রুপির প্রতীক পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত তামিলনাড়ুর, তীব্র হলো হিন্দি-তামিল ভাষাবিরোধ
Published: 13th, March 2025 GMT
হিন্দি ভাষা নিয়ে চলা বিরোধের মধ্যে তামিলনাড়ু নিজেদের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রাক্-বাজেট প্রচারণায় ভারতীয় মুদ্রা রুপির প্রতীক বদলে দিয়েছে। বৃহস্পতিবার প্রাক্-বাজেট প্রচারণার পোস্টারসহ অন্যান্য কাগজপত্রে রুপির দেবনাগরী হরফ ‘র’ প্রতীকের বদলে তামিল বর্ণ ‘রু’ লেখা হয়েছে। শুক্রবার রাজ্যটির বিধানসভায় এই বাজেট পেশ করা হবে। ভারতের দক্ষিণের রাজ্যটি রুপির প্রতীক বদলে দিয়ে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী অনুভূতি’ উসকে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ।
তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন রুপির প্রতীক বদলে দেওয়ার বিষয়ে বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) একটি পোস্ট দেন। এতে তিনি একটি গ্রাফিকস কার্ড যুক্ত করেন। কার্ডের বাঁ পাশে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের ছবি আছে, যেখানে রয়েছে রুপির প্রতীক। আর কার্ডের ডান পাশে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের ছবিতে তামিল অক্ষর ‘রু’ দেখা যাচ্ছে।
তামিল শব্দ ‘রুবাই’–এর আদ্যক্ষর ‘রু’। রুবাই অর্থ রুপি বা টাকা। বাজেটে অর্থের প্রতীক বদলে দেওয়ায় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তামিলনাড়ুর ভাষাযুদ্ধ নতুন মাত্রা পেয়েছে। তামিলনাড়ু সরকারের আলাদা করে রুবাই নোট ছাপানোর ক্ষমতা নেই, তারা কেন্দ্রের ছাপানো নোটই ব্যবহার করবে। তবে এই সিদ্ধান্ত সরকারিভাবে গৃহীত হলে তাদের দাপ্তরিক কাজে বা হিসাবে এখন থেকে রুপি চিহ্নের বদলে রুবাই চিহ্ন ব্যবহার করা হবে।
স্ট্যালিনের পোস্টের পর নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নির্মলা সীতারমণ এক দীর্ঘ পোস্টে লেখেন, তামিলনাড়ুর এই পদক্ষেপ ‘একটি বিপজ্জনক মানসিকতার ইঙ্গিত দেয়, যা ভারতীয় ঐক্যকে দুর্বল করে এবং আঞ্চলিক অহংকারের ছদ্মবেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী মানসিকতাকে উসকে দেয়’।
হিন্দি ভাষা শিক্ষাকে কেন্দ্র করে গত মাস থেকে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে ডিএমকে নেতৃত্বাধীন তামিলনাড়ু সরকারের বিরোধ চরমে ওঠে। ঐতিহাসিকভাবেই তামিল সমাজ ও রাজনীতিতে হিন্দি ভাষা যথেষ্ট স্পর্শকাতর। সেখানে সরকারি স্কুলে হিন্দি ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয় না। শিক্ষায় থাকে কেবল ইংরেজি ও তামিল। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ত্রিভাষা’ নীতি দক্ষিণের এই রাজ্যে তাই কখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
২০২০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার নতুন শিক্ষানীতি চালু করে। সেই নীতিতে নতুন করে ত্রিভাষা বা তিন ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। এই নীতি বাস্তবায়নের ৬০ শতাংশ অর্থ দেয় কেন্দ্রীয় সরকার, ৪০ শতাংশ রাজ্যের দায়িত্ব। গত ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান এক অনুষ্ঠানে বলেন, তামিলনাড়ু সরকার হিন্দি শিক্ষা বাধ্যতামূলক না করলে তার বরাদ্দ পাবে না। সেখান থেকেই নতুন বিতর্কের সূত্রপাত। মুখ্যমন্ত্রী স্ট্যালিন তাঁর প্রতিক্রিয়ায় জানান, রাজ্যকে কেন্দ্রীয় সরকার ব্ল্যাকমেল করছে। রাজ্যের পাওনা ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা আটকে রেখেছে।
বিষয়টি সম্প্রতি ভারতীয় সংসদে উঠেছিল। তা নিয়ে বিরোধীদের সঙ্গে তীব্র বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান। রুপির নতুন তামিল প্রতীক সেই বিতর্কের অংশ।
মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেও তামিলনাড়ু সরকার এই বদলের বিষয়টি সরকারিভাবে এখনো অনুমোদন করেনি। মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে ডিএমকে নেতা সর্বানন আন্নাদুরাই বলেছেন, ‘এতে অন্যায়ের কিছুই নেই। এটা কারও সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ব্যাপার নয়। সরকার তামিল ভাষাকে গুরুত্ব দেয়। এটা সেই অগ্রাধিকারেরই বিষয়।’
রাজ্যের বিজেপি নেতারা এই সিদ্ধান্তকে রাজ্যের মানুষের নজর ফেরানোর অপচেষ্টা বলে মনে করছেন। দলটির মুখপাত্র নারায়ণ তিরুপতি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘রাজ্য সরকার ব্যর্থ। ব্যর্থতা থেকে মানুষের নজর ঘোরাতে তারা এসব করছে।’
বিজেপির রাজ্য সভাপতি কে আন্নামালাই এ কাজকে নিছক ‘বোকামি’ বলে মন্তব্য করেছেন। রাজ্যে তিন ভাষা নীতি কার্যকর করার জন্য তিনি নিরন্তর প্রচার চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, রুপির পরিচিত প্রতীকটি ২০১০ সালে গৃহীত। সেটি তৈরি করেছিলেন যিনি, তিনি এক সাবেক ডিএমকে নেতার ছেলে।
বিজেপির আর এক শীর্ষ নেত্রী সাবেক রাজ্যপাল তামিলিসাই সৌন্দরাজন বলেছেন, ‘এই কাজ সংবিধানবিরোধী। রাষ্ট্রীয় স্বার্থবিরোধীও।’
আগামী বছর তামিলনাড়ুর বিধানসভার নির্বাচন। হিন্দি-তামিলের বিরোধের পাশাপাশি সংসদের আসন বৃদ্ধির প্রশ্নটিও বড় করে তুলছেন মুখ্যমন্ত্রী স্ট্যালিন। জনসংখ্যার ভিত্তিতে লোকসভার আসন বাড়ানো হলে দক্ষিণের তুলনায় উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের রাজ্যগুলোর আসন অনেক বেড়ে যাবে। এর বিরুদ্ধে স্ট্যালিন দক্ষিণের রাজ্যগুলোকে একজোট করতে চাইছেন। সমর্থনও পাচ্ছেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক ন দ র য় সরক র ম খ যমন ত র সরক র র মন ত র
এছাড়াও পড়ুন:
গ্যাস অপচয়ে বছরে ক্ষতি ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি: পেট্রোবাংলা
কারিগরি ক্ষতির (সিস্টেম লস) নামে গ্যাস অপচয় বাড়ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্যাস বিতরণ লাইনে অপচয় হয়েছে গড়ে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ গ্যাস। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। আর গত অর্থবছরের (২০২৪-২৫) মার্চ পর্যন্ত অপচয় হয়েছে ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এতে আর্থিক ক্ষতি ৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। এর বাইরে সঞ্চালন লাইনে অপচয় হয়েছে ২ শতাংশ।
‘দেশের জ্বালানিনিরাপত্তা: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়; গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব তথ্য উপস্থাপন করেছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। এতে বলা হয়, ২ শতাংশ অপচয় গ্রহণযোগ্য, তাই ওইটুকু সমন্বয় করেই আর্থিক ক্ষতির হিসাব করা হয়েছে। গ্যাসের অপচয় রোধে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে ছয়টি গ্যাস বিতরণ সংস্থা।
পেট্রোবাংলা বলছে, গ্যাস অপচয়ের জন্য দায়ী হচ্ছে পুরোনো, জরাজীর্ণ পাইপলাইন; গ্যাস সরবরাহ লাইনের গ্যাসস্টেশন রাইজারে লিকেজ (ছিদ্র); তৃতীয় পক্ষের উন্নয়নকাজে পাইপলাইন ছিদ্র হওয়া এবং আবাসিক খাতে প্রচুর অবৈধ সংযোগ। তবে এসব অপচয় রোধে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানায় পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে রয়েছে গ্যাস সরবরাহব্যবস্থায় মিটারিং/ মনিটরিং ব্যবস্থাপনা কার্যকর করা; লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কারিগরি ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রাখা; অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও উচ্ছেদ কার্যক্রম জোরদার করা এবং আবাসিক গ্রাহকদের প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা।
দেশের গ্যাস খাতের চিত্র তুলে ধরে সেমিনারে মূল নিবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন। তিনি বলেন, দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমতে কমতে ১৫ বছর আগের জায়গায় চলে গেছে। গ্যাস অনুসন্ধান জোরদারের কোনো বিকল্প নেই। গ্যাস চুরি ও অপচয় কমাতে হবে। সঞ্চালন ও বিতরণ মিলে কারিগরি ক্ষতি প্রায় ১০ শতাংশ, যা অনেক বেশি। সঞ্চালন লাইনে কারিগরি ক্ষতি কোনোভাবেই ২ শতাংশ হওয়ার কথা নয়। এটা ভালো করে দেখা উচিত।
শিল্পে নতুন সংযোগে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান বলেন, সঞ্চালন লাইনে কারিগরি ক্ষতির বিষয়টি গভীরভাবে দেখা হচ্ছে। অবৈধ সংযোগ বন্ধে পেট্রোবাংলা তৎপর আছে, খোঁজ পেলেই বিচ্ছিন্ন করা হবে। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিল্পে নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, যেহেতু তারা বেশি দাম দেবে। তাই অগ্রাধিকার বিবেচনা করে তিনটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। প্রথম ধাপের তালিকায় থাকছে, যেসব কারখানায় এখনই সংযোগ দেওয়া যাবে। এগুলো পরিদর্শন প্রায় শেষের দিকে, আগামী সপ্তাহে শেষ হয়ে যাবে।
সাংবাদিকদের অন্য এক প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহ করতে নতুন টার্মিনাল নির্মাণে অগ্রাধিকার পাচ্ছে স্থলভাগের টার্মিনাল। মহেশখালীর মাতারবাড়ী এলাকায় এটি করা হবে। এটি হলে কম দামের সময় বাড়তি এলএনজি কিনে মজুত করা যাবে। তবে এগুলো রাতারাতি করা যায় না, পাঁচ বছর সময় লাগতে পারে।
জাতীয় গ্রিডে নতুন করে দিনে ৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হয়েছে
তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) নিয়ে একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করেন পেট্রোবাংলার পরিচালক (পিএসসি) মো. শোয়েব। তিনি বলেন, স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য তৈরি পিএসসির খসড়া জ্বালানি বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ নিয়ে একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ৫০টি কূপ সংস্কার, উন্নয়ন ও খননের প্রকল্পে ইতিমধ্যে ১৮টির কাজ শেষ হয়েছে। জাতীয় গ্রিডে নতুন করে দিনে ৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হয়েছে। ৪টি কূপের কাজ চলমান। এ ছাড়া পেট্রোবাংলার বিভিন্ন প্রকল্পের কার্যক্রম তুলে ধরেন সংস্থাটির পরিচালক (পরিকল্পনা) মো. আবদুল মান্নান পাটওয়ারী।
সবচেয়ে বেশি বকেয়া বিদ্যুৎ খাতে
পেট্রোবাংলার আর্থিক দিক তুলে ধরেন সংস্থাটির পরিচালক (অর্থ) এ কে এম মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, গত অর্থবছরে পেট্রোবাংলার রাজস্ব আয় ৫৪ হাজার ১১৭ কোটি টাকা, এর মধ্যে অর্ধেক বকেয়া। গত মে পর্যন্ত গ্যাস বিল বকেয়া ২৭ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। এটি ধীরে ধীরে কমে আসছে। ১৩–১৫ হাজার কোটিতে বকেয়া নেমে এলে সন্তোষজনক। সবচেয়ে বেশি বকেয়া বিদ্যুৎ খাতে ১৬ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। এরপর সার কারখানায় বকেয়া আছে ৯৬৪ কোটি টাকা। তবে বিদেশি কোনো কোম্পানির কাছে বিল বকেয়া নেই পেট্রোবাংলার। সব বিল শোধ করা হয়ে গেছে।
গত অর্থবছরে প্রতি ইউনিটে লোকসান হয়েছে ৪ টাকা
পেট্রোবাংলা বলছে, এলএনজি আমদানি শুরুর পর থেকে লোকসান শুরু হয় সংস্থাটির। প্রতিবছর সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিচ্ছে পেট্রোবাংলা। ২০১৮-১৯ সালে এলএনজি আমদানি শুরু হয়, ওই বছর ভর্তুকি ছিল ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এরপর এলএনজি আমদানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভর্তুকিও বাড়তে থাকে। গত অর্থবছরে তারা ভর্তুকি নিয়েছে ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত পেট্রোবাংলা মোট ভর্তুকি নিয়েছে ৩৬ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। পেট্রোবাংলার হিসাবে গত অর্থবছরে প্রতি ইউনিট গ্যাস সরবরাহে পেট্রোবাংলার খরচ হয়েছে ২৭ টাকা ৫৩ পয়সা। তারা বিক্রি করেছে ২২ টাকা ৯৩ পয়সায়। এর মানে প্রতি ইউনিটে লোকসান হয়েছে ৪ টাকা ৬০ পয়সা।