ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি অভিযোগ করেছেন, তাঁর দেশে দ্রুত একটি যুদ্ধবিরতির কূটনৈতিক উদ্যোগ ‘নষ্ট’ করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের ওপর আরও বেশি চাপ প্রয়োগের আহ্বানও জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধ শেষ করতে পরবে।

জেলেনস্কি বলেছেন, ‘শুরু থেকেই, এমনকি একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হওয়ার আগেই পুতিন খুবই কঠিন ও অগ্রহণযোগ্য শর্ত আরোপের মাধ্যমে এই কূটনৈতিক উদ্যোগকে নষ্ট করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন।’

গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে পুতিন বলেছিলেন, তিনি যুদ্ধবিরতির এই উদ্যোগকে গ্রহণ করেছেন। তবে এর বিস্তারিত নিয়ে তিনি অসংখ্য প্রশ্ন তুলেছেন।

পুতিন কুরস্ক সীমান্ত অঞ্চল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ছয় মাস আগে ইউক্রেনের সেনারা রাশিয়ার ওই অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল। রুশ বাহিনী পরে কুরস্ক অঞ্চলটি ইউক্রেনের দখলমুক্ত করে।

পুতিনের অভিযোগ, ইউক্রেনের বাহিনী কুরস্কের ‘বেসামরিক মানুষের বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ’ করেছে। পুতিনের এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে কিয়েভ।

যুদ্ধবিরতির সুযোগে ইউক্রেন আবার সেনা জড়ো করা, প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং সেনাদের জন্য রসদ সংগ্রহ করার কাজ করবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন পুতিন। যদিও তাঁর বাহিনীর ক্ষেত্রে একই সুযোগ গ্রহণের বিষয় নিয়ে তিনি কোনো কথা বলেননি।

ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলজুড়ে যুদ্ধবিরতি যথাযথভাবে পালন হচ্ছে কি না, তার নজরদারি ও পাহারা কীভাবে দেওয়া হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন পুতিন।

আরও পড়ুনরাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ: কীভাবে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হতে পারে১৩ ঘণ্টা আগে

রুশ প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘২ হাজার কিলোমিটারের বেশি এলাকাজুড়ে কেউ সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি চুক্তির লঙ্ঘন করছে কি না এবং ঠিক কোথায় করছে, তা কে খুঁজে বের করবে? যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের দায়ই–বা কে নেবে?’

পরদিনই সাংবাদিকদের সঙ্গে এক বৈঠকে এসব প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেন জেলেনস্কি। তিনি বলেন, আকাশে ও সমুদ্রে যুদ্ধবিরতি যথাযথভাবে পালন হচ্ছে কি না, তা দেখভাল করার জন্য ইউক্রেনই যথেষ্ট। তবে সম্মুখ যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন হচ্ছে কি না, তা নজরদারি করতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের নজরদারি ও গোয়েন্দা সক্ষমতার প্রয়োজন পড়বে।

ইউক্রেন বিশ্বাস করে, পুতিন যেসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, সেগুলোর সমাধান করা সম্ভব; বরং বেশি কঠিন হবে পুতিনের অপছন্দের বিষয়গুলো নিয়ে একটি সমঝোতায় আসা।

পুতিন বলেছেন, এই সংকটের মূলে যেসব কারণ রয়েছে, সেগুলোর সমাধান করতে হবে। তিনি এ বক্তব্যের মাধ্যমে ন্যাটো জোটের বিস্তার নিয়ে তাঁর আপত্তির কথা তুলে ধরেছেন। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের অস্তিত্ব নিয়েও পুতিনের আপত্তি আছে।

আরও পড়ুনযুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনায় মস্কো যাচ্ছেন মার্কিন প্রতিনিধিরা, পুতিন গেলেন কুরস্কে১৩ মার্চ ২০২৫

এ কারণে জেলেনস্কি বলেছেন, ‘রাশিয়াই একমাত্র পক্ষ, যারা যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে এবং কূটনৈতিক উদ্যোগ ভেস্তে দিতে চায়।’

তাহলে এখন কী হবে? সে সিদ্ধান্ত সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রকেই নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার ওপর চাপ আরও বাড়াতে পারেন, যেমনটা ইউক্রেন চাইছে। এ জন্য তিনি রাশিয়ার ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেন। অথবা ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা বাড়াতে পারেন।

আবার এমনটা হতে পারে, ট্রাম্প রাশিয়াকে আরও বেশি ছাড় দিয়ে একটি চুক্তিতে রাজি হওয়ার প্রস্তাব দিলেন, কিয়েভ এই ভয়ই পাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে বেশির ভাগ যোগাযোগ খুবই গোপনে হচ্ছে, যেখানে ইউক্রেনের ওপর প্রকাশ্যেই কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে।

এ কারণেই জেলেনস্কি বারবার পুতিনের সময়ক্ষেপণের কৌশলের কথা উল্লেখ করে পশ্চিমাদের রাশিয়ার ওপর চাপ দিতে বলছেন।

দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসার পর থেকে ট্রাম্প নানা আন্তর্জাতিক বিষয়ে নিজের কূটনীতির বুলডোজার চালিয়ে যাচ্ছেন। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধেও তিনি একই চেষ্টা করছেন।

আরও পড়ুনযুদ্ধবিরতির জন্য যেসব দাবি মানতে হবে, তার তালিকা দিয়েছে রাশিয়া১৩ মার্চ ২০২৫

কিন্তু এবার তাঁকে ক্রেমলিনের শক্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং ক্রেমলিনকে বাগে আনা সম্ভবত কঠিন হবে।

ট্রাম্প দ্রুত যুদ্ধের অবসান চান। অন্যদিকে পুতিন চাইছেন, একটি বিস্তারিত ও মৌলিক সিদ্ধান্ত।

ট্রাম্প ও পুতিন দুজনই একগুঁয়ে এবং দুজনই নিজেদের পছন্দমতো কাজ করতে অভ্যস্ত। তাই কে পিছিয়ে আসেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

আরও পড়ুনইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পুতিনের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে: ট্রাম্প৮ ঘণ্টা আগে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউক র ন র ক টন ত ক বল ছ ন র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

গাজায় ব্যাংক খুলেছে, নেই নগদ অর্থ

ইসরায়েলের আগ্রাসনের শিকার ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতির ফলে কিছু কিছু ব্যাংক খুলেছে। তবে নগদ অর্থের ঘাটতির কারণে বড় সমস্যায় পড়েছেন গাজাবাসী। নগদ অর্থসংকটের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে তাঁদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা সবকিছুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।

দুই বছর ধরে গাজায় নির্বিচার হামলায় ঘরবাড়ি, স্কুল এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো অনেক ব্যাংক ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি ঘোষণার ছয় দিন পর ১৬ অক্টোবর থেকে কিছু ব্যাংক খোলা শুরু করে। এসব ব্যাংক থেকে অর্থ তুলতে বিপুলসংখ্যক মানুষ ভিড় করেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর তাঁদের বেশির ভাগকে হতাশা নিয়েই বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।

যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পরও গাজায় ইসরায়েলের সেনাদের হামলায় দুই শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে গাজায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৮ হাজার ৫২৭। যুদ্ধবিরতির পরও গাজায় ত্রাণসহ যেকোনো কিছু ঢুকছে ইসরায়েলের নজরদারিতেই।

নগদ অর্থের জন্য মধ্য গাজার নুসেইরাতে ব্যাংক অব প্যালেস্টাইনের বাইরে সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন ওয়ায়েল আবু ফারেস (৬১)। তিনি বলেন, ব্যাংকে কোনো অর্থ নেই। নগদ অর্থের সঞ্চালন নেই। হতাশার সুরে ছয় সন্তানের এই বাবা বলেন, ব্যাংকে এসে কাগজপত্রের লেনদেন করে চলে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।

গাজায় খাবার কেনা বা বিভিন্ন পরিষেবার বিল দেওয়ার মতো প্রায় সব দৈনন্দিন লেনদেন নগদ অর্থে করতে হয়। কিন্তু ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামলা শুরু হওয়ার পর গাজা অবরুদ্ধ করে রেখেছেন ইসরায়েলি সেনারা। ফলে সেখানে নিত্যপণ্য ও অন্যান্য সরঞ্জামের মতো নগদ অর্থও ঢুকতে পারছে না। যদিও যুদ্ধবিরতির পর এখন কিছু কিছু ত্রাণবাহী ট্রাক ঢুকছে।

গাজাভিত্তিক অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ আবু জাইয়্যাব বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ব্যাংক খোলা আছে, শীতাতপ যন্ত্রও চালু আছে। কিন্তু ইলেকট্রনিক লেনদেন ছাড়া মূলত আর কিছুই হচ্ছে না। কারণ, কোনো আমানত নেই। তাই নগদ অর্থ তোলা সম্ভব হচ্ছে না।

আবু জাইয়্যাব বলেন, ব্যাংক যেহেতু নগদ অর্থ দিতে পারছে না, তাই বেতন ক্যাশ করতে মানুষজন কিছু লোভী ব্যবসায়ীর কাছে যাচ্ছেন। তাঁদের ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি অর্থের বিনিময়ে বেতন ক্যাশ করতে হচ্ছে।

‘আমরা আর পারছি না’

গাজায় একসময় ব্যাংক লেনদেন এক ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যেত জানিয়ে সাত সন্তানের মা ইমান আল-জাবারি বলেন, ‘এখন ব্যাংকে লেনদেন করতে আপনাকে দুই বা তিন দিন যেতে হয়। একাধিকবার যাতায়াত করতে হয়। পুরোটা সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এত কিছু করে আপনি ৪০০-৫০০ শেকেলের (১২৩-১৫৩ ডলার) মতো তুলতে পারবেন। বর্তমানে অতি উচ্চমূল্যের বাজারে এই অর্থ দিয়ে কী কেনা যায় বলেন? আমরা আর পারছি না।’

নগদ অর্থের ঘাটতি অধিকাংশ গাজাবাসীর জন্য সমস্যা সৃষ্টি করলেও কিছু মানুষ এই সংকটকে জীবিকার উপায় হিসেবে কাজে লাগাচ্ছেন। মানাল আল-সাইদির মতো কেউ কেউ ছেঁড়া-ফাটা ব্যাংক নোট জোড়াতালি দেওয়ার কাজ করছেন। এতে তাঁদের রুটি-রুজি জুটছে। ৪০ বছর বয়সী এই নারী বলেন, ‘কাজ করে আমি দৈনিক ২০-৩০ শেকেল (৬-৯ ডলার) আয় করতে পারি। যা আয় হয়, তা দিয়ে আমি একটি রুটি, অল্প শিম ও ভাজাপোড়াসহ টুকটাক কিছু কিনতে পারি।’

ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজায় সবজির দাম আকাশছোঁয়া। মানাল আল-সাইদি বলেন, ‘সবজি বা এ জাতীয় অন্য কিছু কেনার মতো অর্থ আমি আয় করতে পানি না। আমার যা আয় হয়, তা দিয়ে কোনোমতে দিন চলে যায়।’

নগদ অর্থসংকটে জর্জরিত গাজার অনেক মানুষকে ডিম বা চিনির মতো প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্যও ব্যাংক অ্যাপের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক লেনদেনে ভরসা করতে হচ্ছে। এই সংকটে বিক্রেতারা অতিরিক্ত দাম আদায় করছেন।

নগদ অর্থ কখন ব্যাংকে আসবে ঠিক নেই

গাজায় বর্তমানে ত্রাণ সরবরাহ নজরদারি করছে ইসরায়েলে সেনাবাহিনীর ‘কো-অর্ডিনেটর অব গভর্নমেন্ট অ্যাকটিভিটিজ ইন দ্য টেরিটরিজ (সিওজিএটি)’ নামের একটি শাখা। কখন বা কীভাবে নগদ অর্থ গাজায় প্রবেশের অনুমোদন দেওয়া হবে, তা জানতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

নগদ অর্থের ঘাটতি গাজাবাসীর সংকটকে নানা দিক থেকে আরও নাজুক করে তুলেছে। তাঁবু, খাবার ও ওষুধ কিনতে অনেকে এরই মধ্যে সব সঞ্চয় শেষ করে ফেলেছেন ও হাতের কাছে যে সম্বল ছিল, তা-ও বিক্রি করে দিয়েছেন। কিছু মানুষ টিকে থাকার জন্য বিনিময় পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করছেন।

ফিলিস্তিনি ব্যবসায়ী সামির নামরাউতি (৫৩) জানান, এমন কিছু টাকা হাতে আসছে, যা অতিব্যবহারের ফলে চেনার উপায় নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি এসব টাকা নিচ্ছেন। নামরাউতির ভাষায়, ‘আমার কাছে নোটের সিরিয়াল নম্বর গুরুত্বপূর্ণ। যতক্ষণ সিরিয়াল নম্বর আছে, ততক্ষণ আমি নোটকে টাকা হিসেবে বিবেচনা করি।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ব্যাংক খুলেছে, নেই নগদ অর্থ