বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে উৎসে করহার যৌক্তিকীকরণ, করপোরেট করহার কমানো এবং অগ্রিম আয়কর ও টার্নওভার করনীতি সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে কর প্রশাসনের উন্নয়ন ও স্বয়ংক্রিয় ডিজিটালাইজেশন চালুর মাধ্যমে কর ফাঁকি কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা। 
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কার্যালয়ে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট আলোচনায় ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি) এবং মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ঢাকার প্রতিনিধিরা এসব প্রস্তাবনা দেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এনবিআরের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান। 
শুরুতে প্রস্তাবনা তুলে ধরেন ফিকির সভাপতি জাভেদ আখতার। তিনি বিদেশি বিনিয়োগ টানতে উৎসে কর যৌক্তিকীকরণ, ন্যূনতম কর প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন প্রস্তাব দেন। জাভেদ আখতার বলেন, রাজস্ব নীতি প্রণয়ন এবং আদায় বিভাগ আলাদা করলে রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়া সহজ হওয়ার পাশপাশি কার্যকারিতা বাড়বে। এতে রাজস্ব আদায় এবং কমপ্লায়েন্স অধিকতর কার্যকর হবে। তিনি বলেন, ভ্যাট হার একটি থাকা উচিত। এ ছাড়া পরিবেশবান্ধব উৎপাদনের জন্য করহারে ছাড় দেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।

ফিকির পক্ষে প্রস্তাবনা তুলে ধরে এসএমএসি অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেসের পরিচালক স্নেহাশিস বড়ুয়া বলেন, কর-শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় ব্যবসায়ীরা ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছেন। পাশাপাশি তিনি ইটিডিএস, ই-রিটার্ন ও রিটার্ন ফাইলিং ডেটাবেইসের মধ্যে সমন্বয় আনার আহ্বান জানান। 
সভায় এমসিসিআইর সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, বিগত অর্থবছরগুলোতে শর্তসাপেক্ষে করপোরেট কর হার ধারাবাহিকভাবে কমানো হলেও অর্থ আইন-২০২৪ অনুযায়ী নগদ লেনদেনের শর্তের কারণে কেউই এই সুবিধা নিতে পারছেন না। দেশের অর্থনীতির ৮০ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক,  ব্যাংকিংনির্ভরতা সম্পূর্ণ নয়। ফলে বড় ও মাঝারি কোম্পানির জন্য এই শর্ত পালন করা অত্যন্ত কঠিন। কার্যকরী কর হারও অনেক বেশি, যা উৎসে কর কর্তন ও অননুমোদিত ব্যয়ের ফলে ক্ষেত্রবিশেষে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হয়। তাই কোম্পানির কর হারের ক্ষেত্রে নগদ লেনদেনের শর্ত বাতিল করা দরকার।
এমসিসিআই সভাপতি বলেন, বর্তমান কর প্রশাসন ও নীতিনির্ধারণী কাঠামো একই ছাতার নিচে কাজ করছে। এতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। করনীতি ও কর প্রশাসন আলাদা করলে স্বাধীন ও স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণয়ন করা সম্ভব হবে। এতে কর আদায়ের কার্যক্রমে অপচয় ও হয়রানি কমবে এবং ব্যবসায়ীরা সহজে কর পরিশোধ করতে পারবেন। করনীতি নির্ধারণের জন্য একটি স্বাধীন বোর্ড প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ সহজ হবে। 
কর ব্যবস্থাপনা অনলাইনভিত্তিক করার প্রস্তাব দিয়েছে এমসিসিআই। সংগঠনটির মতে, কর নির্ধারণ ব্যবস্থা, আপিল, ট্রাইব্যুনাল, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পর্যায়ে প্রচলিত আইন সংশোধন করে অনলাইনে শুনানি গ্রহণের বিধান চালু করা অতি জরুরি। করদাতাদের নোটিশ প্রদান, শুনানিতে করদাতাদের হাজিরা পদ্ধতি ইত্যাদি ব্যবস্থা অনলাইনভিত্তিক হওয়া দরকার। এতে ব্যবসায়ীদের অর্থ ও সময়ের অপচয় কমবে। 

তিনি বলেন, এসএমই খাতের বিকাশে আলাদা করহার নির্ধারণ করা প্রয়োজন। টার্নওভার কর কমালে এসএমই ব্যবসায়ীরা করের আওতায় আসতে উৎসাহিত হবে। দেশীয় উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে কাঁচামালের ওপর ভ্যাট ও শুল্ক কমাতে হবে। 
দুই সংগঠনের বক্তব্য শোনার পর এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বলেন, আগামী আয়কর আইনে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। ব্যবসা সহজ করতে ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো, অথরাইজড ইকোনমিক অপারেটরের কাজ শুরু হয়েছে। বন্ড অটোমেশন নিয়ে কাজ চলছে। আগামী বছর করপোরেট ট্যাক্স রিটার্ন অনলাইনে নিয়ে আসা হবে। 
সব ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের ছাড় নেওয়ার মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে এনবিআরের চেয়ারম্যান বলেন, কর ছাড়ের কারণে বৈষম্য তৈরি হয়। ধারণা করে বলা হয়, যে পরিমাণ রাজস্ব আয় হয়, সমপরিমাণ ছাড় দেওয়া হয়। এই ছাড় দেওয়া কমাতে হবে। ভষ্যিতে একক ভ্যাট হার করা হবে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব যবস য় র ত ক কর এমস স

এছাড়াও পড়ুন:

ধান কাটায় আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার, পেশা বদলাচ্ছেন কৃষি শ্রমিকেরা

বছর পাঁচেক আগেও ধান কাটার শ্রমিকেরা বৈশাখ মাসের অপেক্ষায় থাকতেন। বৈশাখে হাওরের বুকজুড়ে সবুজ ধান যখন সোনালি রঙ ছড়াতে শুরু করে, তখন থেকেই দূরদূরান্ত থেকে হাওরে আসতে থাকেন ধান কাটার শ্রমিকেরা। কিন্তু, এই চিত্র দ্রুত বদলাচ্ছে। হাওরের কৃষক এখন ধান কাটার জন্য বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করেন। ফলে কৃষকের শ্রম এবং অর্থ দুটোরই সাশ্রয় হচ্ছে। তবে, কর্মহীন হয়ে পড়ছেন কৃষি শ্রমিকেরা। বাধ্য হয়ে তারা পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে ঝুঁকছেন অন্য পেশায়।

তিন বছর হলো ধান কাটার পেশা ছেড়েছেন মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া গ্রামের মো. মকবুল মিয়া। এখন তিনি সারাবছর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান।

আরো পড়ুন:

খুলনার বরফশ্রমিক
নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি

ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত

মকবুল মিয়া বলেন, ‘‘আগে বছরের ছয় মাস বর্ষায় নৌকা বাইতাম, আর হুগনা সিজন আইলে নিজের জমি চাষ করতাম, আবার মাইনষের জমিতেও কামলা দিতাম। যা আয় অইতো তাই দিয়া আমরার ছয়জনের সংসার চইল্যা যাইতো। কিন্তু, যহন থেইক্যা নতুন নতুন মেশিন হাওরে আইতাছে, তহন থেইক্যা আমরার আর বেইল নাই।’’

‘‘কেউ আর আমরারে আগের মতন দাম দেয় না। কাম করলেও ঠিকমতো টেহা পাই না, তাই পুষায় না,’’ বলেন এই কৃষিশ্রমিক।

মকবুলের মতো ধান কাটা, মাড়াই, রোদে শুকানো, ঝাড়া, কাঁধে বহন করার মতো স্বাধীন পেশা ছেড়েছেন অষ্টগ্রামের ফয়জুল, ইটনার শামছুল মিয়া, নিকলীর ফরিদ উদ্দিনসহ অসংখ্য শ্রমিক। এক সময় যারা এ পেশায় দলবেঁধে কাজ করতেন, এখন দৃশ্যপট পুরোটাই ভিন্ন। ধান কাটার পেশা বদলে তারা এখন কেউ রিকশাচালক, কেউ চায়ের দোকানদার, কেউ চটপটি-ফুচকার দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

তারা বলছেন, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির গতির সঙ্গে তারা কখনো তাল মেলাতে পারবেন না। কৃষকরাও তাদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারছেন না। বেশি জমি যাদের আছে তারাও আধুনিক পদ্ধতির প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন। যে কৃষক অল্প জমিতে চাষাবাদ করেছেন, তারাও আর পয়সা খরচ করে কৃষিশ্রমিকের ওপর নির্ভর করছেন না। তারা পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা নিচ্ছেন। ফলে খেটে খাওয়া শ্রমিকেরা পড়েছেন বিপাকে।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সনাতন পদ্ধতিতে এক বিঘা জমির ধান কাটতে প্রচুর সময় লাগে। ফসল কাটার পরে বহন ও মারাই করা, তারপর বস্তায় সংরক্ষণ করার জন্যও অনেক শ্রমিকের দরকার। এটুকু ৬ থেকে ৭ জন শ্রমিকের সারা দিনের কাজ। তার জন্য মজুরি গুনতে হয় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। কিন্তু, এ কাজে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করলে সময় এবং অর্থ দুটোই কম লাগে।

বৈশাখে বর্ষার পানি ও বৈরী আবহাওয়া না থাকায় কৃষকেরা হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটছেন। বৈশাখের মাঝামাঝি সময়ে ঝড়-তুফান শুরু হলে পাকা ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে তারা যে পদ্ধতিতে ধান কাটা সহজ এবং দ্রুত হয় সেই পদ্ধতি বেছে নিচ্ছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এবার পুরো জেলায় এক লাখ ৬৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু হাওর এলাকাতেই আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার হেক্টর জমিতে। ফলন ভালো হওয়ায় এই ধান থেকে এবার প্রায় ৮ লাখ মেট্রিক টন চাল পাওয়া যাবে। ধান কাটতে এ বছর হাওর অঞ্চলে ৩৫ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত আছেন। এই সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় কম। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধান কাটতে কৃষক কম্বাইন্ড হারভেস্টারসহ ৪১৩টি ধান কাটার যন্ত্র ব্যবহার করছেন। 

জেলা শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. খোরশেদ উদ্দিন বলেন, ‘‘মানুষের পেশা পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের বিভিন্ন পেশা বেছে নিতে হয়। কিন্তু, কৃষি এমন একটা পেশা, যারা এ পেশা রপ্ত করেছেন তাদের জন্য নতুন পেশায় আসা খুব কঠিন। বর্তমানে কৃষিকাজে যেভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে, তাতে কৃষিশ্রমিকেরা ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।’’

‘‘শুধু কৃষিতেই নয়, বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রেই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে,’’ উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকারকেই সুদৃষ্টি দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান, মাঠে যদি কৃষক ও শ্রমিক ন্যায্য শ্রমমূল্য না পান, তাহলে কৃষিও একদিন হুমকির মুখে পড়বে।’’

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত নিবন্ধ