টেকনাফের সৈকতে সারিবদ্ধ কাছিমের অপেক্ষা
Published: 24th, March 2025 GMT
টেকনাফের শামলাপুরে গিয়েছিলাম গত ১০ ফেব্রুয়ারি। আগের রাতে ওই এলাকার পুরো সৈকতে রাতভর সামুদ্রিক কাছিমের খোঁজে ঘুরে বেড়িয়েছেন আমাদের সহযোগীরা। একটি কাছিম সৈকতে উঠে ১০১টি ডিম পেড়ে আবার চলেও গেছে; কিন্তু কেউই তা আঁচ পারেননি। ভেবেছিলাম, সকালে গিয়ে ডিম পাড়তে আসা কাছিমের শরীরে স্যাটেলাইট যন্ত্র বসিয়ে দেব। তা আর হলো না। দুপুরে হঠাৎ খবর এল মাছের একটি জালে ৩৪টি কাছিম আটকা পড়েছে। আমাদের না জানিয়ে জেলেরা সব কটি কাছিম ছেড়েও দিয়েছেন। ঘণ্টাখানেক পরে আরেকটি জালে আটকা পড়ল দুটি কাছিম। দ্রুতই দলবল নিয়ে হাজির হলাম। নিরাপদে কাছিমগুলোকে আনা হলো হ্যাচারিতে।
টেকনাফের শামলাপুরে সৈকতজুড়ে কাছিমের পাঁচটি হ্যাচারি আছে। প্রাকৃতিকভাবে যেসব কাছিম সৈকতে ডিম পাড়ে, সেই ডিমগুলো সংগ্রহ করে এই হ্যাচারিতে বাচ্চা ফুটিয়ে আবার সাগরে ছেড়ে দেওয়া হয়। এখন সামুদ্রিক কাছিমে ভরপুর প্রজনন মৌসুম। এ মৌসুমে প্রতিবছরই ওই এলাকায় যাই কাছিম গবেষণার কাজে। এবারও গেলাম মহাগুরুত্বপূর্ণ এক গবেষণায় অংশ নিতে। সৈকতে ডিম পাড়তে আসা কাছিমের গায়ে স্যাটেলাইট যন্ত্র বসিয়ে তার গতিবিধি জানা আমাদের উদ্দেশ্য। কাজটি জার্মান ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের সহযোগিতায় আইইউসিএনের গবেষক দল করছে।
কাছিম দুটির শরীরে স্যাটেলাইট যন্ত্র বসাতে আমাদের প্রায় চার ঘণ্টা সময় লাগল। সন্ধ্যাবেলায় সেগুলো ছেড়ে দেওয়া হলো সাগরে। মনের আনন্দে তারা ফিরে গেল নিজেদের বিচরণ এলাকায়। আমাদের আরও দুটি কাছিমের ওপর কাজ করতে হবে। পরদিন আবারও কাছিমের আশায় বসে রইলাম। রাতে কোনো কাছিম পেলাম না। সকালে জেলেদের জালের কাছে গিয়ে একসঙ্গে তিনটি কাছিম পেলাম। বড় দুটি রেখে অন্যটি সাগরে ছেড়ে দিলাম।
কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন ও সোনাদিয়া মিলে প্রায় ১০০ কিলোমিটারের ওপর আমাদের সৈকত আছে। পুরোটাই সাগরের কাছিমের ডিম পাড়ার জন্য উপযোগী; কিন্তু পুরো সৈকত এলাকায় এক কিলোমিটার জায়গাও নেই যে সেখানটা জালমুক্ত। আর মানুষের পদচারণ তো সবখানেই, আছে কুকুরের আনাগোনাও বেশ।
কাছিমের এই প্রজনন মৌসুমে শত শত কাছিম সারি ধরে অপেক্ষায় আছে কখন তারা একখণ্ড জনমানবহীন সৈকত পাবে। কখন মাছ ধরার জালগুলো উঠে যাবে। সেই সময় আর পাচ্ছে না কাছিমগুলো। এদিকে তাদের ডিম পাড়ার মৌসুমও শেষ হওয়ার পথে। ভয়াবহ এই বাস্তবতায় অনেকটা সংশয় নিয়েই যখন তারা সৈকতে উঠতে যাচ্ছে, আর তখনই জালে আটকা পড়ছে। আটকা পড়া কাছিমগুলো আর ফেরত না গিয়ে আবারও অপেক্ষা করছে। অপেক্ষার প্রহর যেন আর শেষ হচ্ছে না!
জালে আটকা পড়া কাছিম উদ্ধার করছেন কোডেকের কর্মীরা। পরে কাছিমটি নিরাপদে সাগরে ছেড়ে দেওয়া হয়.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
চা বাগানের ন্যাড়া টিলায় নীল-লেজ সুইচোরাদের কোলাহল
মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার ইটা ও করিমপুর চা বাগানের মধ্যখানে লালচে রঙের ন্যাড়া টিলা। মাটি কেটে নেওয়ায় বির্পযস্ত সেই টিলার গা জুড়ে গর্ত করে আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছে নীল-লেজ সুইচোরা পাখিরা।
নানা অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শণ করে দিনভর চলে উড়াউড়ি আর বেলা-অবেলাজুড়ে চলে নানা সুরের মনমতানো গান। গ্রীষ্মকালে এ এলাকায় বেড়াতে আসা পাখিদের মধ্যে অন্যতম এই নীল-লেজ সুইচোরা পাখি।
টিলার পাশে দাঁড়িয়ে একটু গভীর দৃষ্টিতে তাকালেই দেখা যায় টিলার গায়ে ছোট ছোট অসংখ্য গর্ত। গর্তগুলোর প্রতিটিই একেকটি বাসা, সুইচোরা পাখির বাসা। কোন কোন বাসায় বাচ্চা রয়েছে। আবার কোন বাসায় বসে ডিম তা দিচ্ছে স্ত্রী সুইচোরা।
বিকেলের পড়ন্ত রোদে টিলার গায়ের উঁচু গাছটির মরা ডালগুলোতে সরু, লম্বা ঠোঁট ও নীল লেজের কয়েকটি সুইচোরাকে বসে থাকতে দেখা গেল। কিছুক্ষণ পরপর তারা উড়ে গিয়ে শূন্য থেকে শৈল্পিক ভঙ্গিমায় পোকা ধরে নিয়ে আবারও গাছের ডালে গিয়ে বসছে। মা পাখিরা পোকা ধরে বাসায় নিয়ে বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছে।মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত প্রজননের জন্য নিরাপদ ও উপযুক্ত স্থানে বসবাস করে সুইচোরা পাখিরা। এরা আমাদের দেশীয় পাখি হলেও সব সময় একই অঞ্চলে বসবাস করে না এরা। তাই এদের অনেকে পরিযায়ী বলেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, এরা পরিযায়ী বা আবাসিক পাখি নয়। এরা আমাদের স্থানীয় পাখি।
প্রকৃতি প্রেমি মুরাদ হোসেন বলেন, “এরা এদেশের আবাসিক ‘নীল-লেজ সুইচোরা’। ইংরেজী নাম Blue-tailed Bee-eater. Meropidae নাম এই পরিবারের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Merops Philippinus.”
স্থানীয়রা এদের ‘নীল চড়ুই’ বলে জানেন। তবে সবসময় এদের দেখা মেলে না। কেবল গ্রীষ্মকালেই কোথা থেকে যেন ঝাঁক বেঁধে চলে আসে এরা।
করিমপুর চা বাগানের বাসিন্দা আইয়ুব আলী বলেন, “বাগানের পাশে পরিত্যাক্ত ন্যাড়া টিলার পেটে গর্ত করে গত তিনমাস ধরে পাখিগুলো বসবাস করছে। আগে ফি-বছর তারা আসলেও এখন আর আগেরমতো আসে না। মাঝে মাঝে এদের দেখা মেলে।”
ওই বাগানের বাসিন্দা দিপঙ্কর ঘোষ বলেন, “পাখি তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বসবাস শুরু করে। কোন বাধা বিপত্তি এলে তারা চলে যায়। ৩/৪ বছর পর এদের দেখা মিলল। এরা এখানে নিরাপদে প্রজনন করতে পারছে। জুন মাসের শেষে তারা আবার চলে যাবে।”
শেখ কামাল ওয়াইল্ডলাইফ সেন্টার গাজীপুরের পাখি বিশেষজ্ঞ আল্লামা শিবলী সাদিক বলেন, ‘‘নীল-লেজ সুইচোরা পাখিদের পরিযায়ী বা আবাসিক বলা যাবে না। এরা আমাদের দেশীয় পাখি। প্রজননের সময় তারা নিরাপত্তার স্বার্থে বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান করে বলে এদের অনেকেই মনে করেন তারা পরিযায়ী বা আবাসিক। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত তাদের প্রজনন সময়। এরা পাহাড়ি টিলার নরম মাটিতে গর্ত করে বসবাস করে। গর্তের মধ্যেই বাসা তৈরি করে ডিম পেড়ে বাচ্চা ফোটায়। পরে বাচ্চাদের নিয়ে অন্য স্থানে চলে যায়।”
প্রাপ্তবয়স্ক এই পাখির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার, ওজন ৩৮ থেকে ৫০ গ্রাম। নীল-সবুজ পালক বিশিষ্ট পাখিটির পেছনের অংশ ও লেজ নীল। গলা খয়েরি, বুকের ওপরটা বাদামি, চোখে কাজল টানা এবং পেট আপেলের মতো সবুজ।
চোখ লালচে বাদামি থেকে গাঢ় লাল। কোমর, লেজ ও লেজের নিচের অংশ নীল। লেজের আগায় লম্বা নীল সুই বা পালক রয়েছে।
এদের ঠোঁট সরু, লম্বা ও কালো। নিচের দিকে খানিকটা বাঁকানো। পা ও পায়ের পাতা কালচে বাদামি। অপ্রাপ্তবয়স্ক নীললেজ সুইচোরার দেহের রং অনুজ্জ্বল ও ফ্যাকাশে। স্ত্রী ও পুরুষ একই রকম দেখতে।
এদের আয়ুষ্কাল প্রায় ছয় বছর। মার্চ থেকে জুন এদের প্রজননকাল। এসময় পাহাড়ের গায়ে বা নদী ও খালপাড়ে প্রায় দুই মিটার লম্বা সুড়ঙ্গ খুঁড়ে বাসা বানায় এরা। সেখানে ৫-৬টি ডিম পাড়ে, ডিমের রং সাদা। ২১-২৬ দিনে ডিম ফোটে এবং ২০-২৭ দিন পরে বাচ্চারা উড়তে শেখে।
ঢাকা/আজিজ/এস