অভাব এতই প্রকট ছিল যে রাবার দিয়ে মুছে খাতার একটি পৃষ্ঠায় তিনবার লিখতে হয়েছে। অনেক বেলায় পেটে ভাত জোটেনি। পড়াশোনা চালিয়েছেন টিউশনি করে। তবু দারিদ্র্যের কাছে হার মানেননি। একটি কম্পিউটার কিনতে চাওয়ায় বাবাকে বেচতে হয়েছে তিন বসতঘরের একটি। মা বিক্রি করেছেন ছাগল। সেই কম্পিউটারের বদৌলতে এখন বহুতল বাড়ি, চার চাকার গাড়ি, গরুর খামার আর কোটি টাকার মালিক হয়েছেন রায়হান মিয়া।

নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার পারেরহাট গ্রামে নিভৃত পল্লিতে বসে ফ্রিল্যান্সিংয়ের (তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মুক্ত পেশাজীবী) কাজ করেন রায়হান মিয়া (৩২)। পাশাপাশি নিজের আইটি প্রতিষ্ঠানে বিনা মূল্যে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শিখিয়ে পথ দেখাচ্ছেন এলাকার বেকার তরুণদের। যাঁদের কাছে তিনি এখন অনুপ্রেরণা। এসব কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারি-বেসরকারি নানা স্বীকৃতিও পেয়েছেন।

রায়হানের কর্মকাণ্ড একজন ‘জনসেবকের’ মতো বলে মনে করেন পারেরহাট গ্রামের বাসিন্দা ইউপি সদস্য গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, বেকার শিক্ষিত যুবকদের স্বাবলম্বী করতে রায়হান গ্রামে গড়ে তুলেছেন সাদিয়া আইটি ফার্ম। সেখানে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ শিখিয়ে যুবকদের স্বাবলম্বী করে তুলছেন। তিনি এখন শত যুবকের স্বপ্ন দেখার চোখ।

২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একজন তাঁকে প্রথম ৪৮০ ডলারের একটি কাজ দেন। সময়মতো কাজটি শেষ করায় ১০০ ডলার বকশিশও পান। এরপর শুধুই সফলতার গল্প।

দারিদ্র্যের সঙ্গে বেড়ে ওঠা

রংপুর শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার পশ্চিমে বিনোদনকেন্দ্র ‘ভিন্নজগৎ’ পার হতেই পারেরহাট গ্রাম। পাকা সড়ক ধরে গ্রামে প্রবেশের মুখেই রায়হান মিয়ার বাড়ি। তিনতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকেন রায়হান। নিচতলায় করেছেন মাদ্রাসা। তৃতীয় তলায় সাজানো-গোছানো আইটি প্রতিষ্ঠান। সেখানে কাজ করেন রায়হানের বেতনভুক কর্মীরা। কেউ কেউ সেখানে আসেন শেখার জন্য। বাড়ির ১০০ গজ দক্ষিণে গড়ে তুলেছেন গাভির খামার।

নিজের প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখানোর ফাঁকে ফাঁকে সফল ফ্রিল্যান্সার হয়ে ওঠার গল্প শোনালেন রায়হান। ১৯৯২ সালে অভাবী পরিবারে জন্ম রায়হানের। ছয় ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। ভালো পোশাক তো দূরের কথা, সন্তানদের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে হিমশিম খেতেন বাবা অলিয়ার রহমান। প্রায়ই তাঁকে না খেয়ে স্কুলে যেতে হতো। এভাবে কিশোরগঞ্জ বহুমুখী মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের কারিগরি শাখা থেকে ২০০৭ সালে এসএসসি পাস করেন। ওই বছর ভর্তি হন ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের কম্পিউটার বিভাগে। থাকতেন একটি ছাত্রাবাসে।

রায়হান জানান, ঢাকায় গিয়ে টিউশনি শুরু করেন। তা দিয়ে অতি কষ্টে লেখাপড়া চলত। বাড়ি থেকে টাকা দিতে না পারায় কোনো কোনো দিন দুপুরের খাবার খাওয়া হতো না। হেঁটেই যাতায়াত করতেন।

ফ্রিল্যান্সিং করে মাসে এখন আয় তাঁর পাঁচ লাখ টাকা। এ ছাড়া ফাইবারে লেভেল ওয়ান সেলার হিসেবে কাজ করেন। পাশাপাশি ইউটিউব ও ফেসবুকে কনটেন্ট তৈরি করেন। অনলাইন মার্কেটপ্লেস ছাড়াও সরাসরি বেশ কিছু আমেরিকান কোম্পানির সঙ্গে কাজ করেন। প্রতিষ্ঠানে তাঁর অধীনে কাজ করেন ১৫ জন বেতনভুক্ত কর্মী।

মা বেচেন ছাগল, বাবা ঘর

অভাবের মধ্যে বেড়ে উঠতে উঠতে রায়হান কিছু একটা করার চেষ্টা করতে থাকেন। তখন সাতক্ষীরার এক বন্ধু তাঁকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কথা বলেন। একজন সফল ফ্রিল্যান্সারের গল্প রায়হানের ভাবনার জগতে নাড়া দেয়। রাজধানীর ভাষানটেকের একটি আইটি প্রতিষ্ঠানে তাঁর ফ্রিল্যান্সিংয়ের হাতেখড়ি। ২০১০ সালে তিনি গ্রাফিক ডিজাইনের ওপর ছয় মাসের কোর্স করেন।

রায়হান মিয়া বলেন, কাজ শেখার পরও কম্পিউটারের অভাবে কাজ করতে পারছিলেন না। ২০১১ সালে ডিপ্লোমা শেষ করে গ্রামে চলে আসেন। কম্পিউটার কেনার কথা জানানোর পর মা ময়না বেগম নিজের দুটি ছাগল বেচে ছেলেকে ছয় হাজার টাকা দেন। বাবা বাড়ির তিনটি টিনের ঘরের মধ্যে একটি বসতঘর বিক্রি করে দেন আরও ২০ হাজার টাকা। সেই টাকায় একটি পুরোনো কম্পিউটার কেনেন। আউটসোর্সিংয়ের কাজ দেওয়া-নেওয়ার কয়েকটি ওয়েবসাইটে (অনলাইন মার্কেট প্লেস) যুক্ত হন।

২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একজন তাঁকে প্রথম ৪৮০ ডলারের একটি কাজ দেন। সময়মতো কাজটি শেষ করায় ১০০ ডলার বকশিশও পান। এরপর শুধুই সফলতার গল্প। রায়হান জানান, তিনি এখন অনলাইন মার্কেট প্লেস আপওয়ার্কে টপ রেটেড প্লাস ফ্রিল্যান্সার। শুধু আপওয়ার্ক থেকে তাঁর কয়েক কোটি পেরিয়েছে। তাঁর গ্রাহকদের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, যুক্তরাজ্যের কোম্পানি। ফ্রিল্যান্সিং করে মাসে এখন আয় তাঁর পাঁচ লাখ টাকা। এ ছাড়া ফাইবারে লেভেল ওয়ান সেলার হিসেবে কাজ করেন। পাশাপাশি ইউটিউব ও ফেসবুকে কনটেন্ট তৈরি করেন। অনলাইন মার্কেটপ্লেস ছাড়াও সরাসরি বেশ কিছু আমেরিকান কোম্পানির সঙ্গে কাজ করেন। প্রতিষ্ঠানে তাঁর অধীনে কাজ করেন ১৫ জন বেতনভুক্ত কর্মী।

ফ্রিল্যান্সিংয়ের পাশাপাশি দুটি পুকুরে ছয় বছর ধরে বিভিন্ন মাছ চাষ করছেন। খামারে বিদেশি জাতের গাভি আছে ৩৫টি। জমি কিনে তিনতলা পাকা বাড়ি করেছেন, কিনেছেন দুই একর আবাদি জমি। রংপুর শহরেও বাড়ি করেছেন, আছে প্রাইভেট কার।

রায়হানের পথ ধরে অন্যরাও সফল

রায়হান শুধু নিজেই সফল হয়ে বসে থাকেননি; ২০১৮ সালে গ্রামের তরুণ-যুবকদের ফ্রিল্যান্সিং শেখানো শুরু করেন। প্রথমে কেউ সাড়া দেননি; কিন্তু রায়হানের সাফল্য দেখে ধীরে ধীরে অনেকেই আগ্রহী হয়ে ওঠেন। রায়হান তাঁদের বিনা পারিশ্রমিকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শেখানো শুরু করেন।

রায়হানের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে পারেরহাট গ্রামের অনেক তরুণ-যুবকই সচ্ছল হয়েছেন। আহসান হাবীব, মারজান হোসেন, রাতুল ইসলাম, হাসান রাজা, সাকিব হোসেনদের মাসিক আয় এখন এক থেকে দেড় লাখ টাকা।

গ্রামের তরুণ রিপন হোসেন ২০১৭ সালে এইচএসসি পাসের পর চাকরির পেছনে ছুটে বেড়িয়েছেন চার বছর। মাঝখানে ছোটখাটো ব্যবসা করেও সুবিধা হয়নি। ২০২১ সালে রায়হানের কাছে ডিজিটাল মার্কেটিং কোর্স করে শুরু করেন ফ্রিল্যান্সিং। এখন তাঁর মাসিক আয় দেড় লাখ টাকা। রিপন মিয়া বলেন, ‘রায়হান স্যারের প্রশিক্ষণ ও প্রেরণা আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে।’

আরও বড় স্বপ্ন রায়হানের

সেরা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে রায়হান ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ‘বেসিস আউটসোর্সিং অ্যাওয়ার্ড’ পান। এ ছাড়া জেলাভিত্তিক সেরা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ২০২৩ সালে জুলাইয়ে ‘রাইজিং ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন। ২০১২ সালে রুমানা আক্তারকে বিয়ে করেন রায়হান। এই দম্পতির তিন সন্তান।

কিশোরগঞ্জ বহুমুখী মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কামরুল হাসান বলেন, রায়হান ফ্রিল্যান্সিং করে সহায়সম্পত্তি, জমি, গাড়ি করেছেন; কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে সেই আগের মানুষটিই আছেন। রংপুর শহরে বাসা থাকার পরও তিনি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন গ্রামে। শিক্ষিত যুবকদের দিচ্ছেন প্রশিক্ষণ।

 রায়হানের বাবা অলিয়ার রহমান বলেন, ‘একদিন সমাজে কোনো পরিচয় ছিল না। মাথা নিচু করে চলতে হতো। আজ সফল ছেলের বাবা হিসেবে গর্ববোধ করি।’

নিজের পরিশ্রম আর চেষ্টায় এত দূর এসেছেন উল্লেখ করে রায়হান বলেন, ‘আমি চাই আরও তরুণ-তরুণীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সফল হতে সাহায্য করতে। আমার স্বপ্ন, বাংলাদেশে আরও বেশি মানুষ ফ্রিল্যান্সিংয়ে এগিয়ে আসুক এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে নিজেরা সচ্ছল হোক।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক জ কর ন য বকদ র কর ছ ন র একট

এছাড়াও পড়ুন:

রাজনীতিতে না জাড়ানোর কারণ জানালেন প্রীতি জিনতা

বলিউড অভিনেত্রী প্রীতি জিনতা এখন অভিনয়ে অনিয়মিত। অভিনয়ে তাকে দেখা না গেলেও নিজের ক্রিকেট দলের হয়ে মাঠে তাকে প্রায়ই দেয়া যায়। মাঝে গুঞ্জন উঠেছিলে রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছেন তিন। অবশ্য এবিষয়ে টুঁশব্দও করেননি এই অভিনেত্রী।

এদিকে মাস তিনেক আগে কংগ্রেসের পক্ষ অভিযোগ তোলা হয়েছিল, প্রীতি জিনতার ১৮ কোটি টাকার ঋণ নাকি মকুফ করে দিয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। শুধু তাই নয়, প্রীতি নাকি তার সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট বিজেপির হাতে সঁপে দিয়েছেন- এমন অভিযোগও ওঠে। এরপর বলিউড নায়িকার রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার জল্পনা শুরু হয়।

সম্প্রতি এক্স হ্যান্ডলে প্রীতি জিনতাকে একজন জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কি ভবিষ্যতে বিজেপিতে যোগ দেবেন? আপনার গত কয়েক মাসের টুইট দেখে তো তেমনটাই মনে হচ্ছে। জবাবে অভিনেত্রী বলেন, ‘সোশাল মিডিয়ায় ব্যবহারকারীদের এটাই একটা সমস্যা। সবাই এত বিচার করতে বসে যান সবকিছু নিয়ে। আমি যেমনটা আগে বলেছি, মন্দিরে, মহাকুম্ভে যাওয়া কিংবা নিজের পরিচয় নিয়ে আমি গর্বিত। তার মানে এই নয় যে এসমস্ত কারণে আমি বিজেপিতে যোগ দেব।’

প্রীতি বলেন, ‘ভারতের বাইরে থাকার ফলে আমি দেশের প্রকৃত মূল্য উপলব্ধি করতে পেরেছি এবং আর পাঁচজন ভারতীয়র মতোই গর্ববোধ করি আমার দেশকে নিয়ে।’

রাজনীতিতে না আসার কারণ গত ফেব্রুয়ারি মাসেও জানিয়েছিলেন প্রীতি জিনতা। সেসময় তিনি বলেন, ‘রাজনীতি আমার দ্বারা হবে না। বিগত কয়েক বছরে একাধিক রাজনৈতিক দল আমাকে টিকিট দিতে চেয়েছে। এমনকি রাজ্যসভার আসনের প্রস্তাবও এসেছিল। তবে আমি বিনম্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছি। কারণ, আমার ইচ্ছে নেই। আর আমাকে ‘সৈনিক’ বললেও অতিরঞ্জিত হবে না। কারণ, আমি একজন আর্মি পরিবারের সন্তান। আমার বাবা সৈনিক এবং আমার দাদাও। আর্মি পরিবারের সন্তান হওয়ায় আমাদের মানসিকতা খানিক আলাদা।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা নিজেদের উত্তর ভারতীয়, দক্ষিণ ভারতীয় কিংবা হিমাচলী বা বাঙালি বলে ভাবি না, আমাদের পরিচয় শুধুমাত্র ভারতীয়। আর হ্যাঁ, দেশভক্তি আমাদের রক্তে।’ সূত্র: সংবাদ প্রতিদিন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ৫০ পেরোনো নারীর খাদ্যাভ্যাস যেমন হতে হবে
  • যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করতে কাজ করছে চীন
  • সেলফি’র ধাক্কায় গণস্বাস্থ্যের কর্মীর মৃত্যু, ৬ বাস আটক
  • পেহেলগামে হামলার পর প্রতিশোধের আশঙ্কায় দিন কাটছে ভারতীয় মুসলিমদের
  • প্রথম আলোর সাংবাদিককে বৈষম্যবিরোধী নেতার হুমকি, থানায় জিডি
  • গাজীপুরে জমি নিয়ে বিরোধে সংঘর্ষ, হাতুড়িপেটায় একজন নিহত
  • সিদ্দিককে মারধর ও শিল্পীদের বিরুদ্ধে মামলা, যা বললেন অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি
  • একাধিক সুযোগ পেয়েও কেন রাজনীতিতে জাড়াননি প্রীতি জিনতা
  • সুযোগ পেয়েও কেন রাজনীতিতে জাড়াননি প্রীতি জিনতা
  • রাজনীতিতে না জাড়ানোর কারণ জানালেন প্রীতি জিনতা