দফায় দফায় বেড়েছে মেয়াদ, সঙ্গে লাগামহীন খরচ। দুই যুগেও শেষ হয়নি কাজ। খুলনার উন্নয়নে প্রায় সাড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকার এমন ৩৪ প্রকল্পের ১৭টিতে স্থবিরতা; ঝুলে গেছে ১৫টি। বাতিল হয়েছে ৬৩৬ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প। দীর্ঘদিনের সীমাহীন ভোগান্তিকে মানুষ ‘নিয়তি’ মেনে চলছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঠিকাদারের গাফিলতি, জনপ্রতিনিধি ও সরকারি সংস্থার তদারকির অভাব, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনসহ নানা জটিলতায় মুখ থুবড়ে পড়েছে খুলনার উন্নয়ন।
বন্ধ হয়ে যাওয়া খুলনা টেক্সটাইল মিলের ২৬ একর জমিতে বিটিএমসি ১৯৯৯ সালে শুরু করে টেক্সটাইল পল্লির কাজ। ২০১৮ সালে এসে এটি ভেস্তে যায়। পরে গত বছর জুনে সেখানে থিম পার্ক করার সিদ্ধান্ত হয়। প্রকল্প পরিচালক কাজী ফিরোজ হোসেন জানান, আগ্রহীদের কাছে প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে।
খুলনা শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প ২০১৩ সালে একনেকে অনুমোদন পায়। প্রায় ৯ বছর পর ২০২২ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয় চার কিলোমিটার সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ। ৯৯ কোটি থেকে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৫৪ কোটি টাকায়। কয়েক দফা মেয়াদ বাড়িয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বর করা হলেও ৩০ শতাংশ কাজ বাকি রয়েছে। জমি অধিগ্রহণে দেরি ও ঠিকাদারের গাফিলতিতে এক যুগ ধরে সড়কটিতে মানুষ ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। কেডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী আরমান হোসেন জানান, কাজ দ্রুত শেষ করতে ঠিকাদারকে বলা হয়েছে।
খুলনার জয় বাংলা মোড়ের কাছে ৩০ একর জমিতে ২০১১ সালে ২ হাজার বন্দি ধারণক্ষমতার জেলা কারাগার নির্মাণ প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হয়। জমি অধিগ্রহণে জটিলতা ও ঠিকাদারের কারণে ১৪৪ কোটি টাকার প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে সাতবার; ব্যয় ঠেকেছে ২৮৮ কোটি টাকায়। গণপূর্ত-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো.
২০১৭ সালে ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনা জেনারেল হাসপাতালের আটতলা ভবন নির্মাণ শুরু হয়। কয়েক দফা মেয়াদ বাড়িয়ে হয়েছে ছয়তলা পর্যন্ত। প্রায় ২৭ কোটি টাকা ব্যয় বাড়লেও দ্বিতীয় ধাপের দরপত্র না হওয়ায় সাত ও আটতলার কাজ আটকে গেছে। গণপূর্ত বিভাগ-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী কামরুল হাসান জানান, পুনঃদরপত্র আহ্বানের কাজ চলছে।
জয় বাংলা মোড়ে ৪ দশমিক ৮০ একর জমিতে খুলনা বিভাগীয় শিশু হাসপাতালের পাঁচতলা ভবন নির্মাণ শুরু হয় ২০১৭ সালে। দু’দফা মেয়াদ বাড়িয়ে সম্প্রতি কাজ শেষ হয়েছে। ৩৭ কোটি টাকার প্রকল্প ঠেকেছে ৬৩ কোটিতে। ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. শেখ মো. কামাল হোসেন বলেন, হাসপাতালের প্রবেশ সড়ক হয়নি। জনবলও নেই। এ জন্য বুঝে নিতে দেরি হচ্ছে।
২০১১ সালে নগরীর ফুলবাড়ি গেট রেলক্রসিংয়ে ওভারপাস নির্মাণে ৯৮ কোটি টাকার প্রকল্প নেয় কেডিএ। ১৪ বছরে একাধিকবার প্রকল্প সংশোধনে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৪৫০ কোটি টাকায়। এর পরও প্রকল্পের তেমন অগ্রগতি নেই বলে জানান কেডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী (পূর্ত) আরমান হোসেন।
কেসিসি এলাকা সম্প্রসারণে ২০০৭ সাল থেকে ছয় দফায় প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু ১৮ বছরেও তা আলোর মুখ দেখেনি। প্রস্তাবটি সচিব কমিটির সভায় উত্থাপনের অপেক্ষায় বলে জানান কেসিসির এস্টেট অফিসার গাজী সালাউদ্দিন।
দুই প্রকল্প বাতিল
২০২২ সালে জোড়াগেট সিঅ্যান্ডবি কলোনি এলাকায় ১০ একর জমিতে ৫৫৩ কোটি টাকায় নভোথিয়েটার স্থাপনে প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। ভিন্ন জমিতে করার দাবিতে স্থানীয়দের আন্দোলনে এটি ভেস্তে যায়। গণপূর্ত বিভাগ-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী কামরুল হাসান জানান, জানুয়ারিতে প্রকল্পটি বাতিল করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে, রাজবাঁধ এলাকায় ২০১৮ সালে ৮৩ কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক কসাইখানা নির্মাণে উদ্যোগ নেয় কেসিসি ও প্রাণিসম্পদ বিভাগ। ১০০ শতক জমিও হস্তান্তর করে কেসিসি। গত বছর জানুয়ারিতে দরপত্র হলেও অর্থ সংকটে বাতিল করা হয় ডিসেম্বরে।
শেষ হয় না কাজ, বাড়ে ভোগান্তি
‘খুলনা পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় ২৭০ কিলোমিটার সড়ক খুঁড়ে পাইপলাইন বসানো শুরু হয় ২০২২ সালের অক্টোবরে। খুলনা ওয়াসার ২ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকার এ প্রকল্পের কারণে আড়াই বছর চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে নগরবাসী। ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ থাকলেও কাজ বাকি ৪০ শতাংশের বেশি। প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী খান সেলিম আহম্মদ জানান, দেরিতে অনুমোদনের কারণে ঝুলে গেছে।
কয়রার ১৪/১ নম্বর পোল্ডারে ১২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সংস্কার ও টেকসই কাজ শুরু হয় ২০২২ সালের জানুয়ারিতে। গত ডিসেম্বরে মেয়াদ শেষ হলেও ১ হাজার ১৭২ কোটি টাকার প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ২১ শতাংশ। প্রকল্প পরিচালক পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সৈয়দ সহিদুল আলম বলেন, অর্থছাড় ও জমি অধিগ্রহণে সময় লেগেছে। কার্যাদেশেও দেরি হয়। ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বেড়েছে। কাজ শেষ করতে আরও এক বছর লাগবে।
৬৫ কিলোমিটার কয়রা-বেতগ্রাম আঞ্চলিক মহাসড়কের উন্নয়ন কাজ শুরু হয় ২০২০ সালের জানুয়ারিতে। দু’দফায় সময় বেড়ে শেষ হবে জুনে। তবে ৩৭৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকার প্রকল্পে পাঁচ বছরে অগ্রগতি ৬৪ শতাংশ। জরাজীর্ণ সড়কে চলাচলে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে মানুষ। ঠিকাদারের গাফিলতির কারণে কাজ শেষ করতে দেরি হচ্ছে বলে জানান সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী তানিমুল হক।
নগরীর পশ্চিম রূপসা এলাকায় ১৭০ কোটি টাকায় ৩ দশমিক ৫৯ একর জমিতে হাই-টেক পার্ক নির্মাণ শুরু হয় ২০২২ সালের নভেম্বরে। এখন পর্যন্ত কাজ হয়েছে মাত্র ৩৬ ভাগ। গত বছর ৫ আগস্ট ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লার্সেন অ্যান্ড টুবরোর লোকজন চলে গেলে বন্ধ হয় কাজ। প্রকল্প পরিচালক এ কে এ এম ফজলুল হক জানান, প্রকল্পের মেয়াদ আগামী জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
প্রকল্প হয়, মেলে না সহায়তা
দাকোপ উপজেলার পানখালীতে ঝপঝপিয়া নদীর ওপর ১ হাজার ২৩২ মিটার দৈর্ঘ্য সেতু নির্মাণে ২০১৬ সালে ৭৮২ কোটি টাকার প্রকল্প হয়। চীন সরকারের অনুদান দেওয়ার কথা থাকলেও তা মেলেনি। ২০২২ সালের আগস্টে দাকোপে চুনকুড়ি নদীর পোদ্দারগঞ্জ ফেরিঘাটে ১ হাজার ২৩৪ মিটার দৈর্ঘ্য সেতু নির্মাণ প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। ৭৪৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকার প্রকল্পে ৫৭৪ কোটি ঋণ সহায়তা দিতে চেয়েছিল আবুধাবি ও কুয়েত। প্রকল্প পরিচালক সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কুয়েতের সঙ্গে ঋণ সহায়তা চুক্তি হয়েছে। আবুধাবির সঙ্গে না হওয়ায় ঝুলে আছে।’
প্রকল্প পরিচালক মনিরুল ইসলাম ফিরোজী জানান, ৬ মার্চ বাংলাদেশ ও ভারতের কর্মকর্তারা ঢাকায় ভারতের এলওসি নিয়ে পর্যালোচনা সভা করেন। সভায় প্রকল্পটি এলওসি থেকে বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, ঠিক সময়ে সড়ক, সেতুসহ অবকাঠামো নির্মাণ না করা নিয়ম হয়ে গেছে। ঠিকাদারের গাফিলতির পাশাপাশি সংস্থাগুলোর তদারকির অভাবও দায়ী। তাদের কারণে প্রকল্পের বাড়তি ব্যয় জনগণকে দিতে হচ্ছে; আবার ভোগান্তিও পোহাচ্ছেন তারা।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) খুলনার সাবেক সভাপতি কুদরত-ই খুদা বলেন, চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ চলছে ধীরে। জনপ্রতিনিধিদের কার্যকর ভূমিকার অভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প অনুমোদন পায়নি। ফলে খুলনার উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়েছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ট ক র প রকল প ২০২২ স ল র এর ন র ব হ প রকল প র ণ প রকল প প রকল প প ড স ম বর একন ক
এছাড়াও পড়ুন:
চুইঝাল চাষে সাফল্য পেয়ে প্রবাসফেরত শাহ আলম বললেন, ‘আর বিদেশে যাব না’
সিরাজগঞ্জে বাণিজ্যিকভাবে চুইঝাল চাষ করে সাফল্যের দেখা পেয়েছেন বিদেশফেরত এক ব্যক্তি। জেলায় মসলাজাতীয় ফসল চুইঝালের সফল বাণিজ্যিক চাষ এটিই প্রথম। এই সফলতায় বর্তমানে এলাকার কৃষক, তরুণ ও যুবকেরা চুইঝাল চাষ করতে আগ্রহী হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
ওই ব্যক্তির নাম শাহ আলম (৪৫)। তিনি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার শিয়ালকোল ইউনিয়নের নিয়ামতপুর গ্রামের শুকুর আলীর বড় ছেলে। প্রায় এক যুগ সৌদি আরবে প্রবাসজীবন কাটিয়ে গ্রামে ফিরে ২০২২ সালে সিরাজগঞ্জে চুইঝাল চাষের উদ্যোগ নেন তিনি।
সম্প্রতি এক দুপুরে শাহ আলমের চুইঝালের খেতে গিয়ে দেখা যায়, জমি থেকে ফসল উত্তোলন করা হচ্ছে। বেশ কিছু স্থানে সমূলে চুইঝাল গাছগুলো তুলে বিভিন্ন স্থানে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। খুলনাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকারেরা গিয়ে এসব চুইঝাল কিনে নিচ্ছেন।
জানতে চাইলে শাহ আলম বলেন, ‘বিদেশে থাকা অবস্থাতেই ইউটিউবে খুলনা এলাকায় চুইঝাল চাষে কৃষকদের সফলতা দেখে আমার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে খুলনা এলাকায় চুইঝালের চারা উৎপাদকারী একটি নার্সারির মালিকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি আমাকে বেশ উদ্বুদ্ধ করেছেন। এরপর দেশে ফিরে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সমন্বিত কৃষি ইউনিটের (কৃষি খাত) আওতায় উচ্চমূল্যের মসলাজাতীয় ফসল উৎপাদন প্রদর্শনী বাস্তবায়নকারী স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (এনডিপি) সহায়তায় চুইঝালের চাষ শুরু করি। ২০২২ সালের ৩০ আগস্ট বাড়ির পাশে ৩৩ শতক জমি ৩ বছরের জন্য ৬০ হাজার টাকায় ইজারা নিয়ে এগুলোর চাষ শুরু করা হয়।’
শাহ আলমের দাবি, চুইঝাল চাষ শুরু থেকে এ পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার টাকা। অন্যদিকে চলতি বছর দুই ধাপে ৭ লাখ ৩৭ হাজার টাকার চুইঝাল বিক্রি করেছেন।
সিরাজগঞ্জে বাণিজ্যিকভাবে চুইঝাল চাষ করে সফল হওয়ার দাবি করেছেন প্রবাসফেরত শাহ আলম