উদ্বেগ থেকে প্রতিরক্ষা ব্যয় ৮৬০ বিলিয়ন ডলার বাড়াচ্ছে ইউরোপ
Published: 7th, March 2025 GMT
ইউক্রেন থেকে যুক্তরাষ্ট্র মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় ইউক্রেন তো বটেই, পুরো ইউরোপেরই নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পাঁচ দিনের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো বৈঠকে বসেছেন ইউরোপের নেতারা। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে দিনব্যাপী এ বৈঠকে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ কয়েক শ কোটি ডলার বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা করছেন তাঁরা।
ইউরোপের প্রতিরক্ষা নিয়ে বিশেষ এ বৈঠকে যোগ দিয়েছেন ইউরোপের ২৭ দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরা। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও বৈঠকে যোগ দিয়েছেন। বৈঠকে মার্কিন সামরিক সহায়তা স্থগিতের পরিপ্রেক্ষিতে ইইউ কিয়েভকে কীভাবে সহায়তা করবে তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
বৈঠকের আগে ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লিয়েন ইউরোপের নিরাপত্তা জোরদারে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা জানান। তিনি বলেন, প্রতিরক্ষা খাতে ৮৬০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ বাড়ানোর পরিকল্পনা চলছে। ইইউর এ পরিকল্পনাকে ‘নজিরবিহীন’ হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি।
ইইউ নেতাদের এই সম্মেলন চলাকালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, ‘মস্কোর নিয়ন্ত্রণে থাকা (ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের অনেক ভূখণ্ড এখন রাশিয়ার দখলে রয়েছে) কোনো কিছুই ছেড়ে দেওয়া হবে না।’ ইউক্রেনের সঙ্গে সম্ভাব্য শান্তি চুক্তির বিষয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমাদের এমন একধরনের শান্তি প্রতিষ্ঠায় জয়ী হতে হবে যেটা আমাদের জন্য উপযুক্ত।’
ইউরোপের সামরিক খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। সম্মেলন চলাকালে এক্সে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, তাঁর দেশ শান্তি চায়; কিন্তু ইউক্রেনের বিনিময়ে নয়। যেকোনো শান্তি আলোচনায় ইউক্রেনকে যুক্ত করতে ইউরোপীয় নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাশিয়া ও ইউক্রেনবিষয়ক দূত কেইথ কেলগ ইউক্রেনের খনিজ সম্পদে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত চুক্তিতে সই করতে জেলেনস্কির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, এই চুক্তি সই করা ছাড়া মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে জেলেনস্কির সম্পর্ক আর এগোনোর সুযোগ নেই।
রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহযোগিতা ও নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে ইউরোপের নেতাদের এমন তৎপরতা শুরু হয় ২৮ ফেব্রুয়ারির পর। ওই দিন হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ট্রাম্প ও মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়ান জেলেনস্কি। ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা ও খনিজ সম্পদসংক্রান্ত চুক্তি সই ভেস্তে যায়। এর জেরে ইউক্রেনে মার্কিন সহায়তা স্থগিত করে ট্রাম্প প্রশাসন।
‘রি-আর্ম ইউরোপ’ পরিকল্পনা
ইউরোপের সামরিক সক্ষমতা জোরদারে ‘রি-আর্ম ইউরোপ’ নামে একটি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লিয়েন। এ পরিকল্পনার আওতায় জোটভূক্ত দেশগুলো প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে পারবে। প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগে ১৫০ বিলিয়ন ইউরো ঋণ দেওয়া হবে। পাশাপাশি অন্য কর্মসূচি থেকে তহবিল প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করতে পারবে দেশগুলো।
এদিকে ইউরোপের নিরাপত্তায় ফ্রান্সের পারমাণবিক সক্ষমতা ব্যবহার করার প্রস্তাব দিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখোঁ। তিনি বলেন, ইউরোপের মিত্রদেশগুলোর নিরাপত্তার জন্য ফ্রান্স তার পারমাণবিক অস্ত্রাগার ব্যবহারের বিষয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত। মাখোঁ বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের পাশে থাকবে। আর যদি তা না হয়, সে ক্ষেত্রেও আমাদের প্রস্তুতি রাখতে হবে।’
ট্রাম্প–জেলেনস্কি বাগ্বিতণ্ডার দুই দিন পর রোববার লন্ডনে সম্মেলনে বসেছিলেন ইউরোপের নেতারা। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের আহ্বানে ওই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছান তাঁরা। লন্ডন সম্মেলন থেকে যুদ্ধ বন্ধে চার দফা একটি পরিকল্পনাও তুলে ধরা হয়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বর দ দ ব ড় ইউর প র ন ন ইউর প র ইউক র ন র ইউর প য় আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
ভিসা ও প্রযুক্তি দিয়ে আসিয়ানে সংযোগ বাড়াচ্ছে চীন
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের সদস্যরা এখনও মধ্যম আয়ের ফাঁদে আটকা। এসব দেশে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ কম থাকায় গবেষণা ও উন্নয়নে তেমন অগ্রগতি নেই। প্রযুক্তির সীমিত বিস্তারের কারণে আজও এই অঞ্চলটি পেছনে পড়ে আছে। শিল্প খাতে অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও নিম্নমানের শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি মানবসম্পদ উন্নয়নেও অঞ্চলটি পিছিয়ে।
প্রতিরক্ষা খাত দুর্বল হওয়ায় পরিবর্তিত ঝুঁকি ও হুমকির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহস নেই দেশগুলোর। এ কারণে মিয়ানমার সংকটে শক্তিশালী কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছে না জোটটি। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ বহিরাগত শক্তি এই অঞ্চলে ক্রমশ জেঁকে বসছে। বিশেষ করে চীন বিনিয়োগের পাশাপাশি ভিসা ও প্রযুক্তির ব্যবহার করে আসিয়ানে সংযোগ বাড়াচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমার সংকট নিয়ে আসিয়ান এখনও বিভক্ত। একদিকে চীনের প্রভাব আসিয়ানকে মিয়ানমারে পদক্ষেপ নিতে বাধা দিচ্ছে, অন্যদিকে বহিরাগত শক্তির ওপর নির্ভরতা নিজেদের সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করছে। আঞ্চলিক নেতৃত্ব এবং ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক দৃশ্যপটে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা না রাখায় মিয়ানমার সংকট গভীর হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এই অঞ্চল ঘিরে চীন প্রতিরক্ষাসহ নানা খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। থেমে নেই যুক্তরাষ্ট্রও। উৎপাদন ও প্রযুক্তি খাতে যথেষ্ট উন্নতি না করতে পারায় দেশগুলো সামনের দিকে অগ্রসর হতে বাধা পাচ্ছে।
শক্তিশালী শাসনব্যবস্থার অভাবে তারা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। এই অবস্থায় এই অঞ্চলে অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
আসিয়ানের সদস্য দেশগুলো হলো- ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম।
১০ দেশের এই জোটটির লক্ষ্য দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। আসিয়ানে গড় মাথাপিছু আয় প্রায় ৫ হাজার ৩০০ ডলার এবং দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলার।
আসিয়ান কোন দিকে ঝুঁকছে, যুক্তরাষ্ট্র না চীন- এই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ নিক্কেই এশিয়ায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, দেশগুলোর উচিত বেইজিংয়ের প্রবৃদ্ধি থেকে লাভবান হওয়া। তিনি ভারতের সঙ্গেও বাণিজ্য বৃদ্ধির ওপর জোর দেন।
অন্যদিকে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কলিন্স চং ইউ কিট মনে করেন, আত্মরক্ষার নিজস্ব শক্তি ও ক্ষমতা অর্জন না করা পর্যন্ত আসিয়ান দেশগুলোকে মার্কিন নিরাপত্তার ছাতার তলেই থাকতে হবে।
অধ্যাপক কলিন্স ইউরেশিয়া রিভিউকে বলেন, গত কয়েক দশক ধরে আসিয়ান দেশগুলো নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের ওপর নির্ভর করেছে। হঠাৎ করে চীন এই অবস্থানে যেতে পারবে না। আসিয়ান দেশগুলো এটা ভালো করেই জানে। যদিও বেইজিংকে এই অঞ্চলের প্রধান অর্থনৈতিক বিকল্প ও সম্পদের প্রধান সরবরাহকারী হিসেবে দেখা হয়।
গালফ নিউজের সিনিয়র বিশ্লেষক বলরাম মেনন মনে করেন, অনেক বছর ধরে আসিয়ানসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো বাণিজ্যে স্থিতিশীলতা রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে আসছে। অঞ্চলটিতে যুক্তরাষ্ট্র ভোক্তা বাজার সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। তাছাড়া প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বিনিয়োগও বাড়াতে চায় ওয়াশিংটন।
থাইল্যান্ডের মাহিদোল ইউনিভার্সিটি ইন্টারন্যাশনাল কলেজের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক উইলিয়াম জে জোন্স মনে করেন, আসিয়ান রাষ্ট্রগুলোকে বহিরাগত শক্তির কাছে ঐক্যবদ্ধ বিশ্বাসযোগ্যতা প্রদর্শন করতে ইচ্ছুক হতে হবে। ট্রাম্পের বৈদেশিক নীতির পরিবর্তনের প্রভাব পড়বে পূর্ব এশিয়াও। এজন্য আসিয়ানকে বাস্তবসম্মতভাবে একটি ঐক্যফ্রন্ট উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
আসিয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করছে চীন
ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা ও ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে আসিয়ান ও চীনের মধ্যে সহযোগিতার গভীরতা আগের চেয়ে বেড়েছে। চীন দেশগুলোর সঙ্গে সখ্য গড়তে কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহারকে গুরুত্ব দিচ্ছে। দেশগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা চীনকে এআই প্রযুক্তি কাজে লাগাতে পরামর্শ দিয়েছেন।
এছাড়া চীন আঞ্চলিক সংযোগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য চালু করেছে ‘আসিয়ান ভিসা’। আন্তঃসীমান্ত ভ্রমণ এবং আঞ্চলিক একীকরণে এটি চীনের বড় পদক্ষেপ।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান মনে করেন, নতুন ভিসা সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে বিদ্যমান পারস্পরিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করবে।
গত ২৭ মে কুয়ালালামপুরে হয়ে গেল আসিয়ান-চীন-জিসিসি (উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ) শীর্ষ সম্মেলন। তিনটি পক্ষ তাদের নিজ বাজারকে সংযুক্ত করার মাধ্যমে বিশাল অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ উন্মোচন করতে পারে। তিন পক্ষের সম্মিলিত শক্তি বিশ্ব অর্থনৈতিক দৃশ্যপটকে নতুন রূপ দিতে পারে।
ক্ষমতার আধিপত্য বজায় রেখেছে ওয়াশিংটন
অধ্যাপক কলিন্স চং ইউ কিট মনে করেন, আসিয়ানে প্রযুক্তিগত আধিপত্যসহ অর্থনৈতিক ও সামরিক খাতে আগামী ৫০ বছর ওয়াশিংটন প্রধান ভূমিকায় থাকবে। এই সময়ের মধ্যে দেশগুলোতে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক বিভাজন ঘটতে পারে। ফলে বিনিয়োগ, প্রযুক্তি এবং নিরাপত্তার জন্য তারা বিদেশি শক্তির ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এসব ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই সুবিধা নেবে যুক্তরাষ্ট্র।
কঠোর নিরপেক্ষতা থাকা সত্ত্বেও আসিয়ান দেশগুলো প্রায় নিশ্চিতভাবেই নতুন সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে বলেও মনে করেন কলিন্স চং। তিনি বলেন, দক্ষিণ চীন সাগর ও তাইওয়ান কেন্ত্রিক এই সংঘাত শুরু হতে পারে। এই সংঘাতে ওয়াশিংটন যুক্ত হয়ে পড়লে দক্ষিণ চীন সাগরে চীন বেকায়দায় পড়বে। ফলে আসিয়ান দেশগুলোর মধ্যে আরও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা থাকবে।
সূত্র: গালফ নিউজ, ইউরেশিয়া রিভিউ, ইস্ট এশিয়া ফোরাম