অধ্যাপক, যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

‘সংবাদপত্রের ভাষা’ পরিভাষাটি খুবই প্রায়োগিক ও প্রাত্যহিক। এটি প্রায়োগিক কারণ এটি একটি দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত লিখিত ভাষাকে নির্দেশ করে। একইসঙ্গে এটি অবশ্যই প্রাত্যহিক। কেননা এই লিখিত রূপটি বিপুল আয়তনে প্রতিদিন মানুষের সামনে এসে হাজির হয় যা থেকে মানুষ দেশ-জাতি-রাষ্ট্র-সমাজ ও বিশ্বের রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি-ব্যবসা-বাণিজ্য-রোগবালাই ইত্যাদি সম্পর্কে সংবাদ লাভ করে। 


সংবাদপত্রের ভাষা যেহেতু মানুষের মৌখিক রূপ নির্দেশ করে না, বরং তার লিখিত ভাষাচর্চার একটি অংশ, সেহেতু এটি শুধু অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণে ব্যবহৃত হয়। সে হিসেবে বলা যায়, দেশের বিপুলসংখ্যক নিরক্ষর মানুষের জন্য এই লিখিত ভাষারূপ কোনো অর্থই বহন করে না।


পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাষার যত প্রাত্যহিক লিখিত রূপ আছে, তার মধ্যে সংবাদপত্রের ভাষার আকৃতি ও আওতা সর্ববৃহৎ। এটি বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও সত্যি। কারণ বাংলাদেশে মূলত বাংলা ভাষায় এবং কদাচিৎ অন্য আরও দু’একটি ক্ষুদ্র জনজাতির ভাষায় যেসব পত্রিকা, সাময়িকী প্রকাশিত হয়ে থাকে, তা সমগ্র বাংলাভাষার অন্য লিখিত রূপের তুলনায় শুধু আকৃতিতেই ব্যাপক না, বরং বিষয়চর্চার দিক থেকেও এটি বিশাল। কেননা একটি সংবাদপত্রে জাতির সামষ্টিক জীবনে ব্যবহৃত বহুবিধ বিষয়েরই সংবাদ পরিবেশিত হয়। 


সংবাদপত্র আপামর সবশ্রেণির শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ স্বল্পশিক্ষিত কেরানি থেকে শুরু করে পণ্ডিত ও গবেষক অধ্যাপক সকল শ্রেণির মানুষই প্রতিদিনই সংবাদপত্র পাঠ করেন। ফলে সংবাদপত্রের ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর ভাষারূপ হতে হয় সহজ, সরল এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য, যাতে সবাই সংবাদপত্র পাঠ করে প্রয়োজনীয় অর্থ ও তথ্যটি উদ্ধার করতে পারেন। বিষয়টির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একটি সংবাদপত্রকে সবসময় ভাষার সাম্প্রতিক রূপটিকে নির্বাচন করতে হয়। 

উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে গত দুই দশক ধরে সবগুলো জাতীয় দৈনিক চলিত বাংলাতেই সংবাদ প্রকাশ করে। তবে দুই দশক আগে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দৈনিক ইত্তেফাক সাধু রীতিকে অবলম্বন করলেও মানুষের আধুনিক রুচি এবং এর সহজ ভাবপ্রকাশ নিশ্চিত করা ও আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য সাধুরূপকে বাদ দিয়ে চলিত রূপে ফিরে এসেছে।


একটি দেশে জাতীয় ভাষা বা প্রধান ভাষার দুটি রূপ থাকে, যথা- প্রমিত রূপ বা মান রূপ এবং এর আঞ্চলিক রূপ বা উপভাষা। সংবাদপত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এর ভাষারূপকে অবশ্যই প্রমিত রূপ বা মান রূপ হতে হয়। কারণ সংবাদপত্রের উদ্দিষ্ট পাঠক হচ্ছে দেশের সর্ব অঞ্চলের শিক্ষিত পাঠক শ্রেণি। 

এ ক্ষেত্রে একটি সংবাদপত্র যদি কোনো অঞ্চলের মানুষের আবেগ বা সংবেদনকে গুরুত্ব দিয়ে সে অঞ্চলের আঞ্চলিক রূপকে গ্রহণ করে, তাহলে দেশের অন্য অঞ্চলের মানুষেরা এ থেকে কোনো অর্থ উদ্ধার করতে পারবে না, বা সংবাদপত্রটির কোনো মাহাত্ম্য বা আভিজাত্যও থাকে না। সে কারণে বাংলা ভাষার প্রমিত রূপেই বাংলাদেশের সকল জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকাগুলো প্রকাশিত হয়ে থাকে। একই কারণে পৃথিবীর কোনো দেশেই ভাষার মান রূপকে বাদ দিয়ে নির্দিষ্ট আঞ্চলিক রূপ বা উপভাষায় কোনো সংবাদপত্র প্রকাশের নজির নেই।


এবারে আশা যাক বাংলা সংবাদপত্রের ভাষার বানানরীতির প্রসঙ্গে। আগেই বলা হয়েছে, সংবাদপত্রের ভাষা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ভাষাটির সবচেয়ে বৃহৎ আকৃতির লিখিত রূপ যেটি প্রতিদিন দেশের সর্বাধিক পাঠককে আকৃষ্ট করে থাকে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, সংবাদপত্রের ভাষায় ব্যবহৃত বানানরীতিটি হতে হবে সহজবোধ্য, সাম্প্রতিক রূপের এবং সর্বজনীনও বটে। প্রথমত, এর বানানরূপ হবে সহজবোধ্য এবং সাম্প্রতিক রূপের যাতে সবশ্রেণির পাঠক তাদের নিয়মিত ও সহজ বানানরূপটি দেখে তা থেকে অনায়াসে অর্থ উদ্ধার করতে পারেন। এছাড়া এর বানানরীতি হবে সর্বজনীন। অর্থাৎ দেশের প্রধান ভাষা সংস্থা দ্বারা স্থিরকৃত রূপকেই অবলম্বন করে থাকে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, এদেশের সব জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিকেই বাংলা একাডেমি প্রণীত বানাননীতি অনুসরণ করা উচিত। এতে বাংলা বানানের ঐক্য যেমন থাকে, তেমনি এই রূপটিই একসময় স্থিরকৃত হয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে কোন কোন জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা বাংলা একাডেমি প্রণীত বানাননীতি বাদ দিয়ে নিজস্ব প্রণীত বানাননীতি অনুসরণ করে। আপাতদৃষ্টে এতে কোনো দোষের নয়। কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যায়, এর ফলে বেশ কিছু বাংলা বানানের বিকল্পরূপ দাঁড়িয়ে যায়। এর ফলে পাঠকের দৃষ্টিতে তা যেমন অর্থ উদ্ধারে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি ঠিক কোন রূপটি প্রকৃত মান বানান হিসেবে স্বীকৃতি পাবে তা নিয়ে পাঠকের এক ধরনের ঝামেলা তৈরি হয়। এই বিষয়টিকে বলা হয়, পাঠকের বোধগত ঝামেলা। এই ধরনের বানানঘটিত বোধগত ঝামেলা যত বেশি ঘটতে থাকবে, ততই বাংলা ভাষার বানানে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে থাকবে। সেই বিষয়টি বিবেচনা করে বাংলাদেশের সকল জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিকেরই বাংলা একাডেমি প্রণীত সর্বজনীন রূপটি অনুসরণ করা উচিত।


সংবাদপত্র প্রকৃত অর্থেই তথ্যের আধার। কারণ সংবাদপত্র দেশ-জাতি-রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে এত তথ্যে ভরপুর থাকে যে, পাঠককে একটি সংবাদপত্র পড়ে সেসব তথ্য বিষয়ে অবহিত হয়ে সহজেই এর অর্থ উদ্ধার করতে চায়। সেইসঙ্গে পাঠক একটি বিষয়ে নিশ্চিত হতে চায় যে, যেন সংশ্লিষ্ট সংবাদটিতে প্রকৃত তথ্যই খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থাৎ কোনো ধরনের অতিরঞ্জিত বা মনোকল্পিত বিষয় নয়, বরং একটি বিষয়ে প্রকৃত অর্থেই যা ঘটেছে, পাঠক ঠিক সেই তথ্যটিই পেতে চায়। সে কারণে সংবাদপত্রের ভাষা ও বয়ানকে হতে হয় যথাসম্ভব বস্তুনিষ্ঠ। 

মূলত ভাষারূপের মধ্যেই একটি সংবাদপত্রের বস্তুনিষ্ঠতার প্রাণভোমরা লুকায়িত থাকে। কিন্তু এর বিপরীতে কিছু সংবাদপত্র দেখা যায়, মূলত মালিকের অশুভ উদ্দেশ্য বা সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ভাবাদর্শ প্রচার করতে গিয়ে সংবাদপত্রের ঘটনাপ্রবাহকে তুলে ধরতে গিয়ে প্রায়শই উদ্দেশ্যমূলক শব্দ, পরিভাষা বা বাক্য সংযুক্ত করা হয়। এটিকে আমরা ব্যক্তিনিষ্ঠ প্রকাশরূপ বলতে পারি। এ ধরনের ব্যক্তিনিষ্ঠ ভাষাসমৃদ্ধ সংবাদটি পড়ে মনে হয়, যেন পত্রিকাটি কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা দলের ডিকোর্সকে প্রচার করছে। এভাবে ব্যক্তিনিষ্ঠ ভাষাযুক্ত সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে বর্তমানে বাংলাদেশের কিছু জাতীয় দৈনিক এবং ইউটিউব চ্যানেল মানুষকে বিভিন্ন অপতথ্য প্রদানের মাধ্যমে হলুদ সাংবাদিকতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। 

সম্প্রতি আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের ফলে অতথ্য ও অপতথ্যযুক্ত শিরোনামযুক্ত সংবাদ এতই বেড়ে গিয়েছে যে, মানুষ এতে রীতিমত আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।


সংবাদপত্রে সাংবাদিক বা রিপোর্টার যখন কোন বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন করেন বা প্রতিবেদন তুলে ধরেন, তখন এতে দুটি অংশ পরিলক্ষিত হয়। একটি হচ্ছে সংবাদটির শিরোনাম, এবং অন্যটি এর বর্ণনাংশ। এই পর্যায়ে প্রথমেই সংবাদের শিরোনামের দিকে আলোকপাত করা যেতে পারে। একটি সংবাদের শিরোনাম কি রকম হওয়া উচিত? এ বিষয়ে সবাই অনায়াসে বলেন যে, সংবাদের শিরোনামটি হওয়া উচিত যথাসম্ভব সহজ, স্পষ্ট এবং আকর্ষণীয়। ‘সহজ ও স্পষ্ট’ বলতে শিরোনামটি এমন শব্দ বা পরিভাষা ব্যবহার করতে হবে, যাতে পাঠক সহজেই অর্থ উদ্ধার করতে পারে। সহজ ও স্পষ্ট করার জন্য যথাসম্ভব ক্রিয়াপদ বর্জন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ২৫শে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে প্রকাশিত দৈনিক প্রথম আলোর প্রথম পাতার মূল শিরোনামটি উল্লেখ করা যেতে পারে- ‘অপরাধীরা বেপরোয়া, আতঙ্কে মানুষ’। এই শিরোনামটি পড়ে বাঙালি পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন যে, দেশে বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এবং মানুষ আতঙ্কে আছে। এই সংবাদের প্রতিবেদক শিরোনামটি লিখতে গিয়ে যৌক্তিকভাবেই দুটি ক্রিয়াপদ, যথা- ‘হয়ে উঠেছে’ এবং ‘আছে’ বাদ দিয়েছেন। এর ফলে নিশ্চয়ই বাংলাভাষী কোন পাঠকেরই এর অর্থ উদ্ধারে অসুবিধায় পড়তে হয় না। 


এবারে আসা যাক, একটি শিরোনাম কীভাবে পাঠকের কাছে ‘আকর্ষণীয়’ হয়ে ওঠে। এই শর্ত পূরণ করতে গিয়ে প্রতিবেদক সংশ্লিষ্ট শিরোনামটি কি সরল বাক্যে লিখবেন, নাকি তাকে একটি রূপক বাক্যে পরিণত করবেন? এর উত্তরে বলা যায়, সংবাদপত্রের শিরোনামকে পাঠকের কাছে অধিকতর আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য একে সরলভাবে না লিখে বরং রূপকে পরিণত করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১২ সালের ২৪শে এপ্রিল দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদেও শিরোনাম ছিল, ‘অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে সিলেট’। এটি নিঃসন্দেহে একটি রূপক বাক্য, অতি সরল শিরোনাম নয়। যদি প্রতিবেদক এর শিরোনাম হিসেবে ‘সিলেটে আগুন জ্বলছে’ জাতীয় সরল বাক্য দিয়ে শিরোনামটি লিখতেন, তাহলে নিশ্চয়ই তা পাঠকের কাছে খুব আকর্ষণীয় মনে হতো না। 


অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, সংবাদের শিরোনাম হিসেবে রূপক বাক্য লেখার জন্য সংবাদকর্মীকে কি ভাষা প্রশিক্ষণ নিতে হবে। অবশ্যই না। কারণ আধুনিককালের ভাষাবিজ্ঞানীরা বলছেন যে, ভাষা মাত্রই রূপকের সমষ্টি। শুধু কবি-সাহিত্যিকেরাই নয়, বরং সাধারণ মানুষও তাদের দৈনন্দিন ভাষিক প্রকাশে অসংখ্য রূপক বাক্য তৈরি করে থাকেন। এর সাথে সুর মিলিয়ে আমি বলতে পারি যে, দৈনিক আমার দেশের সংশ্লিষ্ট সংবাদকর্মী নিশ্চয়ই ওপরের শিরোনামটি লিখতে গিয়ে বিশেষ কোন ভাষা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেননি। বরং তিনি তার সহজাত ভাষিক প্রকাশের অংশ হিসেবেই এই ধরনের একটি আকর্ষণীয় রূপকধর্মী বাক্য তৈরি করেছেন।


শিরোনামের পর সংবাদের পরবর্তী অংশ হচ্ছে বর্ণনাংশটি। এই অংশেই মূলত পাঠক সংবাদের প্রকৃত তথ্যটি পেয়ে থাকেন। সে বিবেচনায় বর্ণনাংশের ভাষাও অবধারিতভাবে হতে হবে সরল, স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ। ভাষার প্রগলভতা প্রকাশের চেয়ে সংবাদকর্মী সত্যিকার উদ্দেশ্য হচ্ছে, পাঠককে সংবাদের ভেতরগত মেসেজটি পৌঁছে দেওয়া। এ ছাড়া কখনও কখনও সংবাদকর্মী বা প্রতিবেদক কোনো বড় প্রতিবেদনের বর্ণনাংশে, সংবাদপত্রের ভাষায় যাকে ‘ভিউজ’ বলা হয়, উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিজস্ব ভাবাদর্শ প্রচারে মেতে ওঠেন। ফলে পাঠক সংবাদটির বস্তুনিষ্ঠ অর্থ উদ্ধারের পরিবর্তে সংবাদপত্রের মালিকের রাজনৈতিক আদর্শের বয়ান পাঠ করেন। এ কারণে সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় এবং পাঠক সহজেই সংবাদপত্র সংশ্লিষ্ট সকলের রাজনৈতিক আদর্শ বা ভাবাদর্শ সম্পর্কে জেনে যায়। পরিণতিতে অচিরেই পত্রিকাটি পাঠকের কাছে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মুখপত্র রূপে পরিচিত হয় এবং জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামে।
    
           
 

ঢাকা/ফারুক/টিপু 

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর

এছাড়াও পড়ুন:

পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক পতনের কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি

পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক সময়ে ধারাবাহিক নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা পর্যবেক্ষণে অস্বাভাবিক এবং সন্দেহজনক বলে মনে করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

তাই বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে তদন্ত করে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে করে কমিশন। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজার নিম্নমুখী প্রবণতার কারণ খতিয়ে দেখতে বেশ কিছু শর্ত নির্ধারণ করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গঠিত তদন্ত কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছে বিএসইসি।

গত রবিবার (২৭ এপ্রিল) এ সংক্রান্ত একটি আদেশ জারি করা হয়েছে। বিএসইসির সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা রাইজিংবিডি ডটকমকে এই তথ্য জানিয়েছেন।

আরো পড়ুন:

‘অরেঞ্জ বন্ড অন্তর্ভুক্তিমূলক পুঁজিবাজার তৈরির সুযোগ দিচ্ছে’

যমুনা অয়েলের ৯ মাসে মুনাফা বেড়েছে ৩৭.৭৮ শতাংশ

তদন্তের বিষয়টি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) ও সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডকে (সিডিবিএল) অবহিত করা হয়েছে।

গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন-বিএসইসির অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ শামসুর রহমান, উপ-পরিচালক মুহাম্মদ ওরিসুল হাসান রিফাত, ডিএসইর সহকারী মহাব্যবস্থাপক মাহফুজুর রহমান এবং সিডিবিএলের সহকারী ব্যবস্থাপক কাজী মিনহাজ উদ্দিন।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত বছরের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর পুঁজিবাজারের হাল ধরেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। ওই দিন অর্থাৎ ১৯ আগস্ট ডিএসইর প্রধান ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৫৭৭৫.৪৯ পয়েন্টে। তিনি কাজে যোগ দেওয়ার ৮ মাস অতিবাহিত হলেও পুঁজিবাজারে গতিশীলতা ফিরে আসেনি। বরং, ক্ষেভে বিনিয়োগকারীরা সড়কে নেমে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন।

সর্বশেষ সোমবার (২৮ এপ্রিল) ডিএসইর ডিএসইএক্স সূচক কমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৯৫২.৭৯ পয়েন্টে। ফলে প্রায় ৮ মাসে ডিএসইএক্স সূচক ৮২২.৭০ পয়েন্ট কমেছে।

এমন পরিস্থিতি বিএসইসির গঠিত তদন্ত কমিটি সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজার নিম্নমুখী প্রবণতার কারণ খতিয়ে দেখবে। এ কাজে কোনো কারসাজি চক্র জাড়িত আছে কি-না এবং বাজারে চক্রান্তকারী গুজব রটিয়েছে কিনা-তা খতিয়ে দেখা হবে বলে জানা গেছে।

বিএসইসির তদন্তের আদেশ
সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারের নিম্নমুখী প্রবণতা পর্যবেক্ষণ করেছে বিএসইসি, যা অস্বাভাবিক এবং সন্দেহজনক বলে মনে করা হচ্ছে। তাই কমিশন বিষয়টি পুঁজিবাজার এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বৃহত্তর স্বার্থে তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করছে। এরই ধারাবাহিকতায় সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ, ১৯৬৯ (১৯৬৯ সালের অধ্যাদেশ নম্বর XVII) এর ২১ ধারা এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিও অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন, ১৯৯৩ (১৯৯৩ সনের ১৫ নম্বর আইন) এর ১৭(ক) ধারার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে কমিশন আলোচ্য বিষয়ে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছে। উক্ত তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য বিএসইসি, ডিএসই এবং সিডিবিএলের ৪জন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হলো। গঠিত তদন্ত কমিটির কর্মকর্তারা এই আদেশ জারির তারিখ থেকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করবে।

যেসব বিষয় খতিয়ে দেখবে তদন্ত কমিটি
ডিএসইএক্স সূচকের সাম্প্রতিক পতনের কারণ চিহ্নিত করা। বাজারে গুজব ছড়ানোর সাথে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা অন্য কোনো আনুষঙ্গিক বিষয় থাকলে তা চিহ্নিত করা। গঠিত তদন্ত কমিটি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ানোর জন্য সুপারিশ প্রদান করা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজার নিম্নমুখী প্রবণতার কারণ খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গঠিত তদন্ত কমিটি কি কি কারণে বাজার পতনমুখী প্রবণতায় রয়েছে তা খতিয়ে দেখবে। একইসঙ্গে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ানোর জন্য কি কি করা প্রয়োজন সে বিষয়েও সুপারিশ প্রদান করবে তদন্ত কমিটি।”

ঢাকা/এনটি/এসবি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সাপ্তাহিক পত্রিকা : সোনালি অতীত ও প্রসঙ্গকথা
  • পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক পতনের কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি