সরকার যা বলে আর যা করে, তার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সবচেয়ে সুবোধ ও সুচিন্তিত সরকারের পক্ষেও সমাজে বৈষম্য দূর করা সম্ভব হচ্ছে না। গণতন্ত্রের অভাবে যারা বিপন্ন ছিল, তাদের বিপন্নতা এখনও দূর হয়নি। তাদের মনের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ আসেনি। এসব মন্তব্য করেছেন গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো এবং এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড.

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। 

গতকাল বৃহস্পতিবার এক সংলাপে তিনি বলেছেন, অনেকে এখন নৈতিকতার খবরদারির দায়িত্ব নিয়েছেন। এদের সংখ্যা বেশি নয়, কিন্তু তাদের কণ্ঠস্বর উচ্চ। এই কণ্ঠস্বর মোকাবিলা করতে উদারনৈতিক বহুত্ববাদী সমাজের পক্ষের মানুষকে দাঁড়াতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমি নিরাপদে থাকব ঘরে আর আমার পক্ষে মানুষ পরিবর্তন করে দেবে কিংবা আবার ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থান করবে– মনে করা বোকামি। প্রত্যেক নাগরিককে তার অধিকারের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।’ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন অগ্রগতি নিয়ে আয়োজিত সংলাপের সমাপনী অধিবেশনে এসব কথা বলেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টচার্য। 

‘জাতীয় এসডিজি রিপোর্ট (ভিএনআর) ২০২৫: পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশার অন্তর্ভুক্তি’ শিরোনামের সংলাপ রাজধানীর চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয়। এসডিজি বাস্তবায়ন অগ্রগতি নিয়ে এ সংলাপের আয়োজন করে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এবং গবেষণা সংস্থা সিপিডি। 

সংলাপে আরও বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টার এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ, জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস, ঢাকায় সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত রেতো রেংগলি, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলার প্রমুখ। সংলাপে সভাপতিত্ব করেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।   

ড. দেবপ্রিয় আরও বলেন, গত নির্বাচনগুলোতে সাড়ে ৩ কোটি যুবক ভোট দিতে পারেনি। তারা এবারের নির্বাচনে ভোট দিতে পারবে কিনা, ভোট দেওয়ার পর নিরাপদ থাকতে পারবে কিনা, সে আলোচনা খুব একটা দেখা যায় না। নির্বাচনের ইশতেহার নিয়ে আলোচনা চলছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। ইশতেহারে সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কল্যাণে আলাদা করে প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে। যে দলের ইশতেহার এ রকম প্রতিশ্রুতি থাকবে না, তা গ্রহণ করা হবে না। অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও টেকসই সমাজ বিনির্মাণে রাজনৈতিক দলগুলোর এ ধরনের প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন। 

বৈষম্য পরিস্থিতি নিয়ে ড. দেবপ্রিয় আরও বলেন, দেশে সবচেয়ে বড় আন্দোলন হলো বৈষম্যের বিরুদ্ধে। কিন্তু সব বৈষম্যের কথা বলা হয় না। কোনো বৈষম্যের কথা বলা হয়,  কোনো বৈষম্যকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। নারী ও পুরুষের বৈষম্যের কথায় লিঙ্গবৈচিত্র্যের কথা বলা হয় না। জাতীয়তার প্রশ্নে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বা তাদের জাতিসত্তার স্বীকৃতির কথা হয় না। যখন নতুন করে জাতীয় সত্তার অনুসন্ধান চলছে, তখনও বহুত্ব বা বহু ধরনের মানুষ নিয়ে যে বাংলাদেশ, সে কথা তেমন করে উচ্চারিত হয় না। 

লামিয়া মোরশেদ বলেন, বিগত দিনে এসডিজি কার্যক্রমে রাজধানীর বাইরে তেমন অংশগ্রহণ ছিল না। সরকারি পর্যায়ে তা সীমাবদ্ধ ছিল। আগস্ট বিপ্লব অংশীদারিত্বমূলক উন্নয়নের এক ঐতিহাসিক সুযোগ করে দিয়েছে। অন্তর্ভুক্তি টেকসই উন্নয়নের এ সুযোগ হাতছাড়া হতে দেওয়া যাবে না। 

সুইস রাষ্ট্রদূত বলেন, রাজনীতি এবং স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উত্তরণের মতো বড় দুই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে বাংলাদেশ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি এবং রাজনীতি প্রয়োজন। শান্তিপূর্ণ এবং অগ্রগতির বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সব পক্ষের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা প্রয়োজন। তাঁর দেশ বাংলাদেশের সহায়তায় অতীতের মতো পাশে থাকবে। 

সংলাপে আরও বক্তব্য দেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী শহীদ উজ জামান, একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির, সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত এসড জ

এছাড়াও পড়ুন:

পশ্চিমবঙ্গের চার শ্রমিককে বিদেশি বলে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর চেষ্টা ভারতের

আসাম রাজ্যের পর গোটা ভারত থেকেই বাংলাদেশি বলে ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো (পুশইন) হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শুধু তা–ই নয়, প্রমাণের অভাবে আবার তাঁদের অনেককে ফিরিয়েও আনতে হচ্ছে বলে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত অঞ্চল থেকে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গেরই সংবাদমাধ্যম।

দক্ষিণ ও মধ্য বাংলার দুই জেলা বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদের চার পরিযায়ী শ্রমিক মহারাষ্ট্রে কাজ করতে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করে মহারাষ্ট্র পুলিশ তাঁদের ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে তুলে দেয়। এরপর বিএসএফ তাঁদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়। এ চারজনই আবার মুসলমান।

মুম্বাইয়ে কাজ করতে যাওয়া মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমানের এই চার পরিযায়ী শ্রমিককে মহারাষ্ট্র পুলিশ বাংলাদেশি তকমা লাগিয়ে বিএসএফের হাতে তুলে দেয়। কোনো রকম যাচাই না করেই তাঁদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয় বিএসএফ। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজ্য পুলিশের উদ্যোগে গতকাল রোববার বিকেলে তাঁদের উদ্ধার করা হয়। বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিবি) কাছ থেকে ওই তিন নাগরিককে ফেরত নিয়ে বিএসএফ তাঁদের কোচবিহার জেলার পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে বলে জানা গেছে।

চারজনের মধ্যে তিনজনই মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দা। তাঁরা হলেন হরিহরপাড়ার তরতিপুর গ্রামের বাসিন্দা নাজিমুদ্দিন মণ্ডল, ভগবানগোলার মহিষাস্থলি গ্রামপঞ্চায়েতের হোসেনপুর গ্রামের বাসিন্দা মেহবুব শেখ ও বেলডাঙার কাজিশাহার বাসিন্দা মিনারুল শেখ। অন্যজন পূর্ব বর্ধমানের মন্তেশ্বর থানার কুলুট গ্রামের বাসিন্দা মোস্তাফা কামাল। তাঁরা প্রত্যেকেই পরিযায়ী শ্রমিক। মহারাষ্ট্রের মুম্বইয়ে তাঁরা রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। হেফাজতে নেওয়ার পাঁচ দিন পর তাঁদের উদ্ধার করা হলো বলে জানানো হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্র ‘পুবের কলম’ আজ সোমবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তাঁদের কাছে বৈধ নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও তাঁদের বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করে দুই প্রকৃত বাংলাদেশি নাগরিকের সঙ্গে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।

পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্র ‘পুবের কলম’ আজ সোমবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তাঁদের কাছে বৈধ নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও তাঁদের বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করে দুই প্রকৃত বাংলাদেশি নাগরিকের সঙ্গে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। দুই দিন ধরে তাঁরা কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ থেকে কিছুটা দূরে জিরো পয়েন্টে ছিলেন।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সহায়তায় মুঠোফোন থেকে ভিডিও বার্তায় ওই চার শ্রমিক তাঁদের দুর্দশার কথা জানান। তারপরেই তাঁদের ফেরানোর তৎপরতা শুরু করেন পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ পরিষদের চেয়ারম্যান তথা রাজ্যসভার সংসদ সদস্য সামিরুল ইসলামসহ অন্য জনপ্রতিনিধিরা। পুলিশও বিষয়টি বিএসএএফকে জানায়।

হরিহরপাড়ার বাসিন্দা শামীম রহমান গণমাধ্যমে বলেন, ‘স্থানীয় তৃণমূলের রাজনৈতিক নেতাদের বিষয়টি জানানো হয়। তারপর তাঁদের ফেরানোর তৎপরতা শুরু হয়। তাঁরা উদ্ধার হয়ে ঘরে ফিরছেন ভেবে ভালো লাগছে।’

সূত্রের খবর, বাংলাদেশি সন্দেহে চারজনকে আটক করে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের হাতে তুলে না দিয়ে ১০ জুন বিএসএফের হাতে তুলে দেয় মহারাষ্ট্র পুলিশ। তাঁদের মুম্বাই থেকে আগরতলা ও পরে কোচবিহারের মেখলিগঞ্জে পাঠানো হয়। ওই শ্রমিকদের টাকা, মুঠোফোনও কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

হরিহরপাড়ার তরতিপুর গ্রামের বাসিন্দা নাজিমুদ্দিন দুই বছর ধরে মুম্বাইয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। গতকাল সকালে তাঁর স্ত্রী পিংকি বিবি হরিহরপাড়ার বিধায়ক নিয়ামত শেখের সঙ্গে দেখা করেন। বিধায়কের মাধ্যমে বৈধ নথি সংসদ সদস্য সামিরুল ইসলাম ও প্রশাসনের কর্তাদের কাছে পাঠানো হয়। তারপরই তাঁদের ঘরে ফেরানোর তৎপরতা শুরু হয়।

হরিহরপাড়ার বিধায়ক নিয়ামত শেখ বলেন, নাজিমুদ্দিন এ দেশেরই নাগরিক। তাঁর বৈধ নথি ও নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র রয়েছে।

বিধায়ক নিয়ামত শেখ আরও বলেন, ‘তাঁর মতো আরও তিনজনকে বাংলাদেশি তকমা লাগিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেয় কেন্দ্রের বিএসএফ। গতকাল বিকেলে তাঁরা বিএসএফের হেফাজতে আসেন। আশা করছি, খুব তাড়াতাড়ি তাঁরা ঘরে ফিরবেন।’

এ বিষয়ে মুর্শিদাবাদ পুলিশের তরফে গতকাল জানানো হয়, আটক ব্যক্তিদের কাগজপত্র রোববার বিএসএফের হাতে তুলে দেয় রাজ্য পুলিশ। এরপরে বিএসএফ যাবতীয় কাগজপত্র রাজ্য পুলিশের সঙ্গে যৌথভাবে যাচাইয়ের পরে তা বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিবি) হাতে তুলে দেয়।

এরপর বিএসএফ সবাইকে ফেরানোর ব্যবস্থা করে এবং কোচবিহার পুলিশের হাতে তুলে দেয়। মুর্শিদাবাদ ও বর্তমানের জেলা পুলিশের একটি দল ওই পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনতে ইতিমধ্যে কোচবিহারের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। আজ সোমবার তাঁদের নিজে নিজে জেলায় ফেরানো হবে বলে জানা গেছে।

চারজনের মধ্যে তিনজনই মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দা। তাঁরা হলেন হরিহরপাড়ার তরতিপুর গ্রামের বাসিন্দা নাজিমুদ্দিন মণ্ডল, ভগবানগোলার মহিষাস্থলি গ্রামপঞ্চায়েতের হোসেনপুর গ্রামের বাসিন্দা মেহবুব শেখ ও বেলডাঙার কাজিশাহার বাসিন্দা মিনারুল শেখ। অন্যজন পূর্ব বর্ধমানের মন্তেশ্বর থানার কুলুট গ্রামের বাসিন্দা মোস্তাফা কামাল।

বাঙালি বলে হেনস্তা পশ্চিমবঙ্গে

তবে শুধু দরিদ্র পরিযায়ী শ্রমিকই নন, পশ্চিমবঙ্গে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত অনেকেই সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন, তাঁদের অন্যভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে।

দিল্লির এক অধ্যাপিকা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, গত কয়েক মাসে চারবার দক্ষিণ কলকাতার প্রধান পাসপোর্ট অফিসে গিয়েও তিনি তাঁর ২০০৭ সালের পুরোনো পাসপোর্ট নবায়ন করতে পারেননি।

এই অধ্যাপিকা বলেন, ‘আমাকে পুলিশের তরফে বলা হয়েছে, এখানে প্রচুর বাংলাদেশি ঢুকেছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। সে কারণে আমাদের যাঁদের প্রায় ২০ বছর ধরে বৈধ ভারতীয় পাসপোর্ট রয়েছে, তাঁদেরও সহজে পাসপোর্ট নবায়ন করা হচ্ছে না।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ