যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্য আমদানির ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। এত দিন এই শুল্কের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ। ‘আমেরিকার স্বর্ণযুগ’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ট্রাম্পের সর্বশেষ উদ্যোগ হলো বিশ্বের ৬০টি দেশের ওপর ১০ থেকে ৫০ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ। এর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় ব্যবসায়িক অংশীদার রাষ্ট্রও; ছোটখাটো দেশও রয়েছে অনেক।

অন্তত ১২টি দেশের ওপর শুল্ক ধার্য করা হয়েছে ‘রেসিপ্রোকাল অ্যাকশন’ বা যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো যে শুল্ক নেয় তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে। এই ‘প্রতিক্রিয়া শুল্কের’ বাইরে যেসব দেশ রয়েছে, ধারণা করা হচ্ছে, তাদের সঙ্গে যে বাণিজ্যঘাটতি প্রতিবছর বাড়ছে, তার জন্যই বিভিন্ন হারে শুল্ক প্রয়োগ করা হয়েছে। বাণিজ্যঘাটতি হলো দুটি দেশের মধ্যে আমদানি–রপ্তানির বৈষম্য।

চীন যুক্তরাষ্ট্রের বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ আসে সেখান থেকে। তাদের ওপর নতুন শুল্ক ৩৪ শতাংশ; যদিও চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি বিরাট, প্রায় ২৯২ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে আরেক বড় অংশীদার ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তাদের ঘাটতি ২৪১ বিলিয়ন ডলার। তাদের ওপর নতুন শুল্ক মাত্র ২০ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের মোট আমদানির ৩২ শতাংশ চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আসে। ট্রাম্প এই দুই দেশের শুল্ক তুলনামূলক কম রেখে সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ ভোক্তাদের জন্য ভোগ্যপণ্যের দাম কিছুটা সহনীয় রাখতে চাইছেন।

কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অবাধ বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে। তাই বলে তারা রেহাই পেয়ে যাবে না। তাদের ওপর এরই মধ্যেই ট্রাম্প ৩০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছেন, তা নিয়ে সরকারগুলোর সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। বন্ধু-অবন্ধু সব দেশের ওপরই ট্রাম্প শুল্ক বসিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, রাজনৈতিক বিবেচনার চেয়েও অর্থনৈতিক বিবেচনা ও হিসাব-নিকাশকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এই শুল্ক নির্ধারণে। নতুন তালিকা অনুযায়ী ভারত থেকে আমদানির ক্ষেত্রে ২৬ শতাংশ এবং ইসরায়েলের ক্ষেত্রে ১৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির এক বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হলো ভিয়েতনাম। ভিয়েতনাম থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির পরিমাণ ১২ বিলিয়ন ডলার। দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি প্রায় ১২৩ বিলিয়ন ডলার। ভিয়েতনামের ওপর নতুন শুল্ক আরোপ করা হয়েছে ৪৬ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশের বাণিজ্যঘাটতি হলো ৬ বিলিয়ন ডলার এবং বাংলাদেশে ওপর দেশের শুল্ক বসানো হয়েছে ৩৭ শতাংশ।

ভারতের পণ্যে আরোপ করা শুল্কের পরিমাণ যেহেতু ২৬ শতাংশ এবং বাংলাদেশের চেয়ে বেশ কম, তাই ভারত সুবিধা পেতে পারে। তবে এর মধ্যে আবার কোটা ও প্রাধান্য—এসব সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ভারতের তৈরি পোশাক আবার যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের কাছে খুব জনপ্রিয় নয়। অন্য যেসব দেশ পোশাক রপ্তানি করে থাকে—কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান—তাদের ওপর শুল্কও কম নয়, তাই তারাও খুব সুবিধা পাবে না।

আরও একটা তথ্য দেখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাক আমদানির প্রায় ৪ দশমিক ২ শতাংশ আসে ভিয়েতনাম থেকে। সেই তুলনায় বাংলাদেশ অনেক ছোট অংশীদার, মাত্র দশমিক ৩ শতাংশ আসে বাংলাদেশ থেকে। ভিয়েতনামের ওপর বড় শুল্ক বসানোর ফলে সেখান থেকে আমদানি করা কাপড়চোপড়ের দাম যুক্তরাষ্ট্রে বেশ বেড়ে যাবে। তাই তাদের কাপড়ের আমদানি কমে যাবে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতিও কমবে।

বাংলাদেশ মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানি করে থাকে যুক্তরাষ্ট্রে। বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী হলো চীন, ভিয়েতনাম, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩৩ বিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশের ৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, ভিয়েতনামের ১২ বিলিয়ন ডলার, ভারতের ৮ বিলিয়ন ডলার ও ইন্দোনেশিয়ার ৭ বিলিয়ন ডলার। ভিয়েতনামের ওপর বড় শুল্ক বসানো হয়েছে। চীন ও ইন্দোনেশিয়ার ওপর আরোপর করা রপ্তানি শুল্কও প্রায় বাংলাদেশের সমান। তাই বাংলাদেশের ওপর শুল্ক বৃদ্ধিতে এই তিন দেশ কোনো সুবিধা পাবে না।

ভারতের পণ্যে আরোপ করা শুল্কের পরিমাণ যেহেতু ২৬ শতাংশ এবং বাংলাদেশের চেয়ে বেশ কম, তাই ভারত সুবিধা পেতে পারে। তবে এর মধ্যে আবার কোটা ও প্রাধান্য—এসব সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ভারতের তৈরি পোশাক আবার যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের কাছে খুব জনপ্রিয় নয়। অন্য যেসব দেশ পোশাক রপ্তানি করে থাকে—কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান—তাদের ওপর শুল্কও কম নয়, তাই তারাও খুব সুবিধা পাবে না।

অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ অবশ্যই বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য খুব খারাপ খবর। তবে অন্য দেশগুলোও যেহেতু খুব সুবিধা পাচ্ছে না, তাই এই বাড়তি শুল্ক বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য ধ্বংসাত্মক বা বিপর্যয় ডেকে আনবে—এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। প্রথম দিকের ধাক্কা সামলে নিতে পারলে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের পোশাকবাজারে স্থিতিশীল উপস্থিতি ধরে রাখতে পারবে।

যাঁরা ট্রাম্পকে জানেন, তাঁরা বলবেন, ট্রাম্পের এই লিস্ট চূড়ান্ত নয়। ট্রাম্প ঝানু ব্যবসায়ী, দর-কষাকষিই তাঁর কর্মপদ্ধতির মূলমন্ত্র। এই বিশ্ববাণিজ্যের যুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় দর–কষাকষি করে এর পরিবর্তন আনবে। অনেক ক্ষেত্রে ট্রাম্প শুল্ক কমাতে রাজনৈতিক সুবিধা চাইবেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি বাড়াতেও চেষ্টা করবেন।

গত ২৮ মার্চের খবর; যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অস্ত্র বিক্রি করতে চায়। বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই দর-কষাকষিতে অংশ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। হয়তো এই খারাপ খবরের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনাও থাকতে পারে। আবার হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কাও একদম উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

সালেহ উদ্দিন আহমদ শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ওপর শ ল ক শ ল ক আর প ত দ র ওপর দ শ র ওপর র পর ম ণ আমদ ন র সব দ শ র জন য দশম ক

এছাড়াও পড়ুন:

সাকিবের পথে হাঁটছেন মিরাজ

সাকিব আল হাসানের সঙ্গে নিজের তুলনাকে মেহেদী হাসান মিরাজ হয়তো উপভোগই করেন। কারণ, তাঁর স্বপ্ন সাকিবের মতো বিশ্বনন্দিত অলরাউন্ডার হয়ে ওঠা। সেই পথে বোধ হয় গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে টেস্টে দেশে-বিদেশে সম্প্রতি ভালো করছেন। পাকিস্তানে দারুণ প্রশংসিত ছিলেন অলরাউন্ড পারফরম্যান্স করে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দুই টেস্টের হোম সিরিজে উভয় টেস্টে নিজেকে ছাপিয়ে গেলেন। সিলেটের হারের ম্যাচেও ১০ উইকেট ছিল তাঁর। চট্টগ্রামে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট নিয়ে সাকিব ও সোহাগ গাজীর কাতারে নাম লেখালেন। মূলত মিরাজের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে ইনিংস ব্যবধানে টেস্ট জেতা সম্ভব হয়। 

গতকাল শতকের ঘরে যেতে কম কসরত করতে হয়নি তাঁর। নব্বইয়ের ঘরে গিয়ে তো অনিশ্চয়তায় পড়ে গিয়েছিলেন হাসানের আউটের শঙ্কায়। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় দ্বিতীয় শতকের দেখা পান তিনি। ২০২১ সালে এই চট্টগ্রামেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি ছিল মিরাজের। গতকালের পারফরম্যান্স নিয়ে টাইগার এ অলরাউন্ডার বলেন, ‘ব্যাটিংয়ের সময় চেষ্টা করেছিলাম ২ রান নিয়ে ১০০ রানে যেতে। সেভাবে দৌড় দিয়েছিলাম। কিন্তু ফিল্ডারের হাতে বল চলে গিয়েছিল (হাসি)। তার পর তো আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। হাসান অনেক ভালো সাপোর্ট দিয়েছে। তানজিমও ভালো সাপোর্ট দিয়েছে। তাইজুল ভাইও। এই তিনজনকেই অনেক অনেক ধন্যবাদ। কারণ, ওদের জন্যই আমি ১০০ রান করতে পেরেছি।’ 

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে করা সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট প্রাপ্তিকে নিজের সেরা পারফরম্যান্স দাবি মিরাজের, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ১০০ করেছিলাম, ৩ উইকেট নিয়েছিলাম। অল্পের জন্য ৫ উইকেট হয়নি। হলে ভালো লাগত। ওই ম্যাচ হেরেছিলাম এই মাঠে। সে জিনিসটা মাথায় ছিল। ভালো লাগছে ম্যাচটি জিতেছি।’ মিরাজ ১৬২ বলে ১১টি চার ও একটি ছয় মেরে ১০৪ রান করেন। ২১ ওভারে ৩২ রান দিয়ে নেন পাঁচ উইকেট।

টেস্টে এ রকম অলরাউন্ড পারফরম্যান্স বাংলাদেশে আর দু’জনের আছে। সাকিব আল হাসান দু’বার ম্যাচে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট পেয়েছেন ২০১১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে মিরপুরে আর ২০১৪ সালে খুলনায়। সোহাগ গাজী নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট শিকার করেন চট্টগ্রামে। সেই মাইলফলক ছোঁয়া মিরাজকে সম্প্রতি অলরাউন্ডার ক্যাটেগরিতে ফেলা হয়। সাকিবের বিকল্প ভাবা হয় তাঁকে এখন। 

এ ব্যাপারে মিরাজের অভিমত, ‘দেখেন একটা জিনিস, যখন সাকিব ভাই ছিলেন, ভিন্ন রোল ছিল। এখন ভিন্ন রোল। যেহেতু টিম ম্যানেজমেন্ট, সবাই ব্যাটিংয়ে আস্থা রাখে। আমিও ভেবেছি আমার ব্যাটিংটা গুরুত্বপূর্ণ। এখন হয়তো আমি লিডিং রোল প্লে করছি, আগে সাকিব ভাই করত। এখন আমাদের দায়িত্ব আরও বেশি।’ 

সিলেটে দুই ইনিংসে পাঁচ উইকেট করে নিয়েও দলকে জেতাতে পারেননি মিরাজ। চট্টগ্রামে সাদমান, তাইজুলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ম্যাচ জয়ের নায়ক হন। এই সাফল্য নিয়ে বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, প্রথম ম্যাচ হারার পর যেভাবে কামব্যাক করেছি, এটা খুবই দরকার ছিল। আমাদের সবাই ভেবেছিল, আমরা ভালো করব।’ মিরাজ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন কোচিং স্টাফ ও সতীর্থের কাছে। আর তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা পুরো দলের।

সম্পর্কিত নিবন্ধ