যোগ ও ভবিষ্যতের শঙ্কা নিয়ে দেশের মানুষের কোনো ভাবনা নেই, এটি খুবই হতাশাজনক। দ্বীপের সুরক্ষা যদি নিশ্চিত করা না হয়, আমরা দ্বীপবাসী কোথায় যাব?সেই ১৯৯১ সাল থেকে আজ অবধি দ্বীপের ভাঙন চলমান। কিন্তু কোনো বেড়িবাঁধ নেই। আবার নতুন করে অপরিকল্পিত রিসোর্ট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার কারণেও সৈকতের বালিয়াড়ি ও কেয়া ঝোপ উজাড় হয়েছে। এতে দ্বীপের ঢেউ প্রতিরোধক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের, বিশেষ করে মুরব্বিদের কথায় এবারের মতো জলোচ্ছ্বাস তাঁদের জীবনে দেখেনি। তাঁরা দ্বীপের ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত। আদৌ দ্বীপে অদূর ভবিষ্যতে বসবাস করতে পারবেন কি না, সেটা নিয়ে তাঁদের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ বাসিন্দা মনে করেন, এ রকম আর দু–তিনটি জলোচ্ছ্বাস সহ্য করার মতো শক্তি সেন্ট মাটিনের নেই। দ্রুত স্রোতপ্রতিরোধী বাঁধ নির্মাণ করতে না পারলে সেন্ট মার্টিন ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবে!
দ্বীপবাসী মনে করে, একটা টেকসই বেড়িবাঁধ যেটা সচরাচর উপকূলীয় অঞ্চলের বেড়িবাঁধের মতো না। কারণ, এখানে কচ্ছপের ডিম দেওয়ার জন্য উপযুক্ত স্থান। ফলে কাছিমের ডিম দিতে যাতে বাধা সৃষ্টি না হয়, সেভাবে সৈকত থেকে সমুদ্রের দিকে লম্বালম্বি করে বাঁধ দিয়ে স্রোত সমুদ্রের দিকে ঠেলে দিতে হবে। দক্ষিণ ভারতে এ রকম বাঁধ অনেক কার্যকর প্রমাণিত।
পাশাপাশি দ্বীপের মানুষের আয়ের বিকল্প কর্মসংস্থান বা আয়ের উৎস সৃষ্টি করে পর্যটননির্ভরতা কমাতে হবে। একটা আবাসন নীতিমালা করে দ্বীপে পরিবেশবান্ধব বাড়ি ও ইকো রিসোর্ট করতে উৎসাহিত করতে হবে। যত্রতত্র রিসোর্ট করা বন্ধ করতে হবে। অতিরিক্ত রিসোর্ট কমিয়ে ফেলতে হবে আর যেসব রিসোর্টের বিরুদ্ধে আইনি বাধা আছে, সেগুলো উচ্ছেদ করতে হবে।
সৈকত, জঙ্গল, খাল ও জলাভূমি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। প্রয়োজনে কিছু জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে বা ক্ষতিপূরণ হলেও সৈকতের ১০০ ফুট পর্যন্ত সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে এবং সে জমিতে বনায়ন করতে হবে। ঝাউগাছের পরিবর্তে ভাঙনপ্রতিরোধী কেয়াগাছ, নারকেল ও সাগরলতা রোপণ, রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
সেন্ট মার্টিন নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক। নানা রাজনীতি। দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র বলতে মানুষ সেন্ট মার্টিনই বোঝেন। কিন্তু সেই সেন্ট মার্টিনের দুর্যোগ ও ভবিষ্যতের শঙ্কা নিয়ে দেশের মানুষের কোনো ভাবনা নেই, এটি খুবই হতাশাজনক। দ্বীপের সুরক্ষা যদি নিশ্চিত করা না হয়, আমরা দ্বীপবাসী কোথায় যাব?
তৈয়ব উল্লাহ, আন্দোলনকর্মী ও সেন্ট মার্টিনের স্থানীয় বাসিন্দা