অনেক কারখানার শ্রমিকদের বেতন ভাতা এখনো বাকি
Published: 28th, March 2025 GMT
সরকার নির্ধারিত সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও তৈরি পোশাকশিল্পের অনেক কারখানা এখনো শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধ করেনি। তবে আন্দোলনে থাকা ছয় কারখানার শ্রমিকের পাওনার একটা অংশ পরিশোধের ব্যবস্থা হয়েছে, এমনটা জানিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টার দপ্তর।
শ্রমিকের বেতন-বোনাস পরিশোধ নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার দুই ধরনের পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। শিল্প পুলিশ বলেছে, গতকাল পর্যন্ত তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ১৯ শতাংশ কারখানা ঈদের বোনাস এবং ৭৯ শতাংশ কারখানা মার্চ মাসের অর্ধেক বেতন দেয়নি। যদিও তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর দাবি, তাদের সচল প্রায় ৯৫ শতাংশ কারখানার বোনাস দেওয়া শেষ। আর নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ বলছে, ৮০ শতাংশ কারখানা বোনাস দিয়েছে। উভয় সংগঠনের দাবি, আজ শুক্র ও আগামীকাল শনিবার সব কারখানা বেতন-বোনাস দেবে।
বকেয়া বেতন-বোনাস ও অন্যান্য পাওনার দাবিতে গতকাল পঞ্চম দিনের মতো শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন টিএনজেড গ্রুপের অ্যাপারেল প্লাস ইকো, টি অ্যান্ড জেড অ্যাপারেলস ও অ্যাপারেল আর্ট কারখানার শ্রমিকেরা। পাশাপাশি স্টাইল ক্রাফট ও ইয়াং ওয়ান্স কারখানার শ্রমিকেরাও ক্ষতিপূরণের দাবিতে অবস্থান করেন।
শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টার দপ্তর গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, টিএনজেড গ্রুপের অ্যাপারেলস ইকো লিমিটেডের গাড়ি বিক্রি করে শ্রমিকের বেতন-ভাতা পরিশোধ করেছে। স্টাইলক্রাফট এবং ইয়াং ওয়ান্সের বকেয়া ক্ষতিপূরণ দিতে শ্রমিক ও মালিক প্রতিনিধিদের নিয়ে মন্ত্রণালয়ে সভা হয়েছে। সভায় শ্রমিকদের পাওনাদি পরিশোধের বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে।
এ ছাড়া বিজ্ঞপ্তিতে বন্ধ থাকা গাজীপুরের মাহমুদ গ্রুপ ও ময়মনসিংহের ভালুকার রোর ফ্যাশনের শ্রমিকদের পাওনার বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, মাহমুদ গ্রুপের দুটি কারখানার শ্রমিকের বেতন-ভাতা পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ সহায়তার ১১ কোটি টাকা ছাড় করেছে। রোর ফ্যাশনের মালিক পলাতক থাকায় শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধে মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে ১ কোটি ২৩ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।
গতকাল সন্ধ্যা সাতটায় টিএনজেড গ্রুপের অ্যাপারেল প্লাস ইকোর শ্রমিক রেখা আক্তার মোবাইল ফোনে প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিকেরা এখনো পাওনা বুঝে পাননি। যতক্ষণ তাঁরা বকেয়া পাবেন না, ততক্ষণ শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান করবেন। তিনি জানান, গত জানুয়ারি মাসের আংশিক বেতনের পাশাপাশি ফেব্রুয়ারি ও মার্চ (অর্ধেক) মাসের বেতন, ঈদ বোনাস এবং দুই বছরের ছুটির টাকা তাদের পাওনা রয়েছে। ২২ মার্চ পর্যন্ত কারখানায় কাজ করেছেন শ্রমিকেরা।
একাধিক শ্রমিকনেতা বলেন, ঈদের আগে শেষ মুহূর্তে পোশাকশ্রমিকের বেতন-ভাতা নিয়ে জটিলতা রয়ে গেছে। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য কারখানায় সমস্যা তুলনামূলক কম হলেও সাব কন্ট্রাকটিং বা ঠিকায় কাজ করে, এমন ছোট ছোট কারখানায় বেতন-ভাতা পরিশোধের অবস্থা নাজুক। বেশির ভাগই ৫০০-১০০ টাকা ঈদ বোনাস দিচ্ছে। মার্চের বেতন না দেওয়ার কারখানার সংখ্যাই বেশি। এসব কারখানা নজরদারি করার দায়িত্ব সরকারের।
ঈদের আগে শ্রম পরিস্থিতির পাশাপাশি শিল্প খাতের শ্রমিকদের বেতন-বোনাস ও ছুটি-সংক্রান্ত বিষয় পর্যালোচনার জন্য ১২ মার্চ সরকার, মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিরা বৈঠক করেন। ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদের এই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, শ্রমিকদের বকেয়া বেতন, বোনাসসহ সব পাওনা ২০ রমজানের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। মালিকপক্ষকে চলতি মার্চ মাসের অন্তত ১৫ দিনের বেতনও দিতে হবে। ঈদ সামনে রেখে প্রণোদনা বাবদ দুই হাজার কোটি টাকা ছাড় করেছে সরকার।
পোশাকশিল্পের বেতন-ভাতা পরিস্থিতিম্যাপড ইন বাংলাদেশের (এমআইবি) ডিজিটাল মানচিত্র অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা আছে ৩ হাজার ৫৫৫টি। এর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য সচল কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ১০৭। বিকেএমইএর সচল সদস্য কারখানা ৬১৩টি।
বিজিএমইএ দাবি করেছে, প্রায় ৯৫ শতাংশ কারখানা গতকাল পর্যন্ত শ্রমিকের ঈদ বোনাস দিয়েছে। আর মার্চ মাসের অর্ধেক বেতন দিয়েছে ৮৩ শতাংশ কারখানা। এখন পর্যন্ত ১০টি কারখানা ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন দেয়নি।
যদিও বিজিএমইএর ১ হাজার ৫৫৫ কারখানা তদারকি করে শিল্প পুলিশ বলছে, প্রায় ১৬ শতাংশ কারখানা গতকাল পর্যন্ত বোনাস দেয়নি। বেতন বকেয়া আছে ৮০ শতাংশ কারখানার।
শিল্প পুলিশের পরিসংখ্যান সঠিক নয় উল্লেখ করে বিজিএমইএর প্রশাসক আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কাল (আজ) শুক্রবার ও পরশু (কাল) শনিবার সব কারখানা মার্চের অর্ধেক বেতন দিয়ে ছুটি দেবে। আপাতত বেতন-ভাতা নিয়ে কোনো সংকট নেই। বন্ধ কারখানাগুলোর সমস্যাও সমাধান করা হয়েছে।
বিকেএমইএ দাবি করেছে, ৪৯০ কারখানা গতকাল পর্যন্ত শ্রমিকের বোনাস পরিশোধ করেছে। আর মার্চের অর্ধেক বেতন পরিশোধ করেছে ৩৬৭ কারখানা। অবশ্য বিকেএমইএর ৫৮১ কারখানা তদারকি করে শিল্প পুলিশ বলছে, ৯০ শতাংশ কারখানার বেতন এখনো বাকি। বোনাস দিয়েছে ৩৪ শতাংশ কারখানা।
শিল্প পুলিশের তথ্য ঠিক নয় বলে বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমও দাবি করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একটি কারখানার বেতন-ভাতা পরিশোধে সমস্যা ছিল। কয়েকজন মালিক মিলে ৩৫ লাখ টাকা ঋণ দিয়ে কারখানাটির সমস্যা সমাধান করা হয়েছে। কাল-পরশুর (আজ ও কাল) মধ্যে সব কারখানা বেতন-ভাতা দিয়ে শ্রমিকদের ছুটি দেবে।
পিছিয়ে অন্য শিল্পকারখানাওতৈরি পোশাকশিল্পের বাইরে অন্য শিল্পকারখানার বেতন–ভাতা পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরেছে শিল্প পুলিশ। সাভার-আশুলিয়া, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা, কুমিল্লা ও সিলেটের বিভিন্ন খাতের ৬ হাজার ৮০৫ কারখানা তদারকি করে শিল্প পুলিশ বলেছে, ১ হাজার ৯২৪ বা ২৮ শতাংশ কারখানা গতকাল পর্যন্ত ঈদ বোনাস দেয়নি। এখনো মার্চের বেতন দেয়নি ৪ হাজার ৯৪২টি বা ৭৩ শতাংশ কারখানা।
জানতে চাইলে শ্রমিক সংগঠনগুলোর আন্তর্জাতিক জোট ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সালাউদ্দিন স্বপন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ তৈরি পোশাক কারখানায় ভরপুর ক্রয়াদেশ রয়েছে। এরপরও বেতন-ভাতা নিয়ে যা হচ্ছে, তা দুঃখজনক। ভবিষ্যতে ঈদের আগে তৈরি পোশাকসহ অন্য খাতের শ্রমিকের বেতন-ভাতা পরিশোধে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। কোনো কারখানার মালিক সময়মতো শ্রমিকের বেতন-ভাতা না দিলে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ ল প প ল শ বল প রথম আল ক ব ক এমইএর ব জ এমইএর ব ক এমইএ ব জ এমইএ ঈদ ব ন স গতক ল প সরক র অবস থ সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
বিদ্যুৎ খাতে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি হয়েছে: পর্যালোচনা কমিটি
বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির নামে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো সরকারের কাছ থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া বাবদ অর্থ নিয়েছে, যেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহের চেয়ে দুর্নীতিই মুখ্য ছিল বলে অভিমত দিয়েছে সরকার গঠিত চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। তারা বলেছে, চুক্তিতে ব্যবসায়ীদের কোনো ঝুঁকি নেই, সব ঝুঁকি সরকারের। এটি সরকারের অদক্ষতাজনিত ব্যর্থতা নয়, দুর্নীতি জড়িত। তাই চুক্তি বাতিল করা সম্ভব।
বিদ্যুৎ খাতের চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির তিন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তাঁরা বলেছেন, গত সরকারের দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ, খরচ বেড়েছে ১১ গুণ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনটি করাই হয়েছে দুর্নীতির জন্য। এখানে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি হয়েছে। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিগুলো ভাড়া আদায়ের নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে কাজ করেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো জ্বালানি আমদানি করেছে নিজেরা। এতেও দুর্নীতি হয়েছে।
তবে এখন এসব চুক্তি বাতিল করতে হলে অনুসন্ধান করে দুর্নীতির প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন পর্যালোচনা কমিটির সদস্যরা। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের প্রতিবেদন নিয়ে সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করতে পারে। গত সরকারের সময় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একের পর এক একতরফা চুক্তি করা হয়েছে। চুক্তিতে সব সুবিধা দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে, রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করা হয়নি। একটি চুক্তি যেন আরেকটির প্রতিলিপি। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ সংস্থাগুলো এতে জড়িত ছিল। গ্যাস পাওয়া যাবে না, চুক্তি করা হোক—এমন সুপারিশও দেখা গেছে মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে।
পর্যালোচনা কমিটির তিনজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, শুধু চুক্তি নয়, চুক্তির আগের পুরো প্রক্রিয়া যাচাই করে দেখা হয়েছে। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপের নমুনা পাওয়া গেছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। সাবেক দুই বিদ্যুৎসচিব, যাঁরা পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব হয়েছিলেন; তাঁদের সংশ্লিষ্টতা আছে সংঘবদ্ধ দুর্নীতিতে। এই দুজন হলেন আবুল কালাম আজাদ ও আহমদ কায়কাউস।
# চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন# দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ, খরচ বেড়েছে ১১ গুণ
# ব্যবসায়ী, আমলা, সরকারের শীর্ষ পর্যায় মিলে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি
# চুক্তি বাতিল সম্ভব, দুদকের তদন্ত করতে হবে
# আদানির চুক্তিতে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে
দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনটি বাতিল করা হয় গত বছরের নভেম্বরে। এর আগেই এ আইনের অধীনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে গত সরকারের করা চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আছেন হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী। কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও সহ-উপাচার্য আবদুল হাসিব চৌধুরী, কেপিএমজি বাংলাদেশের সাবেক প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আলী আশফাক, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ফ্যাকাল্টি অব ল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের অর্থনীতির অধ্যাপক মোশতাক হোসেন খান ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক।
জানুয়ারিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন
আজ রোববার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দিয়েছে চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে তারা। এ ছাড়া ভারতের আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে করা চুক্তির অনিয়ম নিয়েও একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তারা। প্রতিবেদন জমার পর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে একটি সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন কমিটির সদস্যরা।
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, কারণ ছাড়া চুক্তি বাতিল করলে তার ক্ষতিপূরণের বিষয়টি চুক্তিতেই বলা আছে। তবে প্রতিটি চুক্তিতেই স্বীকারোক্তি থাকে যে এই চুক্তিতে কোনো দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়নি। এটা যদি লঙ্ঘিত হয়, তাহলে চুক্তি বাতিল করা যায়। কিন্তু মুখের কথা তো আদালত মানতে চাইবেন না, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে হবে আদালতে। কমিটির সহায়তায় চুক্তির অনিয়ম খুঁজে দেখা হচ্ছে। কারণ, খুঁজে পাওয়া গেলে চুক্তি বাতিলে দ্বিধা করা হবে না।
কমিটির আহ্বায়ক মঈনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, চুক্তি কতটা বাতিল করা যাবে, তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। বিদ্যুৎ খাতের চুক্তিগুলো পুরোপুরি কারিগরি, তাই সময় লেগেছে পর্যালোচনায়। এতে ব্যাপক দুর্নীতি পাওয়া গেছে। আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কমিটির সদস্য জাহিদ হোসেন বলেন, চুক্তি–সম্পর্কিত নথি দেখা হয়েছে। পিডিবি থেকে পরিশোধ করা বিলের তথ্য নেওয়া হয়েছে। এগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে, কী কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে। ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ ছিল, মন্ত্রণালয় সব সময় প্রধানমন্ত্রীর হাতে ছিল। বিদ্যুৎ খাতে যে পরিমাণ বিল পরিশোধ করা হয়েছে এবং এর বিপরীতে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে, এর হিসাব আইনস্টাইনও মেলাতে পারবেন না।
চুক্তি বাতিল করলে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির সদস্য শাহদীন মালিক বলেন, যাঁরা ক্ষতিপূরণ দাবি করবেন, তাঁরা তাঁদের ক্ষতির হিসাব দেবেন। তাই ক্ষতিপূরণের বিষয়টা তো এ কমিটি বলতে পারবে না।
দুর্নীতির কারণে বেড়েছে বিদ্যুতের দাম
সংবাদ সম্মেলনে কমিটির সদস্য মোশতাক হোসেন খান বলেন, ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতির কারণে বিদ্যুতের দাম ২৫ শতাংশ বেশি হয়ে গেছে। ভর্তুকি না থাকলে ৪০ শতাংশ বেড়ে যেত। এ দামে ব্যবসা-বাণিজ্য টিকতে পারবে না। এটা কমাতে হবে। যারা টাকা নিয়ে চলে গেছে, তাদের বোঝাতে হবে, তারা পার পাবে না। তাড়াতাড়ি করলে ভুল হতে পারে, তাই সময় লেগেছে। তবে রাষ্ট্রের সঙ্গে কোম্পানির চুক্তিগুলো সার্বভৌম চুক্তি। চাইলেই এটা বাতিল করা যায় না। বড় জরিমানা দিতে হতে পারে।
আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে মোশতাক হোসেন বলেন, আদানির চুক্তির অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে আদালতে রিট হয়েছে। আদালত প্রতিবেদন চেয়েছেন। মাসখানেকের মধ্যে শক্ত প্রমাণ সামনে আসবে। এসব প্রমাণ নিয়ে দেশে-বিদেশে আইনি প্রক্রিয়া নেওয়া যাবে।
পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশে মূলত ভবিষ্যতে সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যাতে এ ধরনের চুক্তি না করা হয়। চুক্তির আগে স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে যাচাই করে দেখার কথা বলা হয়েছে। পর্যালোচনা কমিটির পরামর্শে গত ২১ জানুয়ারি করা হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ট্যারিফ (বিদ্যুতের দাম) পর্যালোচনা কমিটি। এ কমিটির কাজ চলমান।
চুক্তি অনুসারে প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে নেয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম নির্ধারণে একটি সূত্র দেওয়া আছে চুক্তিতে। এ সূত্র অনুসারে দাম নির্ধারিত হয়। একেক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে একেক দাম। সমঝোতার মাধ্যমে কাউকে কাউকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। দরপত্র ছাড়া বিশেষ বিধান আইনে এভাবে চুক্তি করার সুযোগ নিয়েছে গত আওয়ামী লীগ সরকার।
বিশেষ বিধান আইনটি করা হয় ২০১০ সালে। এরপর দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়। এই আইনের অধীনে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এর কারণে এটি দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত। এ আইনের অধীনে দরপত্র ছাড়া একটার পর একটা চুক্তি করেছিল গত সরকার।