সমগ্র দেশে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার নামে বরাদ্দকৃত বনের জমি পুনরুদ্ধারপূর্বক তথায় পুনর্বনায়নের যে সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকার গ্রহণ করিয়াছে, উহাকে আমরা স্বাগত জানাই। শুক্রবার প্রকাশিত সমকালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইতোমধ্যে একাধিক সরকারি সংস্থার নামে থাকা প্রাকৃতিক বনের ৮৭৫ একর জমির বরাদ্দ বাতিল করা হইয়াছে। শীঘ্রই আরও ১৩ সহস্র ৫৬৭ একরের বরাদ্দ বাতিল হইতেছে। আমরা জানি, একটা দেশের মোট ভূখণ্ডের ২৫ শতাংশ বনভূমি না থাকিলে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। অথচ বাংলাদেশ বন বিভাগের ২০১৯ সালের প্রতিবেদনমতে, দেশে বন আচ্ছাদিত অঞ্চল সমগ্র ভূমির ১৩ শতাংশেরও কম। এই বনভূমি হ্রাসের কারণে স্বাভাবিকভাবেই খাদ্য ও অস্তিত্ব সংকটে পড়িয়াছে বন্যপ্রাণী। ইতোমধ্যে সরীসৃপ, পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণীসহ ৩১টি প্রজাতি বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। উপরন্তু, প্রকৃতি সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএনের হিসাবে, বাংলাদেশে ৩৯০ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর প্রায় সকলেই অস্তিত্বের ঝুঁকিতে রহিয়াছে, যাহার মধ্যে মহাবিপন্ন বলিয়া চিহ্নিত হইয়াছে ৫৬টি বন্যপ্রাণী, বিপন্ন ১৮১ ও ঝুঁকিতে ১৫৩ প্রজাতি। বলা বাহুল্য, পরিবেশ-প্রতিবেশের উপর এহেন বন্যপ্রাণীর বিলুপ্তির প্রভাব নেতিবাচক হইতে বাধ্য। বাস্তবেই তাহা ঘটিয়াছে। একদিকে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হইতেছে, অন্যদিকে প্রাণ ও সম্পদ বিধ্বংসী নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাইয়াছে। আমাদের বাঁচিয়া থাকিবার অন্যতম প্রধান অবলম্বন যে কৃষি, উহাও একই কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া চলিয়াছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রাকৃতিক বন পুনরুদ্ধারের উক্ত সরকারি কর্মসূচিকে এক প্রকার আশার আলোরূপেও বর্ণনা করা যাইতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, গত তিন দশকে সমগ্র দেশে সরকারি ৪৫টি সংস্থার নামে ১ লক্ষ ৬১ সহস্র একর জমি বরাদ্দ করা হইয়াছিল এবং এই সকল জমির বৃহৎ অংশে ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ সম্পন্ন হইয়াছে। অথচ জাতীয় বননীতির ১৯ নম্বর ঘোষণায় বলা হইয়াছে, সরকারি মালিকানাধীন বনভূমি বনায়ন ব্যতীত অন্য কোনো কার্যে ব্যবহার করা যাইবে না। শুধু উহাই নহে, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, এমনকি প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন বনভূমিরূপে চিহ্নিত বনেও সরকারের প্রশাসন ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে জমি বরাদ্দ করা হইয়াছে। বন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলিয়াছেন, অনেক বনভূমি বন অধিদপ্তরের নামে নিবন্ধন নাই। তাই জেলা প্রশাসকগণ খাসজমিরূপে সংরক্ষিত বনের জমি প্রতীকী মূল্যে বন্দোবস্ত দেন। তবে সমস্যাটার মূল আরও গভীরে প্রোথিত। পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সমকালকে যথার্থই বলিয়াছেন, ‘বনভূমি বরাদ্দের অর্থ ইহাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা।’ অর্থাৎ বনভূমির সংজ্ঞা অতীতের সরকারসমূহের নিকট নিছক জমি ব্যতীত অন্য কিছু ছিল না। পরিবেশ সচেতন মহলের চাপে তাহারা বিভিন্ন সময় পরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষায় বনের গুরুত্ব স্বীকার করিতেন বটে, বাস্তবে সেই উপলব্ধি তাহারা হৃদয়ে ধারণ করিতেন না। ক্ষেত্রবিশেষ ক্ষমতায় টিকিয়া থাকিতেও তাহারা রাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংস্থাসমূহের বন বরাদ্দের অন্যায় আব্দার রক্ষা করিয়াছেন। প্রসঙ্গত, অতীতের কয়েকটি সরকার সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করিয়াছিল, যাহার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল প্রাকৃতিক বনের গুরুত্বকে হ্রাস করা। আমরা দেখিয়াছি, বিগত সরকারের আমলেও সরকারের শীর্ষ মহল প্রায়ই বড়াই করিয়া বলিত, সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে তাহারা বনভূমি ৯ শতাংশের উপরে বৃদ্ধি করিয়াছেন। অথচ এই ধরনের বন কস্মিনকালেও প্রাকৃতিক বনের বিকল্প হইতে পারে না। কারণ, আর যাহাই হউক এই ধরনের বনে বন্যপ্রাণীর বসবাস সম্ভবপর নহে। ফলে পরিবেশ-প্রতিবেশের সহিতও উহার সংযোগ তেমন নিবিড় হইতে পারে না।
আমাদের প্রত্যাশা, সকল প্রতিরোধ উপেক্ষা করিয়া সরকার প্রাকৃতিক বন উদ্ধারে যে মনোযোগ দিয়াছে, উহা যে কোনো মূল্যে অব্যাহত থাকিবে। একই সঙ্গে বনের জমি বনকে ফিরাইয়া দিয়া বনকে নিজের মতো করিয়া থাকিবার নীতিতেও তাহারা অটল থাকিবেন।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প র ক ত ক বন পর ব শ বর দ দ কর য় ছ বনভ ম সরক র হইয় ছ
এছাড়াও পড়ুন:
ট্রাম্পকে ইউক্রেনের পাশে থাকার আহ্বান রাজা চার্লসের
বিশ্বের সবচেয়ে জটিল কিছু সংকট সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত প্রতিশ্রুতির প্রশংসা করেছেন ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লস। একই সঙ্গে তিনি ‘স্বৈরাচারের (রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন) বিরুদ্ধে ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন সমর্থন’ দেওয়ার জন্য ট্রাম্পের প্রতি আহ্বান জানান। খবর বিবিসির।
বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) মার্কিন প্রেসিডেন্টের সফরের প্রথম দিনে উইন্ডসর ক্যাসলে আয়োজিত রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে দেওয়া বক্তৃতায় এ কথা বলেন রাজা।
আরো পড়ুন:
যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় ৩ পুলিশ নিহত
সম্পদ বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন করায় সাংবাদিকের ওপর ক্ষেপলেন ট্রাম্প
জবাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ সম্পর্কের প্রশংসা করে বলেন, এ সম্পর্ককে ‘বিশেষ’ শব্দ দিয়ে যথাযথভাবে বোঝানো যায় না।
উইন্ডসর ক্যাসলে ১৬০ জন অতিথির জন্য আয়োজিত জাঁকজমকপূর্ণ এই নৈশভোজে রাজার বক্তৃতায় দুই দেশের গভীর বন্ধন এবং সাংস্কৃতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক সম্পর্ক ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়।
ট্রাম্পের রাষ্ট্রীয় এ সফর চলবে আজ বৃহস্পতিবারও। এদিন নানা অনুষ্ঠানে মার্কিন ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্পের সঙ্গে অংশ নেবেন ব্রিটিশ রানি ক্যামিলা ও প্রিন্সেস অব ওয়েলস।
রাজকীয় অ্যাপায়ন শেষে ট্রাম্পের আজকের কর্মসূচি রাজনৈতিক আলোচনায় রূপ নেবে। আজ বৃহস্পতিবার ট্রাম্প ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে তার সরকারি বাড়ি চেকার্সে বৈঠক করবেন। বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনও হবে।
বুধবারের (১৭ সেপ্টেম্বর) রাষ্ট্রীয় ভোজ ছিল আড়ম্বর ও রাজনীতির সমন্বয়ে সাজানো এক বিশেষ আয়োজন। ভোজে রাজা, রানি ও রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের উপস্থিতিতে ট্রাম্পকে স্বাগত জানানো হয় উইন্ডসরে।
উইন্ডসর ক্যাসলের মনোরম প্রাঙ্গণে পৌঁছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও মেলানিয়া রাজকীয় ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামেন। সেখানে সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো সেনাদলের অভিবাদন গ্রহণ করেন তারা।
যুক্তরাজ্যের কর্মকর্তাদের মতে, বিদেশি কোনো রাষ্ট্রপ্রধানকে স্বাগত জানানোর জন্য দেশটিতে আয়োজিত স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সামরিক সংবর্ধনা ছিল এটি।
যুক্তরাষ্ট্রের অতিথিকে স্বাগত জানাতে প্রিন্স ও প্রিন্সেস অব ওয়েলসও উপস্থিত ছিলেন। তারা প্রেসিডেন্ট ও মেলানিয়ার সঙ্গে উষ্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ এক বৈঠকও করেন।
ভোজসভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রিন্স উইলিয়ামের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে তিনি হবেন ‘অসাধারণ সফল নেতা’। প্রিন্সেস অব ওয়েলস ক্যাথরিনকে তিনি আখ্যা দেন ‘উজ্জ্বল, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ও সুন্দরী’ হিসেবে।
ট্রাম্পের ঐতিহাসিক এ দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় সফর প্রমাণ করেছে রাজা ও তাঁর মধ্যে সম্পর্ক বেশ ভালো। সফরে আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজে তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মুহূর্তও দেখা গেছে।
এরপর রাজপ্রাসাদে ট্রাম্প দম্পতিকে স্বাগত জানান রাজা তৃতীয় চার্লস ও রানি ক্যামিলা। ট্রাম্প যখন রাজার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছিলেন, তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের ছয়টি কামান থেকে একযোগে ৪১ বার তোপধ্বনি করা হয়। একই সময়ে টাওয়ার অব লন্ডন থেকে একই রকম তোপধ্বনি হয়।
ট্রাম্প দম্পতিকে স্বাগত জানানোর এ আয়োজনে অংশ নেন ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর ১ হাজার ৩০০ সদস্য। ছিল শতাধিক ঘোড়া।
যুক্তরাজ্যের কর্মকর্তাদের মতে, বিদেশি কোনো রাষ্ট্রপ্রধানকে স্বাগত জানানোর জন্য দেশটিতে আয়োজিত স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সামরিক সংবর্ধনা ছিল এটি।
বিবিসি বলছে, রাজকীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি, বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা থাকবে।
যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রীয় সফর হলো একধরনের নরম শক্তির কূটনীতি, যা গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য রাজকীয় আকর্ষণ ব্যবহার করে, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কেউ নেই।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্টারমার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আর্থিক সেবা, প্রযুক্তি এবং জ্বালানি খাতে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় গড়ে তুলে যুক্তরাজ্যকে আমেরিকান বিনিয়োগের প্রধান গন্তব্য হিসেবে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করছেন। এর মাধ্যমে তিনি নিজ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি করতে চাইছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের সফর শুরু হওয়ার সাথে সাথে, মার্কিন প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর সঙ্গে যুক্তরাজ্যে ৩১ বিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগের একটি বড় প্রযুক্তি চুক্তি ঘোষণা করা হয়েছে। যার মধ্যে মাইক্রোসফট থেকে ২২ বিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং পারমাণবিক শক্তিতে সহযোগিতা দেখা যাবে।
ট্রাম্পের সফরের আগে গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট যুক্তরাজ্যের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণায় ৫ বিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার ট্রাম্প-স্টারমারের বৈঠক থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলারের ব্যবসায়িক চুক্তির ঘোষণাও আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ঢাকা/ফিরোজ