আজ খতমে তারাবিতে পবিত্র কোরআনের সুরা জারিয়াতের ৩১ থেকে সুরা তুর, সুরা নাজম, সুরা কমার, সুরা রহমান, সুরা ওয়াকিয়া ও সুরা হাদিদ তেলাওয়াত করা হবে। ২৭তম পারা পড়া হবে। আজকের তারাবিহতে পূর্ববর্তী জাতির অবাধ্যতার পরিণতি, মানুষ ও জিন জাতি সৃষ্টির উদ্দেশ্য, নবীজির দাওয়াত, মেরাজ, উপদেশ, নবীজির হাতের ইশারায় চাঁদ বিদীর্ণ হওয়া ও আল্লাহর পথে জীবন-সম্পদ উৎসর্গ, আসমান-জমিন সৃষ্টি, কাফেরদের ভ্রান্ত চিন্তার খণ্ডন, তাকদির, আল্লাহর অস্তিত্ব, ইমান, ইমানদারের প্রতিদান ইত্যাদি বিষয়ের আলোচনা রয়েছে।
মানুষ সৃষ্টির কারণ
আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষ পাঠাতে চাইলেন। ফেরেশতাদের বললেন, ‘আমি মানুষ সৃষ্টি করব। পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি পাঠাব।’ ফেরেশতারা বললেন, ‘আমরাই তো আপনার প্রশংসা করছি। মানুষ পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা করবে। মারামারি করবে।’
আল্লাহ আদম (আ.
আল্লাহ বলেন, ‘আমি জিন ও মানবজাতিকে শুধু আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা জারিয়াত, আয়াত: ৫৬) আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশিত পথ ও মতে জীবন পরিচালনা করা হলো ইবাদত।
আরও পড়ুনপ্রাচীন ৬ জাতি ধ্বংসের কাহিনি১৬ মার্চ ২০২৪সুরা তুরে যা আছে
৪৯ আয়াত বিশিষ্ট সুরা তুর মক্কায় অবতীর্ণ, এটি কোরআনের ৫২তম সুরা।
রাসুল (সা.) তখন মক্কায়। মাগরিব নামাজ পড়ছিলেন। নামাজে তিলাওয়াত করছিলেন সুরা তুর। জুবাইর ইবনে মুতইম তখনো মুসলমান হননি। তিনি তিলাওয়াত শুনছিলেন। যখন সুরা তুরের ৩৫ থেকে ৩৭ নম্বর আয়াত শুনলেন, তার মনে হলো, অন্তরাত্মা উড়তে শুরু করেছে। সেদিনই তাঁর অন্তরে ইসলাম জায়গা করে নিয়েছে।
সেই আয়াতগুলোর অর্থ হলো, ‘তারা কি আপনা-আপনিই সৃষ্টি হয়ে গেছে, না কি তারাই (নিজেদের) স্রষ্টা? নাকি আকাশমণ্ডলি ও পৃথিবী তারা সৃষ্টি করেছে? না; বরং মূল কথা হচ্ছে, তারা বিশ্বাসই রাখে না। তোমার প্রতিপালকের ভান্ডার কি তাদের কাছে রয়েছে? নাকি তারাই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক?’ (সুরা তুর, আয়া: ৩৫-৩৭; বুখারি, ৩০৫০, ৪৮৫৪; দালাইলুন নুবুওয়া, আবু নুআইম, ১/৩০৮)
সুরা তুরের ১৭ থেকে ২৮ নম্বর আয়াতে জান্নাতে তাঁদের জন্য কী কী নেয়ামত থাকবে, তার বিবরণ রয়েছে। যেমন তাঁরা দোজখ থেকে রক্ষা পাবেন, সুখে ও সম্পদে থাকবেন, তৃপ্তির সঙ্গে খাবেন ও পান করবেন, সবকিছু আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করবেন, সারি সারি সাজানো আসনে হেলান দিয়ে আরামে বসবেন, সুন্দরী রমণী পাবেন, তাঁদের সন্তানেরাও তাঁদের সঙ্গে থাকবেন, ফলমূল ও গোশত পাবেন, শরাব পান করবেন; কিন্তু অনর্থক প্রলাপ করবেন না, তাঁদের সেবায় সুরক্ষিত মণিমুক্তা সদৃশ কিশোরেরা থাকবেন।
আরও পড়ুনমুসা ও খিজির (আ.)-এর চিত্তাকর্ষক গল্প২৩ মার্চ ২০২৪যে আয়াত শুনে অবিশ্বাসীরাও সিজদা করেছিল
৬২ আয়াত বিশিষ্ট সুরা নাজম মক্কায় অবতীর্ণ, এটি কোরআনের ৫৪তম সুরা। যখন এ সুরার শেষ আয়াত নাজিল হয়েছিল, রাসুল (সা.), উপস্থিত সাহাবি ও অবিশ্বাসীরা সিজদা করেছিল। (তাফসিরে ইবনে কাসির)
এ সুরায় আল্লাহ বেশ কিছু বিষয়ের কসম করে মুহাম্মাদ (সা.)-এর সত্য নবী হওয়া, তাঁর প্রতি নাজিলকৃত ওহিতে সন্দেহ ও সংশয় না থাকার প্রমাণ, মূর্তি উপাসক ও যারা ফেরেশতাদের আল্লাহর কন্যা সাব্যস্ত করে তাদের নিন্দা, কিয়ামতের বর্ণনা, কারও গুনাহের বোঝা অপরের কাঁধে চাপানো হবে না এবং আল্লাহর কুদরতের বর্ণনা রয়েছে।
চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার গল্প
৫৫ আয়াত বিশিষ্ট সুরা কমার মক্কায় অবতীর্ণ। এটি কোরআনের ৫৪ তম সুরা। সুরার শুরুতে রাসুল (সা.)-এর আঙুলের ইশারায় চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার আলোচনা থাকায়, এর নাম সুরা কমার রাখা হয়েছে।
তখন ইসলামের শুরুর সময়। রাসুল (সা.) মক্কার অবিশ্বাসীদের একত্ববাদের দাওয়াত দিচ্ছেন। তারা অস্বীকার করে চলল। একবার আবু জাহেলের নেতৃত্বে একদল মুশরিক ও ইহুদিরা জানাল, ‘যদি মুহাম্মাদ চাঁদ দ্বিখণ্ডিত করতে পারে, তাহলে তাঁকে আল্লাহর রাসুল হিসেবে মেনে নেব।’
জিলহজ মাসের ১৪ তারিখ। নবীজি আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। চাঁদের দিকে আঙুল ইশারা করলেন। চাঁদ দিখণ্ডিত হয়ে যায়। অবিশ্বাসীরা ব্যাপারটি জাদু বলল। ইহুদিদের কেউ ইসলাম গ্রহণ করেছিল। তারা তাওরাতে চাঁদের ব্যাপারটি পড়েছিল। দ্বিখণ্ডিত চাঁদ মক্কার বাইরের লোকজনও দেখেছিল। তারপরও অবিশ্বাসীরা বলল, ‘এটা জাদু। আমরা তাঁকে রাসুল মানব না।’
আরও পড়ুনআল্লাহর নিদর্শন উট হত্যা করেছিল সামুদ জাতি২১ মার্চ ২০২৪নেয়ামতের বর্ণনা সুরা রহমানে
কোরআনের ৫৫তম সুরা রহমান মদিনায় অবতীর্ণ। এর আয়াত সংখ্যা ৭৮। এ সুরার প্রথম আয়াতটিই হলো, আর-রহমান, তাই এর নাম রহমান রাখা হয়েছে। এ সুরার আরেক নাম ‘উরুসুল কোরআন’ বা ‘কোরআনের নববধূ’।
জগতের সবকিছু মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নেয়ামত। সুরা রহমানে আল্লাহ দুনিয়া-আখিরাতের বহু নেয়ামতের উল্লেখ করেছেন। এ নেয়ামতের বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ মোট ৩১ বার প্রশ্ন করেছেন, ‘অতএব তোমরা তোমাদের রবের কোন কোন নেয়ামত অস্বীকার করবে?’
সুরা ওয়াকিয়ার বিষয়বস্তু
৯৬ আয়াতবিশিষ্ট সুরা ওয়াকিয়া মক্কায় অবতীর্ণ। এ সুরার আরেক নাম গিনা, অর্থাৎ সমৃদ্ধিশালী। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সুরা ওয়াকিয়া পাঠ করবে, তাকে কখনো দারিদ্র্য স্পর্শ করবে না।’ (শুয়াবুল ঈমান, বায়হাকি: ২৪৯৮)
এ সুরায় কিয়ামতের সময়কার বিভিন্ন বর্ণনা, কিয়ামতের দিন মানুষের শ্রেণি বিভেদ, আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ববাদ, কুদরত ও ক্ষমতার প্রমাণ, পুনরুত্থান ও হিসাব-নিকাশ, কোরআনের মাহাত্ম্য, মানুষ সৃষ্টির প্রক্রিয়া ও আল্লাহর আনুগত্য ইত্যাদির কথা আছে।
আরও পড়ুনইউসুফ (আ.) কি জুলেখাকে বিয়ে করেছিলেন২০ মার্চ ২০২৪লোহা সৃষ্টির কারণ
২৯ বিশিষ্ট সুরা হাদিদ মদিনায় অবতীর্ণ। হাদিদ অর্থ লোহা। লোহা সৃষ্টির আলোচনা থাকায় এ সুরার নাম হাদিদ।
তাফসিরে ইবনে কাসিরে আছে, ‘রাসুল (সা.) বলেছেন, সুরার ৩ নম্বর আয়াতটি অন্যান্য হাজার আয়াত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।’ এ সুরায় আল্লাহ লোহা সৃষ্টির দুটি কারণ উল্লেখ করেছেন। এক. এতে শত্রুদের মনে ভীতি সঞ্চার হয়। দুই. এতে রয়েছে বহুবিধ কল্যাণ।
জগতের সবকিছু আল্লাহর, তিনি মালিক, সবকিছু তাঁর প্রশংসা করে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ইমান, দ্বীন প্রতিষ্ঠায় জীবন-সম্পদ কোরবানি, দুনিয়ার মোহে ধোঁকায় না পড়া, আল্লাহর ভয় ইত্যাদির বয়ান আছে এ সুরায়।
রায়হান রাশেদ: লেখক ও আলেম
আরও পড়ুননুহ নবীর (আ.) নৌকা১৯ মার্চ ২০২৪উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অব শ ব স র ক রআন র র জন য ন য় মত কর ছ ল র আয় ত কর ছ ন য় মত র আল ল হ করব ন সবক ছ রহম ন
এছাড়াও পড়ুন:
স্তম্ভিত হারমানপ্রীত, আবেগ-রোমাঞ্চ-গর্ব-ভালোবাসায় মিলেমিশে একাকার
২০০৫ ও ২০১৭, ভারতের নারী ক্রিকেট দল ওয়ানডে বিশ্বকাপের খুব কাছে গিয়েও শিরোপা জিততে পারেননি। হারমানপ্রীত কৌররা লম্বা সেই অপেক্ষা দূর করলেন দুই হাজার পঁচিশে।
মুম্বাইয়ের নাভিতে প্রায় ষাট হাজার দর্শকের সামনে উচিুঁয়ে ধরলেন ওয়ানডে বিশ্বকাপের শিরোপা। ২০১৭ সালের ফাইনালেও খেলেছিলেন হারমানপ্রীত। রানার্সআপ হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাকে। এবার আর ভুল করলেন না। অধিনায়ক হয়ে জিতলেন শিরোপা। গড়লেন ইতিহাস। যে ইতিহাস কখনো মুছবে না। কখনো জং ধরবে না।
ঝলমলে হাসিতে হারমানপ্রীত ট্রফি হাতে নিয়ে প্রেস কনফারেন্স রুমে প্রবেশ করেন। এবার তার আবেগের ধরণ ছিল ভিন্ন, যেন স্বপ্ন পূরণের মাখামাখি। লম্বা সংবাদ সম্মেলন জুড়ে বারবার তার কণ্ঠ ধরে আসে। আবেগ, রোমাঞ্চ, গর্ব, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তবে একটি শব্দের ওপর বারবার ফিরে আসছিলেন তিনি, তা হলো আত্মবিশ্বাস,
‘‘আমি কেবল আমার অনুভূতি প্রকাশ করার চেষ্টা করছি। আমি স্তম্ভিত, আমি বুঝতে পারছি না। আসলে, এতে উত্থান-পতন ছিল, কিন্তু দলের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ছিল। আমি প্রথম দিন থেকেই এটা বলে আসছি। আমরা বাম বা ডানে তাকাচ্ছিলাম না। আমরা কেবল আমাদের মূল লক্ষ্যের দিকে তাকিয়েছিলাম।’’ - বলেছেন হারমানপ্রীত।
স্বপ্ন পূরণের রাতে হারমানপ্রীত কাছে পেয়েছিলেন সাবেক তিন ক্রিকেটার মিতালি রাজ, ঝুলন গোস্বামী এবং অঞ্জুম চোপড়াকে। প্রত্যেকেই স্বপ্ন দেখেছিলেন ভারতকে বিশ্বকাপ জেতানোর। তাদের অধরা সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন জেমিমা, দীপ্তি, শেফালি, স্মৃতিরা।
শিরোপা উৎসবে যোগ দেন মিতালি, ঝুলন, আঞ্জুমরা। তাদের হাতেও ট্রফি তুলে দেওয়া হয়। প্রাক্তন খেলোয়াড়দের সাথে সেই মুহূর্তটি ভাগ করে নেওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে হারমানপ্রীত বলেন, ‘‘ঝুলন দি আমার সবচেয়ে বড় আইডল ছিলেন। যখন আমি দলে যোগ দিই, তখন তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। আমি যখন খুব কাঁচা ছিলাম এবং ক্রিকেট সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না, তখনও তিনি সবসময় আমাকে সমর্থন করতেন। অঞ্জুম দি-ও তাই। এই দুজন আমার জন্য দারুণ সমর্থন ছিলেন। আমি কৃতজ্ঞ যে আমি তাদের সাথে এই বিশেষ মুহূর্তটি ভাগ করে নিতে পেরেছি। এটি খুব আবেগপূর্ণ মুহূর্ত ছিল। আমার মনে হয় আমরা সবাই এটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে, আমরা এই ট্রফি স্পর্শ করতে পেরেছি।’’
তার জন্য বিশ্বকাপের পুরো অভিযানটিই ছিল গভীরভাবে আবেগপূর্ণ। রাউন্ড রবিন লিগে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ হার। চোট, অফ ফর্ম, জড়তা। সব সামলে সেরা হয়েছেন। তাইতো নিজেদের নিয়ে গর্বটাও বেশি হারমানপ্রীতদের, ‘‘আমরা প্রথম বল থেকেই অনুভব করেছিলাম যে আমরা জিততে পারি, কারণ শেষ তিন ম্যাচে আমাদের দল যেভাবে খেলছিল, তাতে আমাদের জন্য অনেক কিছুর পরিবর্তন এসেছিল, বিশেষ করে আমাদের আত্মবিশ্বাস। আমরা অনেকদিন ধরেই ভালো ক্রিকেট খেলছি। আমরা জানতাম দল হিসেবে আমরা কী করতে পারি।”
"গত এক মাস খুব আকর্ষণীয় ছিল। সেই দিনটির (ইংল্যান্ডের কাছে হারের) পর আমাদের মধ্যে অনেক পরিবর্তন আসে। সেই রাত আমাদের জন্য অনেক কিছু বদলে দিয়েছিল। এটি প্রত্যেকের উপর প্রভাব ফেলেছিল। আমরা বিশ্বকাপের জন্য আরও প্রস্তুত হলাম। আমরা ভিজ্যুয়ালাইজেশন এবং মেডিটেশন শুরু করেছিলাম। আমরা বারবার বলছিলাম, যে জন্য আমরা এখানে এসেছি এবং এবার আমাদের এটা করতেই হবে।" - যোগ করেন হারমানপ্রীত।
প্রথম যে কোনো কিছুই আনন্দের। রোমাঞ্চের। এই অভিজ্ঞতা শব্দে বয়ান করা যায় না। বয়ান করা সম্ভব হয় না। হারমানপ্রীতও পারেন না নিজের সবটা উজার করে বলতে। তবে এই শিরোপায় তাদের নাম লিখা হবে সেই আত্মবিশ্বাস তারও ছিল, ‘‘আমরা বহু বছর ধরে এটি নিয়ে কথা বলছি—আমরা ভালো ক্রিকেট খেলছি, কিন্তু আমাদের একটি বড় শিরোপা জিততেই হতো।"
ঢাকা/ইয়াসিন