সরকার নির্ধারিত সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও তৈরি পোশাকশিল্পের অনেক কারখানা এখনো শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধ করেনি। তবে আন্দোলনে থাকা ছয় কারখানার শ্রমিকের পাওনার একটা অংশ পরিশোধের ব্যবস্থা হয়েছে, এমনটা জানিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টার দপ্তর।

শ্রমিকের বেতন-বোনাস পরিশোধ নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার দুই ধরনের পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। শিল্প পুলিশ বলেছে, গতকাল পর্যন্ত তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ১৯ শতাংশ কারখানা ঈদের বোনাস এবং ৭৯ শতাংশ কারখানা মার্চ মাসের অর্ধেক বেতন দেয়নি। যদিও তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর দাবি, তাদের সচল প্রায় ৯৫ শতাংশ কারখানার বোনাস দেওয়া শেষ। আর নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ বলছে, ৮০ শতাংশ কারখানা বোনাস দিয়েছে। উভয় সংগঠনের দাবি, আজ শুক্র ও আগামীকাল শনিবার সব কারখানা বেতন-বোনাস দেবে।

বকেয়া বেতন-বোনাস ও অন্যান্য পাওনার দাবিতে গতকাল পঞ্চম দিনের মতো শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন টিএনজেড গ্রুপের অ্যাপারেল প্লাস ইকো, টি অ্যান্ড জেড অ্যাপারেলস ও অ্যাপারেল আর্ট কারখানার শ্রমিকেরা। পাশাপাশি স্টাইল ক্রাফট ও ইয়াং ওয়ান্স কারখানার শ্রমিকেরাও ক্ষতিপূরণের দাবিতে অবস্থান করেন।

শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টার দপ্তর গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, টিএনজেড গ্রুপের অ্যাপারেলস ইকো লিমিটেডের গাড়ি বিক্রি করে শ্রমিকের বেতন-ভাতা পরিশোধ করেছে। স্টাইলক্রাফট এবং ইয়াং ওয়ান্সের বকেয়া ক্ষতিপূরণ দিতে শ্রমিক ও মালিক প্রতিনিধিদের নিয়ে মন্ত্রণালয়ে সভা হয়েছে। সভায় শ্রমিকদের পাওনাদি পরিশোধের বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে।

এ ছাড়া বিজ্ঞপ্তিতে বন্ধ থাকা গাজীপুরের মাহমুদ গ্রুপ ও ময়মনসিংহের ভালুকার রোর ফ্যাশনের শ্রমিকদের পাওনার বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, মাহমুদ গ্রুপের দুটি কারখানার শ্রমিকের বেতন-ভাতা পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ সহায়তার ১১ কোটি টাকা ছাড় করেছে। রোর ফ্যাশনের মালিক পলাতক থাকায় শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধে মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে ১ কোটি ২৩ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।

গতকাল সন্ধ্যা সাতটায় টিএনজেড গ্রুপের অ্যাপারেল প্লাস ইকোর শ্রমিক রেখা আক্তার মোবাইল ফোনে প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিকেরা এখনো পাওনা বুঝে পাননি। যতক্ষণ তাঁরা বকেয়া পাবেন না, ততক্ষণ শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান করবেন। তিনি জানান, গত জানুয়ারি মাসের আংশিক বেতনের পাশাপাশি ফেব্রুয়ারি ও মার্চ (অর্ধেক) মাসের বেতন, ঈদ বোনাস এবং দুই বছরের ছুটির টাকা তাদের পাওনা রয়েছে। ২২ মার্চ পর্যন্ত কারখানায় কাজ করেছেন শ্রমিকেরা।

একাধিক শ্রমিকনেতা বলেন, ঈদের আগে শেষ মুহূর্তে পোশাকশ্রমিকের বেতন-ভাতা নিয়ে জটিলতা রয়ে গেছে। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য কারখানায় সমস্যা তুলনামূলক কম হলেও সাব কন্ট্রাকটিং বা ঠিকায় কাজ করে, এমন ছোট ছোট কারখানায় বেতন-ভাতা পরিশোধের অবস্থা নাজুক। বেশির ভাগই ৫০০-১০০ টাকা ঈদ বোনাস দিচ্ছে। মার্চের বেতন না দেওয়ার কারখানার সংখ্যাই বেশি। এসব কারখানা নজরদারি করার দায়িত্ব সরকারের।

ঈদের আগে শ্রম পরিস্থিতির পাশাপাশি শিল্প খাতের শ্রমিকদের বেতন-বোনাস ও ছুটি-সংক্রান্ত বিষয় পর্যালোচনার জন্য ১২ মার্চ সরকার, মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিরা বৈঠক করেন। ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদের এই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, শ্রমিকদের বকেয়া বেতন, বোনাসসহ সব পাওনা ২০ রমজানের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। মালিকপক্ষকে চলতি মার্চ মাসের অন্তত ১৫ দিনের বেতনও দিতে হবে। ঈদ সামনে রেখে প্রণোদনা বাবদ দুই হাজার কোটি টাকা ছাড় করেছে সরকার।

পোশাকশিল্পের বেতন-ভাতা পরিস্থিতি

ম্যাপড ইন বাংলাদেশের (এমআইবি) ডিজিটাল মানচিত্র অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা আছে ৩ হাজার ৫৫৫টি। এর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য সচল কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ১০৭। বিকেএমইএর সচল সদস্য কারখানা ৬১৩টি।

বিজিএমইএ দাবি করেছে, প্রায় ৯৫ শতাংশ কারখানা গতকাল পর্যন্ত শ্রমিকের ঈদ বোনাস দিয়েছে। আর মার্চ মাসের অর্ধেক বেতন দিয়েছে ৮৩ শতাংশ কারখানা। এখন পর্যন্ত ১০টি কারখানা ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন দেয়নি।

যদিও বিজিএমইএর ১ হাজার ৫৫৫ কারখানা তদারকি করে শিল্প পুলিশ বলছে, প্রায় ১৬ শতাংশ কারখানা গতকাল পর্যন্ত বোনাস দেয়নি। বেতন বকেয়া আছে ৮০ শতাংশ কারখানার।

শিল্প পুলিশের পরিসংখ্যান সঠিক নয় উল্লেখ করে বিজিএমইএর প্রশাসক আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কাল (আজ) শুক্রবার ও পরশু (কাল) শনিবার সব কারখানা মার্চের অর্ধেক বেতন দিয়ে ছুটি দেবে। আপাতত বেতন-ভাতা নিয়ে কোনো সংকট নেই। বন্ধ কারখানাগুলোর সমস্যাও সমাধান করা হয়েছে।

বিকেএমইএ দাবি করেছে, ৪৯০ কারখানা গতকাল পর্যন্ত শ্রমিকের বোনাস পরিশোধ করেছে। আর মার্চের অর্ধেক বেতন পরিশোধ করেছে ৩৬৭ কারখানা। অবশ্য বিকেএমইএর ৫৮১ কারখানা তদারকি করে শিল্প পুলিশ বলছে, ৯০ শতাংশ কারখানার বেতন এখনো বাকি। বোনাস দিয়েছে ৩৪ শতাংশ কারখানা।

শিল্প পুলিশের তথ্য ঠিক নয় বলে বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমও দাবি করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একটি কারখানার বেতন-ভাতা পরিশোধে সমস্যা ছিল। কয়েকজন মালিক মিলে ৩৫ লাখ টাকা ঋণ দিয়ে কারখানাটির সমস্যা সমাধান করা হয়েছে। কাল-পরশুর (আজ ও কাল) মধ্যে সব কারখানা বেতন-ভাতা দিয়ে শ্রমিকদের ছুটি দেবে।

পিছিয়ে অন্য শিল্পকারখানাও

তৈরি পোশাকশিল্পের বাইরে অন্য শিল্পকারখানার বেতন–ভাতা পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরেছে শিল্প পুলিশ। সাভার-আশুলিয়া, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা, কুমিল্লা ও সিলেটের বিভিন্ন খাতের ৬ হাজার ৮০৫ কারখানা তদারকি করে শিল্প পুলিশ বলেছে, ১ হাজার ৯২৪ বা ২৮ শতাংশ কারখানা গতকাল পর্যন্ত ঈদ বোনাস দেয়নি। এখনো মার্চের বেতন দেয়নি ৪ হাজার ৯৪২টি বা ৭৩ শতাংশ কারখানা।

জানতে চাইলে শ্রমিক সংগঠনগুলোর আন্তর্জাতিক জোট ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সালাউদ্দিন স্বপন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ তৈরি পোশাক কারখানায় ভরপুর ক্রয়াদেশ রয়েছে। এরপরও বেতন-ভাতা নিয়ে যা হচ্ছে, তা দুঃখজনক। ভবিষ্যতে ঈদের আগে তৈরি পোশাকসহ অন্য খাতের শ্রমিকের বেতন-ভাতা পরিশোধে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। কোনো কারখানার মালিক সময়মতো শ্রমিকের বেতন-ভাতা না দিলে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ ল প প ল শ বল প রথম আল ক ব ক এমইএর ব জ এমইএর ব ক এমইএ ব জ এমইএ ঈদ ব ন স গতক ল প সরক র অবস থ সমস য

এছাড়াও পড়ুন:

শ্রম আইন সংশোধন দ্রুত শেষ করতে বলেছে মার্কিন প্রতিনিধিদল

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে পাল্টা শুল্ক কমাতে হলে বাণিজ্যঘাটতি কমানোর পাশাপাশি শ্রম আইন সংশোধনপ্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করতে বলেছে ঢাকা সফররত মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদল।

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতাদের সঙ্গে আজ সোমবার সকালে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠক করে এমনটাই বলেছে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদল। যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডেন লিঞ্চ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খানের নেতৃত্বে সংগঠনটির সহসভাপতি মো. রেজওয়ান সেলিম, পরিচালক ফয়সাল সামাদ, মোহাম্মদ আবদুস সালাম প্রমুখ মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠকে আরও ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন। ব্রেন্ডেন লিঞ্চ দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন বাণিজ্যনীতি বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মার্কিন প্রতিনিধিদল বিজিএমইএর নেতাদের স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিয়েছে যে পাল্টা শুল্ক নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে এখনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়নি। ফলে পাল্টা শুল্কের হার সেটি আরও কমানোর সুযোগ রয়েছে। তার জন্য বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বাণিজ্যঘাটতি এবং শ্রম আইন সংশোধনপ্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।

জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাণিজ্যঘাটতি কমানোর বিষয়ে আমরা প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছি, ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি শুরু হয়েছে। এ ছাড়া গম, এলএনজিসহ অন্যান্য পণ্য আমদানির প্রক্রিয়াও চলছে। এসব পণ্য আমদানি হলে বাণিজ্যঘাটতি অনেকটাই কমে আসবে। এ ছাড়া শ্রম আইন সংশোধনের ১২৪টির মধ্যে ১২২টির বিষয়ে আমরা ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে একমত হয়েছি। বাকিগুলোর বিষয়েও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছানো যাবে। তা ছাড়া আইএলওর কনভেনশন অনুসমর্থন নিয়েও আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’

বিজিএমইএর সভাপতি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা কোনো পণ্য উৎপাদনে ওই পণ্যের মোট মূল্যের কমপক্ষে ২০ শতাংশ যদি দেশটির উপকরণ বা কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়, তাহলে ওই ২০ শতাংশের ওপর পাল্টা শুল্ক প্রযোজ্য না হওয়ার একটি বিষয় আমরা জেনেছি। সেটি পরিষ্কার করার বিষয়ে আমরা মার্কিন প্রতিনিধিদলকে অনুরোধ করেছি। তাঁরা বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন। তাঁরা দ্রুতই জানাবেন।’

পাল্টা শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমে ২০ শতাংশ হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর) দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে বাণিজ্য চুক্তির একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। বাণিজ্য চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত করতে তিন দিনের সফরে ঢাকায় এসেছে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদলটি। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের সঙ্গে গতকাল রোববার সচিবালয়ে বৈঠক করে প্রতিনিধিদল। এতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান নাজনীন কাউসার চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সফররত মার্কিন দল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সঙ্গেও বৈঠক করবে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • শ্রম আইন সংশোধন দ্রুত শেষ করতে বলেছে মার্কিন প্রতিনিধিদল
  • জামায়াত আমিরের সঙ্গে শিল্প মালিক‌দের সৌজন্য সাক্ষাৎ