অর্ধেক বেতন পরিশোধেও পিছিয়ে অনেক কারখানা
Published: 27th, March 2025 GMT
সরকার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তৈরি পোশাকশিল্পের সব কারখানা শ্রমিকের ঈদ বোনাস দেয়নি। চলতি মাসের অর্ধেক বেতন পরিশোধেও পিছিয়ে আছে অনেক কারখানা। এর বাইরে বন্ধ থাকা কয়েকটি কারখানার বেতন-ভাতা ও ক্ষতিপূরণ পরিশোধ নিয়ে আগে থেকেই সমস্যা চলছে।
তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ এবং শিল্প পুলিশের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে।
ঈদের আগে শ্রম পরিস্থিতির পাশাপাশি শিল্প খাতের শ্রমিকদের বেতন–বোনাস ও ছুটি–সংক্রান্ত বিষয় পর্যালোচনার জন্য ১২ মার্চ সরকার, মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিরা বৈঠক করেন। ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদের এই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, শ্রমিকদের বকেয়া বেতন, বোনাসসহ সব পাওনা ২০ রমজানের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। মালিকপক্ষকে চলতি মার্চ মাসের অন্তত ১৫ দিনের বেতনও দিতে হবে। এর পাশাপাশি রপ্তানি প্রণোদনার দুই হাজার কোটি টাকা ছাড় করেছে সরকার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইলসহ কয়েকটি জেলার অন্তত ৪৩টি তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিকের বেতন ও ভাতা পরিশোধ নিয়ে সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে ১২টি কারখানার সংকট পুরোনো। এই কারখানাগুলোর শ্রমিকেরা দাবি আদায়ে কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। ঈদের ছুটি ও বোনাস বাড়ানোর জন্যও আন্দোলনে নেমেছেন কয়েকটি কারখানার শ্রমিকেরা।
গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা এলাকায় গতকাল বুধবার সকালে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে বকেয়া টাকার দাবিতে মানববন্ধন করেন মাহমুদ জিনস কারখানার শ্রমিক ও কর্মচারীরা। তাঁরা বলেন, মাসের পর মাস তারিখ দিয়েও ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করছে না মালিকপক্ষ। ঈদের আগে তাঁদের বকেয়া এক মাসের বেতন ও বার্ষিক ছুটির অর্থ পরিশোধের কথা। এই কারখানা দিয়ে মালিক আরও ৪-৫টি কারখানা করেছেন, তাহলে তাঁরা কেন বকেয়া অর্থ পাবেন না—এই প্রশ্ন করেন শ্রমিকেরা।
অবশ্য ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ নির্বিঘ্ন করতে ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ সভায় যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। চলতি সপ্তাহে শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান, সড়ক অবরোধ ও বিজিএমইএ ভবন অবরুদ্ধ করার মতো ঘটনা ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-ভাতা ও ক্ষতিপূরণ পরিশোধ না করায় গত মঙ্গলবার বন্ধ থাকা ১২টি তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার। এগুলো হলো রোর ফ্যাশন, স্টাইলক্রাফট ও ইয়াং ওয়ান্স, ডার্ড গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠান, মাহমুদ গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠান, টিএনজেড গ্রুপের চারটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে শুধু স্টাইলক্রাফট চালু রয়েছে।
জানতে চাইলে শ্রমিকনেতা বাবুল আখতার বলেন, সরকারের আগে থেকে কঠোর হওয়া উচিত ছিল। তাহলে হয়তো পরিস্থিতি এতটা জটিল হতো না। বর্তমানে কারখানার মালিকের সম্পত্তি বিক্রি বা বন্ধক কিংবা বিজিএমইএ বা বিকেএমইএর তহবিল থেকে শ্রমিকের পাওনা পরিশোধ করা প্রয়োজন। সেটি সম্ভব না হলে বেক্সিমকোর শ্রমিকদের যেভাবে টাকা দেওয়া হয়েছে, সেভাবেই সমস্যাযুক্ত কারখানার শ্রমিকদের পাওনা মেটানো উচিত।
বেতন-ভাতা পরিস্থিতি
ম্যাপড ইন বাংলাদেশের (এমআইবি) ডিজিটাল মানচিত্র অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা আছে ৩ হাজার ৫৫৫টি। এর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য সচল কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ১০৭। গতকাল পর্যন্ত ১ হাজার ৯৪৪টি (৯২ শতাংশ) কারখানা শ্রমিকের ঈদ বোনাস দিয়েছে। আর মার্চ মাসের অর্ধেক বেতন দিয়েছে ৭৬১টি (৩৬ শতাংশ) কারখানা। এখন পর্যন্ত ১৬টি কারখানা ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন দেয়নি।
অন্যদিকে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সচল সদস্য কারখানা ৬১৩টি। তার মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ৮০ শতাংশ কারখানা ঈদ বোনাস দিয়েছে। চলতি মাসের অর্ধেক বেতন প্রায় ৫০ শতাংশ কারখানা দিয়েছে। এখনো ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন দেয়নি দুটি কারখানা।
জানতে চাইলে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান প্রথম আলোকে বলেন, ২-৩টি কারখানা ছাড়া সমস্যা নেই। সেগুলো সমাধানের চেষ্টা চলছে। অধিকাংশ কারখানাই বৃহস্পতিবার (আজ) শ্রমিকদের পাওনা দিয়ে ঈদের ছুটি দেবে বলে জানান তিনি।
নারায়ণগঞ্জ শিল্প পুলিশের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জেলার ১৩টি বস্ত্র ও তৈরি পোশাক কারখানার ঈদ বোনাস অথবা চলতি মাসের অর্ধেক বেতন পরিশোধ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এসব কারখানায় কাজ করেন ৮ হাজার ৮৮৮ শ্রমিক। কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে এসিএস টেক্সটাইল, টোটাল ফ্যাশন, অবন্তি কালার টেক্স, ক্রোনি অ্যাপারেলস, তোহা নিট ফ্যাশন, ইউরো নিট সোসিং, জননী নিট ফ্যাশন, এশিয়ান টেক্সটাইল, স্টারলেট কম্পোজিট, স্টারলেট অ্যাপারেলস, ফোর ডিজাইন, ইয়াংথ্রি ফ্যাশন ও এক্সাল্ট অ্যাপারেলস।
গাজীপুরের বস্ত্র ও তৈরি পোশাক কারখানা নিয়েও শিল্প পুলিশ প্রতিবেদন দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২৫টি কারখানা বেতন বা ঈদের বোনাস পরিশোধ করতে পারে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। কারখানাগুলোতে কাজ করেন ১৭ হাজার শ্রমিক। এসব কারখানার মধ্যে রয়েছে হংকং ফ্যাশন, এনআর ফ্যাশন, আলমা নিটওয়্যার, বেসিক ক্লোথিং, ইন্ট্রামেক্স, স্বাধীন গার্মেন্টস, সোয়ান সোয়েটার, হোম টেক্সটাইল, ন্যাশনাল ফ্যাশন, এইচডিএফ অ্যাপারেলস, জারা কম্পোজিট, আর জে নিটওয়্যার ইত্যাদি।
সাভার-আশুলিয়া এলাকায় ১ হাজার ৮৬৩ শিল্পকারখানা রয়েছে, তার মধ্যে অধিকাংশই তৈরি পোশাক। গতকাল পর্যন্ত অর্ধেক কারখানার বোনাস বাকি। চলতি মাসের অর্ধেক বেতন বাকি ৮ শতাংশ কারখানার। এখনো ফেব্রুয়ারির বেতন বকেয়া ৯ শতাংশ কারখানার।
জানতে চাইলে আশুলিয়া শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বেতন-ভাতা নিয়ে ঝামেলা আছে। তিনি আশা করছেন কালকের দিনই (আজ বৃহস্পতিবার) অনেক কারখানা বোনাস ও বেতন দেবে। এটা শুক্রবার পর্যন্ত চলবে।
সংকট বাড়িয়েছে বন্ধ কারখানা
ময়মনসিংহের ভালুকার রোর ফ্যাশন কর্তৃপক্ষ গত জানুয়ারিতে কারখানা লে-অফ করে। এই কারখানার শ্রমিক সংখ্যা ১ হাজার ৩৭৬। গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে বেতন-ভাতা বাবদ এই কারখানার শ্রমিকের পাওনা ৭০ লাখ টাকা। জানুয়ারি মাসের বেতন ও লে-অফের ক্ষতিপূরণ পাবেন তাঁরা।
দাবি আদায়ে গত রোববার রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ ভবনের সামনে অবস্থান নেন রোর ফ্যাশনের শ্রমিকেরা। পরদিন সারা দিন বিজিএমইএ ভবনের ফটক অবরুদ্ধ করে রাখেন তাঁরা। পরে মঙ্গলবার সকালে শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধের আশ্বাস দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়। রোর ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুনুল ইসলাম। যদিও তাঁকে খুঁজে পাচ্ছে না বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ।
গাজীপুরের একই মালিকের স্টাইলক্রাফট লিমিটেড ও ইয়াং ওয়ান্স (বিডি) লিমিটেড দুই বছর আগে আর্থিক সংকটে পড়ে। তখন শ্রমিক ছাঁটাই করে কর্তৃপক্ষ। বন্ধ করা হয় ইয়াং ওয়ান্স। অল্প শ্রমিক দিয়ে স্টাইলক্রাফট চলছে। তবে প্রায় ২ হাজার শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ বাবদ পাওনা রয়েছে ২১ কোটি টাকা। তার মধ্যে বকেয়া বেতন ৬ কোটি টাকা। চলতি মাসের শুরুতে ত্রিপক্ষীয় সভায় ঈদের আগে মোট বকেয়া বেতনের ২৫ শতাংশ অর্থ দেওয়ার প্রস্তাব দেন মালিক। তবে শ্রমিকেরা সেটি প্রত্যাখ্যান করে মোট বকেয়ার ২৫ শতাংশ দাবি করেন।
বকেয়া পাওনা আদায়ে স্টাইলক্রাফট লিমিটেড ও ইয়াং ওয়ান্স (বিডি) লিমিটেডের শ্রমিকেরা গত রোববার শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে অসুস্থ হয়ে রাম প্রসাদ সিং (৪০) নামের একজনের মৃত্যু হয়। এই কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস আলমাস রহমান।
গাজীপুরের টিএনজেড গ্রুপ আর্থিক সংকটে পড়ে গত বছর থেকে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ করছে না। এখনো ডিসেম্বর মাসের ২০ শতাংশ এবং জানুয়ারি মাসের অর্ধেক বেতন বাকি। গত ফেব্রুয়ারির বেতন ২০ মার্চ ও ঈদ বোনাস ২৩ মার্চ দেওয়ার কথা থাকলেও দেয়নি কর্তৃপক্ষ। বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে চলতি সপ্তাহে শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন শ্রমিকেরা। এই গ্রুপের শ্রমিক সংখ্যা ৪ হাজার। গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহদাৎ হোসেন শামীম।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর প্রশাসক আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত বিজিএমইএর সদস্য চার-পাঁচটি কারখানার বেতন-ভাতা পরিশোধে সমস্যা রয়েছে। সেগুলো সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, সাভার; প্রতিনিধি, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অ য প র লস প রথম আল ব ক এমইএ ব জ এমইএ পর স থ ত পর শ ধ ন ঈদ ব ন স দ র বক য় অবস থ ন গতক ল প সরক র সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
বিদ্যুৎ খাতে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি হয়েছে: পর্যালোচনা কমিটি
বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির নামে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো সরকারের কাছ থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া বাবদ অর্থ নিয়েছে, যেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহের চেয়ে দুর্নীতিই মুখ্য ছিল বলে অভিমত দিয়েছে সরকার গঠিত চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। তারা বলেছে, চুক্তিতে ব্যবসায়ীদের কোনো ঝুঁকি নেই, সব ঝুঁকি সরকারের। এটি সরকারের অদক্ষতাজনিত ব্যর্থতা নয়, দুর্নীতি জড়িত। তাই চুক্তি বাতিল করা সম্ভব।
বিদ্যুৎ খাতের চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির তিন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তাঁরা বলেছেন, গত সরকারের দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ, খরচ বেড়েছে ১১ গুণ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনটি করাই হয়েছে দুর্নীতির জন্য। এখানে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি হয়েছে। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিগুলো ভাড়া আদায়ের নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে কাজ করেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো জ্বালানি আমদানি করেছে নিজেরা। এতেও দুর্নীতি হয়েছে।
তবে এখন এসব চুক্তি বাতিল করতে হলে অনুসন্ধান করে দুর্নীতির প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন পর্যালোচনা কমিটির সদস্যরা। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের প্রতিবেদন নিয়ে সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করতে পারে। গত সরকারের সময় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একের পর এক একতরফা চুক্তি করা হয়েছে। চুক্তিতে সব সুবিধা দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে, রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করা হয়নি। একটি চুক্তি যেন আরেকটির প্রতিলিপি। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ সংস্থাগুলো এতে জড়িত ছিল। গ্যাস পাওয়া যাবে না, চুক্তি করা হোক—এমন সুপারিশও দেখা গেছে মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে।
পর্যালোচনা কমিটির তিনজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, শুধু চুক্তি নয়, চুক্তির আগের পুরো প্রক্রিয়া যাচাই করে দেখা হয়েছে। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপের নমুনা পাওয়া গেছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। সাবেক দুই বিদ্যুৎসচিব, যাঁরা পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব হয়েছিলেন; তাঁদের সংশ্লিষ্টতা আছে সংঘবদ্ধ দুর্নীতিতে। এই দুজন হলেন আবুল কালাম আজাদ ও আহমদ কায়কাউস।
# চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন# দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ, খরচ বেড়েছে ১১ গুণ
# ব্যবসায়ী, আমলা, সরকারের শীর্ষ পর্যায় মিলে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি
# চুক্তি বাতিল সম্ভব, দুদকের তদন্ত করতে হবে
# আদানির চুক্তিতে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে
দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনটি বাতিল করা হয় গত বছরের নভেম্বরে। এর আগেই এ আইনের অধীনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে গত সরকারের করা চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আছেন হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী। কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও সহ-উপাচার্য আবদুল হাসিব চৌধুরী, কেপিএমজি বাংলাদেশের সাবেক প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আলী আশফাক, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ফ্যাকাল্টি অব ল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের অর্থনীতির অধ্যাপক মোশতাক হোসেন খান ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক।
জানুয়ারিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন
আজ রোববার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দিয়েছে চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে তারা। এ ছাড়া ভারতের আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে করা চুক্তির অনিয়ম নিয়েও একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তারা। প্রতিবেদন জমার পর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে একটি সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন কমিটির সদস্যরা।
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, কারণ ছাড়া চুক্তি বাতিল করলে তার ক্ষতিপূরণের বিষয়টি চুক্তিতেই বলা আছে। তবে প্রতিটি চুক্তিতেই স্বীকারোক্তি থাকে যে এই চুক্তিতে কোনো দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়নি। এটা যদি লঙ্ঘিত হয়, তাহলে চুক্তি বাতিল করা যায়। কিন্তু মুখের কথা তো আদালত মানতে চাইবেন না, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে হবে আদালতে। কমিটির সহায়তায় চুক্তির অনিয়ম খুঁজে দেখা হচ্ছে। কারণ, খুঁজে পাওয়া গেলে চুক্তি বাতিলে দ্বিধা করা হবে না।
কমিটির আহ্বায়ক মঈনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, চুক্তি কতটা বাতিল করা যাবে, তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। বিদ্যুৎ খাতের চুক্তিগুলো পুরোপুরি কারিগরি, তাই সময় লেগেছে পর্যালোচনায়। এতে ব্যাপক দুর্নীতি পাওয়া গেছে। আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কমিটির সদস্য জাহিদ হোসেন বলেন, চুক্তি–সম্পর্কিত নথি দেখা হয়েছে। পিডিবি থেকে পরিশোধ করা বিলের তথ্য নেওয়া হয়েছে। এগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে, কী কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে। ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ ছিল, মন্ত্রণালয় সব সময় প্রধানমন্ত্রীর হাতে ছিল। বিদ্যুৎ খাতে যে পরিমাণ বিল পরিশোধ করা হয়েছে এবং এর বিপরীতে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে, এর হিসাব আইনস্টাইনও মেলাতে পারবেন না।
চুক্তি বাতিল করলে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির সদস্য শাহদীন মালিক বলেন, যাঁরা ক্ষতিপূরণ দাবি করবেন, তাঁরা তাঁদের ক্ষতির হিসাব দেবেন। তাই ক্ষতিপূরণের বিষয়টা তো এ কমিটি বলতে পারবে না।
দুর্নীতির কারণে বেড়েছে বিদ্যুতের দাম
সংবাদ সম্মেলনে কমিটির সদস্য মোশতাক হোসেন খান বলেন, ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতির কারণে বিদ্যুতের দাম ২৫ শতাংশ বেশি হয়ে গেছে। ভর্তুকি না থাকলে ৪০ শতাংশ বেড়ে যেত। এ দামে ব্যবসা-বাণিজ্য টিকতে পারবে না। এটা কমাতে হবে। যারা টাকা নিয়ে চলে গেছে, তাদের বোঝাতে হবে, তারা পার পাবে না। তাড়াতাড়ি করলে ভুল হতে পারে, তাই সময় লেগেছে। তবে রাষ্ট্রের সঙ্গে কোম্পানির চুক্তিগুলো সার্বভৌম চুক্তি। চাইলেই এটা বাতিল করা যায় না। বড় জরিমানা দিতে হতে পারে।
আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে মোশতাক হোসেন বলেন, আদানির চুক্তির অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে আদালতে রিট হয়েছে। আদালত প্রতিবেদন চেয়েছেন। মাসখানেকের মধ্যে শক্ত প্রমাণ সামনে আসবে। এসব প্রমাণ নিয়ে দেশে-বিদেশে আইনি প্রক্রিয়া নেওয়া যাবে।
পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশে মূলত ভবিষ্যতে সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যাতে এ ধরনের চুক্তি না করা হয়। চুক্তির আগে স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে যাচাই করে দেখার কথা বলা হয়েছে। পর্যালোচনা কমিটির পরামর্শে গত ২১ জানুয়ারি করা হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ট্যারিফ (বিদ্যুতের দাম) পর্যালোচনা কমিটি। এ কমিটির কাজ চলমান।
চুক্তি অনুসারে প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে নেয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম নির্ধারণে একটি সূত্র দেওয়া আছে চুক্তিতে। এ সূত্র অনুসারে দাম নির্ধারিত হয়। একেক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে একেক দাম। সমঝোতার মাধ্যমে কাউকে কাউকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। দরপত্র ছাড়া বিশেষ বিধান আইনে এভাবে চুক্তি করার সুযোগ নিয়েছে গত আওয়ামী লীগ সরকার।
বিশেষ বিধান আইনটি করা হয় ২০১০ সালে। এরপর দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়। এই আইনের অধীনে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এর কারণে এটি দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত। এ আইনের অধীনে দরপত্র ছাড়া একটার পর একটা চুক্তি করেছিল গত সরকার।