ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় সন্তোষপুরের রুক্ষ-বিরান রাবার বাগান। সেই কাঁকডাকা ভোর থেকে সেখানে ঝরেপড়া পাতায় জীবিকা খুঁটতে নেমে এসেছেন একদল নারী। রাবার গাছের ঝরাপাতা খুঁটেই তাদের জোগাড় হয় দুই বেলা আহারের। পঞ্চাশোর্ধ্ব দুই সন্তানের জননী আম্বিয়া খাতুন। ঘরে অসুস্থ স্বামীকে রেখে টাঙ্গাইলের মধুপুরের জিগলবাইদ গ্রাম থেকে রোজ সন্তোষপুর রাবার বাগানে কাজে আসেন সেই ভোরে, কাজ শেষে ফেরেন সন্ধ্যায়। আম্বিয়ার স্বামীর নাম এহসান পাগলা; মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ অবস্থায় পড়ে আছেন ঘরে। জীবনে হাড়ভাঙা খাটুনিতে যেটুকু সঞ্চয় ছিল তা দিয়েই দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। আম্বিয়ার শরীরেও বাসা বেঁধেছে নানা রোগ। দূরের সমান্তরাল ধেয়ে যাওয়া পথটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘সুখ আর পাইলাম না জীবনে। বাপ নাই, মা নাই, ঘর নাই, জমি নাই। থাহি পরের জায়গাত। সারাদিন পাতা হুইরা পাই ২৫০; কুনু দিন আবার ৩০০ টেকা। একদিন কাম করলে দুই দিন পারি না। স্বামীডার অসুখ। এই টেকায় সদাই কিনুম, ওষুধ কিনুম নাকি নিজে একটু ভালাবুড়া কিনা খামু কন দেহি?’
রহিমার দুই ছেলে, স্বামী ভেনগাড়ি চালান। একার রোজগারে সংসার চলে না বলেই পাতা কুড়াতে এসেছেন তিনি। এক ছেলে কলেজে পড়েন আরেক ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতি মাসে ছেলেদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতেই এই মায়ের হাড়ভাঙা খাটুনি।
আম্বিয়া, রহিমার মতো অন্যরাও কুলুর বলদ হয়ে ঘানি টানছেন সংসারের। তবে দিনশেষে এই মজুরিতে নুন আনতেই পান্তা ফুরায় আম্বিয়াদের। ১ হাজার ৬৫ একরের রাবার বাগানে মৌসুমে অন্তত ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার কর্মসংস্থান হয় শুকনা পাতা ঝাড়ু দিয়ে; যা গেরস্তরা ব্যবহার করেন আবাদি আনারস, হলুদের ফসলের ঢাক হিসেবে। সন্তোষপুর রাবার বাগানের সুপারভাইজার নাছির উদ্দীন জানান, ‘এই বাগানে প্রচুর শুকনা পাতা ঝরে এই সময়টাতে, পাতা ঝাড়ু দিতে গিয়ে কর্মসংস্থান হয় এই এলাকার কয়েকশ নারীর। আশপাশের গেরস্তরা তাদের দিয়ে পাতা ঝাড়ু দিয়ে টাকা দেন দিনপ্রতি চুক্তি হিসেবে। আমাদের বাগানও পরিষ্কার হয়, তবে তাদের মজুরিটা একেবারেই কম দেন গেরস্তরা।’
১৭ বছরের কিশোরী সেলিনা বিশ্বাস অভাবের তাড়নায় রাজশাহীর প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে স্বামী স্বপনকে নিয়ে কাজের সন্ধানে আসেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় বুড়ার বাজার এলাকায়। পুরুষের সঙ্গে সমান তালে কাজ করলেও, মজুরি জোটে মাত্র দুই থেকে আড়াইশ টাকা।
সেলিনা বলেন, ‘খুব কম বয়সে বাপমায় বিয়া দিয়া দেয় আমারে, দেশে মেলা অভাব, কাম নাই। তাই জামাইকে সাথে নিয়া এই দেশে আইছি। আইয়াতো দেখি ওমা সারাদিন হলুদ খেতে কাম করাইয়া দেয় মাত্র ২৫০ টেকা। কত আশা আছিলো। পোলাপানগরে লেখাপড়া করামু, ভালো একটা থাকার ঘর বানামু, কিছুই হইলো না।’
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার এই জনপদের কৃষি অর্থনীতিতে গ্রামীণ নারীদের মজুরি পুরুষের অর্ধেকেরও কম। কলা, আনারস, হলুদ, পাতা ঝাড়ু দেওয়াসহ কৃষিতে মজুরি খেটে জীবন চলে এই উপজেলার নাওগাঁও, রাঙ্গামাটিয়া, কালদহসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের বহু নারীর। সরকারি বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা থেকেও বঞ্চিত এ জনপদের নারীসমাজ।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আম ব য়
এছাড়াও পড়ুন:
জমিজমার বিরোধে থানায় সালিসে গিয়ে ‘রাজনৈতিক মামলায়’ গ্রেপ্তার যুবক
জমিজমা–সংক্রান্ত বিরোধে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানায় সালিসে আসা এক যুবককে ‘রাজনৈতিক মামলায়’ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আজ দুপুরে ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ওই যুবকের মা আনারা বেগম এ কথা জানান।
গ্রেপ্তার ওই যুবকের নাম আল-আমিন (৩২)। তাঁর বাড়ি নগরের বলাশপুর এলাকায়। মায়ের দাবি, আল-আমিন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। সালিসে জমিজমার কাগজ ঠিক থাকায় সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে রাজি না হলে রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।
তবে পুলিশ বলছে, ওই যুবক যুবলীগের সমর্থক। তাঁকে গ্রেপ্তারে কয়েকবার বাড়িতে অভিযানও চালিয়েছে পুলিশ। থানায় তাঁকে পেয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যদিও গ্রেপ্তারের পর আদালতে পাঠানো প্রতিবেদনে তাঁকে নগরের কেওয়াটখালী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আল-আমিনের মা আনারা বেগম বলেন, ২০২১ সালে বলাশপুর এলাকায় স্বামীর পেনশনের ১৭ লাখ টাকায় ৩ দশমিক ৬০ শতাংশ জমি কেনেন তাঁরা। এর আগে ২০০৮ সালে একই দাগে ৪ শতাংশ জমি কেনার দাবি করে ২০২২ সালে জোরপূর্বক সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করেন এক ব্যক্তি। এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে সালিস হলেও কোনো সুরাহা হয়নি। ৫ আগস্টের পর সরকার পরিবর্তন হলে নিজের কেনা জমিতে বাড়ি করার উদ্যোগ নিলে বাধা হয়ে দাঁড়ান ওই ব্যক্তি ও তাঁর পক্ষের লোকজন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিষয়টি সমাধানের লক্ষ্যে কোতোয়ালি মডেল থানায় উভয় পক্ষকে ডাকা হয়। গত শনিবার রাত আটটায় থানায় সালিস শুরু হয়। চলে রাত ১২টা পর্যন্ত। সালিসে শেষ পর্যায়ে যখন জমির কাগজপত্র তাঁদের ঠিক পান সালিসকারীরা, তখন ওসি আল-আমিনকে তাঁর কক্ষে নিয়ে পিটিয়ে হাড়গোড় ভেঙে ফেলার হুমকি দেন। পেছনে পেছনে তিনি গিয়ে প্রতিবাদ করলে তাঁর সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করা হয়। এরপর আল-আমিনকে গারদে ঢুকিয়ে সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। রাজি না হওয়ায় সাজানো রাজনৈতিক মামলায় তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।
আনারা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে কোনো রাজনীতি করে না। আমার ছেলে ব্যবসা করে। তাকে রাজনৈতিক মামলায় পুলিশ কারাগারে পাঠিয়েছে।’
২৭ জুলাই আল-আমিনকে আদালতে পাঠানোর প্রতিবেদনে পুলিশ উল্লেখ করে, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাত ১টা ৩৫ মিনিটে পুলিশের টহল দল নগরের আকুয়া ভাঙ্গাপুল এলাকায় অবস্থানকালে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারে যে সদরের উত্তর দাপুনিয়ার সরকারি পুকুরপাড় সেলফি নামের স্থানে পাকা রাস্তার ওপর একদল সন্ত্রাসী জনতাবদ্ধ হয়ে রাস্তা বন্ধ করে গাড়ি ভাঙচুর ও দাঙ্গাহাঙ্গামা সৃষ্টি করে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে ৫টি মশাল, ২০টি লাঠি, ৩০টি ইটের টুকরা, ২৫টি কাচের টুকরা জব্দ করা হয়। এ ঘটনার পরদিন পুলিশ কোতোয়ালি মডেল থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় আল-আমিনকে সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে ২৬ জুলাই রাত ১১টা ৪০ মিনিটে নগরের কেওয়াটখালী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। প্রতিবেদনে পুলিশ আল-আমিনকে যুবলীগের সমর্থক হিসেবে উল্লেখ করে।
থানার ওই সালিসে থাকা মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি মো. বাবু বলেন, থানা চত্বরের একটি ঘরে এসআই সজীব কোচের উপস্থিতিতে দুই পক্ষের কাগজপত্র বোঝেন, এমন লোকজন নিয়ে সালিস শুরু হয়। একপর্যায়ে আল-আমিনকে ‘ফ্যাসিস্ট’ আখ্যায়িত করে গ্রেপ্তারের দাবি জানান প্রতিপক্ষের লোকজন। পরে তাঁকে থানা থেকেই গ্রেপ্তার করা হয়।
জানতে চাইলে কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ শিবিরুল ইসলাম বলেন, ‘১০ দিন আগে থেকে দারোগারা তাঁকে (আল-আমিন) ধরার জন্য খুঁজতেছে। ডেভিল হান্টের আসামি সে। আমাদের দুই দারোগা ছয় থেকে সাতবার তাঁর বাড়িতে রেড দিছে। সে যুবলীগের ফ্যাসিস্ট। মামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তদন্তে প্রাপ্ত আসামি।’ ওসি বলেন, কোনো কাগজপত্র দিয়ে নোটিশ করে তাঁকে থানায় ডাকা হয়নি। বিচারক যদি মনে করে আমরা তাঁকে ইলিগ্যাল অ্যারেস্ট করেছি, তাহলে আদালত ফাইন্ডিংস দেবেন। আসামিকে থানা থেকে গ্রেপ্তার করা কী নিষেধ আছে?’ আদালতের প্রতিবেদনে ভিন্ন স্থান দেখানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জজ এটার বিচার করবে। যদি এমন কইরা থাকে, সমস্যা কী?’