হামজা চৌধুরীর জন্ম ইংল্যান্ডে, জামাল ভূঁইয়ার ডেনমার্কে, তারিক কাজীর ফিনল্যান্ডে। তাঁরা তিনজনই এখন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড়। আন্তর্জাতিক ফুটবলেও এমন উদাহরণ কম নেই। যেমন নরওয়ের হয়ে খেলা আর্লিং হলান্ডের জন্ম ইংল্যান্ডে, স্পেনের দিয়েগো কস্তার ব্রাজিলে, মরক্কোর আশরাফ হাকিমির স্পেনে।

একজন ফুটবলারের কোনো ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন/ফেডারেশনের হয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলার মৌলিক শর্তই হচ্ছে সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকত্ব থাকা। কিন্তু কেউ একজন চাইলেই যেমন আরেকটি দেশের নাগরিক হতে পারেন না, তেমনি নাগরিকত্ব নিলেই সে দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলার যোগ্যতা অর্জনও নিশ্চিত নয়।

একজন ফুটবলার কোন দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে খেলতে পারবেন, কী কী শর্ত পূরণ করতে হবে—এ নিয়ে ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। আরজিএএস (ফিফা রেগুলেশনস গভর্নিং দ্য অ্যাপ্লিকেশন অব দ্য স্ট্যাটিউটস) নামে পরিচিত নীতিমালাটি একবিংশ শতাব্দীতেই তিন দফা হালনাগাদ হয়েছে, যার সর্বশেষটি ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ফিফার ৭০তম কংগ্রেসে।

একজন ফুটবলার আন্তর্জাতিক ফুটবলে অ্যাসোসিয়েশন বা ফেডারেশনের প্রতিনিধিত্ব করেন মোটের ওপর তিনটি সূত্রে—জন্ম, পরিবার ও বসবাস। ফিফা নীতিমালা অনুসারে, একজন খেলোয়াড়ের জাতীয় দলে প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতার প্রাথমিক ভিত্তি তাঁর জাতীয়তা। যেমন ধারা ৫.

১-এ বলা হয়েছে, ‘কোনো নির্দিষ্ট দেশে বসবাসের ওপর নির্ভরশীল নয়—এমন স্থায়ী জাতীয়তাধারী যেকোনো ব্যক্তি সেই দেশের অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিত্বকারী দলের হয়ে খেলার যোগ্য।’

যার অর্থ, জন্মসূত্রে বা জাতিগত সূত্রে (মা–বাবার নাগরিকত্ব) পাওয়া নাগরিকত্বে একজন ফুটবলার সংশ্লিষ্ট দেশের হয়ে খেলতে পারবেন। তবে জন্মগ্রহণ করা মাত্রই যে সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকত্ব নিশ্চিত, তা নয়। কিছু দেশ জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব দেয় না, আবার কেউ কেউ মা–বাবার পেশাগত কারণেও ভিন্ন দেশে জন্মগ্রহণ করে থাকেন। ম্যানচেস্টার সিটির হলান্ডই যেমন ফুটবলার বাবার কর্মসূত্রে ইংল্যান্ডের লিডসে জন্ম নিয়েছেন, তবে জাতীয়তা নরওয়েজীয় এবং সে দেশটির হয়েই বয়সভিত্তিক দল থেকে খেলেছেন বলে কখনো অ্যাসোসিয়েশন বদলানোর প্রসঙ্গই ওঠেনি।

ফিফা বলছে, একজন খেলোয়াড় যে দেশের হয়ে খেলতে চান, সেই দেশটির সঙ্গে তাঁর ‘পরিষ্কার সংযোগ’ বা সম্পর্ক থাকতে হবে। ফিফা নীতিমালায় একটি অ্যাসোসিয়েশনে/জাতীয় দলে যুক্ত হওয়ার ৪টি মাধ্যমের কথা বলা হয়েছে। ধারা ৭.১ অনুসারে:

১. ওই খেলোয়াড়ের জন্ম সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশনের ভূখণ্ডে বা দেশে
২. ওই খেলোয়াড়ের জন্মদাতা মা অথবা জন্মদাতা বাবার জন্ম সে দেশে
৩. ওই খেলোয়াড়ের রক্ত সম্পর্কের দাদা/দাদি অথবা নানা/নানির জন্ম সে দেশে
৪. ওই খেলোয়াড় সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশনের ভূখণ্ডে বসবাস করছেন/করেছেন। এ ক্ষেত্রে দশ বছরের আগে বসবাস শুরু করলে অন্তত ৩ বছর, ১০ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে বসবাস করলে অন্তত ৫ বছর, ১৮ বছর বয়স থেকে বসবাস করলে অন্তত ৫ বছর শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকতে হবে।

একজন খেলোয়াড় তাঁর অ্যাসোসিয়েশন বা জাতীয় দল পরিবর্তনের আবেদনও করতে পারেন। তবে সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড় যদি প্রথম জাতীয় দলের হয়ে প্রতিযোগিতামূলক মঞ্চে খেলে ফেলেন, তাহলে এরপর আর জাতীয় দল পরিবর্তন করতে পারবেন না। যেমন, হামজা চৌধুরী যদি ইংল্যান্ড জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে ইউরো বা বিশ্বকাপে এক ম্যাচও খেলতেন, বাংলাদেশ দলের হয়ে আর খেলতে পারতেন না। আবার বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলার কারণে সামনে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার সুযোগ পাবেন না।

* যদি কোনো খেলোয়াড় ২১ বছর বয়সের আগে তিনটির বেশি প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ (প্রীতি নয়) না খেলেন, তাহলে সর্বশেষ ম্যাচের ৩ বছর পর নতুন দেশের হয়ে খেলতে পারবেন। তবে যেসব খেলোয়াড় ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বরের আগে পুরোনো দলের হয়ে সর্বশেষ ম্যাচ খেলেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে ২১ বছরের নিয়মটি প্রযোজ্য নয়।

* যদি কোনো খেলোয়াড় তাঁর জন্মগ্রহণ করা দেশের জাতীয় দলে না খেলার সুযোগ পান, তাহলে অন্য কোনো দেশে ৫ বছর বসবাস করলে ওই দেশের হয়ে খেলতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ভূখণ্ডে ১২ মাসের মধ্যে অন্তত ১৮৩ দিন শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকলে এক বছর গণনা হবে।

* একজন খেলোয়াড় জাতীয় দল পরিবর্তন করার পর আগের দলে ফিরতে পারবেন, যদি নতুন দলের কোনো আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক ম্যাচে না খেলে থাকেন। অর্থাৎ, নতুন দলে নাম লিখিয়ে মাত্র এক ম্যাচ খেললেই তিনি আর পূর্বের অ্যাসোসিয়েশনে ফিরতে পারবেন না।

একজন খেলোয়াড়ের জাতীয় দল পরিবর্তনের বিষয়টি চূড়ান্ত অনুমোদন করে ফিফা। এ জন্য তাঁর নতুন অ্যাসোসিয়েশন/ফেডারেশনকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ফিফা সচিবালয়ে পাঠাতে হবে। এ ক্ষেত্রে খেলোয়াড়টির ধরন (পূর্বে প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলেছেন/খেলেননি, ১৮ বছরের আগে/পরে বসবাস, নাগরিকত্ব থাকা/না থাকা) অনুসারে কাগজপত্রের ভিন্নতা আছে।

তবে সব ক্ষেত্রেই নতুন দেশটির পাসপোর্ট থাকা আবশ্যক। ফিফা খেলোয়াড়ের জাতীয় দল পরিবর্তনের আবেদনটি তাদের প্লেয়ার্স স্ট্যাটাস কমিটির (পিএসসি) কাছে পাঠায়। আবেদনটি গৃহীত/বাতিল করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় প্লেয়ার্স স্ট্যাটাস কমিটি।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: একজন ফ টবল র একজন খ ল য় ড় র জ ত য় দল জ ত য় দল প ওই খ ল য় ড় দ শ র হয় প রব ন র জন ম নত ন দ বসব স বছর র

এছাড়াও পড়ুন:

মহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সিরাত বা জীবনী শুধু ইসলামের ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়, বরং এটি একটি স্বতন্ত্র জ্ঞানশাখা, যার কেন্দ্রে রয়েছেন তিনি এবং তাঁর যুগের ঘটনাবলি, মূল্যবোধ, নীতি, মুজিজা এবং সম্পর্ক।

নবীজির সিরাত প্রতিষ্ঠিত কোরআন, হাদিস এবং সাহাবিদের জীবনাচরণের আলোকে। তবে এই জীবনী নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা এবং তথ্য বিকৃতির ঘটনা ঘটেছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

প্রামাণিক উৎস

মহানবী (সা.)–এর জীবন সম্পর্কে অধ্যয়নের সবচেয়ে প্রামাণিক উৎস হলো কোরআন মাজিদ। কোরআনে তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়, তাঁর রিসালাত, হিজরত, যুদ্ধ এবং তাঁর মানবিক গুণাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সুরা মুহাম্মদে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে (আয়াত: ২)।

সুরা আলে ইমরানেও এসেছে (আয়াত: ১৪৪), সুরা আহজাবে তাঁকে ‘খাতামুন নাবিয়্যিন’ বা নবীদের সিলমোহর (মানে শেষ নবী) বলা হয়ে (আয়াত: ৪০) এবং সুরা ফাতহে তাঁকে বলা হয়েছে ‘আল্লাহর রাসুল’ (আয়াত: ২৯)।

মহানবীর সিরাত নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা ও রচনা ঐতিহাসিক সত্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করেছে। এই বিকৃতিগুলো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হয়েছে, কখনো অতিরঞ্জিত বর্ণনা বা ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।

এ ছাড়া চরিত্র, কাজ, অবস্থান সম্পর্কে বহু আয়াত আছে কোরআনে।

হাদিস গ্রন্থগুলোও সিরাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ইমাম মালিকের মুয়াত্তা, সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে ইবনে মাজা, সুনানে তিরমিজি এবং সুনানে নাসাইতে তাঁর বাণী, কাজ ও সম্মতির বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এবং সিরাতের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে।

এই গ্রন্থগুলোর সনদ (বর্ণনা পরম্পরা ও বিষয়বস্তু যাচাইয়ের জন্য মুহাদ্দিসগণ কঠোর মানদণ্ড প্রয়োগ করেছেন, যা ‘জার্‌হ ও তাদিল’ নামে পরিচিত।

এ ছাড়া ইবনে ইসহাকের সিরাতু রাসুলিল্লাহ সিরাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলোর একটি, ইবনে হিশাম, যার একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশ করেছেন এবং আস-সুহাইলি তা নিয়ে আর-রওদুল উনুফ নামে একটি ব্যাখ্যা রচনা করেছেন।

এ ছাড়া ইবনে শিহাব জুহরি ও মুসা ইবনে উকবার মাগাজি মহানবী (সা.) রাসুলুল্লাহর নির্ভরযোগ্য জীবনীগ্রন্থ। কাজি ইয়াজের আশ-শিফা বি তা’রিফ হুকুকিল মুস্তফা তাঁর গুণাবলি ও অধিকারের ওপর বিশদ আলোচনা করেছে, যা পূর্ব ও পশ্চিমের পণ্ডিতদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।

আরও পড়ুনমহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর জীবনী রচনার হাজার বছর১১ নভেম্বর ২০২০ভ্রান্ত ব্যাখ্যা ও তথ্য বিকৃতি

মহানবীর সিরাত নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা ও রচনা ঐতিহাসিক সত্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করেছে। এই বিকৃতিগুলো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হয়েছে, কখনো অতিরঞ্জিত বর্ণনা বা ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।

মহানবীর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর অসুস্থতার লক্ষণ প্রকাশ পায় হজ্জাতুল বিদা বা বিদায় হজের সময়। তিনি আরাফাতে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমার কাছ থেকে তোমাদের হজের রীতি গ্রহণ করো। কারণ, এ বছরের পর আমি হয়তো আর হজ করতে পারব না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,২৯৭)

সুরা নাসর অবতীর্ণ হলে তিনি বলেন, ‘এটি আমার মৃত্যুর ঘোষণা।’ (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫/২০৮, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)

আমি এখনো খায়বারে খাওয়া বিষাক্ত খাবারের যন্ত্রণা অনুভব করছি, এখন এর সময় এসেছে যে আমার শিরা ছিঁড়ে যাবে।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪৪২৮

রাসুল (সা.) মসজিদে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর একজন বান্দাকে দুনিয়া ও আল্লাহর নৈকট্যের মধ্যে পছন্দ করতে বলেছেন, আর সেই বান্দা আল্লাহর নৈকট্য পছন্দ করেছেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৫০৪)

তাঁর অসুস্থতার সময় তিনি আয়েশা (রা.)-এর ঘরে থাকতে পছন্দ করেন। আয়েশা বলেন, ‘তিনি জান্নাতুল বাকি (কবরস্থান) থেকে ফিরে এসে আমাকে মাথাব্যথায় কাতর দেখে বললেন, “বরং আমি বলি, হায় আমার মাথা”!’ (মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক, সিরাতু রাসুলিল্লাহ, পৃ. ৬৭৮, দারুল মা’রিফা, বৈরুত, ১৯৭৮)

তিনি তীব্র জ্বরে ভুগছিলেন এবং বলেন, ‘আমি এখনো খায়বারে খাওয়া বিষাক্ত খাবারের যন্ত্রণা অনুভব করছি, এখন এর সময় এসেছে যে আমার শ ছিঁড়ে যাবে’ (সহিহ আল-বুখারি, হাদিস: ৪৪২৮)। তিনি নির্দেশ দেন সাতটি মশকের পানি তাঁর ওপর ঢালার জন্য, যা তাঁর জ্বর কমাতে সাহায্য করে। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৬৪২, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)

১১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল, সোমবার (৭ জুন, ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি আয়েশা (রা.)–এর ঘর থেকে মসজিদে উঁকি দিয়ে মুসল্লিদের দিকে তাকিয়ে হাসেন এবং বলেন, ‘হে আল্লাহ, আমাকে মৃত্যুর যন্ত্রণায় সাহায্য করো।’ (আবু বকর আল-বাইহাকি, দালাইলুন নুবুওয়া, ৭/২৪৪, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৮৫)

তাঁর মৃত্যুর পর আবু বকর (রা.) ঘোষণা দেন, ‘যে মুহাম্মদের ইবাদত করত, সে জানুক, মুহাম্মদ মারা গেছেন। আর যে আল্লাহর ইবাদত করে, সে জানুক আল্লাহ চিরজীবী, তিনি মরেন না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১২৪১)

আরও পড়ুননবীজি (সা.)–র কোন জীবনী পড়বেন২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫খিলাফতের প্রতিষ্ঠা: সাকিফা বনু সায়েদা

মহানবী (সা.)–এর মৃত্যুর পর ‘সাকিফা বনু সায়েদা’য় সাহাবিরা খিলাফত নির্বাচনের জন্য সমবেত হন। আনসাররা সাদ ইবন উবাদার নেতৃত্বে দাবি করেন যে তারা ইসলামের প্রথম দিন থেকে রাসুলকে সমর্থন করেছেন, তাই তাদের মধ্য থেকে আমির নির্বাচিত হওয়া উচিত।

আবু বকর (রা.) মুহাজিরদের পক্ষে বলেন, ‘কুরাইশরা ইসলামে প্রথম ইমান এনেছে এবং তারা আরবের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত গোত্র। আমি তোমাদের জন্য উমর বা আবু উবাইদাহর মধ্যে একজনকে প্রস্তাব করছি।’ (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৫৬, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)

আনসাররা প্রস্তাব করেন, ‘একজন আমির মুহাজিরদের থেকে এবং একজন আনসারদের থেকে হবে।’ তবে এই প্রস্তাব ঐক্য রক্ষার জন্য প্রত্যাখ্যাত হয়। উমর ইবনে খাত্তাব আবু বকরের হাত ধরে বায়আত করেন এবং আনসাররাও তাঁকে সমর্থন দেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৮৩০)

আমি তোমাদের নেতা নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নই। যদি ভালো করি, আমাকে সাহায্য করো; আর যদি ভুল করি, আমাকে সংশোধন করো।হজরত আবু বকর (রা.)

পরদিন মসজিদে সাধারণ বায়আত অনুষ্ঠিত হয়। আবু বকর (রা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের নেতা নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নই। আমি যদি ভালো করি, আমাকে সাহায্য করো; আর যদি ভুল করি, আমাকে সংশোধন করো।’ (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৬৫৮, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)

কয়েকজন সাহাবি, যেমন আলী (রা.) এবং জুবাইর ইবন আওয়াম, ফাতিমা (রা.)-এর ঘরে মহানবীর দাফনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তাই সাকিফায় উপস্থিত ছিলেন না। কেউ কেউ মনে করেন, খিলাফতের জন্য আলী (রা.) বা আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব উপযুক্ত ছিলেন।

তবে মহানবী কাউকে স্পষ্টভাবে খলিফা মনোনয়ন করেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে কাগজ দাও, আমি তোমাদের জন্য এমন কিছু লিখে দেব, যার পর তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।’ কিন্তু উমর বলেন, ‘নবীজি এখন প্রবল যন্ত্রণায় ভুগছেন, (তাকে বিরক্ত করব না) আমাদের জন্য কোরআনই যথেষ্ট।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১১৪)।

রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মহানবীর ভূমিকা

‘আবু বকর (রা.) ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন’ বলে হালা ওয়ার্দি যে দাবি করেছেন, তা ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।

মহানবী (সা.) নিজেই ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি মদিনায় একটি জাতি গঠন করেন, যারা কোরআনের নির্দেশনা অনুসরণ করে ঐক্যবদ্ধ হয়। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধরো এবং বিচ্ছিন্ন হোয়ো না।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৩)

তিনি মদিনা সনদ প্রণয়ন করেন, যা মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/৫০১, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)

তিনি বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে চুক্তি, যুদ্ধে নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্রদূত প্রেরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কাঠামো গড়ে তোলেন। যেমন রোমের সম্রাট হেরাক্লিয়াস, পারস্যের কিসরা এবং মিসরের মুকাউকিসের কাছে পত্র প্রেরণ করেন, যা তাঁর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪/২৬৯, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)

তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় ন্যায়বিচার ও শুরার নীতি প্রয়োগ করেন। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচারের সঙ্গে রায় দাও।’ (সুরা সাদ, আয়াত: ২৬)

মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যদি ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ চুরি করত, আমি তার হাত কেটে দিতাম।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৭৮৭)।

তিনি শুরার বাস্তবায়ন করেন, কেননা কোরআন বলেছে, ‘তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯)

তিনি বলেন, ‘আমি একজন মানুষ। ধর্মীয় বিষয়ে আমার নির্দেশ গ্রহণ করো, কিন্তু পার্থিব বিষয়ে তোমরা আমার চেয়ে বেশি জানো।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৩৬৩)

হালা ওয়ার্দির গ্রন্থের মতো অনেক গ্রন্থ বাজারে পাওয়া যায়, যা ঐতিহাসিক তথ্যের অপব্যাখ্যা করে এবং তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করে।শেষ কথা

মহানবীর ‘সিরাত’ ইসলামের ইতিহাস ও মূল্যবোধের একটি জীবন্ত দলিল। কোরআন, হাদিস এবং প্রামাণিক সিরাত গ্রন্থগুলো তাঁর জীবনের সঠিক চিত্র তুলে ধরেছে। তবে হালা ওয়ার্দির গ্রন্থের মতো অনেক গ্রন্থ বাজারে পাওয়া যায়, যা ঐতিহাসিক তথ্যের অপব্যাখ্যা করে এবং তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করে।

মহানবী (সা.) ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, যিনি ন্যায়বিচার, শুরা এবং ঐক্যের ভিত্তিতে এটি গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নির্বাচনের ঘটনাগুলো তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করেছে। এই সিরাত আমাদের শিক্ষা দেয় যে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকা এবং ঐক্যের মাধ্যমে সমাজ গঠন করা সম্ভব।

সূত্র: আল-মালুম আন আল-জাদওয়াল আত-তারিখি লি-সিরাতির রাসুল

আরও পড়ুনমহানবী (সা.)–এর জন্মকালের অলৌকিক ঘটনাবলি১৯ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ২৬ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার: জাতিসংঘ
  • গ্রাহকের কাছে পেয়ারা খেতে চায় জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা
  • তিন দাবিতে ২৪ ঘণ্টা ধরে ৫ শিক্ষার্থীর অনশন, দুজন অসুস্থ
  • গল্পটা এই ক্লাসরুম থেকেই শুরু: ইরফান সাজ্জাদ
  • রাশিয়ায় এক বাঙালি বিপ্লবীর খোঁজে
  • আপনার এত সাহস হয় কী করে, সাংবাদিককে নায়িকা
  • দুবাইয়ে বিকৃত যৌন ব্যবসা চক্রের প্রধানকে চিহ্নিত করল বিবিসির এক অনুসন্ধান
  • সম্পূরক বৃত্তি ও জকসু নির্বাচনের রূপরেখাসহ তিন দাবিতে অনশনে ৫ শিক্ষার্থী
  • ইসরায়েল ম্যাচের লভ্যাংশ নোবেলজয়ী এনজিওর মাধ্যমে গাজার মানুষদের দেবে নরওয়ে
  • মহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে