আশাশুনির বিছট এলাকার খোলপেটুয়া নদীর ভেঙে যাওয়া বাঁধে ৪৮ ঘণ্টা পর আজ বুধবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে ভাটার সময় ধীরগতিতে শুরু হয়েছে রিং বাঁধ (বিকল্প বাঁধ) দেওয়ার কাজ। কাজ তদরক করছেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় আনুলিয়া ইউনিয়নের ১০টি গ্রাম নদীর পানিতে তলিয়ে ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পাঁচ শতাধিক পরিবার ঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। কয়েক শ কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে।

আরও পড়ুনহঠাৎ বাঁধ ভেঙে আশাশুনিতে ডুবছে একের পর এক গ্রাম০১ এপ্রিল ২০২৫

সাতক্ষীরা থেকে আশাশুনির দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। সেখান থেকে আরও ২৫ কিলোমিটার গেলে আনুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ। পরিষদের দক্ষিণে আরও তিন কিলোমিটার গেলে বিছট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়–সংলগ্ন খোলপেটুয়া নদীর ভাঙনকবলিত এলাকা। সরেজমিনে দেখা যায়, ভাঙনকবলিত এলাকায় যত দূর চোখ যায়, সব পানিতে টইটম্বুর। ভাটায় গ্রামগুলো থেকে পানি নেমে নদীতে যাচ্ছে। বিছট গ্রামের উত্তর-পশ্চিম পাশ দিয়ে রিং বাঁধ দেওয়ার কাজ শুরু করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ জন রিং বাঁধ দেওয়ার জন্য কাজ করছেন। পাউবোর তত্ত্বাবধানে স্থানীয় ইউপির চেয়ারম্যান ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা কাজের তদারক করছেন।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতকাল মঙ্গলবার রাতে জোয়ারের পানিতে কয়েকটি গ্রামের ঘরবাড়ি তলিয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এলাকায় কোনো আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় কয়েক শ পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। গবাদিপশু নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছে তারা। বিছট গ্রামের আবদুল সবুর গাজী (৭৩) তাঁর বাড়ি দেখিয়ে বলেন, বাড়িঘর ছেড়ে দিয়েছেন। গত রোববার রাতে ভাত খেয়েছিলেন। তারপর শুকনা খাবার খেয়ে কোনোরকমে বেঁচে আছেন। প্রতিবেশী লিয়াকত আলীর গাজীর দোতলা বাড়ি দেখিয়ে বলেন, ওই বাড়িটিও ঝুঁকিতে পড়েছে।

একই গ্রামের শ্রমিক আবদুল করিম জানান, কোথাও শুকনা জায়গা নেই যে চুলা জ্বালিয়ে বাচ্চাকাচ্চাদের খাবার রান্না করে দেবেন। প্রতিবেশীদের একই অবস্থা উল্লেখ করে তিনি বলেন, মুড়ি–চিড়া খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। শিশুদের নিয়ে সবাই সমস্যায় রয়েছেন।

বল্লভপুর গ্রামের বাসুদেব দাস জানান, তাঁদের স্বপ্ন ভেঙে গেছে। শ্রমিকের কাজ করে মাটির গাঁথুনি দিয়ে একটি ঘর করেছিলেন। জোয়ারের পানিতে ঘরটি ভেঙে পড়েছে। বাড়ির জিনিসপত্রও সরানো যায়নি। গরু-ছাগলগুলো কোনোরকমে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এগুলো বেঁচে আছে কি না জানেন না।

আনুলিয়া গ্রামের পুষ্প রানী মণ্ডলকে (৬০) দেখা যায়, পানির মধ্যে দিয়ে দুটি গরু নিয়ে ডাঙায় আসছেন। তিনি বলেন, ‘বাড়িঘর সব পানিতে ডুবে গেছে। জিনিসপত্র ঘর থেকে নিতে পারিনি। গরু দুডোনে কোনোরকমে বার হতে পারেছি।’ পুষ্প রানীর অসুস্থ স্বামী প্রতিবাস মণ্ডল বলেন, ‘সব শেষ। ৬০ বছরের মধ্যে এমন ভাঙন আর জল দেখেনি। বুঝে ওঠার আগেই সব তলিয়ে গেল।’

বাসুদেবপুর গ্রামের রমজান মোড়ল পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কাঁচা ধান কাটচ্ছিলেন। তিনি জানান, তিন বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছিলেন ধান ভালোই হয়েছিল। ৬০ থেকে ৭০ মন ধান হবে বলে আসা করছিলেন। বাধ্য হয়ে কাঁচা ধান কেটে নিচ্ছেন, যদি দু–চার বস্তা ধান পাওয়া যায়, এ আশায়।

পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরে আনুলিয়া ইউপির চেয়ারম্যান মো.

রুহুল কুদ্দুস জানান, গত সোমবার রাত থেকে তাঁর ইউনিয়নের মানুষ নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। ঈদে তাঁর ইউনিয়নের মানুষ আনন্দ করতে পারেনি। ইতিমধ্যে বিছট, নয়াখালী, বাসুদেবপুর, বল্লভপুর, আনুলিয়া, চেঁচুয়া, কাকবাশিয়া, চেওটিয়া, কপসান্ডা ও পারবিছট গ্রাম পানিতে তলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। পাঁচ শতাধিক মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। চার শতাধিক মাছের ঘের ভেসে গেছে। পাঁচ শতাধিক বিঘার বোরো ধানের খেত তলিয়ে গেছে। কয়েক শ কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে গেছে।

আজ সকাল আটটার দিকে রিং বাঁধ দেওয়ার কাজ শুরু করা হয়েছে জানিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, জিওটিউব দিয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে কাজ শুরু করা হয়েছে। তবে ন্যূনতম পাঁচটি বাল্কহেড দরকার, সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ড সরবরাহ করেছে মাত্র দুটি। এ জন্য কাজ চলছে ধীরগতিতে। যত সময়ক্ষেপণ হবে, ততই বাঁধের ভাঙন বাড়বে।

আশাশুনির দায়িত্বরত পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী রাশিদুল ইসলাম বলেন, বাল্কহেড পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া যাচ্ছে না দক্ষ শ্রমিক। তারপরও আজ সকাল সাড়ে সাতটার দিকে রিং বাঁধ দেওয়ার কাজ শুরু করেছেন। আধুনিক পদ্ধতির জিওটিউব দিয়ে বাঁধের কাজ চলছে। এটি সফল হলে তিন থেকে চার দিনের মধ্যে পানি আটকানো সম্ভব হবে

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: চ শত ধ ক ঘরব ড়

এছাড়াও পড়ুন:

চারঘাটে পদ্মার ভাঙন রোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন

রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার পিরোজপুর গ্রামের একজন নারী একটি ফেস্টুন হাতে মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাতে লেখা ছিল ‘নদী আমাদের মা, মায়ের বুক ভাঙা চাই না।’ এ রকম আরও বিভিন্ন স্লোগান লেখা ব্যানার, ফেস্টুন হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষেরা।

জেলার চারঘাট উপজেলা সদরে নদীভাঙন রোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবিতে এই মানববন্ধন হয়। জেলার চারঘাট ও বাঘা উপজেলায় পদ্মার ভাঙনকবলিত পাঁচটি গ্রামের মানুষের উদ্যোগে আজ শনিবার বেলা ১১টা থেকে ১১টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত এই আয়োজন হয়।

গ্রামবাসীর ভাষ্য, চারঘাট উপজেলার গোপালপুর, রাউথা, পিরোজপুর, সাহাপুর এবং বাঘা উপজেলার চক রাজাপুর, আতারপাড়া এলাকায় পদ্মা নদীতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ না করা হলে আগামীতে ভাঙনের ঝুঁকি আছে। এই আশঙ্কায় ভাঙনকবলিত গ্রামবাসী এই মানববন্ধনের আয়োজন করে।

এই কর্মসূচিতে যোগ দিতে এসেছিলেন চারঘাটের পিরোজপুর গ্রামের শাহানাজ বেগম (৪০। তিনি বললেন, ‘আমার বাড়ি নদীর পাড়ের ওপরে ঝুলি আছে। যকুন তকুন ভাইঙ্গি পড়বি।’

একই এলাকা থেকে এসেছেন পারভীনা খাতুন (৩৫)। সঙ্গে তাঁর শিশু ও বৃদ্ধ শাশুড়িকে নিয়ে এসেছেন। তিনি জানান, নদী একেবারে পায়ের তলায় এসে গেছে। তাঁদের আর পেছনে সরার জায়গা নেই।

মানববন্ধনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবু সাইদ। তিনি বলেন, পিরোজপুর, গোপালপুর, সাহাপুর এলাকায় দীর্ঘদিন থেকে নদীভাঙন অব্যাহত আছে। এলাকার অন্তত ৫০০ মানুষের ঘরবাড়ি পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এলাকার বাস্তুহারা মানুষ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছেন। তাঁরা এলাকায় ফিরতে পারছেন না। এই ভাঙনকবলিত এলাকায় এবার যদি বাঁধ নির্মাণের ব্যবস্থা না করা হয়, তাহলে জনগণ আবার রাজপথে নামবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) অচল করে দেওয়া হবে। তাঁদের অফিস করতে দেওয়া হবে না।

মানববন্ধনে বক্তব্য দেন উপজেলা বিএনপির সভাপতি জাকিরুল ইসলাম, উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক শাহীন আলী, জেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাব্বির রহমান, পৌর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক আবদুস সালেক আদিল, সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান, উপজেলা ছাত্রদলের সদস্যসচিব শাহীনুর রহমান, ভাঙনকবলিত এলাকার শিক্ষক মনিরুল ইসলাম প্রমুখ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • চারঘাটে পদ্মার ভাঙন রোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন