বহু বছর ধরে অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণা দেখিয়েছে যে, রোজার সময় কর্মীদের উৎপাদনশীলতার ওপর কেমন প্রভাব পড়ে। যেহেতু এই সময় কর্মঘণ্টার পরিবর্তন হয় এবং কোথাও কোথাও কর্মঘণ্টা কমানোও হয়। প্রচলিত ধারণা হলো, রমজানে রোজা রাখার ফলে শক্তির অভাব বোধ হয় বলে উৎপাদনশীলতা কমে যায়। কিন্তু বেশ কিছু গবেষণা উল্টো ফলাফল দেখিয়েছে।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত কুয়েতের তিনজন গবেষক উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, এই সমস্যা মূলত রোজা রাখার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, বরং এটি কাজের পরিচালনার পদ্ধতি এবং সময় সুষম বণ্টনের ওপর নির্ভরশীল। গবেষকেরা কিছু উপায় দেখিয়েছেন, যাতে মালিক ও কর্মচারীদের সন্তোষ বজায় রাখা যায় এবং উৎপাদনশীলতা সাধারণ দিনের মতো থাকে। কুয়েতে বিভিন্ন শিল্পের ২০১ জন কর্মীর ওপর পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে গবেষকেরা বলেছেন যে, রোজা রাখার ফলে তাদের স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি, তবে মনোযোগে ঘাটতি দেখা গেছে।
আরও পড়ুনইফতারের দোয়া আরবি ও বাংলা উচ্চারণ, অর্থসহ০৩ মার্চ ২০২৫অন্য একটি গবেষণা দেখিয়েছে, রমজানে রোজার প্রভাবের বিষয়কে ‘স্পিড ট্রায়াল’ পরিমাপ করে দেখা গেছে যে, রোজা রাখার এবং না রাখার মধ্যে কর্মক্ষমতার কোনো তারতম্য হয়নি।
অনেকগুলো গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, রোজা রাখার নিজস্ব প্রভাব নেই, বরং কিছু অন্যান্য কারণ, যেমন দৈনন্দিন অভ্যাসের পরিবর্তন, যেমন দিনের বেলায় ক্যাফেইন বা অন্য উদ্দীপক খাবারের বন্ধ হওয়া, কিছু কর্মচারীর ছুটি নেওয়া, কর্মঘণ্টা কম হওয়া—এই সমস্তই কখনো কখনো উৎপাদনশীলতা বা শারীরিক, শৈল্পিক বা শিক্ষাগত কার্যক্ষমতা পরিবর্তন করে।
আরও পড়ুনযে কারণে রোজা ভেঙে যায়০৪ মার্চ ২০২৫রোজায় অলসতার অনুভূতির উৎস
রোজার প্রভাব নিয়ে ২০০২ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, রোজা রাখার ফলে শরীরের গঠন, রক্তের উপাদান এবং শারীরিক কর্মক্ষমতার ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি, তবে কিছু সামান্য পরিবর্তন দেখা গেছে, যেমন হার্ট এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের কিছু পরিবর্তন, যা জীববৈচিত্র্যের ঘড়ি পরিবর্তন হওয়ার কারণে হতে পারে।
চমকপ্রদ বিষয় হলো, কিছু গবেষণা বলছে যে, রমজানে বিশ্রামের অভাব এবং ঘুমের সমস্যা রোজার সমস্ত উপকারিতা নষ্ট করে দিতে পারে। এর ফলে শরীর অলস হয় এবং পেশাদারি ফলাফল ক্ষতিগ্রস্ত করে। অতিরিক্ত ক্যালরি খাওয়া হলে এবং রাতে পর্যাপ্ত ঘুম না পাওয়া গেলে অবস্থা আরও খারাপ হয়।
আরও পড়ুনরোজাদারের দিন কীভাবে কাটবে০২ মার্চ ২০২৫রমজানে অলসতা দূর করার উপায়
ইংল্যান্ডের কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম ছাত্রদের রমজানে অলসতা দূর করে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং ভালো পারফরম্যান্সের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছে। যেমন:
১.
২. ঘুমের সময়সূচি সামঞ্জস্য করা: সাহরির জন্য সময়মতো ওঠার জন্য রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়ার চেষ্টা করা।
৩. নিয়মিত বিরতি নেওয়া: বিশেষ করে দিন যতই বাড়বে, ক্ষুধার অনুভূতি বাড়বে, তাই বিরতি নেওয়া জরুরি। বিরতির মধ্যে মুখ ধোয়া এবং কিছু সময় বিশ্রাম নেওয়া ভালো।
৪. কাজের পরিকল্পনা করা: ফোকাস বাড়াতে এবং শক্তি সঞ্চয় করতে, কঠিন কাজগুলো আগে শেষ করার পরিকল্পনা করা, এবং সহজ কাজগুলো দিনব্যাপী বিভক্ত করে রাখা, সবশেষে সবচেয়ে সহজ কাজটি রেখে দেওয়া।
৫. সাহরি বা ইফতার পর কফি বা ক্যাফেইন এড়িয়ে চলা: ক্যাফেইন পান করার ফলে শরীরে পানির অভাব বেড়ে যায়, ফলে তৃষ্ণা বাড়ে। সাহরি বা ইফতার পর ক্যাফেইন এড়িয়ে চলা উচিত।
৬. প্রতিদিনের উৎপাদনশীলতা পর্যালোচনা করা: প্রতিদিনের কর্মদক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা বিশ্লেষণ করা এবং নিজের কাজের পর্যালোচনা করা, যাতে পরবর্তী দিনগুলোতে উন্নতির সুযোগ থাকে।
সূত্র: আল জাজিরা ডট নেট
আরও পড়ুনইফতারের পর ঘুম পায় কেন০৯ মার্চ ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক য ফ ইন র পর ক রমজ ন র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
সন্তানদের টানে বিচ্ছেদ থেকে বন্ধন, আদালত চত্বরে আবার বিয়ে
তিন বছর আট মাস আগে বিবাহবিচ্ছেদ হয় এক দম্পতির। পরে দুই কন্যাসন্তানের হেফাজত চেয়ে আদালতে পাল্টাপাল্টি মামলা করেন মা ও বাবা। শুনানির সময় বাবার সঙ্গে আদালতে সন্তানদের দেখা হতো। কিন্তু এতটুকু দেখাতে মন ভরত না সন্তানদের। সন্তানেরা মা-বাবাকে সব সময় একসঙ্গে কাছে পেতে চাইত। সাত বছর বয়সী বড় কন্যা প্রতিবার সাক্ষাতের সময় কান্নাকাটি করে মা-বাবাকে একসঙ্গে থাকার জন্য আকুতি জানাত।
পরে দুই কন্যার মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে ব্যথা ও অভিমান ভুলে ওই দম্পতি আবার একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। প্রায় তিন বছর মামলা চালানোর পর গত মার্চ মাসে আদালত চত্বরে তাঁদের বিয়ে সম্পন্ন হয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মলয় কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, শুধু কন্যাদের মানসিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ওই দম্পতি আবার এক হয়েছেন। আপসের পর ধর্মীয় বিধান মেনে আদালত চত্বরে তাঁদের আবার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। তাঁরা সংসার শুরু করেছেন।
যেভাবে দ্বন্দ্ব, যেভাবে আপস
২০১৭ সালে পারিবারিকভাবে এই দুজনের বিয়ে হয়। তাঁরা দুজনই উচ্চশিক্ষিত। দুজনই উচ্চপদে চাকরি করেন। বিয়ের পর নারীর বাবার বাড়িতে তাঁদের সংসার শুরু হয়। পরে রাজধানীতে একটি ভাড়া বাসা নিয়ে থাকা শুরু করেন। বিয়ের এক বছরের মাথায় তাঁদের কন্যাসন্তানের জন্ম হয়।
নারীর ভাষ্য, বিয়ের পর তাঁদের সংসার ভালোই চলছিল। স্বামী যৌতুক চেয়েছিলেন। এ কারণে মেয়ের সুখের কথা ভেবে যৌতুক হিসেবে ছয় লাখ টাকা ব্যয় করে টিভি, ফ্রিজ, খাট ও আলমারি উপহার দেন তাঁর বাবা।
মামলায় ওই নারী অভিযোগ করেন, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তাঁর স্বামীর ভাড়া বাসায় ওঠার কয়েক মাস পর থেকে সংসারে অশান্তি শুরু হয়। ভাড়া বাসার পাশে তাঁর ননদের বাসা ছিল। শাশুড়ি কখনো তাঁদের সঙ্গে, আবার কখনো মেয়ের বাসায় থাকতেন। তুচ্ছ কারণে শাশুড়ির সঙ্গে তাঁর প্রায় সময় মনোমালিন্য হতো। এ নিয়ে স্বামী তাঁকে কটু কথা বলতেন। একপর্যায়ে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করতেন স্বামী। তবু সন্তানের কথা ভেবে অত্যাচার সহ্য করে সংসার করতে থাকেন তিনি।
মামলায় ওই নারী আরও অভিযোগ করেন, একপর্যায়ে বাবার কাছ থেকে জমি লিখে নিতে স্বামী তাঁকে চাপ দিতে শুরু করেন। এ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন আরও বেড়ে যায়। একসময় তাঁদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। পরে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বিয়ের চার বছরের মাথায় তিনি স্বামীকে তালাক দিয়ে সন্তান নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যান।
তালাক কার্যকরের (তিন মাস) আগে স্বামীর পরিবারের সদস্যরা তালাকের নোটিশ প্রত্যাহারের অনুরোধ করতে থাকেন। স্বামী ও তাঁদের স্বজনেরা ওই নারীর কাছে অঙ্গীকার করেন, আর কখনোই শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা হবে না। স্বামীর অনুরোধ ও সন্তানের কথা ভেবে কার্যকর হওয়ার আগে ওই নারী তালাকের নোটিশ প্রত্যাহার করে নেন। আবার সংসার শুরু করেন।
আদালতের কাছে নারী দাবি করেন, আবার সংসার শুরুর পর থেকে কয়েক মাস তাঁর স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক বেশ ভালো ছিল। তবে দ্বিতীয় সন্তান গর্ভে আসার পর থেকে আবারও স্বামী নির্যাতন করা শুরু করেন। তিনি এতটাই উগ্র হয়ে ওঠেন যে নির্যাতন ঠেকাতে পরিবারের অন্য সদস্যরা এগিয়ে এলে স্বামী তাঁদের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করতেন। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আবারও স্বামীর বাসা ছেড়ে চলে যান বাবার বাসায়। ২০২১ সালের ৩০ আগস্ট তিনি আবার তাঁর স্বামীকে তালাকের নোটিশ দেন। তালাক কার্যকরও হয়। ছয় মাস পর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর দ্বিতীয় কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। স্বামী কখনো দ্বিতীয় সন্তানকে দেখতে আসেননি।
তবে এই নারীর সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তাঁর সাবেক স্বামী। সাবেক স্বামীর অভিযোগ, তাঁর মায়ের সঙ্গে স্ত্রীর বনিবনা হতো না। এ কারণে স্ত্রী প্রায় সময় তাঁর মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন। একদিন রাগ করে তাঁর স্ত্রী বড় মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যান। দ্বিতীয় সন্তান জন্মের পর কন্যাদের দেখতে তিনি শ্বশুরবাড়িতে গেলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাঁকে মারধর করেন। এ সময় তিনি জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯–এ ফোন দেন। পরে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে।
এ ঘটনার পর তাঁদের দুজনের মধ্যে আর কোনো সমঝোতা হয়নি। পরে দুই কন্যার হেফাজত চেয়ে সাবেক স্ত্রীকে বিবাদী করে পারিবারিক আদালতে মামলা করেন সাবেক স্বামী। অন্যদিকে ওই নারীও সাবেক স্বামীকে বিবাদী করে একই ধারায় মামলা করেন।
আরও পড়ুনবিয়ের অনেক বছর পরও কেন বিচ্ছেদ হয়১০ জুলাই ২০২৪বিবাদীপক্ষের আইনজীবী মলয় কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, এই দম্পতির বড় সন্তানের বয়স প্রায় সাত বছর, আর ছোট সন্তানের বয়স চার বছর। পারিবারিক আদালতে মামলার শুনানি চলাকালে আদালতকক্ষে স্বামী-স্ত্রীর দেখা হতো। দুই কন্যা তখন মা–বাবা দুজনের সঙ্গেই কথা বলত। তারা কান্নাকাটি করত; সবাই মিলে একসঙ্গে থাকতে চাইত। একসময় স্বামী-স্ত্রী দুজনই সন্তানের মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে আবার একসঙ্গে সংসার করার সিদ্ধান্ত নেন।
আইনজীবী মলয় কুমার সাহা বলেন, মা–বাবার বিচ্ছেদের পর সন্তানেরা মানসিক যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়। শিশুর মানসিক বিকাশে মা–বাবার আদর-ভালোবাসা বিরাট ভূমিকা রাখে। বিচ্ছেদের কারণে আদর-ভালোবাসার ঘাটতি সন্তানদের জীবনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। এ কারণে দুই কন্যার মানসিক সুস্থতার কথা ভেবে গত মার্চ মাসে আপস করে ওই দম্পতি আবার বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁরা সংসার শুরু করেছেন। তাঁদের ব্যাপারে নিয়মিত খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। তাঁরা এখন সুখে আছেন।
আরও পড়ুনবিচ্ছেদের ৫০ বছর পর আবার একসঙ্গে দুজন ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪আরও পড়ুনডিভোর্সের পরও সন্তানের কথা ভেবে এক ছাদের নিচে থাকা কি ঠিক২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫