২০৫০ সাল নাগাদ, অর্থাৎ আগামী ২৫ বছরে বিশ্বজুড়ে লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে। স্থূলতা, মদ্যপান ও হেপাটাইটিস (যকৃতে প্রদাহ) হওয়ার মতো প্রতিরোধযোগ্য সমস্যাগুলো ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করা না হলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে।

চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেটে আজ মঙ্গলবার প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। গবেষণাটি করেছে, বিশ্বমানের ক্যানসার তথ্য প্ল্যাটফর্ম ‘গ্লোবাল ক্যানসার অবজারভেটরি (জিসিও)’।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে বর্তমানে প্রতিবছর ৮ লাখ ৭০ হাজার মানুষ লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। বর্তমান প্রবণতা চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বছরে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ১৫ লাখ ২০ হাজারে দাঁড়াবে।

ক্যানসারের যে ধরনগুলোয় আক্রান্ত হওয়ার কারণে প্রাণহানির সংখ্যা বেশি হয়, তার মধ্যে লিভার ক্যানসারের অবস্থান তৃতীয়। গবেষণা প্রতিবেদনে আভাস দেওয়া হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে বছরে ১৩ লাখ ৭০ হাজার মানুষ প্রাণ হারাবে।

অবশ্য, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের একটি দল বলেছে, প্রতি পাঁচটি লিভার ক্যানসারের তিনটি প্রতিরোধ করা সম্ভব।

গবেষকদের মতে, লিভার ক্যানসারের প্রধান ঝুঁকিগুলোর মধ্যে রয়েছে—মদ্যপান, যকৃতে ভাইরাসজনিত প্রদাহ ও স্থূলতার কারণে যকৃতে চর্বি জমে যাওয়া। এর মধ্যে শেষটিকে এমএএসএলডি নামে ডাকা হয়ে থাকে। আগে এটি ‘নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ’ নামে পরিচিত ছিল।

বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস উপলক্ষে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। গবেষকদের ধারণা, ২০৫০ সালেও হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস লিভার ক্যানসারের প্রধান কারণ হিসেবে থেকে যাবে।

হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, জন্মের পরপরই টিকা দেওয়া। তবে দরিদ্র দেশগুলোয়, বিশেষ করে সাব-সাহারান আফ্রিকায় টিকা দেওয়ার হার খুব কম।

আরও পড়ুনহেপাটাইটিস কেন হয়, এর থেকে বাঁচার উপায় কী২৮ জুলাই ২০২৫

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, যদি টিকার হার না বাড়ে, তাহলে ২০১৫ সাল থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে।

গবেষকেরা আভাস দিয়েছেন, ২০৫০ সাল নাগাদ লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাগুলোর মধ্যে ২১ শতাংশের কারণ হবে মদ্যপান। এটি ২০২২ সালের তুলনায় দুই শতাংশের বেশি।

আরও পড়ুনকম বয়সীদের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে, কারণ কী১১ অক্টোবর ২০২৪

একই সময়ের মধ্যে স্থূলতার কারণে যকৃতে চর্বি জমাকে কেন্দ্র করে লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত মানুষের হার বেড়ে ১১ শতাংশে দাঁড়াবে। অর্থাৎ আগের তুলনায় এ হার ২ শতাংশ বাড়বে।

লিভার ক্যানসার প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী পদক্ষেপ নেওয়াটা জরুরি বলে মত দিয়েছেন গবেষকেরা।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, লিভার ক্যানসার প্রতিরোধের জন্য জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়া অঞ্চলে স্থূল মানুষ কিংবা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের যকৃতে চর্বি জমার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করা উচিত বলে মনে করেন তাঁরা।

আরও পড়ুনকীভাবে লিভার সুস্থ রাখবেন৩০ মে ২০২৫আরও পড়ুনলিভার ক্যানসার থেকে বাঁচার উপায়০৭ জুলাই ২০২১.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ২০৫০ স ল ন গ দ হ প ট ইট স হওয় র

এছাড়াও পড়ুন:

তিন কারণে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে, অক্টোবরের বৃষ্টিও ভোগাবে

‘রোগতাত্ত্বিক ত্রিভুজ’ বলে জনস্বাস্থ্যে একটি পরিভাষার ব্যবহার আছে। এই ত্রিভুজের তিন বাহুর একটি হলো জীবাণু (ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে মশা), একটি রোগী এবং তৃতীয়টি পরিবেশ। এই তিনটির একটিও যদি নিয়ন্ত্রণে আসে, তবে রোগ বৃদ্ধির প্রবণতা কমানো যায়।

গতকাল শুক্রবার শেষ হলো অক্টোবর মাস। এ মাসে ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে, এডিস মশার বিস্তার কমেনি এবং জীবাণু সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ যেমন বৃষ্টিও ছিল। পরিবেশের অন্য উপাদান যেমন শহরাঞ্চলে নোংরা ও আবর্জনা। এ ক্ষেত্রেও কোনো উন্নতি হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু থেকে মুক্তির সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা।

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘অক্টোবরের শেষ সময়ে এসে এই বৃষ্টি আমাদের ভোগাবে। নভেম্বরে ডেঙ্গুর বিস্তার কমার সম্ভাবনা কম। রোগতাত্ত্বিক ত্রিভুজ বলতে যা বোঝায়, তাকে রুখে দেওয়ার কোনো তৎপরতা তো দেখছি না। গ্রামে-গঞ্জে এডিস ছড়িয়ে পড়েছে। তার নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দৃশ্যমান কাজ দেখা যাচ্ছে না। ভীতির কারণ এটাও।’

অক্টোবরের শেষে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণের রেকর্ড হয়েছিল। আর গত বুধবার দেখা যায়, এক মাসে বছরের সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়। সব মিলিয়ে অক্টোবর মাসে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২২ হাজার ৫২০ জন। এ মাসে মৃত্যুর সংখ্যা ৮০। সংক্রমণ ও মৃত্যু—দুই দিক থেকেই ডেঙ্গুর আক্রমণে অক্টোবর ছিল বছরের শীর্ষে।

বৃহস্পতিবার সকাল আটটা থেকে গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৫০৩ জন। এ সময় কারও মৃত্যু হয়নি। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ২৭৮ জন। আর হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৬৯ হাজার ৮৮৬। গত বছর এ সময় রোগীর সংখ্যা ছিল ৬১ হাজার ৮১৭ আর মৃত্যু হয়েছিল ২৯৭ জনের।

দুই মাস ধরে বাড়ছে রোগ ও মৃত্যু

চলতি বছরের জুন থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করে। এ সময় অনেক বিশেষজ্ঞই বলেছিলেন, এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বড় আকারের হতে পারে। সরকার তাতে তেমন গা করেনি। গত জুলাই মাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা জুনের দ্বিগুণ হয়ে যায়। আগস্টে মৃত্যু ও সংক্রমণ সামান্য কমে। কিন্তু সেপ্টেম্বরে তা আবার বেড়ে যায়। সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৫ হাজার ৮৬৬ জন। অক্টোবরে প্রায় ৭ হাজার রোগী বেড়েছে।

ঢাকা ও আশপাশে রোগী বাড়ছে

চলতি বছরের ডেঙ্গুর একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এবার ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। এবার মোট আক্রান্তের ২৮ শতাংশ ঢাকার। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ঢাকার বাইরে রোগী বৃদ্ধির প্রবণতা ছিল। কিন্তু অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই ঢাকায় রোগী বাড়তে শুরু করে। শুধু ঢাকা নয়, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের মতো পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোয় রোগী ব্যাপকভাবে বেড়েছে।

ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, অক্টোবরে ঢাকায় অন্তত ১৫ শতাংশ রোগী বেড়েছে সেপ্টেম্বরের চেয়ে। তবে ঢাকায় ভর্তি রোগীদের অন্তত ৫০ শতাংশ ঢাকার বাইরের বাসিন্দা।

নারায়ণগঞ্জে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৭৩০। অক্টোবরের শেষে এসে রোগীর সংখ্যা হয়েছে ১ হাজার ৩১০ জন। অর্থাৎ শুধু অক্টোবরে আগের নয় মাসের তুলনায় রোগী দ্বিগুণ হয়েছে। গাজীপুরে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত রোগী ছিলেন ১ হাজার ৬৬১ জন। আর অক্টোবরের শেষ দিন পর্যন্ত রোগী হয়েছেন ২ হাজার ৯৯৩ জন।

তিন কারণে ডেঙ্গুর বড় বিস্তার

চলতি বছর এপ্রিল থেকে মোটামুটি বৃষ্টি হচ্ছে। জুনে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হলেও পরের মাসগুলোয় স্বাভাবিক বৃষ্টি হয়। আর থেমে থেমে বৃষ্টির সঙ্গে গরম কিন্তু কমেনি। এই বৃষ্টি ও উচ্চ তাপমাত্রা চলতি বছর ডেঙ্গুর বিস্তারে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবীরুল বাশার। তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরেই বর্ষা দেরিতে আসছে। এবারও অক্টোবরজুড়ে বৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নিষ্ক্রিয়তা ডেঙ্গুর বিস্তারে দ্বিতীয় কারণ। পৌরসভার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো জনপ্রতিনিধিশূন্য করা ঠিক হয়নি। ঢাকার বাইরে এবার ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তারে এসব ভঙ্গুর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান বড় কারণ। কবীরুল বাশার মনে করেন, ঢাকার বাইরে যেহেতু চিকিৎসা অবকাঠামো দুর্বল, তাই সেসব এলাকায় রোগ বেড়েছে।

অধ্যাপক কবীরুল বাশার বলেছিলেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে শীতের ভূমিকা আসলে কম। কারণ, এখানে জানুয়ারি মাসে দিনের তাপমাত্রা ১৮ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। রাতে হয়তো তা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রির মধ্যে চলে আসে। কিন্তু এখানে এডিসের বংশ বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখে বৃষ্টি।

অক্টোবরের শেষে যে বৃষ্টি হয়েছে, আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকাল সতর্কবার্তায় জানিয়েছে, অন্তত ৩টি বিভাগে পরের ৪৮ ঘণ্টায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে।এরই মধ্যে বৃষ্টির আরেক খবর আছে। ৬ থেকে ৭ নভেম্বর সাগরে লঘুচাপের ফলে আবারও বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে।

এভাবে বৃষ্টি হলে পাঁচ থেকে সাত দিন লার্ভা থেকে বাচ্চা মশা হয়। সেটি প্রাপ্তবয়স্ক হতে আরও ১১ দিনের মতো সময় লাগে। সব মিলিয়ে আরও ২০ থেকে ২৫ দিন এডিসের বংশবিস্তার ঘটতে থাকবে। ফলে নভেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমবে না। এর রেশ ডিসেম্বর পর্যন্ত থাকতে পারে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • তিন কারণে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে, অক্টোবরের বৃষ্টিও ভোগাবে