অষ্টম শ্রেণিতে পডুয়া ছেলের জন্য ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র মডেল বই কিনতে কিশোরগঞ্জের ভৈরব শহরের একটি বইয়ের দোকানে যান মুদিদোকানের কর্মচারী কামাল হোসেন। চাইতেই স্বল্প আয়ের মানুষটিকে ধরিয়ে দেওয়া হলো দুটি বইয়ের একটি প্যাকেট। প্যাকেটে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পাশাপাশি আছে বাংলা দ্বিতীয় পত্র গাইড বই। বই দুটির দাম ১ হাজার ৬০ টাকা।

কামাল বলেন, বাংলা দ্বিতীয় পত্র বইয়ের প্রয়োজন নেই বলতেই পুস্তক বিক্রয় কর্মচারী সাফ জানিয়ে দেন, শুধু একটা দেওয়া হবে না। অন্য দোকানে গিয়েও একই কথা শুনতে হয়েছে। শেষে সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বাধ্য হয়ে চাওয়া মূল্য পরিশোধ করে জোড়া বই কিনতে হলো। কামাল থাকেন হাজী আসমত কলেজ সড়ক এলাকায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভৈরবে মাধ্যমিকের সব কটি শ্রেণিতে বাংলা দ্বিতীয় পত্র ছাড়া যেমন ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র কেনা যাচ্ছে না। তেমনি ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র ছাড়া বাংলা দ্বিতীয় পত্র কেনার সুযোগ রাখা হয়নি। অধিক মুনাফার আশায় প্রকাশকেরা জোটবদ্ধ হয়ে ভৈরবের শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে বাধাহীন গাইড–বাণিজ্য করছে। জোড়া গাইড বিক্রির এই নিয়ম চার বছর ধরে চলছে। কাজটা ঠিক হচ্ছে না—স্বীকার করলেও দায় নিতে রাজি নন স্থানীয় পুস্তক বিক্রেতারা। আর প্রকাশনাগুলোর মাঠকর্মীরা বাস্তবতার প্রসঙ্গ সামনে আনছেন। কিছুই জানেন না ভাব স্কুল কর্তৃপক্ষের, আর এমনটা হওয়ার কথা নয়—বলছেন সরকারি কর্মকর্তারা।

বই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানা গেছে, এবার বোর্ডের বই ছাপায় দেরি হয়েছে।বাজারে এখন নবম শ্রেণির গাইড ছাড়া অন্য শ্রেণির একাধিক প্রকাশনার সব বিষয়ের গাইড রয়েছে। বাংলা ও ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র মডেল গাইড এক সপ্তাহ আগে থেকে বাজারে আসতে শুরু করে। অন্য বিষয়ের গাইড পৃথকভাবে কেনায় বাধা নেই। কেবল বাংলা ও ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র মডেল গাইড একসঙ্গে প্যাকেট করে পাঠানো হয়। মোট মূল্য থেকে ক্রেতাদের কেবল ৫ শতাংশ ছাড় দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। জোড়া গাইডের মধ্যে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র গাইড কেনায়। কারণ, বোর্ড বইয়ের বাংলা দ্বিতীয় পত্র পড়লেই হয়। গাইড না কিনলেও সমস্যা নেই। এ ক্ষেত্রে উল্টো চিত্র ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের বোর্ড বইয়ের। ফলে শিক্ষার্থীদের যত আগ্রহ ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র গাইড নিয়ে। প্রকাশনাগুলো এটা জেনে ইংরেজির সঙ্গে বাংলা দ্বিতীয় পত্র যুক্ত করেছে, যাতে অবিক্রীত না থাকে।

ভৈরবে মাধ্যমিকের সব কটি শ্রেণিতে বাংলা দ্বিতীয় পত্র ছাড়া যেমন ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র কেনা যাচ্ছে না। তেমনি ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র ছাড়া বাংলা দ্বিতীয় পত্র কেনার সুযোগ রাখা হয়নি। অধিক মুনাফার আশায় প্রকাশকেরা জোটবদ্ধ হয়ে ভৈরবের শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে বাধাহীন গাইড–বাণিজ্য করছে। জোড়া গাইড বিক্রির এই নিয়ম চার বছর ধরে চলছে।

গতকাল সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টায় কলেজ রোডে অবস্থিত পুস্তক বিক্রয় প্রতিষ্ঠান বর্ণমালায় গিয়ে দেখা যায়, লেকচার প্রকাশনীর দশম শ্রেণির জোড়া গাইড ৮৪০ টাকা, অষ্টম শ্রেণির ১ হাজার ৬০ টাকা, সপ্তম শ্রেণির ৯৩৫ ও ষষ্ঠ শ্রেণির ৮৬০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। পাঞ্জেরী প্রকাশনীর দশম শ্রেণির জোড়া বই বিক্রি হচ্ছে ৮৫০, অষ্টম শ্রেণির ১ হাজার ১৬, সপ্তম শ্রেণির ১ হাজার টাকা ও ষষ্ঠ শ্রেণির ৯৪০ টাকায়। আরও কয়েকটিতে প্রকাশনার গাইড একই মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। অভিভাবকদের কেউ কেউ একটি গাইড চাচ্ছেন। কিন্তু বিক্রেতারা অপারগতা প্রকাশ করছেন।

জানতে চাইলে বর্ণমালা লাইব্রেরির স্বত্বাধিকারী জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘যা হচ্ছে, মোটেও ঠিক না। এভাবে অভিভাবকদের জিম্মি করা অন্যায়। কিন্তু আমরা প্রকাশনীদের কাছে অসহায়। প্রতিনিয়ত অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এ নিয়ে ভুল–বোঝাবুঝি হচ্ছে। এ তথ্য আমরা প্রকাশনী কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি।’

এভাবে অভিভাবকদের জিম্মি করা অন্যায়। কিন্তু আমরা প্রকাশনীদের কাছে অসহায়। প্রতিনিয়ত অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এ নিয়ে ভুল–বোঝাবুঝি হচ্ছে।জহিরুল ইসলাম, বই বিক্রেতা

জোড়া গাইড বই বিক্রির কারণ জানতে মুঠোফোনে কথা হয় লেকচার প্রকাশনীর ভৈরব এরিয়ার বিক্রয় প্রতিনিধি জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আসলে এটি আমাদের কোম্পানির পলিসি।’ এই পলিসির কারণ জানা নেই বলে জানান তিনি। মুঠোফোনে পাঞ্জেরী প্রকাশনী ভৈরব এরিয়ার বিক্রয় প্রতিনিধি আবু বক্কর প্রথমে অভিযোগ অস্বীকার করেন। পরে বলেন, ‘আগে করতাম, এখন করি না।’ শেষে বলেন, ‘আসলে অন্য প্রকাশনীরা করে, আমরাও করছি।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক পুস্তক ব্যবসায়ী ও প্রকাশনীর বিক্রয় প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, জোড়া গাইড বিক্রির মূল কারণ কোনো কোনো স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিবেচনায় রেখে মোটা অঙ্কের কমিশন–বাণিজ্য। ভৈরবে এবার কোনো কোনো স্কুলকে এক লাখ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত কমিশন দিতে হয়েছে। আবার কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কমিশন নেয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক পুস্তক ব্যবসায়ী ও প্রকাশনীর বিক্রয় প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, জোড়া গাইড বিক্রির মূল কারণ কোনো কোনো স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিবেচনায় রেখে মোটা অঙ্কের কমিশন–বাণিজ্য। ভৈরবে এবার কোনো কোনো স্কুলকে এক লাখ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত কমিশন দিতে হয়েছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ে উচ্চবিদ্যালয় ভৈরবের প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি। স্কুলটির মাধ্যমিক বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ৩০০। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে, স্কুল থেকে এবার তাদের লেকচার প্রকাশনীর গাইড কিনতে বলা হয়েছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোক্তার হোসেন জানান, জোড়া গাইড কিনতে বাধ্য করার বিষয়টি তিনি আগে শোনেননি। লেকচার গাইড কিনতে বলার কথা স্বীকার করলেও এর বিনিময়ে প্রকাশনী থেকে আর্থিক সুযোগ গ্রহণের কথা অস্বীকার করেন তিনি।

কমলপুর হাজী জহির উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ১ হাজার ১০০। প্রধান শিক্ষক সাফায়েত হোসেন জানান, জোড়া গাইড বিক্রির বিষয়ে তাঁর কাছে কোনো তথ্য নেই। তবে এমনটা হলে দুঃখজনক। তাঁর প্রতিষ্ঠানও প্রকাশনীর কাছ থেকে আর্থিক লেনদেনের দূরে ছিলেন বলে দাবি করেন তিনি।

আর হতে দেওয়া হবে না। গাইড বিক্রির নিয়ম নেই।আবুল হোসেন, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা

ভৈরবের পুস্তক ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করে ভৈরব পুস্তক সমিতি। এ সমিতির সভাপতি আসাদুজ্জামান। জোড়া গাইড বিক্রির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জুলুম করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রকাশনীতে প্রায় প্রতিদিন অভিযোগ করে যাচ্ছি। লাভ হচ্ছে না। এর পেছনে অন্য কোনো গোপন কারণ থাকতে পারে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পদাধিকারবলে ভৈরবের সব কটি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির দায়িত্ব পান। নিজ দপ্তরের প্রশাসনিক কাজ শেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে শিক্ষা–সম্পর্কিত অনেক দুর্নীতি আগের মতো বহাল থাকলেও উপজেলা প্রশাসনের নজরে আসছে না।

জানতে চাইলে ইউএনও শবনম শারমিন বলেন, ‘এ হতে পারে না। প্রতিকারে দ্রুত মাঠে নামব।’ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল হোসেন জোড়া গাইড কেনার রীতি জেনে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘এ হতে পারে না।’ চার বছর ধরে হচ্ছে জানালে তিনি বলেন, ‘আর হতে দেওয়া হবে না। গাইড বিক্রির নিয়ম নেই।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর মকর ত ব ক র কর ব যবস য় ভ রব র উপজ ল র একট বইয় র

এছাড়াও পড়ুন:

কার্টুন, মিমে অভ্যুত্থানের ভিন্ন ধারার দৃশ্যায়ন

টাকার বস্তার ভেতর থেকে মাথা উঁচিয়ে আছেন শুভ্র কেশ, সফেদ দাড়ি, চশমা পরিহিত এক লোক। তাঁর ছবি দেখে তো বটেই, এই বর্ণনা থেকেও তাঁকে চিনবেন দেশবাসী। বর্তমানে কারাগারের বাসিন্দা পতিত স্বৈরশাসকের এই উপদেষ্টা বলছেন, ‘টাকার ওপর আমার বিশ্বাস উঠে গেছে।’ এই ছবির পাশেই এক কাটআউট। সেখানে ‘শেখ হাসিনা পালায় না’ বলতে বলতে দৌড়ে পালাচ্ছেন ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার মসনদ থেকে উৎপাটিত শেখ হাসিনা।

এমন মজার মজার কার্টুন, মিম, গ্রাফিতি, ভিডিও স্থাপনাকর্মসহ বৈচিত্র্যময় সৃজনসম্ভার নিয়ে শুরু হয়েছে ‘বিদ্রূপে বিদ্রোহ’ নামের ব্যতিক্রমী এক প্রদর্শনী। আয়োজন করেছে অনলাইনভিত্তিক স্যাটায়ার সাময়িকী ‘ইয়ারকি’। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দিনের এ প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। চলবে ৫ আগস্ট পর্যন্ত। সবার জন্য প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা।

গত বছর ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল ছিল জুলাই। একটি বৈষম্যহীন, উদার গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য পথে নেমেছিলেন অগণিত মানুষ। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারকে উৎখাত করতে জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদের অনেকে। আহত হয়েছেন বেশুমার। রক্তরঞ্জিত রাজপথ বেয়ে এসেছে জনতার বিজয়।

প্রদর্শনীতে প্রবেশপথটির দুই পাশে লাল রঙের পটভূমিতে বড় বড় ডিজিটাল পোস্টার। সেখানে ২ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিনের বিভিন্ন ঘটনার আলোকচিত্র, সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল, টেলিভিশনের রিপোর্ট, ছবি, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের পোস্ট—এসব তুলে আনা হয়েছে এ পোস্টারগুলোতে। প্রবেশপথটিও লাল রঙের। ‘জুলাই করিডর’ নামে এই রক্তিম পথটি বেয়ে দর্শনার্থীরা প্রদর্শনীতে প্রবেশের সময় অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোর উত্তাপ ফিরে পাবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ