এ জীবন দিয়ে আমি কী করব, আমার একটি সন্তানই ছিল: উত্তর মেসিডোনিয়ায় আগুনে সন্তানহারা বাবার আহাজারি
Published: 17th, March 2025 GMT
উত্তর মেসিডোনিয়ায় নৈশ ক্লাবে আগুনে হতাহত ব্যক্তিদের শুরুতেই যে হাসপাতালে নেওয়া হয়, তার বাইরে আহাজারি করছিলেন দ্রাগি স্টোজানোভ। আগুনে একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছেন এই বাবা।
স্টোজানোভ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাকে সবার সামনে বলতে দিন, আমার ছবি তুলুন। আমি একজন মৃত মানুষ, আমি সবকিছু হারিয়েছি...পুরো ইউরোপের জানা দরকার। দুঃখজনক এই ঘটনার পর, এ জীবন দিয়ে আমি কী করব? আমি এ জীবন চাই না। আমার একটি সন্তানই ছিল এবং আমি তাঁকে হারিয়ে ফেলেছি।’
স্থানীয় সময় গত শনিবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে ইউরোপের বলকান অঞ্চলের দেশ নর্থ মেসিডোনিয়ায় দ্য পালস ক্লাব নামে একটি নৈশ ক্লাবে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ৫৯ জন নিহত এবং আরও ১৫৫ জন আহত হয়েছেন।
সেই রাতে বোনকে নিয়ে বেড়াতে বের হয়েছিলেন মারিজা তাসেভা। দুবোন মিলে গিয়েছিলেন কোচানির ওই নৈশ ক্লাবে, দেশটির জনপ্রিয় হিপ হপ ব্যান্ড ডিএনকের গান শুনতে।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ১৯ বছর বয়সী তাসেভা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘সবাই চিৎকার শুরু করে এবং বলতে থাকে, বেরিয়ে যাও, বেরিয়ে যাও।’
আগুন থেকে বাঁচতে লোকজন পাগলের মতো বেরিয়ে যাওয়ার দরজার দিকে ছুটতে থাকে। কিন্তু বেরিয়ে যাওয়ার একটি মাত্র পথ ছিল এবং সেখানে প্রায় ৫০০ মানুষ ছিল। নৈশ ক্লাবের পেছন দিকে আরেকটি দরজা থাকলেও সেটি তালাবদ্ধ ছিল।
তাসেভা বলেন, ‘আমি জানি না কীভাবে, কিন্তু আমি মাটিতে পড়ে গিয়েছিলাম, আমি উঠতে পারছিলাম না এবং সেই সময় লোকজন আমাকে পদদলিত করে চলে যেতে থাকে।’
তবে শেষ পর্যন্ত প্রাণ নিয়ে সেখান থেকে বের হতে পেরেছেন তাসেভা, কিন্তু তাঁর বোন পারেনি।
তাসেভা বলেন, ‘আমার বোন মারা গেছে। আমি বেঁচে গেছি, সে পারেনি।’
এ ঘটনার জন্য দায়ী সন্দেহে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যেসব মন্ত্রণালয় থেকে ওই অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, সেখানকার কর্মকর্তাদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
দ্য পালস ক্লাবে শনিবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে (রোববার ০১:৩০ জিএমটি) আগুনের সূত্রপাত হয়।
রাজধানী থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের শহর কোচানিতে নৈশ ক্লাবটি অবস্থিত। নৈশ ক্লাব হিসেবে পরিচালনার জন্য সেটির নিবন্ধন ছিল না। আগে এটি কার্পেট রাখার গুদাম ছিল।
ওই নৈশ ক্লাব পরিচালনার সঙ্গে ঘুষ প্রদান এবং দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
কোচানি হাসপাতালের প্রধান ক্রিস্টিনা সেরাফিমোভস্কা সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আতঙ্কে হুড়োহুড়ি করে বের হওয়ার সময় পদদলিত হয়ে বেশির ভাগ মানুষ মারা গেছেন।’
সংবাদ সংস্থা এএফপিকে সেরাফিমোভস্কা বলেছেন, ‘৭০ জন রোগী পোড়া ক্ষত এবং কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের বিষক্রিয়ায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।’
হাসপাতালের বাইরে থাকা রেডক্রসের স্বেচ্ছাসেবক মোস্তফা সাইদভ বলেছেন, যারা মারা গেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ।
সাইদভ আরও বলেন, ভেতরে যেখানে মৃতদেহ শনাক্ত করা চলছে, সেখানে পরিস্থিতি আরও বেশি খারাপ। সেখানে যেসব বাবা-মা এসেছেন, তাঁদের বয়সও কম, তাঁরা চল্লিশের কোঠায়। তাঁদের সন্তানদের বয়স ১৮ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। পরিস্থিতি নিষ্ঠুর, বিশৃঙ্খল, গল্পগুলো খুবই বেদনাদায়ক এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক তরুণ প্রাণ হারিয়েছেন।’
কেউ কেউ নিজেদের সন্তানদের খুঁজে পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন এক ব্যক্তি। আগুনে ওই ব্যক্তির এক স্বজন আহত হয়েছেন।
হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা প্রিয়জনের খবর পেতে হাসপাতালের বাইরে ভিড় করছেন। অনেককে ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছে, কেউ কেউ জবাব খুঁজছেন।
উত্তর মেসিডোনিয়ার প্রেসিডেন্ট গোরদানা সিলজানভস্কা-দাভকোভা বলেছেন, এ ঘটনার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। এবার যাঁরা জড়িত, তাঁদের কেউ বিচার এড়াতে পারবেন না।
প্রেসিডেন্ট বলেছেন, মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু হয় না, বিশেষ করে তরুণ প্রাণের।
গুরুতর আহত ব্যক্তিদের উন্নত চিকিৎসার জন্য বুলগেরিয়া, গ্রিস, সার্বিয়া ও তুরস্কের হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোরদানা।
এ ঘটনায় উত্তর মেসিডোনিয়ায় সাত দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে।
আরও পড়ুননর্থ মেসিডোনিয়ার নৈশক্লাবে আগুন, নিহত ৫৯১৬ ঘণ্টা আগে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বল ছ ন র জন য ঘটন র
এছাড়াও পড়ুন:
গান-কবিতায় ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের মুক্তমঞ্চ গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদ
ময়মনসিংহ নগরের জয়নুল আবেদিন উদ্যান এলাকায় সাহিত্য সংসদের মুক্তমঞ্চ গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদ জানিয়েছেন লেখক, শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা। আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে দুই ঘণ্টা ব্যাপি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নিচে গান, কবিতা ও কথায় এ কর্মসূচি পালিত হয়।
প্রায় চার দশক আগে প্রতিষ্ঠিত ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের মুক্তমঞ্চ গতকাল বুধবার দুপুরে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশন সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালায়।
এর প্রতিবাদে আজ ‘ময়মনসিংহের সচেতন নাগরিক ও শিল্পী সমাজ’–এর ব্যানারে প্রতিবাদ জানানো হয়। বেলা ১১টার দিকে প্রতিবাদী কর্মসূচি শুরু হয়। এ সময় পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) একটি দল এসে মাইকবিহীন কর্মসূচি করতে বলেন আন্দোলনকর্মীদের। কিন্তু প্রতিবাদী কর্মসূচি চলতে থাকে, দাঁড়িয়ে থাকে ডিবি পুলিশের দল। প্রতিবাদী কথা, গান ও কবিতা পড়তে থাকেন কবি ও সংস্কৃতিকর্মীরা। আগামীকাল শুক্রবার সকাল ১০টার মধ্যে সাহিত্য সংসদের মুক্তমঞ্চ পুনর্নির্মাণের দাবি জানান তাঁরা।
বীক্ষণ আসরের প্রথম আহ্বায়ক কথাশিল্পী সালিম হাসান বলেন, ‘ফ্যাসিস্টের অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে মানুষের কথা বলার মঞ্চ গুঁড়িয়ে দেওয়া। বিগত সরকার আমলে দীর্ঘ সময় আমাদের বুকে জগদ্দল পাথর চাপিয়ে আমাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু নতুন বাংলাদেশে গতকাল প্রশাসনের ভূমিকা আমাদের আশাহত করেছে এবং প্রতিবাদে উজ্জীবিত করেছে। দম্ভের কারণে হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। কিন্তু বর্তমান প্রশাসনে যাঁরা আছেন, তাঁরাও দাম্ভিকতা দেখালে পরিণাম ভালো হবে না।’
প্রতিবাদী কথার ফাঁকে ফাঁকে চলে প্রতিবাদী গান। শিল্পী হিরক সিঙ্গার, মিজান বাউলা, শাহনাজ সাথী বিদ্রোহী গান পরিবেশন করেন। কবি সাঈদ ইসলামের সঞ্চালনায় কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন কবি শামসুল ফয়েজ, নাফিসা মাহজাবিন, কামরুল হাসান ও শরৎ সেলিম, সংস্কৃতিকর্মী মাহমুদুল হাসান, সংগীতশিল্পী অঞ্জনা সরকার, আবুল কালাম আল আজাদ, চিত্রশিল্পী হোসাইন ফারুক, নাগরিক নেতা তৌহিদুজ্জামান ছোটন, আন্দোলনকর্মী আরিফুল হাসান, আজিত দাস, আবদুল্লাহ আল নাকীব প্রমুখ।
আশরাফ মীর বলেন, ‘অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে বিনা নোটিশে আমাদের মুক্তমঞ্চ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যা আমারের অন্তরে আঘাত দিয়েছে। কেন মুক্তমঞ্চ বিনা নোটিশে ভেঙে দেওয়া হলো? যার ইঙ্গিতে এই মুক্তমঞ্চ ভেঙে দেওয়া হলো, তিনি অনুতপ্ত হবেন এবং মঞ্চটি পুনরায় নির্মাণ করে দেবেন, এই আশা করি। আমরা জীবন ও বেদনার কথা বলি কবিতায়। আমরা শান্তি চাই, কোনো বিশৃঙ্খলা চাই না।’
স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীরা জানান, ১৯৮০ সালের ২১ মে ময়মনসিংহে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের সমন্বয়ে সাহিত্য সংসদ গঠিত হয়। ১৯৮৩ সাল থেকে নিয়মিত পাঠচক্র বীক্ষণ আসর শুরু হয়। আগামীকাল শুক্রবার ছিল বীক্ষণের ২১৪৬তম আসর। শুরু থেকে বিরতিহীন প্রতি শুক্রবার আসরটি বসে, যা বাংলা সাহিত্যের দীর্ঘতম পাঠচক্রের আসর। একটি মুক্তমঞ্চে কবি-সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিকর্মীরা সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কবিতা, গান, আলোচনা করে থাকেন। দেশের বিখ্যাত কবি–সাহিত্যিক এখানের মুক্তমঞ্চে সাহিত্যায়োজনে কবিতা পড়েছেন, সাহিত্য আলোচনা করে গেছেন।
পুনরায় মুক্তমঞ্চ নির্মাণের দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করেন সাঈদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আগামীকাল গুঁড়িয়ে দেওয়া মঞ্চের সামনে বীক্ষণের নিয়মিত আসর পালন করা হবে। এরপর শনি ও রোববার প্রশাসনকে সময় বেঁধে দেওয়া হবে। এ সময়ের মধ্যে বিষয়টি সমাধান না করলে সোমবার ময়মনসিংহসহ সারা দেশে কর্মসূচি দেওয়া হবে।’
সাহিত্য সংসদের সভাপতি কবি ফরিদ আহমদ দুলাল প্রথম আলোকে বলেন, নগরের জয়নাল আবেদিন উদ্যান এলাকায় ১৯৯৩ সালের দিকে তৎকালীন জেলা প্রশাসন সাড়ে ৬ শতক জমি সাহিত্য সংসদকে বরাদ্দ দেয়। সেই জমিতেই প্রশাসনই মুক্তমঞ্চের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। এখন সেই মুক্তমঞ্চ ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের সচিব সুমনা আল মজিদ গতকাল জানিয়েছিলেন, ‘কাগজপত্রে সাহিত্য সংসদ বলতে সেখানে কিছু নেই। অবৈধভাবে কোনো জায়গা দখল করলে তো হবে না। সাহিত্য সংসদ আমাদের কাছে আবেদন করলে আমরা অন্য জায়গায় ব্যবস্থা করে দেব।’
আরও পড়ুনময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের মুক্তমঞ্চ গুঁড়িয়ে দিল প্রশাসন, সংস্কৃতিকর্মীদের প্রতিবাদ১৫ ঘণ্টা আগে