মনে আছে, ১৯৬১ সালের জুন মাস নাগাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে আমি ও নুরুল ইসলাম দুই অর্থনীতির বিষয়ে একটা সেমিনারের আয়োজন করি, যেখানে বক্তা ছিলাম আমি, নুরুল ইসলাম এবং পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের তৎকালীন ডেপুটি চিফ ড. হাবিবুর রহমান। আমার বিআইডিএস সহকর্মী সুলতান হাফিজ রহমানের বাবা ড. রহমান দুই অর্থনীতি থিমের ওপর বেশ কিছু দারুণ নিবন্ধ লিখেছিলেন, যেগুলো প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের উষ্মার কারণ হয়। সে কারণে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে আমাদের আয়োজিত এ রকম বিদগ্ধ আলোচনা চক্র ছাড়া অন্য কোথাও নিজের মতামত গণপ্রচারে তিনি অনিচ্ছুক ছিলেন।
এই সেমিনারে দুই অর্থনীতি বিষয়ে আমিও একটি নিবন্ধ পাঠ করি। নুরুল ইসলাম ও ড.
সে বছরের শেষ দিকে, অক্টোবর নাগাদ, বোধ হয় দ্য পাকিস্তান অবজারভার আমাকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসার কারণেই, ‘কীভাবে একটি সুসংগঠিত পাকিস্তান গড়ে তোলা যায়’ বিষয়ে বিএনআর আয়োজিত জাতীয় সেমিনারে আমাকে বক্তব্য রাখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি বিএনআরের পূর্বপরিচিত ছিলাম। সামরিক শাসক নিজেদের সংস্কারক ও দেশ নির্মাতা ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে যেসব নিবেদিত প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিল, বিএনআর ছিল তাদেরই একটি। যা–ই হোক, আইয়ুব তাঁর সরকারের রাজনীতিকরণে উদ্যোগী হলে বিএনআর বেশি করে রাজনৈতিক ভূমিকায় নামে। এর কারণ ছিল, নাগরিকদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ, যাদের বেশির ভাগকে বাঙালি বলে অনুমান করা হতো, তারা ইসলামিক পরিচয়ের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তান রাষ্ট্রের ধারণা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল বলে মনে করা হচ্ছিল। ভাবা হতো, এই বিচ্ছিন্নতা একটা মুষ্টিমেয়সংখ্যক বুদ্ধিজীবীর অপপ্রচারের ফলে তৈরি হচ্ছিল। এই দুষ্কর্ম সংশোধনে পাকিস্তান ভাবাদর্শ প্রচারে বিএনআর আরও বেশি করে সক্রিয় হয়ে ওঠে বিশেষ অনুমোদিত প্রকাশনার মাধ্যমে আর জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করে, যেখানে দুই প্রান্তের বুদ্ধিজীবীদের জড়ো করা হবে, যাতে তাঁরা পরস্পরকে আরও ভালো করে বুঝতে পারেন এবং সেই সঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রের যৌক্তিকতাও অনুধাবন করতে পারেন।
এদের বোধ হয় মনে হয়েছিল, রেহমান সোবহান বিপথগামী এক বুদ্ধিজীবীমাত্র, ঠিক বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দালাল নন; এবং এভাবেই তাঁকে আলাদা করে সরকারের অনুগত পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে আরও নিবিড় মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে জাতীয় সংহতি নির্মাণের কাজে ব্যবহার করা যাবে। সেমিনারের নামকরণের উদ্দেশ্য ছিল, আমার নিবন্ধ পরিধির সীমা বেঁধে দেওয়া যাতে আমি মূল বার্তা থেকে সরে যেতে না পারি। আমার নির্দিষ্ট সূচি ছিল ‘পাকিস্তানের জাতীয় অর্থনীতির অবিচ্ছিন্নতা’ বিষয়ে নিবন্ধ উপস্থাপন।
আমার লেখা পড়ে বিএনআর নিশ্চয়ই বিস্মিত হয়েছিল। আমি যুক্তি দেখিয়েছিলাম যে পাকিস্তানের সংহতি সবচেয়ে ভালো রক্ষিত হবে যদি এই রাষ্ট্র তার দুটি খণ্ডে নীতিনির্ধারণে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দেয়। এতে প্রতিটি অংশ নিজস্ব রাজস্ব আদায় ও রপ্তানি বাণিজ্যের আয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবে। সেই সময় অবধি দেশের অর্ধেকের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস ছিল পূর্ব পাকিস্তান।
সেমিনারের প্রাসঙ্গিক পর্বেই আমার উপস্থাপনা শেষ করেছিলাম এই মন্তব্য করে, যা আমার লিখিত একাডেমিক পেপারে ছিল না। যদি পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন না দেওয়া হয় এবং বছরের পর বছর যদি বৈষম্য বাড়তে থাকে, তাহলে এর ফলে ভবিষ্যতে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিপন্ন হবে এবং পাকিস্তানকে একটি সংগঠিত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে।
আমার বক্তব্য বিস্তার, বিশেষ করে পরিসমাপ্তি, যা লিখিত অংশের মধ্যে ছিল না, সেমিনারের মূল সুর থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন ছিল। অধিবেশনের সভাপতিত্ব করছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্টের যে বিচারক, তিনি আমার বন্ধু ইফতেখার বুখারিকে খুঁজে বের করেন। বুখারি আমার সঙ্গে ওই সেমিনারে এসেছিল। তার কাছে সভাপতি জানতে চেয়েছিলেন, আমি যুবকটি কে এবং আমি কি জানতাম না যে পাকিস্তানে তখনো সামরিক শাসন চলছে!
বিএনআর ও তার রাজনৈতিক প্রভুদের দুশ্চিন্তা ভীষণ বেড়ে যায় যখন তারা আবিষ্কার করে যে লাহোরে আমার বক্তৃতা, যেটা পশ্চিম পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম মূলত উপেক্ষা করেছিল, সেটাই ঢাকার প্রধান খবরের কাগজগুলোর প্রথম পাতায় বড় করে ছাপা হয়। দ্য পাকিস্তান অবজারভার তাদের ২৩ থেকে ২৫ অক্টোবর ১৯৬১ সংস্করণে আমার নিবন্ধ পুরোটা ছাপে। এই প্রচার সরকার ও তার গুপ্তচর সংস্থাগুলোর রাজনৈতিক রাডারের পর্দায় আমাকে তুলে আনে। কয়েক বছর পর পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের এক অর্থনীতিক ড. আনিসা ফারুকি, আমার সঙ্গে তাঁর ভালো আলাপ হয়েছিল যখন তিনি এলএসইতে পিএইচডি করছেন, তিনি আমাকে জানান যে এই সেমিনারে নিবন্ধ পাঠের পর আমার লেখা খুঁজে বের করে সেগুলোর যুক্তি খণ্ডনে প্ল্যানিং কমিশনের কিছু সদস্যকে নিযুক্ত পর্যন্ত করা হয়েছিল।
দুই অর্থনীতি ধারণার কথা উচ্চারিত হয়েছিল ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার একটি বেসরকারি রিপোর্টে, যেটি আওয়ামী লীগ জমানায়, যখন অনেক বেশি বাক্স্বাধীনতা ছিল, তখন পেশ করেছিলেন বাঙালি অর্থনীতিকেরা। অক্টোবর ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সালের মাঝামাঝি সামরিক শাসনের পর্যায়ে শিক্ষাবিদেরা বিতর্কিত বিষয়ে তাঁদের মতামত প্রকাশে অনেকখানি দমিত বোধ করতেন এবং সে সময় নিজস্ব মতামত প্রকাশে সেমিনার অথবা কেতাবি লেখালেখির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকাই তাঁদের বেশি পছন্দ ছিল।
(সংক্ষেপিত)
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক ন বন ধ প প রথম প র র জন র আয় জ হয় ছ ল আম র ব কর ছ ল সরক র রহম ন ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
প্রেমিকার বিয়ের দিনে প্রেমিকের লাশ উদ্ধার, হত্যার অভিযোগ পরিবারের
নড়াইলের লোহাগড়ায় প্রেমিকার বিয়ের দিনে প্রেমিক সৈয়দ মাসুম বিল্লাহর (২০) মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। মাসুমের বাম হাতের একটি আঙুলের নখ উপড়ে ফেলার আলামত থাকায় তার পরিবার অভিযোগ করছে, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
শুক্রবার (১ আগস্ট) দুপুরে কালনা মধুমতি সেতুর পশ্চিম পাশে রাস্তার ওপর মাসুমকে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে ইজিবাইকের চালক সুজন শেখ তাকে উদ্ধার করে লোহাগড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসেন। বিকেলে অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।
মাসুম বিল্লাহ লোহাগড়া উপজেলার শালনগর ইউনিয়নের মাকড়াইল গ্রামের মৃত সৈয়দ রকিবুল ইসলামের ছেলে।
আরো পড়ুন:
জুলাই হত্যাকাণ্ডের মামলায় চট্টগ্রামে প্রথম অভিযোগপত্র দাখিল
সিলেটে স্কুলছাত্র সুমেল হত্যা: ৮ জনের মৃত্যুদণ্ড, ৭ জনের যাবজ্জীবন
মাসুমের স্বজনরা জানিয়েছেন, শালনগর ইউনিয়নের এক কিশোরীর সঙ্গে মাসুমের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। মেয়েটির বিয়ের খবর পেয়ে শুক্রবার (১ আগস্ট) সকালে তিনি ঢাকা থেকে লোহাগড়ায় আসেন। সকালে পরিবারের সঙ্গে তার শেষবার কথা হয়, এরপর থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল।
মাসুম বিল্লাহর চাচা শরিফুল ইসলাম বলেছেন, “আমরা শুনেছি, সকালে লোহাগড়া বাজারের একটি পার্লারে মেয়েটির সঙ্গে মাসুমের কথা হয়। এর পর মেয়েটির বাবার কাছ থেকে হুমকি পায় সে। পরে হাসপাতাল থেকে ফোন পেয়ে মাসুমের মৃত্যুর খবর জানি। তার বাম হাতের নখ উপড়ানো ছিল। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।”
মাসুমকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া ইজিবাইক চালক সুজন বলেছেন, “ঘটনাস্থলে কোনো দুর্ঘটনার চিহ্ন ছিল না। তবে মনে হয়েছে, কেউ মাসুমকে গাড়ি থেকে ফেলে দিয়েছে।”
লোহাগড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শরিফুল ইসলাম শনিবার (২ আগস্ট) সকালে সাংবাদিকদের বলেছেন, “আমরা মাসুম বিল্লাহকে মৃত অবস্থায় লোহাগড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে থানায় নিয়ে আসি। মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য নড়াইল আধুনিক সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর আসল কারণ জানা যাবে।”
ঢাকা/শরিফুল/রফিক