ভারতে মোগল শাসক আওরঙ্গজেবকে নিয়ে এখন কেন এত বিতর্ক
Published: 22nd, March 2025 GMT
দত্ত শিরকে দুই দিন বাড়ি থেকে বের হননি। পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে তাঁর আশঙ্কা ছিল। তিনি যেখানে বসবাস করেন, সেখানে সড়কের পাশে পার্ক করে রাখা গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ চলার সময় এমন ঘটনা ঘটেছে।
দত্তের বাড়ি থেকে মাত্র এক মাইল দূরে থাকেন আসলাম। তিনি তাঁর পুরো নাম বলতে চাননি। তিনিও একইভাবে ভীত, আতঙ্কিত। তিনি বাড়ি ফিরতে ভয় পাচ্ছেন, যেখানে তাঁর স্ত্রী ও মা রয়েছেন। তাঁর আশঙ্কা, বাড়িতে গেলে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারে। তিনি বলছেন, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশ নিরীহ মুসলিমদের গ্রেপ্তার করছে। আসলাম বলেন, ‘আমি কিছুই করিনি। কিন্তু পুলিশ যখন বাড়ি আসবে, তখন তারা আমি কোন সম্প্রদায়ের, সেটাই বিবেচনা করবে।’
মোগল বাদশাহ আওরঙ্গজেবের সমাধি সরানোর দাবিকে ঘিরে মহারাষ্ট্রের নাগপুর শহর অশান্ত হয়ে ওঠে। সম্ভাজি নগরকে কেন্দ্র করে এই সহিংসতার সূচনা হয়। এই জেলার আগের নাম ছিল আওরঙ্গবাদ। বর্তমান নাম ছত্রপতি শিবাজির জ্যেষ্ঠ ছেলে সম্ভাজির নামে, সম্ভাজি নগর।দত্ত ও আসলাম দুজনই ৩০ লাখ মানুষের নগর নাগপুরের বাসিন্দা। ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের এই শহরে রয়েছে মোগল বাদশা আওরঙ্গজেবের সমাধি। বেশ কিছুদিন ধরে তাঁর সমাধি সেখান থেকে সরানোর দাবি জানিয়ে আসছেন হিন্দুত্ববাদীরা।
গত সোমবারের সহিংসতা ঘিরে নাগপুরে কারফিউ জারি করা হয়েছে। তল্লাশি অভিযান চালিয়ে অন্তত ৫০ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, যাঁদের বেশির ভাগই মুসলিম। এই নাগপুর শহরে ৩০ মার্চ সফরে আসছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই শহরে আবার বিজেপির আদর্শিক উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সদর দপ্তর।
ভারতজুড়ে গেরুয়া পোশাকের মানুষের জন্য এই নগরের আলাদা একটা খ্যাতি রয়েছে। কেন এই শহরে সাম্প্রদায়িক সংঘাত দেখা দিল। কে এই আওরঙ্গজেব? কেন এখনো তাঁকে নিয়ে ভারতে বিভক্তি?
ভারতীয় উপমহাদেশে মোগল শাসকদের মধ্যে আওরঙ্গজেব ছিলেন সবচেয়ে প্রভাবশালী। প্রায় ৫০ বছর তিনি ভারত শাসন করেছেন। তাঁর সমাধি নাগপুরে নয়। এটি নাগপুর শহর থেকে ৪৫০ কিলোমিটার (২৮০ মাইল) দূরে অবস্থিত। ওই জায়গার নাম ২০২৩ সাল পর্যন্ত ছিল আওরঙ্গবাদ। এরপর ওই জায়গার নাম পরিবর্তমন করে ছত্রপতি সম্ভাজির নামে করা হয়েছে।নাগপুরে কেন সহিংসতাগত সপ্তাহে মোগল বাদশাহ আওরঙ্গজেবের সমাধি সরানোর দাবিকে ঘিরে মহারাষ্ট্রের নাগপুর শহর অশান্ত হয়ে ওঠে। সম্ভাজি নগরকে কেন্দ্র করে এই সহিংসতার সূচনা হয়। এই জেলার আগের নাম ছিল আওরঙ্গবাদ। বর্তমান নাম ছত্রপতি শিবাজির জ্যেষ্ঠ ছেলে সম্ভাজির নামে, সম্ভাজি নগর। সেখানেই খুলদাবাদ এলাকায় রয়েছে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধি। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা সেই সমাধি সেখান থেকে সরানোর দাবি অনেক দিন ধরেই জানিয়ে আসছেন। সম্প্রতি সেই দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে।
গত সোমবার নাগপুর শহরের মহল অঞ্চলে এই দাবিতে উগ্রবাদী বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের প্রতিনিধিরা জমায়েত করেন। তাঁদের অভিযোগ, ১৬৫৮ সাল থেকে ১৭০৭ সাল পর্যন্ত ভারতের শাসক আওরঙ্গজেব হিন্দুদের প্রতি বৈষম্য করেছেন এবং তাঁদের প্রার্থনালয়ে হামলা চালিয়েছেন। জমায়েতে সবুজ কাপড়ে ঢাকা আওরঙ্গজেবের কুশপুত্তিলকায় আগুন লাগানো হয়।
বিক্ষোভ কর্মসূচির অন্যতম আয়োজক ও ভিএইচপির মুখপাত্র অমিত বাজপাই বলেন, ‘এই কবর আমাদের মাতৃভূমির জন্য এক কালো দাগ। আমরা একটা চত্বরে জড়ো হয়েছি এবং পুলিশের সামনে সবুজ কাপড়ে মোড়ানো আওরঙ্গজেবের কুশপুত্তলিকা পুড়িয়েছি।’
অমিত আরও বলেন, ‘আমরা যা সঠিক মনে করি, তার দাবি করা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার।’
মুসলিম দোকানিসহ প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছেন, পুলিশ বিক্ষোভকারীদের থামাক। বিশেষ করে এই পবিত্র রমজান মাসে যখন এমন আন্দোলন হচ্ছেআসিফ কুরেশি, আইনজীবী ও মহারাষ্ট্র বার কাউন্সিলের সাবেক সভাপতিআইনজীবী ও মহারাষ্ট্র বার কাউন্সিলের সাবেক সভাপতি আসিফ কুরেশি বলেন, মুসলিম দোকানিসহ প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছেন, পুলিশ বিক্ষোভকারীদের থামাক। বিশেষ করে এই পবিত্র রমজান মাসে যখন এমন আন্দোলন হচ্ছে।
গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল, কুশপুত্তলিকাকে মোড়ানো সবুজ কাপড়ে পবিত্র কোরআন শরিফের আয়াত লেখা ছিল। এমন তথ্য জানাজানির পর মুসলিমদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ওই দিন ইফতার ও মাগরিবের নামাজের পর একদল মুসলমি ওই ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন। তাঁরা পবিত্র কোরআনের আয়াত পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে ভিএইচপির সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরসহ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।
কুরেশি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল এবং ক্ষুব্ধ জনতা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ল।’
তখন থেকে নাগপুর শহরের একাংশে কারফিউ জারি করা হয়েছে। এরপর পুলিশ অভিযান চালায়। কুরেশি বলেন, সংঘর্ষে জড়িত ছিল এমন মুসলিমদের পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারে, ঠিক আছে। কিন্তু নামাজ আদায় করতে গেছে, এমন অনেক নিরীহ মানুষকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
সংঘর্ষের পর ভিএইচপির মুখপাত্র বাজপাই বলেন, তিনি চরম ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ। উগ্র হিন্দুত্ববাদী এই নেতা বলেন, ‘এখন আমরা আরও কঠোরভাবে প্রতিরোধ করব। তাঁরা (মুসলিম) কেন মনে করছে, দাঙ্গা বাঁধিয়ে তাঁরা আমাদের ভীতসন্ত্রস্ত করতে পারবেন। আমরা চাই, আওরঙ্গজেবকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হোক।’
মহারাষ্ট্র রাজ্যের বিজেপিদলীয় মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফাডনাভিস গত মঙ্গলবার বলেন, তাঁর মনে হচ্ছে, সম্প্রতি বলিউডে নির্মিত একটি সিনেমায় আওরঙ্গজেবকে ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ওই সিনেমার কারণে হিন্দুদের মধ্যে এমন প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
‘চাভা’ নামের ওই সিনেমায় মোগল শাসকের সঙ্গে মারাঠাদের যুদ্ধ চিত্রিত করা হয়েছে। সেই মারাঠারা তখন আজকের এই মহারাষ্ট্র শাসন করত।
ফাডনাভিস বলেন, ওই সিনেমা হয় তো ‘আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ’ সামনে নিয়ে এসেছে।
আওরঙ্গজেব কেভারতীয় উপমহাদেশে মোগল শাসকদের মধ্যে আওরঙ্গজেব ছিলেন সবচেয়ে প্রভাবশালী। প্রায় ৫০ বছর তিনি ভারত শাসন করেছেন। তাঁর সমাধি নাগপুরে নয়। এটি নাগপুর শহর থেকে ৪৫০ কিলোমিটার (২৮০ মাইল) দূরে অবস্থিত। ওই জায়গার নাম ২০২৩ সাল পর্যন্ত ছিল আওরঙ্গবাদ। এরপর ওই জায়গার নাম পরিবর্তন করে ছত্রপতি সম্ভাজির নামে করা হয়েছে। তিনি ছত্রপতি শিবাজির ছেলে।
উগ্র হিন্দুত্ববাদী গ্রুপগুলোর দাবির মুখে ওই জায়গার নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। এই হিন্দুত্ববাদীরা দীর্ঘদিন ধরে মনে করছেন, আওরঙ্গজেব হচ্ছেন আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুর ভিলেন। তবে ইতিহাসবিদেরা যুক্তি তুলে ধরে বলেন, আজকের ভারতে আওরঙ্গজেবকে যেভাবে চিত্রায়িত করা হচ্ছে, তাঁর বিষয়টি তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল।
ইতিহাসবিদ ও লেখক অড্রে ট্রুসকি তাঁর ‘আওরঙ্গজেব: দ্য ম্যান অ্যান্ড দ্য মিথ’ বইয়ে বলেছেন, ‘আওরঙ্গজেব একটি শক্তিশালী রাজপরিবারের উত্তরাধিকার। তিনি তাঁর বাবাকে বন্দী করে আর বড় ভাইকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেছিলেন। তবে ক্ষমতাপিপাসু এই শাসক তাঁর সময়ে যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন অতুলনীয়। ঐক্য ও জোট গড়ার ক্ষেত্রে ছিলেন দারুণ এক নেতা।’
ট্রুসকি বলেন, ‘আওরঙ্গজেবের নীতিনির্ধারণে তাঁর প্রপিতামহ আরেক মোগল শাসক সম্রাট আকবরের প্রভাব ছিল অপরিসীম।’
এই ইতিহাসবিদ ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আওরঙ্গজেব তাঁর সাম্রাজ্যে সব ধরনের মানুষকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছিলেন। একজন যুবরাজ হিসেবে তিনি পুরো সাম্রাজ্য ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি সবকিছু বোঝার চেষ্টা করেছেন। তিনি সব পক্ষের মানুষ—মারাঠা থেকে রাজপুত—সবার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলেছিলেন। পরে এসব মানুষকে তিনি তাঁর রাজসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিলেন।’
তবে ট্রুসকি এটাও বলেন, ‘আওরঙ্গজেব খুব কঠিন ইসলামি আইন বলবৎ করেছিলেন। তিনি বৈষম্যমূলক করারোপ করেছিলেন, যাতে সুরক্ষার বিনিময়ে হিন্দু অধিবাসীদের কর দিতে হতো।’ তিনি বলেন, ‘আওরঙ্গজেব তাঁর নানা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে বেশ জটিল এক বাদশাহ ছিলেন।’
ভারতের উগ্র ডানপন্থী হিন্দুরা আওরঙ্গজেবকে ধর্মান্ধ বলে অভিযোগ তুললেও ট্রুসকি বলেন, এই মোগল শাসক তাঁর রাজত্বকালে বারবারই দেখিয়েছেন, তিনি বিশ্বাস দিয়ে নয়, তিনি রাজ্য সাম্রাজ্য শাসন করেছিলেন ক্ষমতা দিয়ে। এই ইতিহাসবিদ বলেন, ‘যখনই ধর্ম আর ক্ষমতা মুখোমুখি অবস্থানে এসেছে, তিনি ক্ষমতাকে বেছে নিয়েছিলেন। সব সময়ই তিনি এ কাজটি করেছেন।’
তাঁর মনে হচ্ছে, সম্প্রতি বলিউডে নির্মিত একটি সিনেমায় আওরঙ্গজেবকে ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ওই সিনেমার কারণে হিন্দুদের মধ্যে এমন প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারেদেবেন্দ্র ফাডনাভিস, বিজেপিদলীয় মুখ্যমন্ত্রী, মহারাষ্ট্রআওরঙ্গজেবকে নিয়ে ভারতে কেন বিভক্তিঅনেক ঐতিহাসিক একটি বিষয়ে একমত, শাসক হিসেবে ওই সময়ে কোনো রাজা বা বাদশাহ গণতান্ত্রিক ছিলেন না। ট্রুসকি বলেন, নানাভাবে দেখলে প্রাক্–আধুনিক যুগে ভারতের অন্যান্য রাজার থেকে আওরঙ্গজেবও বিশেষভাবে বিচ্যুত ছিলেন না।
ট্রুসকি বলেন, কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকেরা আওরঙ্গজেবের নিন্দা ও সমালোচনা করে থাকেন। বিজেপি ও আরএসএসের অনুসারী হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা মূলত উপনিবেশ–পূর্ব যুগের সেই অপপ্রচারের পুনরাবৃত্তি করছেন।
ভারতে আওরঙ্গজেববিরোধী অনুভূতি ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে এবং এটিকে আক্রমণাত্মকভাবে এমনকি সহিংস উপায়ে ব্যবহার করা হচ্ছে।
২০২৪ সালে একটি শোভাযাত্রায় আওরঙ্গজেবের ছবিসংবলিত পোস্টার বহন করায় চার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ২০২৩ সালে ইনস্টাগ্রামে আওরঙ্গজেবকে নিয়ে পোস্ট দেওয়ায় ১৪ বছর বয়সী এক মুসলিম বালককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
২০২২ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার স্কুল ও মাধ্যমিক স্কুলের ইতিহাসের বই থেকে মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস অধ্যায় বাদ দিয়ে দেয়। বই থেকে আওরঙ্গজেব ও তাঁর পূর্বসূরি শাসকদের বিস্তারিত তথ্যসংবলিত একটি টেবিল মুছে দেওয়া হয়।
মোদি ও তাঁর রাজনৈতিক সমর্থকদের বেশির ভাগের কাছে আওরঙ্গজেব কেবল ইতিহাস নয়। তাঁরা ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করেন, আওরঙ্গজেব অসংখ্য মন্দির ধ্বংস করেছেন। আবার এটাও জানা যায়, তিনিই হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির তৈরির জন্য জমি ও অর্থ বরাদ্দ দিয়েছিলেন।
এখন হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা দাবি তুলেছেন, বিজেপিদলীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনী আসন ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ বারানসির জ্ঞানবাপি মসজিদের নিচে শিবলিঙ্গ আছে। তাঁরা দাবি করছেন, ষোড়শ শতকে নির্মিত বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস করে ১৬৬৯ সালে আওরঙ্গজেবের নির্দেশে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে।
২০২২ সালে বারানসিতে এক জনসভায় ভাষণদানকালে নরেন্দ্র মোদি ‘আওরঙ্গজেবের নৃশংসতা ও তাঁর সন্ত্রাস’ নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘তরবারি দিয়ে তিনি সভ্যতার পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। ধর্মান্ধতা দিয়ে তিনি সংস্কৃতিকে ধ্বংসের চেষ্টা করেছিলেন।’
তখন থেকে হিন্দুত্ববাদী নেতা নরেন্দ্র মোদি অসংখ্যবার আওরঙ্গজেবকে নিয়ে বক্তৃতা করেছেন।
নাগপুরে সংঘর্ষের এক দিন পর মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী ফাডনাভিস বলেন, ‘এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে আওরঙ্গজেবের নির্যাতনের ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও সরকারকেই তাঁর কবর সংরক্ষণের দায়দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।’
১৯৫৮ সালের একটি আইনের আওতায় ভারতের প্রত্নতত্ত্ব সমীক্ষাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ঘোষিত জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্মতিচিহ্ন হিসেবে আওরঙ্গজেবের সমাধি সুরক্ষিত। বেআইনিভাবে এটির নকশা বদল বা ধ্বংস করা থেকে সুরক্ষা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব।
নাগপুরে মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের উত্তেজনা চলতে থাকায় এখানকার বাসিন্দা ও স্থানীয় কর্মীরা আশঙ্কা করছেন, আশপাশের এলাকায় সংঘাত আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
দত্ত শিরকে বলেন, ‘একের প্রতি অন্যের কোনো আস্থা বা বিশ্বাস নেই। আমি আস্থা রাখতে পারছি না যে আমার প্রতিবেশী সুযোগ পেলে আমার ও পরিবারের ক্ষতি করবে না।’
কুরেশি বলেন, মুসলিম বাসিন্দারা পুলিশের তল্লাশি অভিযানের ভয়ে আছেন। তিনি আশা করেন, কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব ছাড়া রাজ্যের কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে।
ইতিহাসবিদ ট্রুসকি বলছিলেন, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইতিহাস নিয়ে যেভাবে চিন্তা করে থাকে, সেখানে অতীতে বা বর্তমানে মুসলমিদের প্রতি ঘৃণার চিত্র ফুটে ওঠে। ইতিহাস আসলে এক জটিল বিষয়। কোনো সম্প্রদায় বা দেশ ইতিহাসকে কীভাবে দেখছে, কীভাবে অনুধাবন করছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এই ইতিহাসবিদ আরও বলেন, ১৭ শতকে যদি ঘটনা ঘটেও থাকে, সেটি নিয়ে এখন মামলা–মোকদ্দমা ও সহিংসতা আসলে কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ ছাড়া আর কিছু নয়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ র প ত র কর ওই স ন ম কর ছ ল ন স ঘর ষ ব স কর কর ছ ন ব দশ হ দ র কর করছ ন ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
বুড়িগঙ্গায় ডুবে যাওয়া কামান কালু ঝমঝমকে কি খুঁজে পাওয়া সম্ভব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল থেকে একটু সামনে এগোলে ঢাকা গেট। ঢাকা গেটে রাখা আছে মোগল আমলে বাংলার সুবেদার মীর জুমলার কামান ‘বিবি মরিয়ম’। তেমনই একটি কামান ২৩৮ বছর আগে বুড়িগঙ্গায় তলিয়ে গেছে।
তলিয়ে যাওয়া কামানটির নাম ‘কালু ঝমঝম’। ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মনে করেন, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনুসন্ধান চালালে কামানটি খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু নয়। সে জন্য দরকার সরকারি উদ্যোগ।
কালু ঝমঝম কীভাবে ঢাকায় এল, কে এনেছিল, কীভাবে সেটি বুড়িগঙ্গায় তলিয়ে গেল—এসবের উত্তর খোঁজা হয়েছে ইতিহাসের বইয়ে। এই লেখায় রয়েছে তার বিস্তারিত বর্ণনা। কালু ঝমঝম কোথায় ছিল ব্রিটিশ আমলে ইংরেজ কর্মচারী হিসেবে ভারতে আসেন রবার্ট লিন্ডসে। তিনি পরে কালেক্টর হয়েছিলেন। ভারতে থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখেছিলেন অ্যানেকডোটস অব অ্যান ইন্ডিয়ান লাইফ নামের একটি বই।
রবার্ট লিন্ডসে লিখেছেন, কালু ঝমঝম কামানটি ঢাকা শহরের উল্টো দিকে বুড়িগঙ্গা নদীর একটি চরে রাখা ছিল। বেশ কয়েকজন ইতিহাসবিদের গ্রন্থে চরটির নাম উল্লেখ করা হয়েছে মোঘলানী চর।
লিন্ডসে আরও লিখেছেন, কামানটি কোথা থেকে এসেছে, তা স্থানীয় বাসিন্দারা কেউ জানতেন না। অনেকেই বিশ্বাস করতেন, কামানটি অলৌকিকভাবে আকাশ থেকে পতিত হয়েছে। কেউ কেউ কামানটির পূজাও করতেন।
কামানটি বুড়িগঙ্গায় তলিয়ে যাওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন রবার্ট লিন্ডসে। তিনি এর কারণ হিসেবে সে সময় ঢাকা শহরে হওয়া বন্যাকে দায়ী করেন। তিনি লিখেছেন, ঢাকা বোর্ডের ভদ্রলোকদের নির্লিপ্ততা ছিল ক্ষমার অযোগ্য। তাঁরা বন্যার সময় দুই কূল ছাপিয়ে এলাকা প্লাবিত হওয়ার ব্যাপারে কিছুই করেননি। ফলে অস্ত্রটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। উদ্ধার করার আর কোনো সুযোগ নেই।
ঢাকার সেই ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল ১৭৮৭ সালে। সেই ইতিহাস জানা যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কাজ করা চিকিৎসক জেমস টেইলরের লেখা এ স্কেচ অব দ্য টপোগ্রাফি অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস অব ঢাকা গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, ১৭৮৭ সালে প্লাবনের ফলে ঢাকা জেলা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিশেষ করে দক্ষিণের পরগনাগুলো এবং বুড়িগঙ্গার উত্তরের অঞ্চলটি। বন্যায় কালু ঝমঝমের সলিলসমাধি হয় ১৭৮৭ সালে।
ব্রিটিশ আমলে ঢাকার মোগলানী চরটি ছিল বুড়িগঙ্গা নদীর মাঝখানে, বর্তমান সোয়ারীঘাটের উল্টো দিকে। চরটি মোগল আমলে সামরিক কৌশলগত কারণে ব্যবহৃত হতো।
কালু ঝমঝম কোথায় ছিল ব্রিটিশ আমলে ইংরেজ কর্মচারী হিসেবে ভারতে আসেন রবার্ট লিন্ডসে। তিনি পরে কালেক্টর হয়েছিলেন। ভারতে থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখেছিলেন অ্যানেকডোটস অব অ্যান ইন্ডিয়ান লাইফ নামের একটি বই।কালু ঝমঝমকে স্বচক্ষে দেখেছেন ইংরেজ ভূগোলবিদ ও লেখক জেমস রেনেল। পাশাপাশি রবার্ট লিন্ডসেও সেটি দেখেছেন। দুজনের লেখায় কামানটির বর্ণনা পাওয়া যায়, যা মোটামুটি একই।
জেমস রেনেলের মেমোয়ার অব এ ম্যাপ অব হিন্দুস্তান বইয়ে বলা হয়েছে, ১৪টি লোহার টুকরার ওপর লোহার চাকা পিটিয়ে কামানটি তৈরি করা হয়েছিল। এটির উপরিভাগ মসৃণ ছিল না। কামানটির দৈর্ঘ্য ছিল ২২ ফুট ১০ ইঞ্চি ৫ সেন্টিমিটার। পেছনের অংশের ব্যাস ছিল ৩ ফুট ৩ ইঞ্চি। সামনের অংশ, যেখান থেকে গোলা বের হয়, সেই অংশের ব্যাস ১৫ ইঞ্চি। কামানটির ওজন ছিল ৬৪ হাজার ৮১৪ পাউন্ড (২৯ হাজার ৪০০ কেজি)। কামানের পাশে রাখা ছিল দুটি পাথরের গোলা। আর এর সঙ্গে থাকা প্রতিটি গোলার ওজন ছিল ৪৬৫ পাউন্ড (২১১ কেজি)।
রবার্ট লিন্ডসে কামানটির দৈর্ঘ্য উল্লেখ করেছেন ৩৬ ফুট। উল্লেখ্য, ৬৫ বছর বয়সে লিন্ডসে তাঁর আত্মজীবনী লিখেছিলেন, যার মুখবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, তাঁর অনেক স্মৃতিই ধূসর হয়ে গেছে। অন্যদিকে রেনেল তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন, তিনি সতর্কভাবে পুরো কামানটির মাপ নিয়েছিলেন এবং আলাদাভাবে প্রতিটি অংশের মাপ হিসাব করেছিলেন। তাই রেনেলের মাপকেই সঠিক বলে গণ্য করেন ইতিহাসবিদেরা।
রবার্ট লিন্ডসে লিখেছেন, কালু ঝমঝম কামানটি ঢাকা শহরের উল্টো দিকে বুড়িগঙ্গা নদীর একটি চরে রাখা ছিল। বেশ কয়েকজন ইতিহাসবিদের গ্রন্থে চরটির নাম উল্লেখ করা হয়েছে মোঘলানী চর।রেনেল বা লিন্ডসে কারও বইয়ে কামানটির নাম সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায় না। সেটি পাওয়া যায় ইতিহাসবিদ সৈয়দ মো. তাইফুরের গ্লিম্পসেস অব ওল্ড ঢাকা বইয়ে। সেখানে কামানটিকে ‘কালু ঝমঝম’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য কোথাও কোথাও কামানটিকে ‘কালে জমজম’ নামে লেখা হয়েছে। কেউ কেউ একে কালে খাঁ নামও দিয়েছেন। এই নামকরণ কীভাবে, তা জানা যায়নি।
কালু ঝমঝমের সময়ের ১১ ফুট দৈর্ঘ্যের আরও একটি কামান ব্রিটিশদের নজর কেড়েছিল। গ্লিম্পসেস অব ওল্ড ঢাকা বইয়ে যেটিকে বিবি মরিয়ম নামে উল্লেখ করা হয়েছে। কামানটি ১৮৩২ সালের আগ পর্যন্ত রাখা ছিল পুরান ঢাকার সোয়ারী ঘাটে।
ধারণা করা হয়, মোগল আমলে বাংলার সুবেদার মীর জুমলা কামানটি সোয়ারি ঘাটে স্থাপন করেছিলেন। ডুবে যাওয়ার শঙ্কায় ১৮৩২ সালে তা আবার স্থানান্তর করা হয় চকবাজারে। এরপর ১৯১৭ সালে সদরঘাটে, সেখান থেকে পাকিস্তান আমলে গুলিস্তানে এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কামানটি সরিয়ে নেওয়া হয় ওসমানী উদ্যানে।
দীর্ঘদিন অবহেলায় পড়ে থাকার পর গত বছর বিবি মরিয়ম কামানটি ওসমানী উদ্যান থেকে এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বরের কাছে ঐতিহাসিক ঢাকা গেটে স্থাপন করা হয়।
মীর জুমলা ১৬৬০ থেকে ১৬৬৩ সাল পর্যন্ত বাংলার সুবেদার ও মোগল সাম্রাজ্যের একজন প্রভাবশালী সেনাপতি ছিলেন। জগদীশ নারায়ণ সরকারের লাইফ অব মীর জুমলা: দ্য জেনারেল অব আওরঙ্গজেব বই থেকে জানা যায়, মীর জুমলার জন্ম ইরানে। এক দরিদ্র তেল ব্যবসায়ীর পুত্র থেকে তিনি হন ধনী হীরা ব্যবসায়ী এবং পরবর্তী সময়ে গোলকুন্ডার উজির। উল্লেখ্য, গোলকুন্ডা ছিল প্রাচীন ভারতের একটি দুর্গ। তখন দুর্গকেন্দ্রিক একটি রাজ্য ছিল; যেটির অবস্থান ছিল বর্তমান ভারতের তেলেঙ্গানায়। এক পর্যায়ে গোলকুন্ডা মোঘল সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে।
মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের অধীন মীর জুমলা শাহ সুজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেন ও বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হন। ঢাকাকে রাজধানী হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা, প্রশাসনিক সংস্কার, রাস্তাঘাট, সেতু ও দুর্গ নির্মাণ ছিল তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
দীর্ঘদিন অবহেলায় পড়ে থাকার পর গত বছর বিবি মরিয়ম কামানটি ওসমানী উদ্যান থেকে এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বরের কাছে ঐতিহাসিক ঢাকা গেটে স্থাপন করা হয়।কামান দুটি এল কোথা থেকেকালু ঝমঝম ও বিবি মরিয়ম কামান দুটি ঢাকায় কীভাবে এল, তা ইতিহাসের বইয়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই। কামান দুটি একই জায়গায় তৈরি কি না, তা-ও নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে কামান দুটির মধ্যে একটি সাধারণ মিল হলো সম্ভবত দুটি কামানই মীর জুমলার আসাম-কোচবিহার অভিযানের সঙ্গে সম্পর্কিত।
বুড়িগঙ্গায় তলিয়ে যাওয়া কামানটির নাম আওরঙ্গজেবের অস্ত্রের তালিকায় থাকা ঝমঝম নামের একটি কামানের সঙ্গে মিলে যায়। আওরঙ্গজেবের অস্ত্রের তালিকাটি পাওয়া যায় ইতালির ভেনিসে জন্ম নেওয়া পর্যটক নিকোলাও মানুচির বিবরণ থেকে। এই বিবরণ উল্লেখ করেছেন সৈয়দ মো. তাইফুর তাঁর গ্লিম্পসেস অব ওল্ড ঢাকা বইয়ে। লেখকের দাবি, বুড়িগঙ্গায় হারিয়ে যাওয়া কামানটি বাদশাহ আলমগীরের (আওরঙ্গজেবের উপাধি) সময়ের অর্থাৎ মোগল আমলের।
গ্লিম্পসেস অব ওল্ড ঢাকা বইয়ে বলা হয়েছে, সপ্তদশ শতাব্দী বা এরও আগে থেকে ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কামান তৈরির কারখানা ছিল। এ প্রসঙ্গে লেখক ঢাকা জাদুঘরে রক্ষিত ‘দেওয়ানবাগ’ কামান এবং মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত ‘জাহানখুশা’ কামানের কথা উল্লেখ করেন।
যতীন্দ্রমোহন রায়ের ঢাকার ইতিহাস বইয়ে বলা আছে, জাহানখুশা কামানটি ১৬৩৭ সালে তৈরি বলা হয়েছে। জনার্দন নামে একজন কারিগর এটি তৈরি করেছিলেন।
গ্লিম্পসেস অব ওল্ড ঢাকা বই থেকে আরও জানা গেছে, ১৬৬০ সালে মীর জুমলা যখন বাংলার সুবেদার, তখন টমাস প্র্যাট নামের একজন ইংরেজ বাণিজ্য প্রতিনিধি তাঁর অধীন কাজ করতেন। তাঁর কাজ ছিল ঢাকার নদীর তীরে যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র তৈরির কাজ তত্ত্বাবধান করা। এ থেকে মোগল আমলে ঢাকায় অস্ত্র তৈরি হতো বলে ধারণা পাওয়া যায়।
সৈয়দ তাইফুরের ওই গ্রন্থে বিবি মরিয়ম কামান সম্পর্কে বলা হয়েছে, কামানটি সুবেদার মীর জুমলার আসাম অভিযানে জব্দ করা। কামানটি সে সময় ঢাকায় আনা হয়।
গ্লিম্পসেস অব ওল্ড ঢাকা বইয়ে বলা হয়েছে, সপ্তদশ শতাব্দী বা এরও আগে থেকে ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কামান তৈরির কারখানা ছিল। এ প্রসঙ্গে লেখক ঢাকা জাদুঘরে রক্ষিত ‘দেওয়ানবাগ’ কামান এবং মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত ‘জাহানখুশা’ কামানের কথা উল্লেখ করেন।জলপথে যুদ্ধকামানভারতীয় ইতিহাস গবেষক জগদীশ নারায়ণ সরকারের লেখা দ্য লাইফ অব মীর জুমলা: দ্য জেনারেল অব আওরঙ্গজেব বই থেকে জানা যায়, আসাম অভিযানের আগে কোচবিহার অভিযান করেন মীর জুমলা। ১৬৬১ সালে কোচবিহার দখলের পর সেখানে থাকা বিভিন্ন যুদ্ধসরঞ্জাম জব্দ করেন তিনি, যার মধ্যে ১০৬টি ভারী কামানও ছিল। সেগুলো পরবর্তী সময়ে ঢাকায় পাঠান তিনি। তবে পরে কামানগুলোর কী হয়েছিল, তা জানা যায়নি
কালু ঝমঝম কামানটি কোচবিহার-আসাম অভিযানে ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনাও পাওয়া যায় জগদীশ নারায়ণ সরকারের বই থেকে। সেখানে বলা হয়েছে, কোচবিহার আক্রমণের সময় মীর জুমলা ৩২৩টি যুদ্ধজাহাজ ও বড় নৌকার বহর নিয়ে গিয়েছিলেন। তার সেই বহরে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল ‘ঘুরাব’ নামের একপ্রকার ভ্রাম্যমাণ কামানবাহী জাহাজ, যার প্রতিটিতে থাকত ১৪টি করে কামান এবং ৫০ থেকে ৬০ জনের জাহাজ পরিচালনাকারী। এগুলো পরিচালনার ভার ছিল ডাচদের ওপর। প্রতিটি ঘুরাব টেনে নিয়ে যেতে লাগত চারটি করে ‘কুসা’ বা বড় বৈঠাবিশিষ্ট নৌকা। যেহেতু মীর জুমলা কোচবিহার ও আসাম অভিযান প্রায় একই সময়ে করেছিলেন সুতরাং ঝমঝম কামানটি কোচবিহার ও আসাম অভিযানে ব্যবহৃত হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়।
ঘুরাব এবং কুসার আরও উল্লেখ পাওয়া যায় ডাচ নাবিক ফ্রান্স জান্স হেইডেনের লেখা ভ্রমণকাহিনি থেকে। যিনি এক ভয়াবহ নৌকাডুবির শিকার হয়ে মীর জুমলার কোচবিহার অভিযানে জড়িয়ে পড়েন। ডাচ ভাষায় লেখা ওই গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ করেন ডব্লিউ গ্লানিয়াস নামে এক ইংরেজ লেখক। ‘এ রিলেশন অব অ্যান আনফরচুনেট ভয়েজ টু দ্য কিংডম অব বেঙ্গালা’ নামের ওই গ্রন্থে ঘুরাব নামক কামানবাহী জাহাজে নিজে চড়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন লেখক।
১৬৬১ সালে কোচবিহার দখলের পর সেখানে থাকা বিভিন্ন যুদ্ধসরঞ্জাম জব্দ করেন তিনি, যার মধ্যে ১০৬টি ভারী কামানও ছিল। সেগুলো পরবর্তী সময়ে ঢাকায় পাঠান তিনি। তবে পরে কামানগুলোর কী হয়েছিল, তা জানা যায়নিকালু ঝমঝম কি খুঁজে পাওয়া সম্ভবকালু ঝমঝম বুড়িগঙ্গায় তলিয়ে যাওয়ার পর কেটে গেছে ২৩৮ বছর। এখন সেই কামান খুঁজতে যাওয়া কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে নদী বা সমুদ্রগর্ভ থেকে দীর্ঘ সময় পর এ ধরনের ঐতিহাসিক বস্তু খুঁজে বের করা নতুন নয়। ২০২২ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কলম্বিয়ার উপকূলে ডুবে যাওয়া দুটি সামুদ্রিক জাহাজ খুঁজে বের করা হয়েছে। ডুবে যাওয়া বিখ্যাত জাহাজ সান হোসের ধ্বংসাবশেষের কাছে জাহাজ দুটির সন্ধান পাওয়া যায়। ১৭০৮ সালে স্প্যানিশ জাহাজ সান হোসেকে ডুবিয়ে দেয় ব্রিটিশরা।
ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা, এটা আমাদের অবনতির বিরাট বড় একটি কারণ।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান এবং ইতিহাসবিদ শরীফ উদ্দিন আহমেদপ্রত্নতাত্ত্বিকেরা বলছেন, এ ধরনের অনুসন্ধানগুলো মেরিটাইম আর্কিওলজির (সমুদ্র প্রত্নতত্ত্বের) আওতাধীন। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কালু ঝমঝমকে খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু নয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান ১৯ মে প্রথম আলোকে বলেন, এটা তোলা সম্ভব। উন্নত দেশগুলো মেরিটাইম আর্কিওলজি প্রক্রিয়ায় সমুদ্র এবং নদীতলের প্রত্নসম্পদ উত্তোলন করে।
কালু ঝমঝম কামানটি খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান এবং ইতিহাসবিদ শরীফ উদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা, এটা আমাদের অবনতির বিরাট বড় একটি কারণ।’