নারীবান্ধব সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বিকল্প নেই
Published: 11th, March 2025 GMT
দেশে যেন ধর্ষণের মহামারি লেগেছে। পত্রিকার পাতা ওল্টালেই ধর্ষণের খবর চোখে পড়ছে। সোমবার প্রকাশিত সমকালের খবর– দেশে ২০২৪ সালে ৫১৬ কন্যাশিশু ও নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আর ২০২৫ সালের প্রথম দুই মাসেই (জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি) ৯৭ কন্যাশিশু ও নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এ বিষয়ে যেসব তথ্য এসেছে, তা গা শিউরে ওঠার মতো। মাগুরার ৮ বছরের শিশু তার বাবার বয়সী এক নরপশুর ধর্ষণের শিকার হয়ে এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। ধর্ষণের শিকার ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার ৪ বছরের শিশুটি জেলা হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে এখনও ব্যথায় কাতর। ফরিদপুর সদর উপজেলার কানাইপুর গ্রামের সাড়ে ৪ বছরের শিশুটিও জেলা হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। এক নরাধম তাকে সাইকেলে চড়ানোর কথা বলে পাশের এক মেহগনি বাগানে নিয়ে ধর্ষণ করে। রাজধানীর রামপুরায় এক বাবা ধর্ষণ করেছে তার নিজের ঔরসজাত কন্যাকে। এমন আরও কত! গাজীপুরের মাওনা এলাকার বাগে জান্নাত নূরানীয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক তারই ছাত্রীকে ধর্ষণ করতে গিয়ে ধরা পড়ে এখন জেলে। হুজুর অবশ্য সব দোষ অদৃশ্য শয়তানের ওপর চাপিয়ে দিয়ে বলেছে, শয়তানই নাকি তাকে দিয়ে এ কাজ করিয়েছিল। এ জাতীয় ঘটনার তালিকা আরও লম্বা করা যায়, কিন্তু অপরাধের প্রকৃতি ও গভীরতা বুঝতে এটুকুই যথেষ্ট।
ধর্ষণের ঘটনা এদেশে বরারবই উদ্বেগজনক মাত্রায় ছিল। সাম্প্রতিক সময়ের মতো এ বিষয়ে উদ্বেগ জনপরিসরে বিশেষত নিকট-অতীতে এতটা তীব্র ছিল না। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে– কেন এমনটি হচ্ছে। বিষয়টি পেশাদার সমাজবিজ্ঞানীদের জন্য প্রভূত গবেষণার খোরাক জোগাবে, সন্দেহ নেই। সাদামাটা চোখে এ কথা বলা যেতেই পারে, সমাজে মূল্যবোধের ভয়াবহ রকম অবক্ষয় নেমে এসেছে। না হয়, একজন জন্মদাতা পিতা কেমন করে তার ঔরসজাত সন্তানের ওপর উপগত হতে পারে, কিংবা একজন পিতৃপ্রতিম শিক্ষক তার সন্তানসম ছাত্রীর কাপড় খুলে নিতে পারে– ভাবনাতেই আসে না। তাহলে কি আমরা এক অন্ধকার গহ্বরের দিকে এগিয়ে চলেছি? গত ক’দিনের পত্রপত্রিকার খবর দেখে তো তা-ই মনে হয়।
কেউ যদি বলেন, যা ঘটছে তা লক্ষণ মাত্র; ব্যাধি নয়; তাহলেও হয়তো ভুল হবে না। আর বহু আগে জন্ম নেওয়া ব্যাধিটা ইতোমধ্যে সমাজের অনেক গভীরে ছড়িয়ে পড়েছে, ঠিক ক্যান্সারের মতো। সমাজের বৃহত্তর অংশের কাছে নারী নিছক একটা ভোগের সামগ্রী বৈ কিছু নয়। এটি এমনই এক সমাজ, যেখানে প্রকাশ্যে প্রচার করা হয়– নারীকে স্রষ্টা সৃষ্টিই করেছেন পুরুষের ভোগের জন্য। অতএব পুরুষের অধিকার রয়েছে নারীকে যেভাবে খুশি ভোগ ও ব্যবহার করার। এমন ফতোয়া দেওয়া হচ্ছে– বৈধ পুরুষ সঙ্গী ছাড়া বাইরে আসা কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হলে দোষ ওই নারীরই হবে! আবার সমাজের আধুনিক দাবিদার অংশেও পণ্যের বিজ্ঞাপন ও নানা অনুষ্ঠানে নারীকে ভোগ্যপণ্যরূপেই তুলে ধরা হয়। দুর্ভাগ্যবশত, এসবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক কোনো পদক্ষেপ বা প্রতিবাদ দেখা যায় না।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, ধর্ষণ একটি মানসিক ব্যাধি। অবশ্যই এটি একটি ব্যাধি। যারা ধর্ষণের মতো ভয়াবহ কাজ করে বা করতে পারে, নিঃসন্দেহে তারা মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত। বিষয়টি যত না ব্যক্তিগত, তার চেয়ে অনেক বেশি সামাজিক। কারণ, দিনশেষে সবাই আমরা সমাজের সন্তান। তাই আচার-আচরণে সমাজের প্রভাব কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব। রুগ্ণ সমাজ রুগ্ণ মানুষেরই জন্ম দেয়। আমরাও এক রুগ্ণ সমাজে বাস করছি। ক্রমে সমাজের রুগ্ণতা আমাদের মনন ও মজ্জায় ছড়িয়ে পড়ছে। অধিকাংশই তা বুঝতে পারছেন না। যারা পারছেন, তারাও অসহায়ের মতো নিজেকে সমাজের কাছে সমর্পণ করে বসে আছেন। ফলে ব্যাধিটা বাড়ছেই।
আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে দেশে যে বিশাল অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু অবকাঠামোর সঙ্গে যে সামাজিক উন্নয়নের প্রয়োজন ছিল, তারা তা করেনি। এই না-করাটাও ছিল স্বাভাবিক। কারণ কোনো বুর্জোয়া দলই সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না। সমাজ যত রুগ্ণ থাকে, বুর্জোয়াদের শাসন টিকিয়ে রাখা ততই সহজ হয়। বুর্জোয়া পুঁজিবাদী শাসন তাই সমাজ নিয়ে ভাবতে চায় না; ব্যক্তি নিয়ে ভাবে। ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় সমাজ থেকে। এটাই পুঁজির ধর্ম। এখানেই সব ব্যাধির বীজ লুকোনো। ধর্ষণ-সংস্কৃতি তারই অনিবার্য পরিণতি। উন্নত পুঁজিবাদী সমাজে অবশ্য এমনটি দেখা যায় না। কারণটা শিক্ষা। শিক্ষা তাদের ব্যক্তিক বিকাশের উন্নততর স্তরে নিয়ে গেছে। আমরা সেখানে পৌঁছতে পারিনি। উন্নত দেশগুলোতে বিরাজমান আইনের শাসনও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, যা আমাদের দেশে প্রায় অনুপস্থিত। বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত আন্দোলনের চাপে এখানে ধর্ষণের বিরুদ্ধে কড়া আইন তৈরি হয়েছে বটে, সে আইনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে। এ জন্য একদিকে আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে নারী অধিকার সম্পর্কিত সচেতনতার অভাব এবং প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণার প্রাবল্যকে যেমন দায়ী করা যায়; অন্যদিকে ঔপনিবেশিক আমলের বিচার ব্যবস্থার ধারাবাহিকতাও কম দায়ী নয়।
অন্তত দুই দশক ধরে বাংলাদেশ মাদকের এক স্বর্গরাজ্যে রূপান্তরিত হয়েছে; আমরা সবাই তা জানি, কিছু বলি না। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে বিস্তৃত হয়েছে মাদক ব্যবসার রুট। এই সূত্র ধরে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম হয়ে উঠেছে মাদকের নিরাপদ হাব। বেকার, কর্মহীন যুবসমাজের একটি বড় অংশ এখন মাদকনির্ভর। কেউ কারবারি, কেউ ভোক্তা। কেউ কেউ রাতারাতি হয়ে উঠছে লাখোপতি। আবার কেউ সবকিছু হারিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন। শুধু যুবসমাজ নয়, মধ্যবয়সীরাও মাদকে ব্যাপক আক্রান্ত হচ্ছে। এই মাদকাসক্তদের একটি বড় অংশই বাস্তব কারণে যৌন বিকৃতিতে ভুগছে। ধর্ষণ তো যৌনতারই এক বিকৃত রূপ। আজ যখন আমরা ধর্ষণের বিরুদ্ধে কথা বলছি, এই বাস্তবতাকে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এই নারী-বৈরী রাষ্ট্র ও সমাজ পাল্টে দেওয়ার একটা সুযোগ তৈরি করেছিল। বিশেষত গত ৫৩ বছরে ক্ষমতাসীনদের ব্যর্থতায় তা কাজে লাগানো যায়নি। ইদানীং যা চলছে, তা এক প্রকার নারীবিরোধী প্রতিবিপ্লব। বিগত পাঁচ দশকে সংগ্রামের মাধ্যমে সংসারে ও বাইরে নারী তার নিজের জন্য যতটুকু পরিসর তৈরি করতে পেরেছে, তাও যেন সংকুচিত হতে চলেছে। আজকের ধর্ষণ মহামারিকে এই দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখতে হবে। একে ঠেকাতে হলে নারীবান্ধব সাংস্কৃতিক-সামাজিক বিপ্লবের কোনো বিকল্প নেই।
মোশতাক আহমেদ: জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: অবশ য
এছাড়াও পড়ুন:
বিস্ফোরক মামলায় চিন্ময় দাসকে কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ
চট্টগ্রামে বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলায় সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপত্র চিন্ময় দাসকে কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দিয়েছেন আদালত। পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আজ সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এস এম আলাউদ্দিন এ আদেশ দেন।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) মফিজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারে থাকা চিন্ময় দাসকে কোতোয়ালি থানার বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। শুনানি শেষে আদালত তা মঞ্জুর করেছেন।
গত বছরের ২৬ নভেম্বর সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপত্র চিন্ময় দাসের জামিনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের মধ্যে আইনজীবী সাইফুলকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ হত্যার ঘটনায় তাঁর বাবা জামাল উদ্দিন বাদী হয়ে ৩১ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা করেন। এ ছাড়া পুলিশের ওপর হামলা, কাজে বাধা এবং আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের ওপর হামলা ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় আরও পাঁচটি মামলা হয়। ৬টি মামলায় গ্রেপ্তার হন ৫১ জন। তাঁদের মধ্যে হত্যায় জড়িত অভিযোগে ২১ জন গ্রেপ্তার রয়েছেন।
আদালত সূত্র জানায়, সাইফুল হত্যার আসামিদের মধ্যে চন্দন দাস, রিপন দাস ও রাজীব ভট্টাচার্য আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এতে উল্লেখ করা হয়, আইনজীবীর ঘাড়ে বঁটি দিয়ে দুটি কোপ দেন রিপন দাস। আর কিরিচ দিয়ে কোপান চন্দন দাস। পরে রাস্তায় পড়ে থাকা সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট পরা এই আইনজীবীকে লাঠি, বাটাম, ইট, কিরিচ ও বঁটি দিয়ে তাঁরা ১৫ থেকে ২০ জন পিটিয়ে হত্যা করেন।
গত বছরের ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ খান বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় চিন্ময় দাসসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে জাতীয় পতাকা অবমাননায় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা করেন। পরে ফিরোজ খানকে বিএনপি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ মামলায় চিন্ময় দাসকে ২৫ নভেম্বর ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।