ঘুষের টাকায় আমেরিকায় বাড়িসহ অঢেল সম্পদের মালিক খোকন
Published: 27th, March 2025 GMT
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপ প্রেস সচিব-১ থাকাকালে ঘুষ দুর্নীতি করে আমেরিকায় বাড়িসহ অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন মুহাম্মদ আশরাফুল আলম খোকন। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্ত্রী রেজওয়ানা নূরের নামেও গড়েছেন প্রায় ৩,০৮.৮১,০৫৬৬ টাকার অবৈধ সম্পদ।
দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ঘুষ দুর্নীতির প্রমাণ পেয়ে মুহাম্মদ আশরাফুল আলম খোকন ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
বৃহস্পতিবার (২৭ মার্চ) দুদক তাদের বিরুদ্ধে মামলা দুটি করে। কমিশনের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আরো পড়ুন:
খুলনায় সীমা হত্যা নাটকে এসআই শাহ আলমের কারাদণ্ড
‘ক্লিন ইমেজের’ আড়ালে ‘কলঙ্ক’, দুদকের জালে জিএম কাদের
তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ২৭/১) ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪ (২) ০৪(৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
প্রথম মামলায় বলা হয়, আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপ প্রেস সচিব-১ মুহাম্মদ আশরাফুল আলম সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে অসাধু উপায়ে অজ্ঞাত আয়ের উৎসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ ১৩,৩৩,৯৮৮২৭ টাকার সম্পদের মালিকানা অর্জন করে ভোগ দখলে রেখেছেন।
তিনি ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থের উৎস গোপন বা আড়াল করার জন্য তার নামে ৩টি ব্যাংক হিসাবে ১,৩৪,৩৯,৫৭২ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন করে তার রূপায়ন ও স্থানান্তরপূর্বক 3067 ira Road, Bellmore, NY 11710 আমিরকায় বাড়ি ক্রয় করে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ২৭/১) ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪ (২) ০৪(৩) ধারায় অপরাধ করেছেন।
দ্বিতীয় মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামি মিসেস রেজওয়ানা নূর এবং তার স্বামী মুহাম্মাদ আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত থাকাকালে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে অসাধু উপায়ে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ ৩,০৮.
এছাড়া তার নিজ নামে মোট ৬৩টি অ্যাকাউন্ট এর মাধ্যমে মোট ৬,১২,৪৯,৮৩৭ টাকা হস্তান্তর, রূপান্তর, স্থানান্তরের মাধ্যমে সন্দেহজনক অসংখ্য লেনদেন করে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১), দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ৪(২) ৩৪/৩) এবং দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় অপরাধ করেছেন।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/এসবি
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর দ আশর ফ ল আলম দমন ক
এছাড়াও পড়ুন:
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক, যে বাস্তবতা ভোলা যাবে না
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—এই ২৪ বছর ধরে পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানকে তদানীন্তন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যেভাবে ‘অভ্যন্তরীণ কলোনি’ হিসেবে লুণ্ঠন, শোষণ, বঞ্চনা, পুঁজি পাচার ও অমানুষিক নিপীড়নের অসহায় শিকারে পরিণত করেছিল, সে সম্পর্কে নিচে কয়েকটি নজির উপস্থাপন করছি। এগুলো জানার পর বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী কারোরই পাকিস্তানপ্রেমী হওয়া অযৌক্তিক। কেউ যদি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতবিরোধী হয়, সেটাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে অভিহিত করলে দোষণীয় নয়। কিন্তু পাকিস্তান তো এখনো বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি।
১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার জনগণ ছিল পাকিস্তানের জনগণের ৫৬ শতাংশ, কিন্তু উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্তগুলো প্রমাণ করছে, কত নির্মমভাবে পাকিস্তানের শাসকমহল পূর্ব পাকিস্তানকে (‘পূর্ব বাংলা’ থেকে যার নাম ১৯৫৫ সালে হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান’) বঞ্চনা, শোষণ, লুণ্ঠন, পুঁজি-পাচার ও বৈষম্যের শিকার করেছিল—
১. প্রাথমিক পর্যায়ে পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ের ৭৫-৭৭ শতাংশই আসত পূর্ব বাংলার রপ্তানি পণ্য থেকে। ওই রপ্তানি আয়ের প্রায় পুরোটাই ১৯৪৭-৪৮ অর্থবছর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার দখলে নিতে শুরু করেছিল। ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন যখন জোরদার হতে শুরু করেছিল, তখন বৈদেশিক রপ্তানি আয়ের একটা ক্রমবর্ধমান অংশ পূর্ব পাকিস্তানে বরাদ্দ করা হলেও ১৯৪৭-১৯৭১ এই ২৪ বছরের শেষে এসেও কখনোই বছরে রপ্তানি আয়ের এক-পঞ্চমাংশও পূর্ব পাকিস্তান নিজেদের ভাগে পায়নি, এই ২৪ বছরের গড় বার্ষিক হিস্যা ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ।
২. ইঙ্গ-মার্কিন বলয়ে অবস্থান গ্রহণের কারণে পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই বিভিন্ন দাতাদেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান পাওয়ার ব্যাপারে অগ্রাধিকার পেয়েছিল। ২৪ বছরে ওই বৈদেশিক সাহায্যের মাত্র ১৭ শতাংশ পেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। স্বাধীনতার পর ওই ১৭ শতাংশ ঋণের দায়ভার বাংলাদেশ গ্রহণ করার পরই কেবল দাতাদেশ ও সংস্থাগুলো নতুন করে স্বাধীন বাংলাদেশকে ঋণ ও অনুদান দিতে রাজি হয়েছিল।
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলেও কোনোমতেই ভুলে যাওয়া যাবে না যে পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের জনগণের কাছে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি এবং বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনাও পরিশোধ করেনি৩. পূর্ব পাকিস্তান থেকে ২৪ বছরে পাকিস্তানের ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করেছিল, তার মাত্র ৮ শতাংশ বাংলাদেশের ঋণগ্রহীতারা পেয়েছে, বাকি ৯২ শতাংশই পাকিস্তানের সরকার ও শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা কবজা করে নিয়েছেন।
৪. ওই ২৪ বছরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সরকারি বাজেটের মাত্র ২৮ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয়িত হয়েছিল, বাকি ৭২ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে।
৫. ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়িত পাকিস্তানের তিনটি পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যয় বরাদ্দের মাত্র ২৯ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে।
৬. পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানিদের অনুপাত কখনোই ৭ শতাংশ অতিক্রম করেনি। সশস্ত্র বাহিনীগুলোর অফিসারদের মধ্যে বাঙালিদের অনুপাত এমনকি ৫ শতাংশেও পৌঁছায়নি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত।
৭. ১৯৭০ সালে খোদ পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত প্রাইভেট খাতের শিল্পকারখানার মাত্র ১১ শতাংশের মালিক ছিল বাঙালিরা, বাকি ৮৯ শতাংশের মালিক ছিল হয় পশ্চিম পাকিস্তানিরা নয়তো অবাঙালিরা। পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত একটি শিল্পকারখানার মালিকও বাঙালি ছিল না।
৮. মুক্তিযুদ্ধের সময় ডিসেম্বর মাসে যখন পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব ব্যাংকের ভল্ট খালি করে অর্থ পাচার করে দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানে। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের রিজার্ভের সব সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়েছিল পাকিস্তানে।
৯. ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সিভিল প্রশাসনে বাঙালি ছিল মাত্র ১৬ শতাংশ, আর বাকি ৮৪ শতাংশই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি ও অবাঙালিরা।
১০. যখন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানে থাকা নৌবাহিনীর জাহাজ, বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টারের একাংশ এবং পিআইএর বেশ কয়েকটি উড়োজাহাজ বার্মার সহায়তায় পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পেরেছিল পাকিস্তান সরকার।
১১. পাকিস্তানের তিনটা রাজধানী করাচি, রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদের বিপুল নির্মাণ ব্যয়ের সিংহভাগই বহন করেছিল পূর্ব পাকিস্তান।
১২. ২৪ বছরে পাকিস্তান সিন্ধু নদ ও এর শাখাগুলোতে বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচব্যবস্থা গড়ে তুলেছে বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে। এ কারণে পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের ৬৫ শতাংশ কৃষিজমি ১৯৭০ সালে সেচের আওতায় এসেছিল। এর বিপরীতে ওই ২৪ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের মাত্র ২২ শতাংশ কৃষিজমি সেচের আওতায় আনা হয়েছিল। উপরন্তু আর্থিক ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা সমস্যার সমাধানে অর্থায়ন করতে বারবার অস্বীকার করেছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার।
স্বাধীনতা-উত্তর ৫৪ বছরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন বারবার বিঘ্নিত হলেও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ২০২৫ সালে ২ হাজার ৭৫০ ডলার ছাড়িয়েছে, অথচ পাকিস্তানের মাত্র ১ হাজার ৫৪৭ ডলার। এই অর্থনৈতিক বাস্তবতা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের জনগণের জন্য কতখানি যৌক্তিক ছিল।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনার সরকারের মতো ভারতের কাছে নতজানু হবে না, সেটাই যৌক্তিক। কিন্তু বাংলাদেশের সীমানার প্রায় তিন পাশ ঘিরে থাকা বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় না রাখলে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলেও কোনোমতেই ভুলে যাওয়া যাবে না যে পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের জনগণের কাছে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি এবং বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনাও পরিশোধ করেনি।
ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়