ট্রাম্প গোটা ইউরোপকে যে সংকটে ফেলে দিয়েছেন
Published: 29th, March 2025 GMT
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈদেশিক নীতিতে আমূল পরিবর্তন দেখে অনেকেই মনে করছেন, তিনি দীর্ঘ মেয়াদে আমেরিকাকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ করতে চান। এখন ধারণা করা হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া মিলে বিশ্বকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে, যেমনটি ১৯৪৫ সালের ইয়াল্টা সম্মেলনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ীরা করেছিল। ট্রাম্প আমেরিকার ৮০ বছরের পুরোনো নিয়ম ও আইনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ধরে রাখার অঙ্গীকার থেকে সরে আসছেন, ফলে বিশ্ব আবার সেই যুগে ফিরে যাচ্ছে, যেখানে শক্তিই শেষ কথা বলে।
তবে এর মানে এই নয় যে ট্রাম্প পুতিনের সঙ্গে বিশেষভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়তে চান বা চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের প্রতি গভীর প্রশংসা প্রকাশ করেন। তদুপরি ধরে নেওয়া উচিত নয় যে পুতিন ও সি আমেরিকার প্রতি কখনোই পুরোপুরি আস্থাশীল হবেন, এমনকি যদি তঁারা ট্রাম্পের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়েও তোলেন।
বর্তমান পরিস্থিতিকে বোঝানোর জন্য আরও ভালো একটি উপায় হতে পারে এই যে ট্রাম্প রাশিয়ার প্রতি ঝুঁকছেন না, যতটা না তিনি ইউরোপের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে এবং সম্ভব হলে পুরো আটলান্টিক জোট থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চান। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমন একটি প্রকল্প, যেখানে প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্র সমান অধিকার ভোগ করে, যা ট্রাম্পের বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মেলে না।
ট্রাম্প মনে করেন যে ইউক্রেন যুদ্ধ ও ইউরোপীয় মিত্রদের প্রতি আমেরিকার দায়বদ্ধতা তার দেশের জন্য একধরনের ব্যয়বহুল বাধা। তাঁর বিশ্বাস, যুক্তরাষ্ট্র যদি আন্তর্জাতিক আইন, নিয়ম ও প্রতিশ্রুতি পরিহার করতে পারে, তাহলে এককভাবেই বিশ্বকে শাসন করতে পারবে। এই নতুন বিশ্বব্যবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা সামরিক সংঘাতে পরিণত না–ও হতে পারে, তবে এটি অবশ্যই প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও আর্থিক আধিপত্যের জন্য একধরনের যুদ্ধের রূপ নেবে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন কৌশল ইউরোপের জন্য গভীর প্রভাব ফেলবে। আমেরিকার সরে যাওয়ার ফলে ইউরোপে এক ধরনের ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি হবে, যা ইতিমধ্যেই বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার প্রবল চাপের মধ্যে রয়েছে। ট্রাম্প মনে করেন তিনি ইউরোপ থেকে নিজেকে মুক্ত করেছেন, কিন্তু রাশিয়া ও চীন তা ভালো করেই বুঝতে পেরেছে এবং তারা এই ভাঙনকে কাজে লাগাতে প্রস্তুত।
বিরোধপূর্ণ হলেও, যখন বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারকেন্দ্র ইউরো-আটলান্টিক অঞ্চল থেকে ইন্দো-প্যাসিফিকে স্থানান্তরিত হয়েছে, তখনো ইউরোপ আবারও বিশ্বরাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ইউরোপের ভূরাজনৈতিক প্রভাব হয়তো এখনো ততটা শক্তিশালী নয়, তবে এর মানে এই নয় যে ইউরোপের দেশগুলো ও প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দুর্বল অবস্থানে থাকবে।
জার্মানি ইউরোপকে আরও সহায়তা করতে পারে কেবল সামরিক শক্তি বাড়িয়েই নয়, কূটনৈতিক সংলাপের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে। সামরিক শক্তি এবং সংলাপের জন্য উন্মুক্ততা—এই দুই দিক একসঙ্গে মিলেই শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করে। ইউরোপের শান্তি ও সমৃদ্ধির ভবিষ্যৎ এখন সম্পূর্ণ ইউরোপীয়দের হাতেই।ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার জন্য সম্প্রতি ঘোষিত ‘ইচ্ছুকদের জোট’ একটি বড় পদক্ষেপ, যা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর পথে এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। উল্লেখযোগ্যভাবে, এই উদ্যোগে ইইউর বাইরের সদস্যরাও রয়েছে এবং এটি ইইউর পরিবর্তে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে।
ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য (প্রত্যেকেই পারমাণবিক শক্তিধর) নেতৃত্ব ধরে রাখলে, এই জোট একটি অস্থায়ী নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করতে পারে, যা ভবিষ্যতে একটি ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা ইউনিয়ন গড়ে তোলার জন্য কাজ করবে। এতে জার্মানি, পোল্যান্ড ও ইতালিকেও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এই পরিষদ সদস্যপদের প্রশ্ন নির্ধারণের পাশাপাশি ইইউ ও ন্যাটোর সঙ্গে জোটের সম্পর্ক কী হবে, তা স্পষ্ট করতে পারবে।
এ ছাড়া ইউরোপকে দক্ষিণের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নত করতে হবে। বিপরীতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা থেকে পিছিয়ে গিয়ে কেবল সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে সম্পদ ব্যয় করা ইউরোপের জন্য বিপজ্জনক হবে। কারণ, এটি সেই প্রতিযোগিতামূলক বৈশ্বিক পরিবেশকে আরও তীব্র করবে, যা ইউরোপ এড়িয়ে যেতে চাইছে।
এই প্রচেষ্টায় জার্মানির ভূমিকা কেন্দ্রীয় হবে। দীর্ঘদিন ধরে দেশটি ইউরোপের ব্যাপারে মনোযোগ হারিয়ে নিজের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোতেই বেশি মনোযোগ দিয়েছে। তবে এখন সেই বিপজ্জনক অবস্থান অতীত হতে চলেছে।
নতুন চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস দায়িত্ব গ্রহণের আগেই বিশ্বকে একটি শক্তিশালী বার্তা দিয়েছেন: জার্মানি আবারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ফিরছে এবং এবার এটি সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ফিরে আসছে। প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও অবকাঠামো শক্তিশালী করতে যে বিশাল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে, তা প্রমাণ করে যে এটি শুধু কথার কথা নয়। মের্ৎস বুঝতে পেরেছেন, ইউরোপমুখী সফল জার্মান নীতির জন্য একটি শক্তিশালী ও গতিশীল অর্থনীতি অপরিহার্য।
মের্ৎস ও তাঁর ভবিষ্যৎ জোটসঙ্গী, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, বুঝতে পেরেছেন যে ইউরোপের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে জার্মানির নেতৃত্বে ইউরোপীয় সংহতি জোরদার করার ওপর। ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁও এটি উপলব্ধি করেছেন এবং তিনি ইতিমধ্যে নতুন জার্মান নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন।
তবে জার্মানি ইউরোপকে আরও সহায়তা করতে পারে কেবল সামরিক শক্তি বাড়িয়েই নয়, কূটনৈতিক সংলাপের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে। সামরিক শক্তি এবং সংলাপের জন্য উন্মুক্ততা—এই দুই দিক একসঙ্গে মিলেই শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করে। ইউরোপের শান্তি ও সমৃদ্ধির ভবিষ্যৎ এখন সম্পূর্ণ ইউরোপীয়দের হাতেই।
● সিগমার গ্যাব্রিয়েল আটলান্টিক-ব্রুকের চেয়ারম্যান ও জার্মানির সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর
● পিটার আইটেল জার্মানির এফটিআই কনসাল্টিংয়ে ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি পরামর্শ বিভাগের সিনিয়র পরিচালক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম র ক র প র জন য ইউর প র অবস থ ন ইউর প য
এছাড়াও পড়ুন:
সরকারি জমিতে সস্তায় সচিবদের ফ্ল্যাট বরাদ্দ তদন্তে কমিটি, কার্যক্রম স্থগিত
সরকারি জমিতে সচিবসহ সরকারি কর্মকর্তাদের ফ্ল্যাট বরাদ্দের বিষয়টি তদন্তে তিন সদস্যের উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব এহসানুল হককে। অন্য দুই সদস্য হচ্ছেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব।
তদন্ত কমিটি গঠনসংক্রান্ত আদেশ আজ রোববার প্রকাশ করা হয়েছে। ১৪ জুন প্রথম আলোয় ‘সরকারি জমিতে সস্তায় ফ্ল্যাট নেন সচিবেরা’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে। আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, তদন্ত কমিটি গঠনের পাশাপাশি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান উল্লিখিত ফ্ল্যাট প্রকল্পের নির্মাণ এবং হস্তান্তর কার্যক্রম স্থগিত রাখার জন্য সেতু বিভাগকে নির্দেশনা দিয়েছেন। সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ ফ্ল্যাট বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিদের জানিয়ে দেওয়ারও নির্দেশ দেন উপদেষ্টা। এ ছাড়া সচিবসহ কর্মকর্তাদের ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়ে তিন কার্যদিবসের মধ্যে একটি প্রতিবেদন জমা দিতে সেতু বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, সেতু বিভাগের অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন ও তদন্ত কমিটির পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তদন্ত কমিটি গঠনের আদেশে কমিটির কার্যপরিধি উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, কী পদ্ধতিতে, কিসের ভিত্তিতে এবং কাদের নামে ফ্ল্যাট বরাদ্দ করা হয়েছে, তা তদন্ত কমিটি নির্ধারণ করবে। এ ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে কি না, তা নির্ধারণ এবং দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করবে। এ ছাড়া যাঁদের নামে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) কিংবা জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ থেকে কোনো জমি বা ফ্ল্যাট পেয়েছেন কি না, তা–ও যাচাই করবে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটিকে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করবে।
সরকারি-বেসরকারি যৌথ অংশীদারত্বে (পিপিপি) ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য আবাসন নির্মাণের জন্য কেনা ৪০ একর জমি থেকে ১ দশমিক ১৫ একর জমি নিয়ে ৪টি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে আমলা ও কর্মচারীদের জন্য। এর মধ্যে তিনটি ভবন সচিব ও বড় আমলাদের জন্য। তাতে ১৬৮টি ফ্ল্যাট রয়েছে। ইতিমধ্যে ১৪০টি ফ্ল্যাট বরাদ্দ হয়ে গেছে। বাকিগুলো ভবিষ্যতে সচিব ও কর্মকর্তাদের মধ্যে বরাদ্দের চিন্তা রয়েছে বলে সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে। চারটির মধ্যে একটি ভবন রাখা হয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মচারীদের জন্য, যেখানে ফ্ল্যাট রয়েছে ১১২টি।
ফ্ল্যাটগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে উত্তরা মডেল টাউনে (তৃতীয় ধাপ), যা দিয়াবাড়ি এলাকা নামে পরিচিত। সেখানে বিভিন্ন সময় সেতু কর্তৃপক্ষের পরিচালনা পর্ষদে থাকা সচিবেরা ফ্ল্যাট নিয়েছেন। ফ্ল্যাট পেয়েছেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের প্রভাবশালী আমলারা। ফ্ল্যাট পাওয়া সচিব ও সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার সংখ্যা ৩২। তাঁদের মধ্যে চারজন চাকরিতে রয়েছেন, দুজন অবসরের পর বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকে (এডিবি) সরকারের পক্ষ থেকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন, বাকিরা অবসরে গেছেন। সচিবদের বাইরে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিবসহ বিভিন্ন পদের কর্মকর্তারা পেয়েছেন ফ্ল্যাট।
সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ব্যক্তিগত কর্মকর্তাসহ ঘনিষ্ঠরাও পেয়েছেন পানির দামের ফ্ল্যাট। যেসব কর্মকর্তা সচিব পদে থেকে এসব ফ্ল্যাট নিয়েছেন, তাঁদের অনেকের আবার রাজউকের প্লট রয়েছে। সরকারি পদে থেকে তাঁরা ঢাকায় জমি ও ফ্ল্যাট—দুটোই নিয়েছেন।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১০ সালে। এর আওতায় বিমানবন্দর থেকে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী পর্যন্ত উড়ালসড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্প এখনো শেষ হয়নি।
আরও পড়ুনসরকারি জমিতে সস্তায় ফ্ল্যাট নিয়েছেন সচিবেরা, তালিকায় কারা রয়েছেন১৪ জুন ২০২৫