ইউক্রেনে শান্তিচুক্তির জন্য জেলেনস্কির পদত্যাগ করা লাগতে পারে: ট্রাম্পের উপদেষ্টা
Published: 3rd, March 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির নজিরবিহীন বাগ্বিতণ্ডার পর ইউক্রেন সংকট সমাধানের আশা অনেকটাই মিইয়ে এসেছিল। হোয়াইট হাউস থেকে একেবারে খালি হাতে ফিরে লন্ডনে ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন জেলেনস্কি। তবে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে আবারও এক টেবিলে বসার ইঙ্গিত দিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। তিনি বলেছেন, ইউক্রেন ও রাশিয়া—দুই পক্ষই আলোচনায় না বসলে যুদ্ধ থামবে না।
সংবাদমাধ্যম এবিসি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন আশার কথা শুনিয়েছেন রুবিও। রোববার দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, হোয়াইট হাউসে শুক্রবার ট্রাম্প-জেলেনস্কি বিতণ্ডার পর থেকে ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আর কথা হয়নি। যুদ্ধ থামানোর জন্য রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে আনতে হবে। তবে তাদের প্রতি বৈরী মনোভাব রাখলে, মস্কোকে আলোচনায় যুক্ত করা সম্ভব হবে না। কোনো চুক্তি করার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই মনোভাবই দেখিয়ে আসছেন।
শুক্রবারের ঘটনার পরও যুদ্ধ বন্ধে আবার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের আলোচনায় বসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান রুবিও। তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, সবকিছু আবার শুরু হতে পারে। আশা করি, তিনি (জেলেনস্কি) এটা বুঝতে পারবেন যে আমরা আসলে আরও হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর আগে, তাঁর দেশকে সাহায্যের চেষ্টা করছি।’
তবে রুবিও জেলেনস্কির সঙ্গে আলোচনা শুরুর ইঙ্গিত দিলেও সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়ালৎস। শান্তিচুক্তির জন্য জেলেনস্কিকে পদত্যাগ করতে হতে পারে—এমন কথা উল্লেখ করে রোববার সিএনএনকে ওয়ালৎস বলেন, ‘(ইউক্রেনের) একজন নেতা প্রয়োজন, তিনি আমাদের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন, শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করতে পারবেন এবং এই যুদ্ধ থামাতে পারবেন।’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার পরই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে তৎপর হয়েছেন ট্রাম্প। সৌদি আরবে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসেছে তাঁর প্রশাসন। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপও করেছেন তিনি। তবে এসব আলোচনায় ইউক্রেনকে যুক্ত করেননি ট্রাম্প। এমন পরিস্থিতিতে একপ্রকার চাপের মুখে গত শুক্রবার হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বসেন জেলেনস্কি। সেখানে কথোপকথনের এক পর্যায়ে দুজনের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। সেদিন দুই পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি।
খনিজ চুক্তি করতে প্রস্তুত জেলেনস্কিহোয়াইট হাউসে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যে যে চুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল, সেটি খনিজ সম্পদবিষয়ক। ওই চুক্তির মাধ্যমে ইউক্রেনের বিরল খনিজ সম্পদে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে। গত শুক্রবারের সেই বিতণ্ডার পর আবার চুক্তিটি করতে প্রস্তুত ভলোদিমির জেলেনস্কি। যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে সম্মেলন শেষে রোববার বিবিসিকে এ কথা জানিয়েছেন তিনি।
চুক্তিটির ভবিষ্যৎ নিয়ে জানতে চাওয়া হলে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘খনিজ চুক্তিটি (যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের) মন্ত্রীদের সইয়ের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। আমরা এটি সই করতে প্রস্তুত।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদি সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো প্রস্তুত থাকে, তাহলে টেবিলে যে চুক্তিটি রয়েছে, তা সই করা হবে।’
আসলে এই চুক্তি নিয়ে আগে থেকেই বড় চাপের মুখে ছিলেন জেলেনস্কি। রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছ থেকে তিনি যে পরিমাণ সহায়তা পেয়েছিলেন, ট্রাম্প ক্ষমতায় বসার পর তা শঙ্কার মুখে পড়েছে। যুদ্ধ বন্ধের তৎপরতায় বাইডেনের নীতির বিপরীত পথে হেঁটে রাশিয়া ও পুতিনের দিকে ঝুঁকেছেন ট্রাম্প। এখন ইউক্রেন চাইছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে খনিজ সম্পদ চুক্তি করে ট্রাম্পকে হাতে রাখতে। এতে করে যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়ার সঙ্গে যেকোনো শান্তিচুক্তির ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থানে থাকতে পারবে কিয়েভ।
আংশিক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবরোববারের লন্ডন সম্মেলন পূর্বনির্ধারিত ছিল। তবে ট্রাম্প-জেলেনস্কির বিতণ্ডার পর ওই সম্মেলনের গুরুত্ব বেড়ে যায়। সম্মেলনে ইউক্রেনের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও জোটের নেতারা। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার জানান, কিয়েভের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে চারটি পদক্ষেপের বিষয়ে একমত হয়েছেন তাঁরা।
লন্ডন সম্মেলনে উপস্থিত ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে ছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁও। সেদিনই ফরাসি দৈনিক লে ফিগারোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে এক মাসের আংশিক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেবে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য। তবে এই যুদ্ধবিরতির আওতায় স্থলযুদ্ধ পড়বে না। আকাশ, সমুদ্র ও জ্বালানি অবকাঠামোতে হামলার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে।
মাখোঁর ভাষ্যমতে, আংশিক যুদ্ধবিরতির সময় মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে শান্তিচুক্তির বিষয়ে আলোচনা হবে। এই আলোচনায় কয়েক সপ্তাহ লাগবে। আলোচনা শেষে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ইউক্রেনে ইউরোপের স্থলসেনা মোতায়েন করা হবে।
‘পশ্চিমে ভাঙন শুরু হয়েছে’গত শুক্রবার হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প-জেলেনস্কির বিতণ্ডার ঘটনায় বেশ খুশি হয়েছিল মস্কো। অন্তত ওই ঘটনার পর রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাতে তা স্পষ্ট। ট্রাম্প ক্ষমতায় বসার পর পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে, তা ইউক্রেন যুদ্ধে কাজে লাগাতে চাইছে রাশিয়া।
এরই মধ্যে সোমবার নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, ‘আমরা যেমন দেখেছিলাম, (রাশিয়ার বিরুদ্ধে) পশ্চিমারা ঐক্যবদ্ধ ছিল, তবে সেই ঐক্য কমে এসেছে। পশ্চিমাদের ঐক্যে ভাঙন শুরু হয়েছে। আর পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের এবং বিভিন্ন দেশ নিয়ে গঠিত জোটের মধ্যে আরও বিভেদ দেখা দিচ্ছে।’
রোববারের লন্ডন সম্মেলন নিয়ে পেসকভ বলেন, এখনো কয়েকটি দেশ ইউক্রেনের পাশে রয়ে গেছে। মনে হচ্ছে তারা যুদ্ধের পক্ষে রয়েছে। এই দেশগুলো যুদ্ধ চালিয়ে যেতে ইউক্রেনকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এবং অস্ত্র সরবরাহ করছে।
এমন পরিস্থিতিতে লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযান চলবে বলে জানান ক্রেমলিনের মুখপাত্র। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিচুক্তির প্রক্রিয়া কোন পর্যায়ে আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে এখনো কোনো ‘সমন্বিত পদক্ষেপ’ নেওয়া হয়নি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউক র ন র প য দ ধ বন ধ শ ক রব র প রব ন র জন য মন ত র ইউর প
এছাড়াও পড়ুন:
এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।
জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।
জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।
মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।