গত ১৮ অক্টোবর সমকালে প্রকাশিত আমার সাপ্তাহিক কলামের শিরোনাম ছিল–‘বামপন্থিদের বেগার খাটা আর কতদিন?’ সেখানে অতীতের সব শাসক বদলে দেওয়া আন্দোলনের পাশাপাশি ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানেও বামপন্থিরা যে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন, তার প্রশংসা ছিল। একই সঙ্গে বামপন্থিদের সম্পর্কে কিছু সমালোচনাও ছিল। আমার বক্তব্য ছিল, ‘স্বাধীনতার পূর্বাপর সময়ে কোনো সফল গণআন্দোলনই বামপন্থিদের বাদ দিয়ে সম্ভবপর হয়নি।’

সর্বশেষ গণঅভ্যুত্থানও ‘সংগঠিত শক্তি হিসেবে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ার পরও বামপন্থিদের স্পর্শ ছাড়া তা সর্বাত্মক রূপ’ পায়নি। কিন্তু কাজ ফুরোবার সঙ্গে সঙ্গেই অতীতের মতো এবারও গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারীদের কাছে বামপন্থিরা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ল। এ পরিপ্রেক্ষিতেই আমার প্রশ্ন ছিল, ‘এবারও কি বামপন্থিরা অন্যের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হলেন?’ 

না; কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন অন্য মানুষদের মতো আমিও আশা করিনি যে বামপন্থি কেউ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীতে ঠাঁই পাবেন কিংবা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নানা জায়াগায় বসে তারা জাতিকে অহোরাত্র সবক দেবেন। এই সকল কিছুই যে বস্তুত গরল ভেল– তা বুঝতে এখন সচেতন মহল তো বটেই, আমজনতার মধ্যেও সম্ভবত কেউ বাকি নেই। আমার আক্ষেপ ছিল, গণঅভ্যুত্থান বামপন্থার জন্য যে রাজনৈতিক পরিসর তৈরি করেছে, তা তারা ধরতে পারেননি। 

বিশেষত ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রশ্নে অন্তত গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বামপন্থিদের ভূমিকা ছিল হতাশাজনক। বহু জায়গায় তাদের কর্মীরা আক্রান্ত হলেও অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মতোই বাম দলগুলো সরকারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে থাকে, এ ধরনের ঘটনা তেমন ঘটেনি। যা ঘটেছে তা মূলত রাজনৈতিক। যেন অমুসলিমদের এখানে কোনো দলকে পছন্দ করার অধিকারটুকুও নেই! গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দল ও সংগঠনগুলোর সিংহভাগ ছিল ডান ও চরম ডানপন্থি; সেখানে বামপন্থিরা ভেড়েন কীভাবে?

একই ইস্যু নিয়ে ভারতীয় সরকার ও মিডিয়ার তথ্য বিকৃতি ও বাড়াবাড়িও অনস্বীকার্য। কিন্তু সেটাকে কেন্দ্র করে ডিসেম্বরের ৪ তারিখে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে ডেকে যে ‘জাতীয় ঐক্য’ দেখিয়েছে, তা কতটা ফলপ্রসূ ছিল, জানা নেই। তবে সেই সভায় জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বামপন্থি নেতাদের সহাস্য বদনে ছবি আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে।

বাম নেতাদের দেশপ্রেম ধারণা বরাবর ছিল শাসক বুর্জোয়াদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেশপ্রেমের নামে গৃহীত শাসকদের কোন পদক্ষেপে তাদের হীন স্বার্থ লুকিয়ে থাকে; কোন পদক্ষেপে আমজনতার স্বার্থ যুক্ত, সে শিক্ষা বামপন্থিরাই মানুষকে দিয়েছেন। এ জন্য দেশে দেশে বহু বাম দলকে সমালোচনা এমনকি লাঞ্ছনাও কম সইতে হয়নি। ৪ ডিসেম্বরের ছবি দেখে আমার মনে হয়েছিল, বাম নেতারা সম্ভবত সেই শিক্ষাই ভুলে গেছেন। 

আগেও বলেছি, এখনও বলছি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি যেমন মুক্তিযুদ্ধ, তেমনি এখানকার রাজনীতিও মোটাদাগে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত। বিশেষত যারা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকার চান; এক কথায় উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা বলেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে বিবেচিত। কারণ এগুলোই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা; রাষ্ট্রের মূল সংবিধানেও যেগুলো অন্তর্ভুক্ত। তাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ঐতিহ্য লালনকারী বলেও চিহ্নিত করা হয়। কারণ মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধানের অন্যতম মূলনীতিও এটাই। যারা রাষ্ট্র ও সমাজে মূলত ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর প্রাধান্য সংরক্ষণ করতে চান, তাদের কাছে স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত আবেগ-অনুভূতির কোনো মূল্য থাকে না। তাদের কাছে তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেয়ে মুসলিম জাতীয়তাবাদই অগ্রগণ্য। এ ধারণা অমূলক নয়; প্রথম ভাগে আছে আওয়ামী লীগ ও বাম ধারার অধিকাংশ দল; বিপরীতে আছে বিএনপি-জামায়াত ও অন্যান্য রক্ষণশীল দল। নিজেকে যতই মধ্যপন্থি বলুক; অন্তত ক্রিয়া-কর্ম ও বুলি-বচনে স্পষ্ট– নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) দ্বিতীয় ভাগে।

ব্যাপার হলো, গণঅভ্যুত্থানের ধাক্কায় আওয়ামী লীগ এখন মাঠের বাইরে। ফলে বামদের বিচরণক্ষেত্র এখন বিশাল। বলতে গেলে সমাজের প্রায় পুরো উদারমনা অংশ। ১৮ অক্টোবরের কলামে আমার সংশয় ছিল– বাম দলগুলো আদৌ এ সুযোগ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত কিনা। তাদের গত তিন মাসের কার্যক্রমে মনে হচ্ছে, সেই সংশয় দূর হওয়ার কিছুটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। 

প্রথমত, ইতোমধ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ইস্যুতে বামপন্থিদের প্রধান শক্তি বাম গণতান্ত্রিক জোট বেশ স্বচ্ছ ও শক্ত অবস্থান নিয়েছে। তারা সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনায় শ্বেতপত্রের পাশাপাশি প্রতিকারও দাবি করেছে। সাম্প্রতিক নারী-শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনাগুলোর ন্যায়বিচার চেয়ে তারা যেভাবে রাস্তায় সক্রিয়, তা আশার সঞ্চার করেছে। এর আগে অর্থবছরের শেষভাগে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের ওপর হুট করে চাপিয়ে দেওয়া ভ্যাটের বিরুদ্ধে বামশক্তির মিছিল-মিটিংও ছিল চোখে পড়ার মতো। দ্রুত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বাম জোটের অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। বিএনপির সঙ্গে বামেরাও এ নিয়ে ধারাবাহিকভাবে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করায় দ্রুত গণতান্ত্রিক উত্তরণ নিয়ে জনমনে বিরাজমান শঙ্কা কেটে যাচ্ছে।

বর্তমান সময়ের অন্যতম জনাতঙ্ক মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাম দলগুলো যেভাবে দাঁড়িয়েছে, তাকে সীমিত অর্থে হলেও ‘গেম চেঞ্জার’ বলা যায়। বিদেশে বসে মব সন্ত্রাসের উস্কানিদাতারা যেন সরকারের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলেন। অন্তত সিপিবি কার্যালয় দখল কর্মসূচি ব্যর্থ হওয়ায় তাদের সেই ভাবমূর্তি ধাক্কা খেয়েছে।

এর মধ্যেও উদ্বেগের বিষয় হলো, বামপন্থিরা এখনও একটা প্ল্যাটফর্মে আসতে পারেননি। বর্তমানে বামদের প্রধান দুই প্ল্যাটফর্ম বাম গণতান্ত্রিক জোট ও গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। তার বাইরে আছে ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা ও আরও কিছু জোট। আবার বাম গণতান্ত্রিক জোটভুক্ত দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছাত্র ও অন্য গণসংগঠনগুলোও আলাদা প্ল্যাটফর্মে সক্রিয়। যেমন ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনে বাম গণতান্ত্রিক জোট ও গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি বেশ সক্রিয় ছিল। আবার ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে তাদেরই ছাত্র সংগঠনগুলো আলাদা দুই জোট করে মাঠে আছে। অথচ এরা সবাই এক হলে আন্দোলনের শক্তি কয়েক গুণ হতো।

বামদের আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে যে বাজে প্রচারণা চলছে, তা মোকাবিলার জন্যও সব বাম শক্তির এক প্ল্যাটফর্মে আসা দরকার। শুধু তা কেন; গণফোরামসহ উদারপন্থি দলগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন স্বতন্ত্র পেশাজীবী ও সংখ্যালঘু জাতি-ধর্মের সংগঠনকেও টানতে পারে তারা। শঙ্কা হয়, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বললে আওয়ামী লীগ লাভবান হবে– এই ভয়ে বাম দলগুলো বিগত সময়ের মতো এ নিয়ে কথা বলাই বন্ধ করে দেয়। অথচ মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলোর সুরক্ষায় দাঁড়ালে সব উদারমনা মানুষেরই সমর্থন পাবে তারা। বস্তুত এতদিন যে বিকল্প নির্মাণের কথা বামেরা বলে এসেছে, এখনই তার অনুকূল সময়। বাম নেতৃত্বের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতারও পরিচয় রাখার সময় এখন। 

সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন ব ম গণত ন ত র ক জ ট গণঅভ য ত থ ন ব মপন থ দ র প ল য টফর ম ব মপন থ র ব ম দলগ ল র জন ত ক সরক র র

এছাড়াও পড়ুন:

লন্ডনে ড. ইউনূস-তারেক রহমানের বৈঠককে স্বাগত জানাল জেএসডি

লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের আলোচনা ও ঐকমত্যের সূচনাকে স্বাগত জানিয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)। দলটি বলেছে, আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, জনগণ শুধু কথায় নয়, বাস্তবে সংস্কার ও বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতির পদক্ষেপ দেখতে চায়।

শুক্রবার জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন এক বিবৃতিতে এ কথা বলেন।

তারা বলেন, এই উচ্চপর্যায়ের সংলাপ দেশে রাজনৈতিক সমঝোতা ও জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানের কাঙ্ক্ষিত অভিপ্রায় অনুযায়ী রাষ্ট্র সংস্কার, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর এবং গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

বিবৃতিতে নেতারা বলেন, অধ্যাপক ইউনূস এবং তারেক রহমানের বৈঠক ও বিবৃতিতে আগামী বছরের পবিত্র রমজানের আগেই একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ এবং তার পূর্বশর্ত হিসেবে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার ও ফ্যাসিস্ট সরকারের বিচারের প্রক্রিয়ায় দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জনের ঘোষিত প্রত্যয়ে রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।

বিবৃতিতে বলা হয়, গণমানুষের রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম দাবি- গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য কাঠামোগত মৌলিক সংস্কার এবং গণহত্যাকারী ফ্যাসিবাদী শক্তির বিচারের ব্যবস্থা। এই বিষয় দুটির দৃশ্যমান অগ্রগতিই কেবল একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ভিত্তি রচনা করতে পারে।

রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সমাজের শ্রমজীবী, কর্মজীবী ও পেশাজীবীদের মতামত, আকাঙ্ক্ষা ও অংশগ্রহণে রাষ্ট্রীয় রাজনীতির মৌলিক সংস্কারের লক্ষ্যে দ্রুত ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়নের আহ্বান জানায় জেএসডি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নাগরিক সমাজ শাসকদের পক্ষে থাকে কেন?
  • আবু সাঈদ হত্যা: এক মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ ট্রাইব্যুনালের
  • রংপুরে আবু সাঈদ হত্যা: এক মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ ট্রাইব্যুনালের
  • গণঅভ্যুত্থানে আহত সামিউলের দিন কাটছে অনিশ্চয়তায়
  • লন্ডনে ড. ইউনূস-তারেক রহমানের বৈঠককে স্বাগত জানাল জেএসডি