লোকসান কাটিয়ে প্রাণচঞ্চল পোশাকপল্লি
Published: 15th, March 2025 GMT
বুড়িগঙ্গার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। নদীতে পানি প্রবাহ আগের মতো নেই। যৌবন হারিয়ে ভাটা পড়া নদী ঘিরে থেমে নেই কর্মযজ্ঞ। বুড়িগঙ্গার এক পারে তিলোত্তমা রাজধানী, অন্য পারে কেরানীগঞ্জ। সেতু আর সড়কে কেরানীগঞ্জে লেগেছে নগরায়ণের ছোঁয়া। অনেকটা কোলাহলমুক্ত এই এলাকা দ্রুতই নজর কাড়ে বিনিয়োগকারীদের। এ উপজেলার আগানগর ও শুভাঢ্যা ইউনিয়নে আশির দশক থেকে সীমিত পরিসরে শুরু হয় তৈরি পোশাক কারখানা। শুরুটা হয়েছিল পুরোনো কাপড় জোড়াতালি দিয়ে। বুড়িগঙ্গার পারে দূরদূরান্ত থেকে ঝুট কাপড়ভর্তি নৌযান আসত। আশপাশের লোকজন সেগুলো পুঁজি করেই ব্যবসা শুরু করেন। থাকতেন ছোট ছোট বাঁশের ছাপরায়। এখন সেখানে বড় বড় দালান। ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, পূর্ব আগানগর গুদারাঘাট, আগানগর ছোট মসজিদ, চরকালীগঞ্জ ও খেজুরবাগ এলাকা মিলিয়ে প্রায় দুই কিলোমিটারজুড়ে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় পোশাকশিল্প কারখানা। গড়ে উঠেছে তিন শতাধিক ছোট-বড় মার্কেট। ছোট ও মাঝারি আকারের পোশাক কারখানাসহ রয়েছে ১০ হাজারের বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ঈদ ঘিরে পোশাকশিল্পের বড় এই জনপদ জেগে আছে রাতদিন। কী নেই এই পোশাকপল্লিতে। গেঞ্জি, প্যান্ট, সালোয়ার-কামিজ, টি-শার্ট, পাঞ্জাবি, ফতুয়া– সবই আছে।
বিশ্বের নামিদামি ব্র্যান্ডের ডিজাইন-মানও অনুকরণ করা হয়। দেশের পোশাকের বাজারের বড় সরবরাহ হয় এখান থেকেই। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ী-ক্রেতাদের আনাগোনা থাকে বছরজুড়ে। অবশ্য সারা বছরের ৬০-৭০ শতাংশ বেচাকেনা হয় ঈদের আগে। কিন্তু ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের সময় বেচা-বিক্রির বড় এই পল্লি থমকে দাঁড়ায়। তখন ঈদুল ফিতরের আগেই বন্ধ হয়ে যায় মার্কেট। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিলেন ব্যবসায়ীরা। বারবার লড়াই করেও আগের সেই সুদিন আর ফেরেনি। ঋণের ভারে অনেক ব্যবসায়ী পথে বসেছেন। চার বছর ধরে পোশাকপল্লিজুড়ে ছিল পুঁজি হারানোর আক্ষেপ, বেকারত্বের শঙ্কা, ঋণের বেড়াজালে আটকে থাকার ভয়। এবার গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন স্বপ্ন বুনেছেন তারা। সুদিনের আশায় এ বছর রমজানের আগ থেকেই নতুন বাহারি পোশাক তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। অবশেষে এবার সেই সাফল্য ধরা দিতে শুরু করেছে।
পোশাকপল্লিতে যে ‘ঈদ’ চলছে, তার প্রমাণ মিলেছে গত বুধবার সরেজমিন ঘুরে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পাইকাররা আসছেন। ঘুরে ঘুরে কিনছেন পছন্দসই পোশাক। বেচাকেনাও বেশ। শুধু মার্কেট কিংবা দোকান নয়, ফুটপাতও বাদ যায়নি বেচাকেনার এই আয়োজনে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই বেচাকেনার হাট সরগরম থাকবে ঈদের আগের দিন চাঁদ রাত পর্যন্ত। তবে পাইকারদের আনাগোনা কমে যাবে ২৫ রমজানের পর।
ব্যবসায়ীরা জানান, দেশের অভ্যন্তরীণ পোশাক চাহিদার ৮০ শতাংশ বাজার এই পল্লির দখলে। সারা বছরের ৬০-৭০ শতাংশ বেচা-বিক্রি হয় এই ঈদের আগে। ঈদ মৌসুমে কম করে হলেও হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। এখানকার বিক্রয়কেন্দ্র ও কারখানায় দুই থেকে আড়াই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জ, চরকালীগঞ্জ, আগানগর, পূর্ব আগানগর ও খেজুরবাগ এলাকার জিলা পরিষদ মার্কেট, তানাকা মার্কেট, আশা কমপ্লেক্স, খাজা মার্কেট, এস আলম সুপারমার্কেট, নুর সুপারমার্কেট, চৌধুরী মার্কেট, আলম সুপারমার্কেট ও ইসলাম প্লাজা ঘুরে দেখা যায় পাইকারি বাজারে ঈদের বেচা-বিক্রি জমে উঠেছে। সারাদেশের ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের চাহিদা বিবেচনা করে বিভিন্ন ধরনের পোশাক কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে কেরানীগঞ্জের পোশাকপল্লির পাইকারি বাজার এখন বেশ সরগরম।
তালহা গার্মেন্টের মালিক মনির হোসেন বলেন, পবিত্র শবেবরাতের পর থেকে কেরানীগঞ্জ পোশাকপল্লিতে বেচাকেনা শুরু হয়েছে। করোনার পর থেকে অনেক লোকসান দিয়েছেন। এবার রাজনৈতিক কোনো অস্থিরতা নেই। চাঁদাবাজি নেই। ফলে ব্যবসা ভালোই চলছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে লোকসান কাটিয়ে আমরা টিকে থাকতে পারব।
১৪-১৫ বছর ধরে কেরানীগঞ্জে পণ্য কিনতে আসেন গাজীপুরের ব্যবসায়ী মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, এখানে সব বয়সের মানুষের উপযোগী তৈরি পোশাক পাওয়া যায়। ফলে সব সময় এখান থেকেই পোশাক কিনি।
বগুড়া থেকে এবার নিয়ে দু’বার পোশাক কিনতে এসেছেন সেখানকার শিহাব গার্মেন্টের মালিক রমিজ উদ্দিন। তিনি বলেন, কেরানীগঞ্জের পোশাকের দাম কম। এখানে বিদেশি পোশাকের আদলে তৈরি করা হয় বলে বাজারে এগুলোর চাহিদাও বেশি।
আহসান উল্লাহ চৌধুরী টাওয়ারের নয়ন গার্মেন্টের মালিক আব্দুর রহমান জানান, গত বছর দুই ঈদের জন্য ৩০ হাজার প্যান্ট তৈরি করেছিলেন। অর্ধেকই বিক্রি হয়নি। এবার ৩৫ হাজার প্যান্ট তৈরি করেছেন। এসব প্যান্টের অর্ধেকের বেশি বিক্রি হয়ে গেছে।
একাধিক ব্যবসায়ী জানান, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য কম দামের পোশাকের জোগান দিতে কেরানীগঞ্জ বিখ্যাত। এখানে ২০০ টাকা থেকে শুরু করে হাজার টাকায় ছোট ও বড়দের জিন্স প্যান্ট পাওয়া যায়। তবে তরুণদের জন্য ৪৫০-৬০০ টাকার জিন্সই বেশি চলে। এ ছাড়া ১১০-৩০০ টাকায় ফতুয়া, ২২০-৫৫০ টাকায় পাঞ্জাবি, ১৫০-১০০০ টাকায় শার্ট, ৩০০-৪০০ টাকায় বাচ্চাদের পোশাক এবং ৩০০-৮০০ টাকায় মেয়েদের সালোয়ার-কামিজ পাইকারি দরে বিক্রি হয়। তাই সারাদেশের খুচরা ব্যবসায়ীরা এখানে পাইকারি দরে পোশাক কিনতে আসেন।
আজগর আলী নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, গত রোজায় ৭ হাজার প্যান্ট বিক্রি করেছিলাম। এবার ১০-১২ হাজার করব। আশা করছি, ভালো ব্যবসা করতে পারব।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কেরানীগঞ্জের পোশাকপল্লিতে দেশি পোশাকের পাশাপাশি চীন ও থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করা বিভিন্ন ধরনের পোশাক পাওয়া যায়। ক্রেতা-বিক্রেতার সুবিধার্থে দুই ডজনের বেশি ব্যাংকের শাখা ও ৩০টি পরিবহন কোম্পানির শাখা আছে। এ ছাড়া কাপড়, বোতাম, সুতা, হ্যাঙ্গার এবং পলিব্যাগের বাজার গড়ে উঠেছে। তাই এসব পণ্য কিনতে পুরান ঢাকার ইসলামপুরে যাওয়ার খুব একটা প্রয়োজন হয় না ব্যবসায়ীদের।
কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, করোনাকাল থেকে এখানকার ব্যবসায়ীরা লোকসান দিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের আমলে ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হয়েছে। সব কাঁচামালের দাম বেশি ছিল। অস্থির এক সময় পার করে এখন ব্যবসা জমে উঠেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে লোকসান কাটিয়ে উঠে ব্যবসায়ীরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন।
এদিকে অনেকটা অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এই পোশাকপল্লিতে মার্কেটগুলো খুবই ঘিঞ্জি পরিবেশে গড়ে উঠেছে। সড়কগুলো অপ্রশস্ত। দেশের অর্থনীতিতে এসব কারখানার বিশেষ অবদান থাকলেও ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, গ্যাসসহ নানা সমস্যা সমাধানে নেই তেমন কোনো উদ্যোগ। সম্ভাবনা বিবেচনা আর পরিবেশের সুরক্ষায় এই পোশাকপল্লিকে দ্রুত শিল্পাঞ্চলের আওতায় আনলে সব পক্ষই উপকৃত হতে পারে।
.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবস য় র র ব যবস য়
এছাড়াও পড়ুন:
ঢাকায় অটোমোবাইল ও কৃষি যন্ত্রপাতির প্রদর্শনী শুরু হচ্ছে শনিবার
ঢাকায় দুই দিনব্যাপী অটোমোবাইল ও কৃষি যন্ত্রপাতির প্রদর্শনী শুরু হচ্ছে আগামী শনিবার। এতে অটোমোবাইল, কৃষি যন্ত্রপাতিসহ হালকা প্রকৌশল খাতের ২৬টি স্টল থাকবে। পাশাপাশি শিল্পের সহায়ক প্রতিষ্ঠানের স্টল থাকবে আরও ১২টি। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান।
বাংলাদেশ অটোমোবাইলস অ্যাসেম্বলার্স অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন ও অ্যাগ্রিকালচার মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সহযোগিতায় এই প্রদর্শনীর আয়োজন করছে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই)। ঢাকার তেজগাঁও শিল্প এলাকায় এডিসন প্রাইম ভবনের ছাদে এই প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে। এই ভবনেই বিসিআইয়ের কার্যালয় অবস্থিত।
আজ বৃহস্পতিবার বিসিআই কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে দুই দিনব্যাপী এই প্রদর্শনী নিয়ে বিস্তারিত জানান চেম্বারটির সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী। আরও উপস্থিত ছিলেন অ্যাগ্রিকালচার মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সভাপতি আলিমুল আহসান চৌধুরী, বিসিআইয়ের পরিচালক মো. শাহেদ আলম, এস এম শাহ আলম, জিয়া হায়দার প্রমুখ।
বিসিআইয়ের সভাপতি বলেন, হালকা প্রকৌশল খাতে বাংলাদেশে বর্তমানে ছোটবড় প্রায় ৫০ হাজার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই খাতে কাজ করেন ১০ লাখ মানুষ। হালকা প্রকৌশল খাতে স্থানীয় বাজার ১২ বিলিয়ন ডলারের হলেও দেশীয় উৎপাদকেরা অর্ধেক পূরণ করতে পারছেন। তা ছাড়া হালকা প্রকৌশল খাতের বৈশ্বিক বাজারের আকার প্রায় ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। তিনি আরও বলেন, তৈরি পোশাক খাত আর বেশি মূল্য সংযোজন করতে পারবে না। ফলে আমাদের অর্থনীতিকে টেকসই করতে হলে আমাদের অন্য খাতে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে হালকা প্রকৌশল খাত পারে বড় সম্ভাবনার।
অ্যাগ্রিকালচার মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সভাপতি আলিমুল আহসান চৌধুরী বলেন, প্রতিবছর কৃষিজমি কমছে। কৃষকের বয়স বাড়ছে, তার কারণ তরুণেরা খুব কম কৃষিকাজে আসছেন। বিশ্বের অনেক দেশেই মোট জনগোষ্ঠীর ১০ শতাংশের কম কৃষিকাজে নিয়োজিত। ১০ শতাংশ মানুষ বাকি ৯০ শতাংশের জন্য খাদ্য জোগান দিচ্ছে। সে কারণে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। বাংলাদেশেও কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। তবে বড় অংশই আমদানি করতে হচ্ছে।
আলিমুল আহসান চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে ১২০০ থেকে ১৫০০ কোটি টাকার কৃষি যন্ত্রপাতির বাজার আছে। তার মধ্যে দেশীয় কোম্পানিগুলো সরবরাহ করছে মাত্র ৪০০ থেকে ৪৫০ কোটি টাকার যন্ত্রাংশ। নীতিসহায়তা পেলে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি।