যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার ১৯০৯ সালের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দরাজ গলায় ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আজ আমরা একটি যুগে আছি। কাল নতুন একটি যুগে পা রাখব।’ তিনি বলেছেন, ‘আমরা এমন কিছু করেছি, যা আগে কেউ কখনো করেনি!’

ট্রাম্পের এই কথা সত্য নয়।

১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর চেয়ারম্যান মাও সে–তুং বেইজিংয়ের নিষিদ্ধ নগরীর প্রবেশদ্বারখ্যাত তিয়েনআনমেনের ওপর দাঁড়িয়ে চীনের ‘মুক্তি দিবস’ ঘোষণা করেছিলেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এর পর থেকে বিশ শতককে দুটি ভাগে ভাগ করে। একটি ভাগ হলো চিয়াং কাইশেকের শাসনকালের ‘মুক্তির আগের সময়’ এবং অন্য ভাগটি হলো মাও সে–তুংয়ের শাসনকালের ‘মুক্তির পরের সময়’। ‘মুক্তির পরের সময়’ চীন তিন দশকের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে নিমজ্জিত ছিল।

এখন ট্রাম্পের ‘মুক্তি দিবস’ বিশ্বব্যাপী সে ধরনেরই অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা বয়ে আনতে পারে।

ইউরোপীয়দের জন্য এটি যেন হঠাৎ সূর্যের আলো নিভে যাওয়ার মতো। ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থা তার স্থিরতা ও পূর্বানুমেয়তা হারিয়ে ফেলেছে। গ্রহগুলো যেন কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়ছে। একসময় যে ইউরোপীয়রা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করত, তারা এখন নিজেদের সম্পূর্ণ একা ভাবতে শুরু করেছে। তারা এমন এক মার্কিন নেতার মুখোমুখি হয়েছে, যিনি অজ্ঞতা ও নির্লজ্জতার চূড়ান্ত রূপ নিয়ে হাজির হয়েছেন।

পুরোনো ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কারণে চীন ও রাশিয়া এখন সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে প্রস্তুত। এর মধ্যে এক দেশ হলো অস্ত্রভান্ডার, বিশাল ভূখণ্ড ও প্রাকৃতিক সম্পদসমৃদ্ধ একটি দুর্বল অর্থনীতির অধিকারী মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী শাসনাধীন, যার অর্থনীতি কানাডার চেয়ে ছোট। আর অন্যটি হলো পুনরুজ্জীবিত একদলীয় লেনিনবাদী রাষ্ট্র, যার রয়েছে বিশাল অর্থনীতি, সংবেদনশীল নেতা এবং একটি দ্রুত বিকাশমান বৈশ্বিক প্রযুক্তিকেন্দ্র।

এই যখন অবস্থা, তখন ইউরোপ কি সত্যিই এমন এক বিশ্ব চায়, যেখানে স্বৈরতন্ত্র নিরাপদ থাকবে?

সান ইয়াৎ-সেন একসময় বলেছিলেন, ইউরোপ যদি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আলগা বালুর মতো থাকতে না চায়, তাহলে শুধু সামরিক শক্তি বাড়ানোই যথেষ্ট নয়, তাকে গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা পুনরুদ্ধারেও ভূমিকা রাখতে হবে।

মাও সে–তুং এই ‘শান্তিপূর্ণ বিবর্তন’ কৌশলকে যুদ্ধের চেয়ে ভয়ানক মনে করতেন। কারণ, এটি চীনের কমিউনিস্ট ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। সি চিন পিংও সব সময় যুক্তরাষ্ট্রকে ‘শত্রুভাবাপন্ন বিদেশি শক্তি’ হিসেবে দেখে আসছেন।

এটি করতে হলে ইউরোপের নিজস্ব যেসব গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রয়েছে, তা তারা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে। যেমন ফ্রান্স ও ব্রিটেনের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে এবং সেগুলো ইউরোপের জন্য প্রতিরক্ষাব্যবস্থা হিসেবে কাজে লাগানো যেতে পারে। জার্মানির রাইনমেটাল নামের প্রতিষ্ঠান অস্ত্র তৈরি করে আর ইউক্রেন ড্রোন প্রযুক্তিতে দক্ষ। এটি ইউরোপের সামরিক খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যুক্তরাজ্যের বিএই সিস্টেমস এবং ফ্রান্সের এয়ারবাস সামরিক সরঞ্জাম ও বিমান নির্মাণের ক্ষেত্রে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। নেদারল্যান্ডসের এএসএমএল এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যার উন্নত মাইক্রোচিপ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ইইউভি প্রযুক্তির ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এসব সম্পদকে কাজে লাগিয়ে ইউরোপ যদি চায়, তবে বৈশ্বিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এবং স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে একত্র করতে পারে।

কিন্তু ইউরোপ এখনো সেই ধরনের সহযোগিতামূলক জোট গঠনের চেষ্টা শুরু করেনি। যদি তারা জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে, তাহলে চীন বুঝতে পারবে, যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে বিশ্ব কেবল তাদের জন্য উন্মুক্ত নয়।

ট্রাম্পের ন্যাটোবিরোধী মনোভাবের কথা বিবেচনায় নিয়ে ইউরোপীয় ও এশীয় গণতন্ত্রপন্থীদের উচিত তাদের সামরিক ও অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা কমিয়ে একে অপরের সঙ্গে নতুন ধরনের অংশীদারি গড়ে তোলা। ভারত বরাবরই কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সংবেদনশীল। তাই ভারত এ ধরনের প্রচেষ্টায় সহযোগী হতে পারে।

একসময় ফরাসি নেতা শার্ল দ্য গল ফ্রান্সের জন্য এই কাঠামোই কল্পনা করেছিলেন। ১৯৫০-এর দশকে ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার পর দ্য গল আশঙ্কা করেছিলেন, সোভিয়েত আক্রমণ করলে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ইউরোপকে রক্ষা করতে আসবে না। তিনি স্পষ্টভাবেই আমেরিকানদের বলেছিলেন, প্যারিসকে বাঁচানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র নিউইয়র্ককে বলি দেবে, এমন কথা তিনি বিশ্বাস করেন না।

এ কারণে দ্য গল ফ্রান্সের নিজস্ব পারমাণবিক বাহিনী ‘ফোর্স দ্য ফ্রাপ’ গড়ে তোলেন এবং ১৯৬৬ সালে ন্যাটোর সামরিক কমান্ড থেকে ফ্রান্সকে প্রত্যাহার করেন (যদিও ফ্রান্স ন্যাটোর সদস্যপদ বজায় রাখে)। তখন অনেকে তাঁর পদক্ষেপকে শিশুসুলভ জেদ বলে মনে করেছিল। কিন্তু তাঁর যুক্তি এখন যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন দীর্ঘদিন ধরে তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে আলোচনা, সংলাপ, বাণিজ্য চুক্তি, সাংস্কৃতিক বিনিময় ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে। তবে এসব কৌশল চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মতো নেতাদের মনোভাব বদলাতে পারবে না। তাঁরা বিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে চান না, বরং তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে দিয়ে নিজেরা বিশ্ব নেতৃত্ব গ্রহণ করতে চান এবং তারপর সেই বিশ্বব্যবস্থাকে নিজেদের মতো করে বদলে দিতে চান।

একসময় মাও সে–তুং বলেছিলেন, ‘ধ্বংস ছাড়া বিনির্মাণ সম্ভব নয়।’ তাঁর এ কথার মধ্যে কিছু সত্য রয়েছে। ট্রাম্পও একধরনের ধ্বংসের কাজ করছেন। তবে যদি ইউরোপ সঠিকভাবে সুযোগটি কাজে লাগাতে পারে, তাহলে ট্রাম্পের নীতিই পরোক্ষভাবে এমন এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার জন্ম দিতে পারে, যা আর আমেরিকাকেন্দ্রিক থাকবে না।

কিন্তু ইউরোপীয়দের মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই একবার এমন কৌশল প্রয়োগ করেছে। সে কৌশল তারা শুধু সোভিয়েত রাশিয়ার ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করেছে, তা নয়; বরং চীনের বিষয়েও তারা একই কৌশল নিয়েছে। ১৯৭২ সালের পর থেকে ১০ মার্কিন প্রেসিডেন্ট চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে নানা কৌশল অবলম্বন করেছেন।

কিন্তু এসব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা বরাবরই মনে করেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টরা মুখে যা-ই বলুন না কেন, যুক্তরাষ্ট্র মূলত চীনের একদলীয় শাসন উচ্ছেদ করতেই চায়। তারা প্রায়ই প্রেসিডেন্ট ডুয়াইট আইজেনআওয়ারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডালেসের ১৯৫৩ সালে বলা সেই কথা মনে করিয়ে দেন, যেখানে ডালেস বলেছিলেন, ‘মুক্তি’ কেবল যুদ্ধের মাধ্যমেই নয়, বরং ‘অভ্যন্তরীণ চাপের মাধ্যমে’ও অর্জন করা সম্ভব, আর সেটিই কমিউনিস্ট শাসনকে তার চরিত্র পরিবর্তন করতে বাধ্য করবে।

মাও সে–তুং এই ‘শান্তিপূর্ণ বিবর্তন’ কৌশলকে যুদ্ধের চেয়ে ভয়ানক মনে করতেন। কারণ, এটি চীনের কমিউনিস্ট ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। সি চিন পিংও সব সময় যুক্তরাষ্ট্রকে ‘শত্রুভাবাপন্ন বিদেশি শক্তি’ হিসেবে দেখে আসছেন।

তাই ইউরোপের চীন সম্পর্কে কোনো ভ্রান্ত ধারণা না রাখা উচিত। সাহসী প্রতিরোধ, জোটগত ঐক্য এবং অর্থনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমেই আজকের আত্মবিশ্বাসী স্বৈরতন্ত্রগুলোর বিরুদ্ধে শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব।

যুক্তরাষ্ট্র যদি বিশ্ব গণতন্ত্রের এই দায়িত্ব নিতে না চায়, তাহলে ইউরোপেরই সেই দায়িত্ব নেওয়া উচিত। অন্য কেউ তা করবে না।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

অরভিল শেল এশিয়া সোসাইটির সেন্টার অন ইউএস-চায়না রিলেশনসের পরিচালক।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: বল ছ ল ন ইউর প য় ইউর প র ব যবস থ এমন এক র জন ত র জন য কর ছ ল র ওপর ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ

এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।

সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।

ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।

ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।

‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।

ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।

খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।

এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী

ডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।

প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।

ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।

পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।

ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।

পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।

ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।

ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।

বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।

নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউব

ইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।

ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।

ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।

২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।

মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ