‘বড় হয়ে আমি ডাক্তার হবো’– যে শিশুটি মাঝেমধ্যেই বলত এমন কথা, সে এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে। অন্য শিশুদের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে না। নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির জামিনের পর থেকে পার্বতীপুরের এই শিশু ও তার পরিবারের সদস্যরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। শিশুটি ঘর থেকে বের হতে পারে না, লেখাপড়াও বন্ধ । আশপাশের কারও কারও কটু কথা শুনতে হয়। ২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবরের ঘটনা। তখন তার বয়স ছিল পাঁচ বছর। পার্বতীপুর উপজেলার জমিরহাট তকেয়াপাড়ায় এই কন্যাশিশুকে ১৮ ঘণ্টা আটকে রেখে ধর্ষণ করে তার খেলার সাথী রেশমার বাবা সাইফুল ইসলাম। ব্লেড দিয়ে শিশুটির প্রজনন অঙ্গ কেটে ফেলা হয়। সিগারেটের ছ্যাঁকাও দেওয়া হয় ছোট্ট শরীরে। এদিকে, প্রজনন অঙ্গ কেটে ফেলায় পাঁচ বছর অনিয়ন্ত্রিত মূত্র সমস্যার কারণে সে চলাফেরা করতে পারেনি। পরে রাজধানীর বেশ কয়েকজন চিকিৎসক, সমাজসেবীর সহায়তায় তার চিকিৎসা হলে বর্তমানে প্রায় আধঘণ্টা মূত্র আটকে রাখতে পারে। ৯ বছর ধরে সে ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে।
ওই বছরের ২০ অক্টোবর তার বাবা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করলে সাইফুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হওয়ায় ঘটনাটি আলোচিত হয়। বিচারে সাইফুলের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। পরে সে আপিল করে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুর জেলা কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হয়েছেন। দিনাজপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে দেওয়া এক আবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২৮ জানুয়ারি হাইকোর্ট তার জামিন মঞ্জুর করেছেন।
এ প্রসঙ্গে উই ক্যান অ্যালায়েন্সের জাতীয় সমন্বয়ক জিনাত আরা হক সমকালকে বলেন, ‘কোন গ্রাউন্ড দেখিয়ে হাইকোর্ট থেকে এই আসামি জামিন পায়, তা বোধগম্য নয়। মেয়েটার নিরাপত্তা নিয়ে আমরা খুবই শঙ্কিত। আসামিরা এভাবে জামিন পেলে নারী নির্যাতন আরও বেড়ে যাবে। ধর্ষণের শিকার শিশুটির সঙ্গে সমাজের মানুষের আচরণ স্বাভাবিক নয়। সমাজ কিংবা রাষ্ট্র কেউ তার নিরাপত্তা দিতে পারছে না। তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ বিভিন্নভাবে এই পরিবারের সদস্যদের হুমকি দেওয়া হতো। এখন তো মেয়েটির ঘরের সামনে দিয়েই চলাচল করে আসামি। তাদের ঘরের পাশেই আসামির ঘর।
শুধু এই শিশুই নয়, ধর্ষণ কিংবা শারীরিকভাবে সহিংসতার শিকার অসংখ্য শিশু ও নারী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। গত কয়েক মাসে বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি কারাগার থেকে জামিনে বের হয়েছে। ধর্ষণ মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরও জামিন হচ্ছে। এতে ভুক্তভোগীরা আতঙ্কে আছেন।
সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের জামিন দেওয়া প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ওয়ালিউর রহমান দোলন বলেন, শুধু ধর্ষণ মামলার আসামিই নয়, এসিড সহিংসতাসহ বিভিন্ন আলোচিত ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামিরা রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে বিভিন্ন উপায়ে আদালত থেকে জামিন পেয়ে যাচ্ছে। এটা সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। এ পরিস্থিতি আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধকে ম্লান করে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে কোর্টের আরও বেশি সচেতন হওয়া দরকার। কোর্টের বাদীপক্ষকে এসব মামলার ব্যাপারে অত্যন্ত সাবধানী ও কঠোর মনোভাবাপন্ন হওয়া উচিত।
আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের তথ্য অনুযায়ী ধর্ষণের ঘটনায় করা মামলাগুলোর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় সাত ভাগেরও কম। সাজা পায় স্বল্পসংখ্যক আসামি। আইনের ত্রুটি, ফরেনসিক পরীক্ষার সীমাবদ্ধতা, প্রভাবশালীদের চাপ, অর্থের দাপট এবং সামাজিক কারণে কঠোর শাস্তির বিধান থাকলেও ধর্ষক ভীত হচ্ছে না।
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের ন্যাশনাল কোঅর্ডিনেটর সৈয়দা আহসানা জামান
(এ্যানী) বলেন, ধর্ষণের অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। অনেক ঘটনা চাপা পড়ে যাচ্ছে। অনেক ভুক্তভোগীর পরিবার মামলা করতে সাহস পায় না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থ বা পেশির দাপটে মামলা তুলে নেওয়া হয়। এতে আসামিরা পার পেয়ে যায়। এখনতো ধর্ষণের মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকেও জামিন দেওয়া হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক ব্যবহার। পুরুষরা যাই করুক না কেন, সবকিছুতেই তারা পার পেয়ে যায়। আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র নারীর নিরাপত্তা দিতে পারে না। বর্তমানে কন্যাশিশু ও নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনোভাবেই যেন ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জামিন না পায়। এমনটি ঘটতে থাকলে আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা থাকবে না।
.
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
চা বাগানের ন্যাড়া টিলায় নীল-লেজ সুইচোরাদের কোলাহল
মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার ইটা ও করিমপুর চা বাগানের মধ্যখানে লালচে রঙের ন্যাড়া টিলা। মাটি কেটে নেওয়ায় বির্পযস্ত সেই টিলার গা জুড়ে গর্ত করে আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছে নীল-লেজ সুইচোরা পাখিরা।
নানা অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শণ করে দিনভর চলে উড়াউড়ি আর বেলা-অবেলাজুড়ে চলে নানা সুরের মনমতানো গান। গ্রীষ্মকালে এ এলাকায় বেড়াতে আসা পাখিদের মধ্যে অন্যতম এই নীল-লেজ সুইচোরা পাখি।
টিলার পাশে দাঁড়িয়ে একটু গভীর দৃষ্টিতে তাকালেই দেখা যায় টিলার গায়ে ছোট ছোট অসংখ্য গর্ত। গর্তগুলোর প্রতিটিই একেকটি বাসা, সুইচোরা পাখির বাসা। কোন কোন বাসায় বাচ্চা রয়েছে। আবার কোন বাসায় বসে ডিম তা দিচ্ছে স্ত্রী সুইচোরা।
বিকেলের পড়ন্ত রোদে টিলার গায়ের উঁচু গাছটির মরা ডালগুলোতে সরু, লম্বা ঠোঁট ও নীল লেজের কয়েকটি সুইচোরাকে বসে থাকতে দেখা গেল। কিছুক্ষণ পরপর তারা উড়ে গিয়ে শূন্য থেকে শৈল্পিক ভঙ্গিমায় পোকা ধরে নিয়ে আবারও গাছের ডালে গিয়ে বসছে। মা পাখিরা পোকা ধরে বাসায় নিয়ে বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছে।মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত প্রজননের জন্য নিরাপদ ও উপযুক্ত স্থানে বসবাস করে সুইচোরা পাখিরা। এরা আমাদের দেশীয় পাখি হলেও সব সময় একই অঞ্চলে বসবাস করে না এরা। তাই এদের অনেকে পরিযায়ী বলেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, এরা পরিযায়ী বা আবাসিক পাখি নয়। এরা আমাদের স্থানীয় পাখি।
প্রকৃতি প্রেমি মুরাদ হোসেন বলেন, “এরা এদেশের আবাসিক ‘নীল-লেজ সুইচোরা’। ইংরেজী নাম Blue-tailed Bee-eater. Meropidae নাম এই পরিবারের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Merops Philippinus.”
স্থানীয়রা এদের ‘নীল চড়ুই’ বলে জানেন। তবে সবসময় এদের দেখা মেলে না। কেবল গ্রীষ্মকালেই কোথা থেকে যেন ঝাঁক বেঁধে চলে আসে এরা।
করিমপুর চা বাগানের বাসিন্দা আইয়ুব আলী বলেন, “বাগানের পাশে পরিত্যাক্ত ন্যাড়া টিলার পেটে গর্ত করে গত তিনমাস ধরে পাখিগুলো বসবাস করছে। আগে ফি-বছর তারা আসলেও এখন আর আগেরমতো আসে না। মাঝে মাঝে এদের দেখা মেলে।”
ওই বাগানের বাসিন্দা দিপঙ্কর ঘোষ বলেন, “পাখি তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বসবাস শুরু করে। কোন বাধা বিপত্তি এলে তারা চলে যায়। ৩/৪ বছর পর এদের দেখা মিলল। এরা এখানে নিরাপদে প্রজনন করতে পারছে। জুন মাসের শেষে তারা আবার চলে যাবে।”
শেখ কামাল ওয়াইল্ডলাইফ সেন্টার গাজীপুরের পাখি বিশেষজ্ঞ আল্লামা শিবলী সাদিক বলেন, ‘‘নীল-লেজ সুইচোরা পাখিদের পরিযায়ী বা আবাসিক বলা যাবে না। এরা আমাদের দেশীয় পাখি। প্রজননের সময় তারা নিরাপত্তার স্বার্থে বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান করে বলে এদের অনেকেই মনে করেন তারা পরিযায়ী বা আবাসিক। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত তাদের প্রজনন সময়। এরা পাহাড়ি টিলার নরম মাটিতে গর্ত করে বসবাস করে। গর্তের মধ্যেই বাসা তৈরি করে ডিম পেড়ে বাচ্চা ফোটায়। পরে বাচ্চাদের নিয়ে অন্য স্থানে চলে যায়।”
প্রাপ্তবয়স্ক এই পাখির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার, ওজন ৩৮ থেকে ৫০ গ্রাম। নীল-সবুজ পালক বিশিষ্ট পাখিটির পেছনের অংশ ও লেজ নীল। গলা খয়েরি, বুকের ওপরটা বাদামি, চোখে কাজল টানা এবং পেট আপেলের মতো সবুজ।
চোখ লালচে বাদামি থেকে গাঢ় লাল। কোমর, লেজ ও লেজের নিচের অংশ নীল। লেজের আগায় লম্বা নীল সুই বা পালক রয়েছে।
এদের ঠোঁট সরু, লম্বা ও কালো। নিচের দিকে খানিকটা বাঁকানো। পা ও পায়ের পাতা কালচে বাদামি। অপ্রাপ্তবয়স্ক নীললেজ সুইচোরার দেহের রং অনুজ্জ্বল ও ফ্যাকাশে। স্ত্রী ও পুরুষ একই রকম দেখতে।
এদের আয়ুষ্কাল প্রায় ছয় বছর। মার্চ থেকে জুন এদের প্রজননকাল। এসময় পাহাড়ের গায়ে বা নদী ও খালপাড়ে প্রায় দুই মিটার লম্বা সুড়ঙ্গ খুঁড়ে বাসা বানায় এরা। সেখানে ৫-৬টি ডিম পাড়ে, ডিমের রং সাদা। ২১-২৬ দিনে ডিম ফোটে এবং ২০-২৭ দিন পরে বাচ্চারা উড়তে শেখে।
ঢাকা/আজিজ/এস