বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনই সিদ্ধান্তে আসা না গেলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যবাসায়ীরা; আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে জট জলদি মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে বোঝাপড়া তৈরি করতে হবে; একই সঙ্গে তৈরি পোশাক ও অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের বিকল্প বাজার খুঁজে বের করতে হবে।

বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছন, ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, তাতে দেশটির নাগরিকদের ক্রয় ক্ষমতা কমে আসবে। এর প্রভাবে পোশাক রপ্তানি কমে আসবে।

তারা বলছেন, নতুন নতুন বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানির মাধ্যমে এই সংকট কাটিয়ে উঠতেও সময় লেগে যাবে।

আরো পড়ুন:

৯ দিনের ছুটি
ভোমরা স্থলবন্দরে ১৪ কোটি টাকার রাজস্ব হারাবে সরকার

বাংলাবান্ধায় আমদানি-রপ্তানি ৯ দিন বন্ধ

দেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুধু বাংলাদেশি পণ্যই নয় সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক হার বাড়িয়েছে। উচ্চহারে শুল্ক আরোপ দেশটিতে মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতা কমার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি কিছুটা মন্দার কবলে পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে। যেহেতু তৈরি পোশাক রপ্তানির শীর্ষ গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র, ফলে রপ্তানি কমে আসবে। যা পুরো রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। 

তবে সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে শুল্ক কমাতে পারলে রপ্তানি আয় কমার শঙ্কা কিছুটা কাটবে বলেও মনে করেন তারা।  

তারা বলছেন, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে একক দেশের প্রতি নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করে রপ্তানি বাড়াতে হবে। পণ্যের বৈচিত্র্য আনতে হবে। এফটিএ-এর মতো বাণিজ্য চুক্তির তাগিদ দিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মো.

মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৬০টি দেশের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ বা বৃদ্ধি করেছে। প্রত্যেক দেশের ওপরই তার প্রভাব পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ক্রয় ক্ষমতা কমবে, মূল্যস্ফীতি বাড়বে, যা দেশটির জন্য ভালো কিছু হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ-বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে সারা বিশ্ব ধুম্রজালের মধ্যে পড়েছে। এটা নিয়ে ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন।”

“বাংলাদেশ সরকার এটা নিয়ে কাজ করলে শুল্ক কমতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে আলোচনা করে ন্যূনতম পর্যায়ে আনতে হবে; যাতে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে যেন শুল্ক না বাড়ে। তাহলে আমরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারব। তাছাড়া আমরা অনেকটা পিছিয়ে পড়ব,” বলেন মহিউদ্দিন রুবেল। 

মুক্তবাজার অর্থনীতির এই সময়ে এসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কযুদ্ধ কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে তা নিয়ে রাইজিংবিডি ডটকম কথা বলে বিকেএমইএ-এর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসানের সঙ্গে।  

শামীম এহসান বলেন, “শুল্কযুদ্ধ কোনোভাবে আধুনিক বিশ্বে কাম্য নয়। এই শুল্ক আমেরিকার অর্থনীতিতে খুব বেশি সাফল্য বয়ে আনবে না। আমাদের রপ্তানি করা পণ্যে প্রফিট মার্জিন অনেক কম। যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, এই পণ্যগুলো মেইড ইন ইউএসএ (যুক্তরাষ্ট্র) হবে। তা সম্ভব নয়। কারণ এই শিল্পগুলো শ্রমঘন ইন্ডাস্ট্রি। আমি মনে করি, শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে কতটুকু স্থির থাকবে ইউএসএ প্রশাসন, সেটিই এখন দেখার বিষয়।”

ট্রাম্পের চাপানো শুল্কের কারণে শুরুর ধাক্কা কাটিয়ে উঠার ওপর জোর দিয়ে বিকেএমইএ-এর নির্বাহী সভাপতি বলছেন, “শুরুতে আমাদের উপর একটা ঝড় আসবে। কারণ বায়াররা সব সময় সুযোগ-সন্ধানী। বায়ররা আমাদের পণ্যের দাম কমানোর চেষ্টা করবে। এটা যদি আমরা কাটিয়ে উঠতে পারি; সরকারের নীতিগত সাপোর্ট নিয়ে যদি টিকে থাকতে পারি, তাহলে দীর্ঘমেয়াদি সুফল আমরা পাব।”

“এই শুল্কারোপ শুধু আমাদের ক্ষতি করবে না, আমেরিকান নাগরিকদের ওপরও এর প্রভাব পড়বে। তাই আমাদের শঙ্কিত হওয়ার কারণ থাকলেও ভীত হওয়ার কারণ নেই,” বলেন শামীম এহসান।

বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি বাংলাদেশের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই প্রভাব পড়বে আমেরিকার অর্থনীতিতে চাহিদা কমার কারণে।

বাংলাদেশের ওপর প্রভাবের পাশাপাশি ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করে জাহিদ হোসেন বলছেন, ধারণা করা হচ্ছে এই ট্যারিফ (শুল্ক) আরোপ করায় আমেরিকার অর্থনীতিতে মন্দা আসবে। সবকিছুর দাম বাড়বে। এতে ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতা কমতে পারে। ফলে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি কমার আশঙ্কা রয়েছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশকে মার্কিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসে আলোচনা করতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে শুল্ক কমানোর যুক্তি তুলে ধরতে হবে। সরকার এরই মধ্যে যে সংস্কারগুলো করেছে, সেগুলো আলোচনায় তুলে ধরা জরুরি। 

বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি রকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, সাধারণত শুল্কের বাড়তি ব্যয় ক্রেতার ওপরেই যায়। নতুন শুল্ক আরোপের কারণে পণ্যের দাম বাড়বে, তখন ক্রেতারা ব্যয় কমানোর জন্য বিকল্প উৎস খুঁজবে। 

“আমাদের চেয়ে যাদের শুল্ক কম তারা তখন সুফল পাবে। তাই যুক্তরাষ্ট্রে নতুন আরোপিত শুল্ক প্রত্যাহারে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে শুল্কনীতি পুনর্বিবেচনা এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তাছাড়া দেশের পোশাক খাত সংকটে পড়বে,” মনে করেন রকিবুর আলম চৌধুরী।

যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারত, চীন থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশে শুল্কারোপের হার ঘোষণা করেন। এতে নড়ে যায় বিশ্ব অর্থনীতির ভিত। ট্রাম্পের এই পদক্ষেপকে ‘শতবর্ষে বিশ্ব বাণিজ্যে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন’ বলে মনে করছেন বিবিসির অর্থনীতি সম্পাদক ফয়সাল ইসলাম।

তিনি বলছেন, “আমদানি পণ্যে ট্রাম্পের চাপানো শুল্কের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক রাজস্ব লাফিয়ে এমন জায়গায় পৌঁছাতে পারে, যা গত এক শতকে দেখা যায়নি; ছাড়িয়ে যেতে পারে ১৯৩০-এর দশকের কঠোর সুরক্ষামূলক বাণিজ্যনীতি যুগেকেও। কিংবা রাতারাতি শেয়ার বাজারের পতন দেখা যেতে পারে, বিশেষ করে এশিয়া।”

বিবিসির অর্থনীতি সম্পাদক মনে করেন, এসব কারণে যা যা ঘটবে, তা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বৈশ্বিক বাণিজ্যের অলিগলিতে বড় রদবদল নিয়ে আসবে।

ফয়সাল ইসলামের সাদামাটা চোখে ধরা পড়ছে, ট্রাম্প আদতে যুক্তরাষ্ট্রের সব আমদানি পণ্যে সার্বজনীন ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, যা এই শুক্রবার (৪ এপ্রিল) রাত থেকে কার্যকর হচ্ছে। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যে উদ্ধৃত রয়েছে এমন কয়েক ডজন ‘বাজে অপরাধী’ দেশের ওপর পাল্টা আরও কিছু শুল্ক যুক্ত হয়েছে।

“বিশেষ করে এশীয় দেশগুলোর ওপর যে শুল্ক দেওয়া হয়েছে, তা চোখ ধাঁধা দেখার মতো বিষয়। ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ হাজার হাজার কোম্পানি, কারখানা এবং হয়তো অনেক দেশেরই ব্যবসায়িক মডেল পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দিতে পারে,” বলেন ফয়াসাল ইসলাম।

তিনি বলেছেন, “ট্রাম্পের এই পদক্ষেপে মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে পড়বে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অনেক কোম্পানির সাপ্লাইন চেইন। এর অনিবার্য প্রভাব কোম্পানিগুলোকে চীনের দিকে ঠেলে দেবে।”

ট্রাম্পের এই শুল্কের পাল্টায় বাকি বিশ্ব কী ধরেনের প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেটিই এখন ট্রিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।

ঢাকা/এনএফ/রাসেল

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ট র ম প র এই শ ল ক আর প শ ল ক কম ব যবস য় আম র ক এই শ ল আম দ র র ওপর বলছ ন ক ষমত সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

বিদ্যুৎ খাতে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি হয়েছে: পর্যালোচনা কমিটি

বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির নামে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো সরকারের কাছ থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া বাবদ অর্থ নিয়েছে, যেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহের চেয়ে দুর্নীতিই মুখ্য ছিল বলে অভিমত দিয়েছে সরকার গঠিত চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। তারা বলেছে, চুক্তিতে ব‍্যবসায়ীদের কোনো ঝুঁকি নেই, সব ঝুঁকি সরকারের। এটি সরকারের অদক্ষতাজনিত ব‍্যর্থতা নয়, দুর্নীতি জড়িত। তাই চুক্তি বাতিল করা সম্ভব।

বিদ্যুৎ খাতের চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির তিন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তাঁরা বলেছেন, গত সরকারের দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ, খরচ বেড়েছে ১১ গুণ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনটি করাই হয়েছে দুর্নীতির জন্য। এখানে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি হয়েছে। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিগুলো ভাড়া আদায়ের নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে কাজ করেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো জ্বালানি আমদানি করেছে নিজেরা। এতেও দুর্নীতি হয়েছে।

তবে এখন এসব চুক্তি বাতিল করতে হলে অনুসন্ধান করে দুর্নীতির প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন পর্যালোচনা কমিটির সদস্যরা। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের প্রতিবেদন নিয়ে সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করতে পারে। গত সরকারের সময় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একের পর এক একতরফা চুক্তি করা হয়েছে। চুক্তিতে সব সুবিধা দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে, রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করা হয়নি। একটি চুক্তি যেন আরেকটির প্রতিলিপি। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ সংস্থাগুলো এতে জড়িত ছিল। গ্যাস পাওয়া যাবে না, চুক্তি করা হোক—এমন সুপারিশও দেখা গেছে মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে।

পর্যালোচনা কমিটির তিনজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, শুধু চুক্তি নয়, চুক্তির আগের পুরো প্রক্রিয়া যাচাই করে দেখা হয়েছে। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপের নমুনা পাওয়া গেছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। সাবেক দুই বিদ্যুৎসচিব, যাঁরা পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব হয়েছিলেন; তাঁদের সংশ্লিষ্টতা আছে সংঘবদ্ধ দুর্নীতিতে। এই দুজন হলেন আবুল কালাম আজাদ ও আহমদ কায়কাউস।

# চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন
# দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ, খরচ বেড়েছে ১১ গুণ
# ব্যবসায়ী, আমলা, সরকারের শীর্ষ পর্যায় মিলে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি
# চুক্তি বাতিল সম্ভব, দুদকের তদন্ত করতে হবে
# আদানির চুক্তিতে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে

দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনটি বাতিল করা হয় গত বছরের নভেম্বরে। এর আগেই এ আইনের অধীনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে গত সরকারের করা চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আছেন হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী। কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও সহ-উপাচার্য আবদুল হাসিব চৌধুরী, কেপিএমজি বাংলাদেশের সাবেক প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আলী আশফাক, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ফ্যাকাল্টি অব ল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের অর্থনীতির অধ্যাপক মোশতাক হোসেন খান ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক।

জানুয়ারিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন

আজ রোববার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দিয়েছে চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে তারা। এ ছাড়া ভারতের আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে করা চুক্তির অনিয়ম নিয়েও একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তারা। প্রতিবেদন জমার পর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে একটি সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন কমিটির সদস্যরা।

সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, কারণ ছাড়া চুক্তি বাতিল করলে তার ক্ষতিপূরণের বিষয়টি চুক্তিতেই বলা আছে। তবে প্রতিটি চুক্তিতেই স্বীকারোক্তি থাকে যে এই চুক্তিতে কোনো দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়নি। এটা যদি লঙ্ঘিত হয়, তাহলে চুক্তি বাতিল করা যায়। কিন্তু মুখের কথা তো আদালত মানতে চাইবেন না, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে হবে আদালতে। কমিটির সহায়তায় চুক্তির অনিয়ম খুঁজে দেখা হচ্ছে। কারণ, খুঁজে পাওয়া গেলে চুক্তি বাতিলে দ্বিধা করা হবে না।

কমিটির আহ্বায়ক মঈনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, চুক্তি কতটা বাতিল করা যাবে, তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। বিদ্যুৎ খাতের চুক্তিগুলো পুরোপুরি কারিগরি, তাই সময় লেগেছে পর্যালোচনায়। এতে ব্যাপক দুর্নীতি পাওয়া গেছে। আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কমিটির সদস্য জাহিদ হোসেন বলেন, চুক্তি–সম্পর্কিত নথি দেখা হয়েছে। পিডিবি থেকে পরিশোধ করা বিলের তথ্য নেওয়া হয়েছে। এগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে, কী কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে। ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ ছিল, মন্ত্রণালয় সব সময় প্রধানমন্ত্রীর হাতে ছিল। বিদ্যুৎ খাতে যে পরিমাণ বিল পরিশোধ করা হয়েছে এবং এর বিপরীতে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে, এর হিসাব আইনস্টাইনও মেলাতে পারবেন না।

চুক্তি বাতিল করলে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির সদস্য শাহদীন মালিক বলেন, যাঁরা ক্ষতিপূরণ দাবি করবেন, তাঁরা তাঁদের ক্ষতির হিসাব দেবেন। তাই ক্ষতিপূরণের বিষয়টা তো এ কমিটি বলতে পারবে না।

দুর্নীতির কারণে বেড়েছে বিদ্যুতের দাম

সংবাদ সম্মেলনে কমিটির সদস্য মোশতাক হোসেন খান বলেন, ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতির কারণে বিদ্যুতের দাম ২৫ শতাংশ বেশি হয়ে গেছে। ভর্তুকি না থাকলে ৪০ শতাংশ বেড়ে যেত। এ দামে ব্যবসা-বাণিজ্য টিকতে পারবে না। এটা কমাতে হবে। যারা টাকা নিয়ে চলে গেছে, তাদের বোঝাতে হবে, তারা পার পাবে না। তাড়াতাড়ি করলে ভুল হতে পারে, তাই সময় লেগেছে। তবে রাষ্ট্রের সঙ্গে কোম্পানির চুক্তিগুলো সার্বভৌম চুক্তি। চাইলেই এটা বাতিল করা যায় না। বড় জরিমানা দিতে হতে পারে।

আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে মোশতাক হোসেন বলেন, আদানির চুক্তির অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে আদালতে রিট হয়েছে। আদালত প্রতিবেদন চেয়েছেন। মাসখানেকের মধ্যে শক্ত প্রমাণ সামনে আসবে। এসব প্রমাণ নিয়ে দেশে-বিদেশে আইনি প্রক্রিয়া নেওয়া যাবে।

পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশে মূলত ভবিষ্যতে সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যাতে এ ধরনের চুক্তি না করা হয়। চুক্তির আগে স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে যাচাই করে দেখার কথা বলা হয়েছে। পর্যালোচনা কমিটির পরামর্শে গত ২১ জানুয়ারি করা হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ট্যারিফ (বিদ্যুতের দাম) পর্যালোচনা কমিটি। এ কমিটির কাজ চলমান।

চুক্তি অনুসারে প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে নেয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম নির্ধারণে একটি সূত্র দেওয়া আছে চুক্তিতে। এ সূত্র অনুসারে দাম নির্ধারিত হয়। একেক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে একেক দাম। সমঝোতার মাধ্যমে কাউকে কাউকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। দরপত্র ছাড়া বিশেষ বিধান আইনে এভাবে চুক্তি করার সুযোগ নিয়েছে গত আওয়ামী লীগ সরকার।

বিশেষ বিধান আইনটি করা হয় ২০১০ সালে। এরপর দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়। এই আইনের অধীনে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এর কারণে এটি দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত। এ আইনের অধীনে দরপত্র ছাড়া একটার পর একটা চুক্তি করেছিল গত সরকার।

সম্পর্কিত নিবন্ধ