টানা ১১তম ঈদ পালন করলাম প্রবাসে। ২০১৫ সাল থেকে কখনো দেশে ঈদ পালন করা হয়নি আমার। তবে এ নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই, নেই কোনো অভিযোগ। আমি বরাবরই অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা হতে পছন্দ করি। 

ঈদ আসলে দেড় কোটি প্রবাসীর আকুতি শুনতে পাই। তবে, আমি কখনো আকুতি জানাইনি। কখনো কাউকে বলা হয়নি, ঈদে আমার খারাপ লাগে, কষ্ট লাগে। ঈদ আসলে অন্যরা কষ্ট পেলেও আমি আনন্দ খোঁজার চেষ্টা করি। অন্যরা কষ্ট পায়, কারণ ঈদটাকে তারা উপলব্ধি করে, যখন তারা তাদের মনের সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে না! যেমন তাদের ইচ্ছে করে, পরিবারের সাথে ঘুরবে, বউ-বাচ্চা, মা-বাবার মুখ দেখবে; যখন সেটি করতে পারে না, তখনই তারা কষ্ট পায়।

আর যার কোনো আকাঙ্ক্ষাই থাকে না, তার তো কষ্ট পাওয়ারও কিছু থাকে না। আমার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। ঈদ এলে আমার আলাদা কোনো অনুভূতি কাজ করে না। ফলে, আমি কষ্ট না পেয়ে আনন্দ খুঁজি।

যে বছর প্রথম প্রবাসে ঈদ পালন করেছি, সে বছর বরাবরের মতোই বাংলাদেশের আমেজ উপলব্ধি করতাম। যখন দেখলাম, ঈদের দিনেও কাজ থেকে ছুটি পাইনি, ঈদের জন্য কোনো নতুন জামা কিনতে পারিনি, সেদিনই প্রবাস জীবন কী, তা আর বুঝতে বাকি রইল না। ঈদের দিন ছুটি না পাওয়ার কারণ হলো—আমার প্রবাস জীবন শুরু হয়েছে ইউরোপের দেশ সাইপ্রাসে। সাইপ্রাস খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের দেশ হওয়ায় সে দেশে মুসলমানদের ধর্মীয় কোনো উৎসবে সরকারিভাবে বন্ধ দেওয়া হয় না। আমি জানতাম না, এ দেশে এরকম সিস্টেম। আমি তখন গাড়ির ওয়ার্কশপে কাজ করতাম সাইপ্রাসের রাজধানী নিকোশিয়ার ফ্যাক্টরি এরিয়াতে। আমার দেশের বাড়ি চট্টগ্রামের চন্দনাইশে।

ভেবেছিলাম, মালিকের কাছ থেকে ঈদের দিন ছুটি চেয়ে নেব। কিন্তু, ঈদের দুই দিন আগ থেকে কাজের এতটাই চাপ ছিল যে, তার কাছে যে ছুটি চাইব, সে পরিস্থিতি ছিল না। রাতে পরিকল্পনা করি, ঈদের নামাজ আর পড়ব না। কারণ, আমি যেখানে কাজ করি, ওখান থেকে মসজিদ প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু, কয়েকজন বন্ধুর অনুরোধে ভোরে উঠে পুরাতন জামা পরে বাসে করে চলে গেলাম রাজধানী নিকোশিয়ায় নামাজ পড়তে। কিন্তু, নামাজ শেষ করে কিছুতেই আর কাজে ফিরতে ইচ্ছে করছে না। বন্ধুরা ডেকে নিয়ে গেল বাসায়। তারা রান্না করছে, আমাকে না খেয়ে আসতে দিচ্ছিল না। কিন্তু, যখন সকাল ৯টা বাজে, মালিকের ফোনের পর ফোনে বিরক্ত হয়ে খাবার না খেয়েই চলে আসতে হয়েছে কাজে। রাগ করে আর বাড়িতেও কাউকে ফোন দিয়ে বলিনি এ কষ্টের কথা। কিন্তু, তারা ধরে নিয়েছিল যে, আমি অনেক আনন্দ করছি বিদেশে।

পরের বছর থেকে আর কখনো এটা নিয়ে আক্ষেপ করিনি। আমার ছয় বছরের সাইপ্রাস প্রবাস জীবনে একবার ছুটি পেয়েছিলাম ঈদের দিন। কারণ, সেদিন ছিল রবিবার। সাইপ্রাসে রবিবারে সরকারি ছুটি। সাইপ্রাসে প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশির একই অবস্থা—কারো মনে ঈদের আনন্দ নেই।

এরপর ২০২০ সালের শেষের দিকে চলে আসলাম সংযুক্ত আরব আমিরাতে। এখানে এসে বড় ভাইয়ের কন্সট্রাকশন ঠিকাদারি কোম্পানিতে জয়েন করলাম। এখানে এসে নতুন করে ঈদের অনুভূতি হতে লাগল। কারণ, এখানে এসেই ঈদের দিন মা, ভাই ও ভাইয়ের পরিবারকে পেয়েছিলাম। আমিরাতে প্রথম ঈদ ছিল অনেক আনন্দের। মনে হয়েছিল, আমি দেশেই ঈদ করছি। ঈদের সময়টা নিজের পরিবারের সাথে কাটাতে পারার মাঝে যে প্রশান্তি, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।

আমার কাছে ইউরোপ আর মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের মাঝে অনেক তফাৎ মনে হয়। ইউরোপ প্রবাসীরা অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হয়। ইউরোপ প্রবাসীরা চাইলেও দেশে যেতে পারে না, যেটা মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীরা পারে।

কত মানুষ দেশে ঈদের আগে স্বজন হারিয়ে ফেলে, কত অসহায় মানুষ দেশে ঈদ করতে পারে না। কত মানুষ পরিবার থেকে দূরে কাজ করার কারণে ঈদে বাড়ি যেতে পারে না। কিন্তু, আমরা কি কখনো তাদের কথা ভেবেছি? তারা হয়ত প্রবাসী নয়, কিন্তু তারাও তো আমাদের মতো কষ্টের ভাগিদার। শুধু প্রবাসীদেরকেই সহানুভূতির চোখে তাকাতে হবে, তা আমি একজন প্রবাসী হয়েও সমর্থন করি না। বরং আমরা সেসব মানুষের চেয়ে ভালো আছি। অন্তত আমাদের আত্মতৃপ্তি পাবার মতো একটা বিষয় আছে। আমরা তাদের চেয়ে বেশি টাকা ইনকাম করি, তাদের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছি। আসলে পৃথিবীটা কারো জন্যই পুষ্পশয্যা নয়। 

ঢাকা/হাসান/রফিক

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর প রব স র ঈদ র দ ন ক জ কর পর ব র ইউর প আনন দ

এছাড়াও পড়ুন:

আজও আছে পরতে পরতে সৌন্দর্য

কারুকার্যখচিত বিশাল ভবন। দেয়ালের পরতে পরতে মনোহর সৌন্দর্য। মনোরম পরিবেশে ভবনের চারপাশে দাঁড়িয়ে সুন্দরী পরীর আবক্ষ মূর্তি। ছবির মতো সাজানো ‘পাকুটিয়া জমিদারবাড়ি’ এখন কালের সাক্ষী।

মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে টাঙ্গাইলের নাগরপুরের কলমাই নদীতীরে ১৫ একর জমিতে জমিদারবাড়িটি। ঢুকতেই চোখে পড়ে পুরোনো মন্দির। লোকমুখে প্রচলিত, শরতের দিনে দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরিতে এখানে ব্যস্ত থাকতেন ভারতবর্ষের নামকরা কারিগররা। কালের বিবর্তনে স্থানটি এখন নির্জন। নেই আগের গৌরব-আভিজাত্যের ছাপ, এমনকি প্রতিমা তৈরির ব্যস্ততাও।

মন্দির ঘুরে দেখা যায়, এর কোথাও কোথাও ইট খসে পড়েছে। পুরোনো দিনের নকশা হারাচ্ছে তার সৌন্দর্য। মন্দিরের পেছনে বিশাল তিনটি মহল, যা সেকালে তিন তরফ নামে পরিচিত ছিল। মহলগুলোর আলাদা কোনো নাম পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে বড় মহলে বর্তমান পাকুটিয়া বিসিআরজি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পরিচালিত হচ্ছে।

দোতলা ভবনের নির্মাণশৈলী মুগ্ধ করবে সবাইকে। যদিও সংস্কারের অভাবে ভবনটিতে ফাটল দেখা দিয়েছে। পাশেই অপূর্ব লতাপাতার কারুকার্যখচিত বিশাল আরেকটি ভবন, যার মাথায় ময়ূরের মূর্তি। এ ছাড়া কিছু নারী মূর্তিরও দেখা মেলে। জমিদার আমলের টিনের চৌচালা ঘরে অস্থায়ীভাবে সরকারি তহশিল অফিস স্থানান্তর হলেও, সেটি এখন স্থায়িত্ব পেয়েছে।

লতাপতায় আচ্ছন্ন ভবনের একাংশ বর্তমানে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং আরেকাংশে একটি বেসরকারি দাতব্য সেবা সংস্থা কার্যক্রম চালাচ্ছে। ভবনটির পিলারের মাথায় এবং দেয়ালেও অসাধারণ নকশা মুগ্ধ করে।

দোতল আরেকটি মহল, যার সামনে বিশাল শান বাঁধানো সিঁড়ি। অন্য সব ভবনের সঙ্গে এটির নকশার যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ভবনটির বারান্দা ও পুরোনো কাঠের দরজা সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে কয়েক গুণ। ভবনটির মাথায় ময়ূরের সঙ্গে দুই পাশে দুই নারী মূর্তির দেখা মেলে। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে গেলে গাছগাছালির সবুজে ঘেরা পুরো জমিদারবাড়ির সৌন্দর্য বিমোহিত করতে বাধ্য। যদিও ভবনের ভিন্ন অংশ খসে পড়ছে, হারাচ্ছে রূপ-লাবণ্য।

জমিদারবাড়ির পেছনে রয়েছে দীঘি ও দুটি পরিত্যক্ত কূপ। এ ছাড়া জমিদারবাড়ির বিশাল মাঠের এক কোণে নাটমন্দির। জানা যায়, নাগরপুরের সঙ্গে কলকাতার একটি বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে আসেন ধনাঢ্য ব্যক্তি রামকৃষ্ণ সাহা মণ্ডল। তিনিই ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটিশদের কাছ থেকে বিপুল অর্থের বিনিময়ে জমি কিনে জমিদারি শুরু করেন।

রামকৃষ্ণ সাহার দুই ছেলে বৃন্দাবন ও রাধাগোবিন্দ। রাধা নিঃসন্তান। তবে বৃন্দাবনের তিন ছেলে– ব্রজেন্দ্র মোহন, উপেন্দ্র মোহন ও যোগেন্দ্র মোহন দীর্ঘকাল রাজত্ব করেন। এভাবে পাকুটিয়া জমিদারবাড়ি তিন ভাইয়ের তরফে বিভক্ত থাকলেও, জমিদাররা সবাই ছিলেন প্রজানন্দিত। বৃন্দাবনের মেজ ছেলে উপেন্দ্রকে কাকা রাধাগোবিন্দ দত্তক নেন। ফলে উপেন্দ্র কাকার জমিদারির পুরো সম্পত্তি লাভ করেন।

দৃষ্টিনন্দন পাকুটিয়া জমিদারবাড়িতে প্রতিনিয়ত পর্যটকের ভিড় বাড়ছে। ইতিহাসের সাক্ষী বাড়িটি সংস্কার না হওয়ায় একদিকে যেমন সৌন্দর্য হারাচ্ছে, অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের কাছে অজানা থেকে যাচ্ছে ইতিহাস। জমিদারবাড়িটি পুরাকীর্তি হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে নিয়ে সংস্কার ও সংরক্ষণের দাবি জোরালো হচ্ছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ