গত শুক্রবার ওভাল অফিসে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটল; যেখানে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে প্রকাশ্যে অপমান ও আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জে ডি ভ্যান্সের হাতে। এই জেলেনস্কি তিন বছর ধরে রাশিয়ার নৃশংস আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাঁর দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ঘটনার পর ইউরোপের কিছু নেতা দ্রুতই তাঁকে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের পরামর্শ দিতে ছুটে যান। তাঁদের মধ্যে কিয়ার স্টারমার ও ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক রুটও রয়েছেন। কিন্তু এটি ছিল ভুল পরামর্শ। জেলেনস্কির উচিত এটিকে উপেক্ষা করা। আসলে তাঁর সামনে বিকল্পও খুব কম।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও তাঁর প্রশাসন ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করে দিয়েছে, তারা মস্কোর সঙ্গে দ্রুত একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে চায়। এর ফলে ইউক্রেন বিভক্ত হয়ে পড়বে। দেশটি মার্কিন বা ন্যাটোর নিরাপত্তা নিশ্চয়তা থেকে বঞ্চিত হবে। আর মার্কিন কোম্পানিগুলো সেখানে ঢুকে কৌশলগত খনিজ সম্পদ লুটে নেবে।

ট্রাম্প তাঁর চিরচেনা মাফিয়া ধাঁচের কৌশল প্রয়োগ করে তাঁর অনুসারীদের জেলেনস্কির অপসারণ দাবি করতে উৎসাহিত করেছেন। বলেছেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত আমেরিকার সমর্থন তার সঙ্গে আছে, ততক্ষণ এই লোকটা শান্তি চাইবে না।’ এরপর তিনি ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেন। উদ্দেশ্য, কিয়েভ যেন নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং পুতিনের শর্ত মেনে যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে বাধ্য হয়।

এখন এটা একেবারেই পরিষ্কার যে ট্রাম্প প্রশাসনের আসলে জেলেনস্কির সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের কোনো ইচ্ছা নেই। তাই যদি জেলেনস্কি এখন ট্রাম্পের কাছে মাথা নত করেন, তাহলে কেবল আরও অপমানিতই হবেন। কিন্তু নতুন করে অস্ত্রসাহায্য বা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা—কিছুই পাবেন না। যে ব্যক্তি পুতিনের আগ্রাসনের সামনে মাথা নত করেননি, তাঁরও উচিত নয় এখন ট্রাম্পের শর্তের কাছে আত্মসমর্পণ করা।

জেলেনস্কির জন্য বরং ভালো হবে যদি তিনি তাঁর ইউরোপীয় সমর্থকদের ওপর তাদের প্রতিশ্রুতি দ্রুত বাস্তবায়ন করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারেন। একই সঙ্গে তিনি ইউক্রেনের দুর্লভ খনিজ সম্পদের সম্ভাবনা দেখিয়ে তাদের উৎসাহিত করতে পারেন। এটি কিয়েভের ইউরোপীয় ইউনিয়নে দ্রুত অন্তর্ভুক্তির একটি প্যাকেজের অংশ হিসেবেও কাজ করতে পারে।

তবু জেলেনস্কি ও ইউক্রেন এখনো এই যুদ্ধে বিজয়ী হতে পারে। শর্ত একটাই, ইউরোপীয় দেশগুলোর পূর্ণ সমর্থন। ইউক্রেনের দখলকৃত প্রতিটি ইঞ্চি ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে না পারলেও ইউক্রেনের উচিত ইউরোপের সহায়তায় জেলেনস্কির নেতৃত্বে লড়াই চালিয়ে যাওয়া।

এদিকে ট্রাম্পের আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যেমন তিনি ইউক্রেনের জন্য মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যপ্রবাহ বন্ধ করে দিতে পারেন। অথবা ইলন মাস্কের স্টারলিংক স্যাটেলাইট যোগাযোগব্যবস্থায় ইউক্রেনের অ্যাকসেস বন্ধ করে দিতে পারেন। তাহলে ইউরোপীয় দেশগুলোর উচিত হবে দ্রুত এগিয়ে এসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সরকারি স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে দিয়ে ইউক্রেনকে সহায়তা করা। যুক্তরাষ্ট্রেরও এ ধরনের পদক্ষেপ থেকে সাবধান থাকা উচিত। কারণ, এটি বিশ্বের মার্কিন মিত্রদের কাছে স্পষ্ট বার্তা দেবে যে সংকটময় সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সহযোগিতা কিংবা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভর করা যায় না।

ওভাল অফিসে যা ঘটেছে, তা এত আকস্মিক যে অনেক ইউরোপীয় নেতা এখনো এর গুরুত্ব পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি। এটা অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ, এ ঘটনা তাদের দীর্ঘদিনের ধারণাকে ওলট–পালট করে দিয়েছে। এত দিন ইউরোপীয় নিরাপত্তার ভিত্তি ছিল ট্রান্সআটলান্টিক মৈত্রী। এই মৈত্রী দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে তাদের সমৃদ্ধি এনেছে। কারণ, প্রতিরক্ষা খাতে তাদের বেশি ব্যয় করতে হয়নি। তারা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সুরক্ষাছাতার নিচে।

ওভাল অফিসের সেই তীব্র বাগ্‌বিতণ্ডার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক রুট বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির উচিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও শীর্ষ মার্কিন নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে গড়ে তোলা।’ তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। তিনি সেই জোটকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন, যা তাঁর বেতন দেয় এবং যা ইউরোপে ৭৫ বছর ধরে শান্তি বজায় রেখেছে। কিন্তু রুট এখনো ওয়াশিংটনের নতুন বাস্তবতা মানতে পারছেন না। পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে সময় লাগবে। হাতে তো সময় নেই।

একইভাবে কিয়ার স্টারমার মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। যদিও তিনি ইউক্রেনের প্রতি ব্রিটেনের পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করেছেন। এ মুহূর্তে ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনকে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে চাইছে। যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তাব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এতটাই জড়িত যে কোনো ব্রিটিশ নেতাই ইউক্রেনের ন্যায্য দাবির প্রতি সমর্থন ও ওয়াশিংটনের সঙ্গে তাদের বিশেষ সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার দুঃস্বপ্ন দেখতে চান না।

এখন দায়িত্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যও রয়েছে। তারা ইউক্রেনকে বাস্তবে সহায়তা করতে পারে ইউক্রেনকে গোলাবারুদ সরবরাহ করে। এর জন্য তাদের সামরিক উৎপাদন বাড়িয়ে ক্রমাগত অস্ত্র পাঠাতে হবে। তাদের উচিত অবিলম্বে রাশিয়ার ঘাঁটি ও সরবরাহ লাইন লক্ষ্য করে মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে ইউক্রেনকে অনুমতি দেওয়া; পাশাপাশি যুদ্ধবিরতির পর ইউক্রেনের জন্য নিরাপত্তা বাহিনী গঠনের বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা করা জরুরি। নিশ্চিত করতে হবে যেন তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর খুব বেশি নির্ভর করতে না হয়। যদিও স্টারমার যুক্তরাষ্ট্রকে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার জন্য চাপ দিচ্ছেন।

জেলেনস্কি এখন একদিকে বীর, অন্যদিকে ট্র্যাজিক এক চরিত্র। রাশিয়ার আক্রমণের মুখে তিনি ইউক্রেনের প্রতিরোধের প্রতীক হয়েছেন। কিন্তু এখন তিনি যেন প্রতিশোধপরায়ণ পুতিন ও নির্লজ্জ ট্রাম্পের মাঝে আটকা পড়ে যাওয়া এক শহীদ।

তবু জেলেনস্কি ও ইউক্রেন এখনো এই যুদ্ধে বিজয়ী হতে পারে। শর্ত একটাই, ইউরোপীয় দেশগুলোর পূর্ণ সমর্থন। ইউক্রেনের দখলকৃত প্রতিটি ইঞ্চি ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে না পারলেও ইউক্রেনের উচিত ইউরোপের সহায়তায় জেলেনস্কির নেতৃত্বে লড়াই চালিয়ে যাওয়া।

পল টেলর ইউরোপীয় নীতিকেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ গবেষক

গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউক র ন র প র ও ইউক র ন র ইউর প ইউর প য ইউর প য় র জন য সহ য ত র করত

এছাড়াও পড়ুন:

লামিনে ‘মেসি’ ইয়ামাল

১৭ বছর বয়সী ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো: ১৯ ম্যাচ, ৫ গোল, ৪ গোলে সহায়তা।

১৭ বছর বয়সী লিওনেল মেসি: ৯ ম্যাচ, ১ গোল, গোলে সহায়তা নেই।

১৭ বছর বয়সী লামিনে ইয়ামাল: ১০০ ম্যাচ, ২২ গোল, ৩৩ গোলে সহায়তা।

মেসি–রোনালদোর সঙ্গে তুলনা নয়, লামিনে ইয়ামালের শুরুটা বোঝাতে এই পরিসংখ্যান হাজির করেছে টিএনটি স্পোর্টস। ধূমকেতুর মতো শুরু হলেও ধূমকেতুর মতোই মিলিয়ে যাওয়ার পাত্র তিনি নন।

বার্সেলোনার এস্তাদি অলিম্পিক লুইস কোম্পানিসে  গত রাতের ম্যাচটি স্মরণ করতে পারেন। ৬ গোলের থ্রিলার, যেখানে বার্সেলোনা–ইন্টার মিলান সেমিফাইনাল প্রথম লেগের ‘ক্লাসিক’ লড়াই ৩–৩ গোলে অমীমাংসীত। দুই দলের হয়েই ‘সুপার হিরো’ ছিলেন বেশ কজন। ইন্টারের যেমন ডেনজেল ডামফ্রিস ও মার্কাস থুরাম, বার্সার তেমনি রাফিনিয়া, ফেরান তোরেসরা। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে ঠিকই রবির কিরণের মতো আলো দিয়েছেন এক কিশোর—লামিনে ইয়ামাল নাসরাউয়ি এবানা। সংক্ষেপে লামিনে ইয়ামাল।

আরও পড়ুন৬ গোলের থ্রিলারে বার্সেলোনা–ইন্টার সেয়ানে সেয়ানে টক্কর৮ ঘণ্টা আগে

২৪ মিনিটে ইয়ামালের করা গোলটির প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। যেভাবে খেলেছেন তাতে গোলটি না করলেও লোকে কাল রাতে তাঁর পারফরম্যান্স মনে রাখতেন। পরিসংখ্যান বলছে ১০২টি টাচ, একটি গোল, ২টি গোল হওয়ার মতো পাস, ৬টি শট (পোস্টে মেরেছেন দুবার) এবং ১০টির মধ্যে ৬টি সফল ড্রিবলিং।

কিন্তু পরিসংখ্যানে এ তথ্য নেই—মাঠে ডান প্রান্তকে ইয়ামাল ফাইনালে ওঠার হাইওয়ে বানিয়ে যতবার কাট–ইন করে ইন্টারের বক্সে ঢুকেছেন, সেটা আসলে ইতালিয়ান ক্লাবটির রক্ষণের জন্য দুঃস্বপ্নের। প্রতিবারই মৌমাছির মতো ছেঁকে ধরা হয়েছে ইয়ামালকে। কিন্তু আটকানো কি সম্ভব হয়েছে? রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিওগুলো ভাসছে। সেসব আসলে ইয়ামালের পায়ের কারুকাজে ইন্টারের রক্ষণকে স্রেফ খোলামকুচির মতো উড়িয়ে দেওয়ার ভিডিও।

ইয়ামাল কত ভয়ংকর সেটা এই এক ছবিতেই পরিস্কার। সবাই ছেঁকে ধরেও তাঁকে আটকাতে পারেননি

সম্পর্কিত নিবন্ধ