ত্রিশালে একের পর এক শ্রমিক অসুস্থের ঘটনায় কারখানায় ছুটি ঘোষণা, তদন্ত কমিটি
Published: 13th, March 2025 GMT
ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। নির্ধারিত সময়ের পর অতিরিক্ত কাজ (ওভারটাইম) করার সময় গতকাল বুধবার তাঁরা কারখানায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। ত্রিশালের রামপুর ইউনিয়নের বীর রামপুর এলাকায় ‘জেওসি বিডি গার্মেন্টস কোম্পানি লিমিটেড’ নামের একটি কারখানায় ওই ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর আজ কারখানাটিতে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
এ ঘটনায় কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
কারখানার শ্রমিক ও কর্মকর্তারা জানান, কারখানায় কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকেরা গতকাল বেলা ১১টার পর থেকে অসুস্থবোধ করতে থাকেন। শ্রমিকেরা প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত নির্ধারিত সময়ে কাজ করার পর রাত ১০টা পর্যন্ত ওভারটাইম করেন। গতকাল সন্ধ্যার পর হঠাৎ শ্রমিকেরা অচেতন হয়ে পড়তে থাকেন। এ অবস্থায় ১৩ জনকে ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক নিয়ামুল হোসাইন বলেন, শ্রমিকেরা দুপুর ১২টা থেকে অসুস্থবোধ করলে কারখানার চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দেন বলে কারখানা কর্তৃপক্ষ জানায়। শরীরে চিনির পরিমাণ কমে যাওয়া, গরমের কারণে পানিশূন্যতা থেকে এমনটি হতে পারে। দিনের বেলায় শ্রমিকেরা অসুস্থ হলেও কেউ হাসপাতালে আসেনি। তিনি বলেন, শ্রমিকদের সবার রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে কম ছিল। তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে দ্রুত ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ শফিকুল ইসলাম বলেন, রাত নয়টার পর হাসপাতালের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে ১০ জন শ্রমিককে ভর্তি করা হয়। তাঁদের অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছিল। রাত ১২টার পর শ্রমিকেরা কিছুটা সুস্থ অনুভব করতে থাকেন।
আজ বেলা ১১টার দিকে হাসপাতালের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, শ্রমিকদের চিকিৎসা চলছে। কারখানাটির বিভিন্ন পদের কর্মীরা শ্রমিকদের ঘিরে আছেন। চিকিৎসাধীন তাহমিনা আক্তার (২৫) জানান, তাঁরা কারখানায় সকাল সাতটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করেন। সকালে কাজ শুরুর পর বেলা ১১টার পর হঠাৎ একজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে কারখানার মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসা দেওয়া হয়। লাঞ্চের পর আরও কয়েকজন অচেতন হয়ে পড়েন। ইফতারের পর অন্যরা অসুস্থ হতে থাকলে কারখানা ছুটি দেওয়া হয়। আগে দু-একজন অসুস্থ হলেও গতকালের মতো পরিস্থিতি কোনো দিন হয়নি।
কারখানার সেকশন ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডিউটির চাপ একটু বেশি ছিল। রোজায় অনেকের শরীর দুর্বল ছিল। দুপুরের পর দু-তিনজন অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁদের ছুটি দেওয়া হয়। ইফতারের পর আরও ১০ জন অসুস্থ হলে তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করি। তাঁরা এখন সুস্থ। খাবার বা অন্য কোনো কারণ থেকে এ সমস্যা হয়নি।’ তিনি বলেন, শ্রমিকেরা আজ কারখানায় এলেও গতকালের পরিস্থিতির কারণে বিশ্রামের জন্য আজ ছুটি দেওয়া হয়েছে।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এমদাদ উল্লাহ খান বলেন, ১০ জন নারী শ্রমিক ভর্তি হয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগের বয়স ২০ থেকে ২২। সবার একই ধরনের উপসর্গ ছিল—মাথা ঘোরাচ্ছিল, অচেতন হয়ে যাচ্ছিল। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছেন, অসুস্থ শ্রমিকেরা ওভারটাইমের কাজ করছিলেন। চিকিৎসায় আজ তিনজনের কিছুটা মাথা ঝিমঝিম ভাব থাকলেও বাকিরা অনেকটা সুস্থ। সাইকোলজিক্যাল ইলনেস থেকে শ্রমিকদের এমন হয়েছে। তবে তদন্ত করলে প্রকৃত কারণ বেরিয়ে আসবে।
ঘটনা তদন্তে কমিটিএ ঘটনায় কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
অধিদপ্তরের ময়মনসিংহ কার্যালয়ের উপমহাপরিদর্শক আহমাদ মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাতে অসুস্থ হয়ে ১০ জন শ্রমিক ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়। আজ তাঁদের প্রতিনিধি দল হাসপাতালে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে ঘটনার বিস্তারিত জানার চেষ্টা করে। শ্রমিকেরা অসুস্থ হওয়ার ঘটনায় আজ ও কাল কারখানাটিতে ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। ঘটনাটি তদন্তের জন্য তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে পরবর্তী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। অতিরিক্ত কাজের চাপে শ্রমিকেরা অসুস্থ হয়েছে কি না তা তদন্তের পর বলা যাবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক জ কর র র পর ১০ জন ঘটন য় তদন ত গতক ল
এছাড়াও পড়ুন:
‘রক্ত দিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা আর অন্য কিছুতেই নেই’
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চর আনন্দিপুর গ্রামের মামুন মিয়া (২২) ছোটবেলা থেকে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত। প্রায় প্রতি মাসেই তাঁর একাধিক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের পক্ষে এক সময় রক্তের জোগাড় বেশ কষ্টসাধ্যই হয়ে ওঠে। মানুষ বিনা স্বার্থে রক্ত দিতে চাইতেন না। ২০১৬ সাল থেকে পরিবারটিকে রক্তের জন্য আর কাউকে অনুরোধ করতে হচ্ছে না। মামুনের পাশে দাঁড়িয়েছে জেলার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
সম্প্রতি মামুনের মা মাজেদা বেগম অতীতের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘পোলার রক্তের লাইগ্গা মাইনষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। কেউ রক্ত দিতে চাইতো না। মানুষ টাকা ভিক্ষা চায়, আর আমি মানুষের কাছে আমার পোলার জন্য রক্ত ভিক্ষা করছি। শইল্যে রক্ত না ভরলে আমার পোলা মইরা যাইতো।’
দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ব্যক্তি, জরুরি বা সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার, ক্যানসার, থ্যালাসেমিয়া কিংবা কিডনি আক্রান্ত রোগীর জন্য প্রায়ই প্রয়োজন হয় রক্তের। আত্মীয়স্বজন বা চেনাজানা কারও কাছে প্রয়োজনমাফিক রক্ত না পেয়ে অনেকেই ছুটে যান স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংগঠনের কাছে। খবর পেয়ে স্বেচ্ছাসেবীরা দ্রুততার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রক্তদাতাকে খুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করেন। আর মানুষের জীবন বাঁচানোর মতো মহৎ এই কাজেই তাঁদের আনন্দ বলে জানান ময়মনসিংহের ‘ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটি’ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কয়েকজন কর্মী।
শুধু রক্তদান নয়, সমাজ পরিবর্তনে নানা কাজও করে চলেছে তরুণদের নিয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট এটি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন পায়। তবে এর দু-এক বছর আগেই সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু হয় বলে জানান সংগঠনটির মূল পরিকল্পনাকারী মমিনুর রহমান। তাঁর বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মাইজবাগ এলাকায়।
সম্প্রতি মমিনুর রহমান বলেন, ‘শুধু রক্তের অভাবে একটি মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে না, এই চিন্তা থেকে কাজ শুরু করি। ময়মনসিংহে রক্তদান নিয়ে কাজ করে—এমন কোনো সংগঠন ছিল না। তখন স্থানীয়ভাবে মানুষকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্যাম্পেইন করে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর ৩৯ জনকে নিয়ে প্রথম সভা করি। পরে সেখান থেকে রক্তদানের এই সংগঠন করার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। যেহেতু ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বসে ওই সভা হয়েছিল, তাই সংগঠনটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটি’। ‘আর্তের মুখে হাসি ফোটানোই হয় যদি মানবতা, তবে তার শ্রেষ্ঠ সেবক হলো প্রতিটি রক্তদাতা’, এই স্লোগান সামনে রেখে শুরু হয় এর যাত্রা।
সংগঠনটি থেকে জানানো হয়েছে, রক্তদাতা তরুণেরা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সংগঠনটির একটি কমিটি ও ফেসবুক পেজ আছে। এর মাধ্যমে কিংবা মুঠোফোনে খবর পেয়েই রক্ত দিতে ছুটে যান তরুণেরা। তরুণদের তৎপরতায় দিন দিন সংগঠনটির পরিসর বাড়ছে। বর্তমানে এই সংগঠনের প্রায় ৫০ হাজার সদস্য আছেন, যাঁরা নিজেরা রক্তদান করেন এবং রক্তদানে অন্য তরুণদের উৎসাহিত করেন। ২০ বারের বেশি রক্ত দিয়েছেন, এমন রক্তদাতা আছেন ৮০ জন, যার ৬০ জনই শিক্ষার্থী। শুধু ময়মনসিংহ শহরেই ইতিমধ্যে ৩৫ হাজার ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন সংগঠনটির তরুণেরা। এর মধ্যে প্রায় ২৩ হাজার ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস ২০১৮ সাল থেকে ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত আছেন। এ পর্যন্ত তিনি ২৬ বার রক্ত দিয়েছেন। অন্যদের উৎসাহী করতে তিনি বলেন, ‘মুমূর্ষু অবস্থায় মানুষ রক্তের কারণে মারা যাবে, এটি কখনো হতে পারে না। তাই অসুস্থ জটিল রোগীর খবর পেলেই রক্ত দিতে যাই। রক্ত দিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা আর অন্য কিছুতেই নেই।’
সংগঠনটির বর্তমান সভাপতি আবিদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক সুমন রাহাত। স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত আবিদুর রহমান বলেন, ‘যাঁদের রক্তের প্রয়োজন, তাঁরা আমাদের ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করেন। অথবা রক্তের প্রয়োজন ফেসবুকে কারও স্ট্যাটাস দেখলেই আমরা নিজে থেকে যোগাযোগ করে রক্তের ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। আমরা রক্তদানের মাধ্যমে অন্যের জীবন বাঁচিয়ে আনন্দিত হই। আমরা মানুষ বাঁচানোর এই আনন্দ সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। গ্রামে, পাড়ায় মহল্লায় রক্তের জন্য মানুষ যেন না মরে, এটিই আমাদের লক্ষ্য।’