গৃহঋণ দেওয়া দেশের একমাত্র সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের (বিএইচবিএফসি) সব ধরনের ঋণের সুদ ১ শতাংশ করে বেড়েছে। গত ১ জানুয়ারি থেকে তা কার্যকর হবে। তাতে ঋণের ধরন অনুযায়ী সুদ হবে ৮ থেকে ১০ শতাংশ। বিএইচবিএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আবদুল মান্নান গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে এ তথ্য জানান।

বিএইচবিএফসির ঋণের সুদ ১ শতাংশ বৃদ্ধির একটি প্রস্তাব গত নভেম্বরে অনুমোদন করে সংস্থাটির পরিচালনা পর্ষদ। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সম্মতি না পাওয়ায় তা কার্যকর করা হয়নি। সর্বশেষ গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সুদ বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। গত ৫ ডিসেম্বর এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অনুমোদন চেয়ে চিঠি দিয়েছিল বিএইচবিএফসি।

জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক প্রথম আলোকে বলেন, এত লম্বা সময় ফাইল পড়ে থাকার কথা নয়। কী কারণে অনুমোদনে দেরি হয়েছে, তার খোঁজ নেওয়া হবে।

সর্বোচ্চ ২৫ বছরের জন্য ১১ ধরনের গৃহঋণ দেয় বিএইচবিএফসি। এসব ঋণের মধ্যে রয়েছে—নগর বন্ধু, পল্লীমা, আবাসন উন্নয়ন, আবাসন মেরামত, প্রবাস বন্ধু, হাউজিং ইকুইপমেন্ট ঋণ, কৃষক আবাসন ঋণ, সরকারি কর্মচারী ঋণ, ফ্ল্যাট ঋণ, ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন ঋণ এবং স্বপ্ননীড় ঋণ। এত দিন এসব ঋণের সুদ ছিল ৭ থেকে ৯ শতাংশ। এখন তা বেড়ে ৮ থেকে ১০ শতাংশ হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগর এলাকার সব ধরনের ঋণ এবং দেশের অন্য এলাকার ফ্ল্যাট ঋণের সুদ ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১০ শতাংশ হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকা ছাড়া অন্য এলাকার সব ধরনের ঋণের সুদ ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৯ শতাংশ। আর পেরি আরবান, উপজেলা সদর ও গ্রোথ সেন্টার এলাকায় ঋণের সুদ ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮ শতাংশ হয়েছে।

বিএইচবিএফসি সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির মোট গ্রাহক ৯২ হাজার ৬৬৮ জন। চলতি অর্থবছরে সংস্থাটির ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ২৫ বছর মেয়াদি সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ পাচ্ছে বিএইচবিএফসি। প্রথম কিস্তি ৮৫০ কোটি টাকা এরই মধ্যে পাওয়া গেছে। আগামী জুলাইয়ে দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পাওয়ার কথা রয়েছে। সংস্থাটির খেলাপি ঋণের হার ৪ শতাংশের কম।

বিএইচবিএফসির এমডি মো.

আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত ১ জানুয়ারি থেকে যারা ঋণ নিয়েছেন, তাঁদের জন্যই নতুন হার প্রযোজ্য। আগে যাঁরা ঋণ নিয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে আগের হারই বহাল থাকবে।’

বিশেষায়িত সরকারি এ সংস্থার মূল কাজ হলো গৃহঋণ বিতরণ। পাশাপাশি সংস্থাটি ফ্ল্যাট নিবন্ধন, আবাসন উন্নয়ন ও মেরামত এবং বাড়ি নির্মাণে সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্যও ঋণ দিয়ে থাকে। সব বিভাগীয় শহর ছাড়াও দেশের প্রতিটি জেলায় শাখা আছে বিএইচবিএফসির। সংস্থাটির ঋণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সরল সুদ।

বিএইচবিএফসি থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ি নির্মাণ করতে চাইলে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ টাকা নিজের থাকতে হয়। যেমন বাড়ি নির্মাণে যদি এক কোটি টাকা খরচ হয়, তার ৩০ লাখ টাকা নিজের থাকতে হবে। তবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতাধীন অভিজাত এলাকায় বাড়ি নির্মাণের জন্য একক ব্যক্তি দুই কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ পান।

আবাসন ব্যবসায়ীদের সমিতি রিহ্যাবের সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, মূল্যস্ফীতি এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদ্যমান হারের তুলনায় বিএইচবিএফসির নতুন হার যৌক্তিক পর্যায়েই আছে। তবে সংস্থাটি এখনো পুরোনো ধাঁচেই আছে। ফ্ল্যাট কেনায় ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে রক্ষণশীলতা থেকে সংস্থাটির বেরিয়ে আসা উচিত।

কত সুদে কত টাকা ঋণ

ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার নাগরিক, যাঁদের বাড়ি নির্মাণ উপযোগী জমির মালিকানা রয়েছে এবং উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বাড়ি নির্মাণের নকশা অনুমোদন করা আছে, তাঁরা পাবেন নগর বন্ধু ঋণ। এ ঋণের সুদ হার বেড়ে ১০ শতাংশ হবে। সর্বোচ্চ ২০ বছর মেয়াদে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ নেওয়া যাবে।

ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকা বাদে দেশের সব বিভাগীয় ও জেলা সদর এলাকা এবং উপশহর (পেরি আরবান), উপজেলা সদর ও গ্রোথ সেন্টার এলাকার নাগরিকেরা বাড়ি নির্মাণ ও ফ্ল্যাটের জন্য পল্লীমা নামক ঋণ নিতে পারে, যার সুদ ৮ থেকে বেড়ে ৯ শতাংশ হবে।

নিজস্ব অর্থায়নে এক বা একাধিক তলা নির্মাণের পর এবং অসম্পূর্ণ নির্মাণকাজ সমাপ্ত করার জন্য আবাসন উন্নয়ন ঋণ দেওয়া হয়। এ কর্মসূচির আওতায় বহুতল বাড়ি নির্মাণের নকশা অনুমোদন করে সর্বোচ্চ ২০ বছর মেয়াদে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ নেওয়া যায়।

ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকা, দেশের সব বিভাগীয় ও জেলা সদর এলাকায় যাঁদের নির্মিত ও সংস্কার বা মেরামতযোগ্য বাড়ি আছে, তাঁরা নিতে পারবেন আবাসন মেরামত ঋণ। সর্বোচ্চ ১৫ বছর মেয়াদে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নেওয়া যাবে। এখানে নিজস্ব তহবিল থাকা বাধ্যতামূলক নয়।

ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর ভেতরে বাড়ি নির্মাণের জন্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য রয়েছে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত প্রবাস বন্ধু নামক ঋণ নেওয়ার সুযোগ। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে অন্য সিটি করপোরেশন ও বিভাগীয় শহর এলাকায় এক কোটি টাকা পর্যন্ত এ ঋণ পাওয়া যায়। এ ছাড়া সব জেলা সদরে ৮০ লাখ এবং পেরি আরবান, উপজেলা সদর ও গ্রোথ সেন্টার এলাকার জন্য ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাওয়া যায়। এ ছাড়া হাউজিং ইকুইপমেন্ট ঋণ, কৃষক আবাসন ঋণ, সরকারি কর্মচারী ঋণ, ফ্ল্যাট ঋণ, ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন ঋণ, স্বপ্ননীড় নামক ঋণের সুদ ১ শতাংশ করে বেড়েছে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রথম আল ক বছর ম য় দ ঋণ র স দ ম র মত র এল ক এল ক র র ঋণ র র জন য এল ক য় ধরন র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

মাঝরাতে সরকারি কর্মকাণ্ড কতটা স্বাভাবিক

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের রাতের কর্মকাণ্ড নিয়ে বোধকরি একটা মহাকাব্য লিখে ফেলা সম্ভব। তাঁরা যেভাবে গভীর কিংবা শেষ রাতে নানা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, ফেসবুকে বার্তা দিচ্ছেন; তাতে তো মনে হচ্ছে সরকারের কর্তা-ব্যক্তিরা দিনে কাজ না করে রাতেই মনে হয় বেশি কাজ করেন! কয়েকটা উদাহরণ বরং দেওয়া যাক।

মাস কয়েক আগে যখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্বাভাবিক ভাবে খারাপ হয়ে গেল, আমাদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা  মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী রাত তিনটার সময় সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন! বাংলাদেশের ইতিহাসে রাত তিনটার সময় আর কোনো মন্ত্রী এ ধরনের সম্মেলনের আয়োজন করেছেন কি না, আমার অন্তত জানা নেই। আমরা সবাই ভাবলাম, তিনি হয়তো বড় কোনো ঘোষণা দেবেন। এরপর কী দেখলাম?

তিনি খুব সাধারণভাবে বললেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকার নিজেদের উদ্যোগকে কঠিন ও শক্তিশালী করার চেষ্টা করবে।

সপ্তাহখানেক আগে হঠাৎ আকাশ থেকে একটি  যুদ্ধবিমান ঢাকা শহরের উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল বিল্ডিংয়ে ভেঙে পড়ল। আগুনে দগ্ধ শিশুরা ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে নিজেরা উঠে এসে হাঁটছে; এমন দৃশ্যও আমাদের দেখতে হয়েছে। যে দৃশ্য দেখলে যে কেউ হয়তো ট্রমায় চলে যাবে। ওই স্কুলের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা হয়তো সরাসরি সেই দৃশ্য দেখেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই চলতে থাকে—এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া সময়ের দাবি ছিল। এ সিদ্ধান্ত সরকার দিনের বেলাতেই নিতে পারত। অথচ আমরা কী দেখলাম?

সরকারের পক্ষ থেকে  রাত তিনটার দিকে ফেসবুকে এসে ঘোষণা করা হলো, পরের দিনের এইচএসসি পরীক্ষা পেছানো হয়েছে।

যখনই আপনি সরকারের অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করবেন কিংবা আপনার মনে এই প্রশ্ন জাগবে; তখনই কিন্তু রাষ্ট্র ভালো আছে কি না; সেই প্রশ্নও সামনে আসবে।

দিন দু-এক আগে এ সরকারকেই যাঁরা চাকরি দিয়েছেন, এ কথা বলছি কারণ, সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিজেই বলেছিলেন, ‘ছাত্ররা আমার নিয়োগকর্তা’—সেই ছাত্রদের সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা গভীর রাতে ফেসবুক এসে লাইভ করেন প্রায় আড়াই ঘণ্টা।

এই আড়াই ঘণ্টার লাইভে মূল যে বক্তব্য তিনি তুলে ধরেছেন,  সারমর্ম করলে দাঁড়ায়: বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্ম মানি মেকিং মেশিনে পরিণত হয়েছে এবং অনেকেই এর সঙ্গে জড়িত। তিনি এটাও বলেছেন, এই সংগঠনের সব সিদ্ধান্ত হেয়ার রোড থেকে আসে। অর্থাৎ উপদেষ্টারা যেখানে থাকেন।

এদিকে সোমবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম একটা ফেসবুক পোস্ট করেছেন। যদিও ফেসবুক স্ট্যাটাসটি তিনি বেশ কয়েকবার এডিট করেছেন। তবে প্রথমে যা লিখেছেন, সেটা হচ্ছে, নতুন একটি দলের মহারথীদের কয়েকজন দুর্নীতিতে জড়িত। এ ছাড়া তিনি এটাও বলেছেন, একটা সার্কেলের সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত!

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে তাঁদের কেন প্রশ্রয় দেওয়া হলো? আপনারা যদি জানেনই কিছু মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত। তাহলে সরকারের অংশ হিসেবে আপনাদের তো দায়িত্ব তাঁদের আইনের আওতায় আনা। সেটা না করে ফেসবুকে পোস্ট করতে হচ্ছে কেন? তা–ও আবার রাত তিনটায়!

এই সরকার কি মাঝরাতের ফেসবুকীয় সরকারে পরিণত হয়েছে? পরীক্ষা পেছানোর মতো সিদ্ধান্ত যখন মাঝরাতে নিতে হয়, সংবাদ সম্মেলন যখন রাত তিনটায় করতে হয়, তখন তো প্রশ্ন জাগতেই পারে। কারণ এটা তো স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়।

যখনই আপনি সরকারের অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করবেন কিংবা আপনার মনে এই প্রশ্ন জাগবে; তখনই কিন্তু রাষ্ট্র ভালো আছে কি না; সেই প্রশ্নও সামনে আসবে।
রাষ্ট্র যদি ভালো না থাকে তবে তার মাত্রা কতটুকু, সেটা নির্ণয় এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।

আমিনুল ইসলাম প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি
[email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ