ওসমানী বিমানবন্দরে প্রকল্পের ক্ষতিপূরণ পাননি জমির মালিকেরা
Published: 5th, March 2025 GMT
সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তাবেষ্টনী ও নিরাপত্তা টহল সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রায় ১৫১ একর জমি অধিগ্রহণ করতে নোটিশ দেয় কর্তৃপক্ষ। এরপর চার বছর পার হলেও এখনো ক্ষতিপূরণের টাকা বুঝে পাননি জমির মালিকেরা। অধিগ্রহণের নোটিশ জারি হওয়ায় জমি কেনাবেচা বা খাজনাও দিতে পারছেন না মালিকেরা। ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় তাঁরা নতুন ঠিকানায়ও যেতে পারছেন না।
সদর উপজেলার বড়শালা মৌজার ধুপাগুল এলাকার রাজীব হোসেনের ১১ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু চার বছর ধরে আশ্বাস পেলেও এখনো ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। তিনি বলেন, বর্ষায় পানি বাড়লে ঘরে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। অধিগ্রহণ হয়ে যাওয়ায় নতুন করে ঘর মেরামতও করতে পারছেন না। অধিগ্রহণের পর ঘরের ছবি ও ভিডিও নেওয়া হয়েছে। এখন নতুন করে মেরামত করলে মেরামতের টাকা বৃথা যাবে।
ক্ষতিপূরণের টাকার জন্য চার বছর ধরে সিলেট জেলা প্রশাসন, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকার ধরনা দিয়েও কোনো সুরাহা পাননি বিমানবন্দর এলাকার আবদুল হাকিম (৪৮)। তিনি বলেন, তাঁরা ভুক্তভোগীরা একত্র হয়ে একাধিকবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়েছেন। বিভিন্ন কর্মসূচি করেছেন। কিন্তু কোনো অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছেন না। প্রশাসন শুধু সময় নিচ্ছে। একেকবার একেক ধরনের কথা বলছে। বিষয়টি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কাগজের জন্য আটকে আছে বলে জানাচ্ছে জেলা প্রশাসন। আবার বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে জেলা প্রশাসন বিষয়টি দেখছে।
আবদুল হাকিম বলেন, অনেক ভুক্তভোগী আছেন, যাঁদের জমিগুলোই শেষসম্বল। কিন্তু চার বছরের বেশি সময় ধরে তাঁরা জমি নিয়ে কিছুই করতে পারছেন না। এতে অনেকের ঘরের জন্য ছেলেমেয়েদের বিয়েও দিতে পারছেন না।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ‘সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তাবেষ্টনী ও নিরাপত্তা টহল সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্পের জন্য ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ১৫১ একর জায়গা অধিগ্রহণের জন্য নোটিশ জারি করে জেলা প্রশাসন। স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল আইন ২০১৭ (২০১৭ সালের ২১ নম্বর আইন)–এর ৪ ধারা অনুযায়ী এ নোটিশ জারি করা হয়। এ নোটিশ জারির প্রকল্প এলাকার কোনো জমি বেচাকেনা বন্ধ হয়ে যায়।
ভুক্তভোগীদের কয়েকজন বলেন, সামনে বর্ষাকাল। তাঁদের মধ্যে যাঁদের ঘরবাড়িসহ জমি অধিগ্রহণের আওতায় পড়েছে, চার বছর ধরে মেরামত বা সংস্কার না হওয়ায় সেগুলোর অবস্থা ভালো না। বর্তমানে ঘরগুলো মেরামত না করা গেলে বর্ষা মৌসুম কাটানো সম্ভব হবে না। অন্যদিকে ক্ষতিপূরণের টাকাও পাওয়া যাচ্ছে না। টাকা পেলে তাঁরা নতুন জায়গায় স্থায়ী হতে পারতেন। ঘরগুলো মেরামতের প্রয়োজন পড়ত না।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে জমির মালিকদের সঙ্গে নিজ কার্যালয়ে বৈঠক করেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব বৈঠক করেছেন। বৈঠকে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক মো.
বৈঠকে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ ও অধিগ্রহণের জায়গাসংক্রান্ত বিষয় আগামী এক মাসের মধ্যে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী ৭ এপ্রিল ওসমানী বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও ভুক্তভোগীদের নিয়ে চূড়ান্ত শুনানি হবে। সেই শুনানিতে অধিগ্রহণের বিষয়গুলো সমাধান হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
মাঝখানে বেশ কিছুদিন ভূমি অধিগ্রহণ বন্ধ ছিল। পরবর্তী সময়ে বিশেষ অনুমোদন আনা হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে কিছুটা সময়ক্ষেপণ হয়েছে।হাফিজ আহমেদ, ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালকজানতে চাইলে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক হাফিজ আহমেদ বলেন, অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময় সংশোধন করতে হয়েছে। কিছু অপ্রয়োজনীয় বিষয় বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হয়েছে। বিষয়টি সিভিল এভিয়েশনের প্রশাসন শাখা জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে তদারকি করছে। তিনি বলেন, এ ছাড়া মাঝখানে বেশ কিছুদিন ভূমি অধিগ্রহণ বন্ধ ছিল। পরবর্তী সময়ে বিশেষ অনুমোদন আনা হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে কিছুটা সময়ক্ষেপণ হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় চার বছর আগে জমি অধিগ্রহণের জন্য নোটিশ জারি করার মাধ্যমে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। বর্তমানে অধিগ্রহণের জায়গাগুলো চিহ্নিত হওয়ার চূড়ান্ত হওয়ার পর্যায়ে আছে। জায়গা চিহ্নিত হয়ে গেলে যেগুলো অধিগ্রহণের বাইরে থাকবে, সেগুলো মালিকেরা বেচাকেনা করতে পারবেন। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রত্যাশী সংস্থা একাধিকবার প্রস্তাব পরিবর্তন করায় প্রক্রিয়া কিছুটা দীর্ঘ হয়ে গেছে। এরপরও আগামী ৭ এপ্রিল অধিগ্রহণের জায়গা চূড়ান্ত হবে বলে তিনি আশা করছেন। এরপর মূল্য নির্ধারণের পর চলতি বছরের মধ্যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব হবে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: চ র বছর প রকল প ম র মত র জন য র পর চ ওসম ন
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।
সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।
জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’
ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।
জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।
জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।