যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার ১৯০৯ সালের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দরাজ গলায় ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আজ আমরা একটি যুগে আছি। কাল নতুন একটি যুগে পা রাখব।’ তিনি বলেছেন, ‘আমরা এমন কিছু করেছি, যা আগে কেউ কখনো করেনি!’
ট্রাম্পের এই কথা সত্য নয়।
১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর চেয়ারম্যান মাও সে–তুং বেইজিংয়ের নিষিদ্ধ নগরীর প্রবেশদ্বারখ্যাত তিয়েনআনমেনের ওপর দাঁড়িয়ে চীনের ‘মুক্তি দিবস’ ঘোষণা করেছিলেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এর পর থেকে বিশ শতককে দুটি ভাগে ভাগ করে। একটি ভাগ হলো চিয়াং কাইশেকের শাসনকালের ‘মুক্তির আগের সময়’ এবং অন্য ভাগটি হলো মাও সে–তুংয়ের শাসনকালের ‘মুক্তির পরের সময়’। ‘মুক্তির পরের সময়’ চীন তিন দশকের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে নিমজ্জিত ছিল।
এখন ট্রাম্পের ‘মুক্তি দিবস’ বিশ্বব্যাপী সে ধরনেরই অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা বয়ে আনতে পারে।
ইউরোপীয়দের জন্য এটি যেন হঠাৎ সূর্যের আলো নিভে যাওয়ার মতো। ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থা তার স্থিরতা ও পূর্বানুমেয়তা হারিয়ে ফেলেছে। গ্রহগুলো যেন কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়ছে। একসময় যে ইউরোপীয়রা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করত, তারা এখন নিজেদের সম্পূর্ণ একা ভাবতে শুরু করেছে। তারা এমন এক মার্কিন নেতার মুখোমুখি হয়েছে, যিনি অজ্ঞতা ও নির্লজ্জতার চূড়ান্ত রূপ নিয়ে হাজির হয়েছেন।
পুরোনো ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কারণে চীন ও রাশিয়া এখন সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে প্রস্তুত। এর মধ্যে এক দেশ হলো অস্ত্রভান্ডার, বিশাল ভূখণ্ড ও প্রাকৃতিক সম্পদসমৃদ্ধ একটি দুর্বল অর্থনীতির অধিকারী মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী শাসনাধীন, যার অর্থনীতি কানাডার চেয়ে ছোট। আর অন্যটি হলো পুনরুজ্জীবিত একদলীয় লেনিনবাদী রাষ্ট্র, যার রয়েছে বিশাল অর্থনীতি, সংবেদনশীল নেতা এবং একটি দ্রুত বিকাশমান বৈশ্বিক প্রযুক্তিকেন্দ্র।
এই যখন অবস্থা, তখন ইউরোপ কি সত্যিই এমন এক বিশ্ব চায়, যেখানে স্বৈরতন্ত্র নিরাপদ থাকবে?
সান ইয়াৎ-সেন একসময় বলেছিলেন, ইউরোপ যদি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আলগা বালুর মতো থাকতে না চায়, তাহলে শুধু সামরিক শক্তি বাড়ানোই যথেষ্ট নয়, তাকে গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা পুনরুদ্ধারেও ভূমিকা রাখতে হবে।
মাও সে–তুং এই ‘শান্তিপূর্ণ বিবর্তন’ কৌশলকে যুদ্ধের চেয়ে ভয়ানক মনে করতেন। কারণ, এটি চীনের কমিউনিস্ট ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। সি চিন পিংও সব সময় যুক্তরাষ্ট্রকে ‘শত্রুভাবাপন্ন বিদেশি শক্তি’ হিসেবে দেখে আসছেন।এটি করতে হলে ইউরোপের নিজস্ব যেসব গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রয়েছে, তা তারা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে। যেমন ফ্রান্স ও ব্রিটেনের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে এবং সেগুলো ইউরোপের জন্য প্রতিরক্ষাব্যবস্থা হিসেবে কাজে লাগানো যেতে পারে। জার্মানির রাইনমেটাল নামের প্রতিষ্ঠান অস্ত্র তৈরি করে আর ইউক্রেন ড্রোন প্রযুক্তিতে দক্ষ। এটি ইউরোপের সামরিক খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যুক্তরাজ্যের বিএই সিস্টেমস এবং ফ্রান্সের এয়ারবাস সামরিক সরঞ্জাম ও বিমান নির্মাণের ক্ষেত্রে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। নেদারল্যান্ডসের এএসএমএল এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যার উন্নত মাইক্রোচিপ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ইইউভি প্রযুক্তির ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এসব সম্পদকে কাজে লাগিয়ে ইউরোপ যদি চায়, তবে বৈশ্বিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এবং স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে একত্র করতে পারে।
কিন্তু ইউরোপ এখনো সেই ধরনের সহযোগিতামূলক জোট গঠনের চেষ্টা শুরু করেনি। যদি তারা জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে, তাহলে চীন বুঝতে পারবে, যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে বিশ্ব কেবল তাদের জন্য উন্মুক্ত নয়।
ট্রাম্পের ন্যাটোবিরোধী মনোভাবের কথা বিবেচনায় নিয়ে ইউরোপীয় ও এশীয় গণতন্ত্রপন্থীদের উচিত তাদের সামরিক ও অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা কমিয়ে একে অপরের সঙ্গে নতুন ধরনের অংশীদারি গড়ে তোলা। ভারত বরাবরই কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সংবেদনশীল। তাই ভারত এ ধরনের প্রচেষ্টায় সহযোগী হতে পারে।
একসময় ফরাসি নেতা শার্ল দ্য গল ফ্রান্সের জন্য এই কাঠামোই কল্পনা করেছিলেন। ১৯৫০-এর দশকে ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার পর দ্য গল আশঙ্কা করেছিলেন, সোভিয়েত আক্রমণ করলে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ইউরোপকে রক্ষা করতে আসবে না। তিনি স্পষ্টভাবেই আমেরিকানদের বলেছিলেন, প্যারিসকে বাঁচানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র নিউইয়র্ককে বলি দেবে, এমন কথা তিনি বিশ্বাস করেন না।
এ কারণে দ্য গল ফ্রান্সের নিজস্ব পারমাণবিক বাহিনী ‘ফোর্স দ্য ফ্রাপ’ গড়ে তোলেন এবং ১৯৬৬ সালে ন্যাটোর সামরিক কমান্ড থেকে ফ্রান্সকে প্রত্যাহার করেন (যদিও ফ্রান্স ন্যাটোর সদস্যপদ বজায় রাখে)। তখন অনেকে তাঁর পদক্ষেপকে শিশুসুলভ জেদ বলে মনে করেছিল। কিন্তু তাঁর যুক্তি এখন যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন দীর্ঘদিন ধরে তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে আলোচনা, সংলাপ, বাণিজ্য চুক্তি, সাংস্কৃতিক বিনিময় ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে। তবে এসব কৌশল চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মতো নেতাদের মনোভাব বদলাতে পারবে না। তাঁরা বিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে চান না, বরং তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে দিয়ে নিজেরা বিশ্ব নেতৃত্ব গ্রহণ করতে চান এবং তারপর সেই বিশ্বব্যবস্থাকে নিজেদের মতো করে বদলে দিতে চান।
একসময় মাও সে–তুং বলেছিলেন, ‘ধ্বংস ছাড়া বিনির্মাণ সম্ভব নয়।’ তাঁর এ কথার মধ্যে কিছু সত্য রয়েছে। ট্রাম্পও একধরনের ধ্বংসের কাজ করছেন। তবে যদি ইউরোপ সঠিকভাবে সুযোগটি কাজে লাগাতে পারে, তাহলে ট্রাম্পের নীতিই পরোক্ষভাবে এমন এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার জন্ম দিতে পারে, যা আর আমেরিকাকেন্দ্রিক থাকবে না।
কিন্তু ইউরোপীয়দের মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই একবার এমন কৌশল প্রয়োগ করেছে। সে কৌশল তারা শুধু সোভিয়েত রাশিয়ার ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করেছে, তা নয়; বরং চীনের বিষয়েও তারা একই কৌশল নিয়েছে। ১৯৭২ সালের পর থেকে ১০ মার্কিন প্রেসিডেন্ট চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে নানা কৌশল অবলম্বন করেছেন।
কিন্তু এসব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা বরাবরই মনে করেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টরা মুখে যা-ই বলুন না কেন, যুক্তরাষ্ট্র মূলত চীনের একদলীয় শাসন উচ্ছেদ করতেই চায়। তারা প্রায়ই প্রেসিডেন্ট ডুয়াইট আইজেনআওয়ারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডালেসের ১৯৫৩ সালে বলা সেই কথা মনে করিয়ে দেন, যেখানে ডালেস বলেছিলেন, ‘মুক্তি’ কেবল যুদ্ধের মাধ্যমেই নয়, বরং ‘অভ্যন্তরীণ চাপের মাধ্যমে’ও অর্জন করা সম্ভব, আর সেটিই কমিউনিস্ট শাসনকে তার চরিত্র পরিবর্তন করতে বাধ্য করবে।
মাও সে–তুং এই ‘শান্তিপূর্ণ বিবর্তন’ কৌশলকে যুদ্ধের চেয়ে ভয়ানক মনে করতেন। কারণ, এটি চীনের কমিউনিস্ট ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। সি চিন পিংও সব সময় যুক্তরাষ্ট্রকে ‘শত্রুভাবাপন্ন বিদেশি শক্তি’ হিসেবে দেখে আসছেন।
তাই ইউরোপের চীন সম্পর্কে কোনো ভ্রান্ত ধারণা না রাখা উচিত। সাহসী প্রতিরোধ, জোটগত ঐক্য এবং অর্থনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমেই আজকের আত্মবিশ্বাসী স্বৈরতন্ত্রগুলোর বিরুদ্ধে শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব।
যুক্তরাষ্ট্র যদি বিশ্ব গণতন্ত্রের এই দায়িত্ব নিতে না চায়, তাহলে ইউরোপেরই সেই দায়িত্ব নেওয়া উচিত। অন্য কেউ তা করবে না।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
অরভিল শেল এশিয়া সোসাইটির সেন্টার অন ইউএস-চায়না রিলেশনসের পরিচালক।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বল ছ ল ন ইউর প য় ইউর প র ব যবস থ এমন এক র জন ত র জন য কর ছ ল র ওপর ধরন র
এছাড়াও পড়ুন:
মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ, সভ্যতার তিন শত্রুকে ঠেকাব কী করে
ইউভাল নোয়াহ হারারি তাঁর বহুল আলোচিত হোমো ডিউস বইয়ে যুক্তি দিয়েছেন, মানবজাতিকে ধ্বংসের মুখে ফেলেছে তিনটি প্রধান বিপদ। এক. মহামারি, দুই. দুর্ভিক্ষ, এবং তিন. যুদ্ধ।
হারারির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে আমরা প্রথম দুটি বিপদ (মহামারি ও দুর্ভিক্ষ) অনেকটাই জয় করেছি।
মহামারির ইতিহাস নিঃসন্দেহে ভয়ংকর ও বিভীষিকাময়। কিন্তু আশার কথা হলো, আধুনিক মাইক্রোবায়োলজির সাফল্যে আমরা কোভিড-১৯-এর মতো প্রাণঘাতী ভাইরাসকে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছি।
ম্যালেরিয়া মশার কামড়ে ছড়ায়—রোনাল্ড রস ও তাঁর সহকর্মীরা কীভাবে তা আবিষ্কার করেন, ছেলেবেলায় আমরা সেই গল্প পাঠ্যবইয়ে পড়েছি। তার আগে বহু মানুষ ম্যালেরিয়ার জন্য সন্ধ্যার বাতাস বা অলৌকিক কারণকে দায়ী করতেন। কুসংস্কার ছিল মানুষের একমাত্র ব্যাখ্যা। অথচ প্রকৃতিতেই ছিল প্রতিষেধক—দক্ষিণ আমেরিকার সিঙ্কোনা গাছের ছাল থেকে তৈরি কুইনাইন।
আরও পড়ুনগাজা থেকে ইউক্রেন—যে কারণে এত যুদ্ধ২১ জুলাই ২০২৫কলেরাকে একসময় বলা হতো ‘ওলা ওঠা’; শরৎচন্দ্রের রচনায় ‘ওলাদেবী’র মতো পৌরাণিক চরিত্রের কথা আমরা পড়েছি, যিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়ে প্রাণ হরণ করেন। অথচ এই মরণব্যাধির মূল কারণ ছিল দূষিত পানি। আজ এক চিমটি লবণ, এক মুঠো গুড় ও বিশুদ্ধ পানি দিয়ে বানানো ওরস্যালাইনই সেই ‘ওলাদেবী’কে হার মানিয়েছে।
টাইফয়েড, প্লেগ, ব্ল্যাক ফিভার, সিফিলিস ইত্যাদি বহু রোগ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল স্মলপক্স বা বসন্ত, যা দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী জনপদকে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল।
আজ বিজ্ঞান সে রোগকেও চিরতরে বিলুপ্ত করেছে—বসন্ত এখন কেবল গবেষণাগারের বিষয়।
হারারির দ্বিতীয় শত্রু—দুর্ভিক্ষ। মানব ইতিহাসে হাজারো দুর্ভিক্ষ নথিবদ্ধ আছে। কিন্তু গত ১৫০ বছরে দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৭ থেকে ১২ কোটি মানুষ। যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল একটির কারণ, তবে যুদ্ধ, প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক অবহেলা ছিল আরও বড় কারণ।
আরও পড়ুনমহামারি ও যুদ্ধ অপুষ্টি বাড়িয়েছে৩১ জানুয়ারি ২০২৪আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি, খাদ্যশস্যের অধিক উৎপাদন, গুদামজাতকরণ ও বৈজ্ঞানিক বিতরণব্যবস্থা আজ দুর্ভিক্ষকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এনেছে।
তৃতীয় বিপদ—যুদ্ধ। ১৮০০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। হারারি মনে করেন, যুদ্ধের পেছনের যুক্তিগুলো আজকাল আর তেমন কার্যকর নয়। একসময় যুদ্ধ হতো জমি, সম্পদ ও সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য। কিন্তু আধুনিক যুগে সেই প্রয়োজন অনেকটাই বিলুপ্ত।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, যদি চীন আমেরিকার সিলিকন ভ্যালি সামরিক শক্তি দিয়ে দখল করতে চায়, তবে তার খরচ হবে বিপুল। বরং সেখানে বিনিয়োগ করলে লাভ হবে বহুগুণ। আজকের দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো ‘মানব মেধা’, যা অস্ত্র দিয়ে জবরদস্তিমূলকভাবে দখল করা যায় না।
এই যুক্তিতে হারারি আশাবাদী যে হোমো স্যাপিয়েন্স একসময় রূপ নেবে ‘হোমো ডিউস’ বা এক প্রকার দেবতুল্য প্রজাতিতে। তারা বিজ্ঞানের সহায়তায় শত শত বছর বাঁচবে এবং শুধু বড় দুর্ঘটনাতেই তাদের মৃত্যু হবে।
আরও পড়ুনগাজা নিয়ে ‘গণহত্যামূলক সাংবাদিকতা’ করছে নিউইয়র্ক টাইমস২৬ জুলাই ২০২৫কিন্তু বাস্তবতা এই আশাবাদের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। বইটি প্রকাশের পরপরই শুরু হয়েছে ইসরায়েল-হামাস সংঘাত এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি এখন আর অলীক নয়, বাস্তবতার অংশ। রাশিয়া পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, তাদের অস্তিত্ব যদি হুমকির মুখে পড়ে, তাহলে তারা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে।
এমন কিছু ঘটে গেলে, হারারির পূর্বাভাস যে ভুল প্রমাণিত হবে, তা বলাই বাহুল্য। যদিও তা দেখার মতো তখন কেউ থাকবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
ইরান যদি ইসরায়েলের ওপর বড় ধরনের হামলা চালায়, তাহলে ইসরায়েল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে না—এমন নিশ্চয়তা নেই। হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ১৯৭৩ সালের ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধে ইসরায়েলের গোলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং তারা মিসরের ওপর পারমাণবিক হামলার চিন্তা করছিল।
সেই পরিস্থিতিতে তিনি জরুরি ভিত্তিতে ইসরায়েলকে অস্ত্র ও বিমান সরবরাহ করেন।
বিশ্ব রাজনীতির আরেক উদ্বেগজনক দিক হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় পরিবর্তন। ৯/১১-পরবর্তী সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের বিখ্যাত ঘোষণা ছিল—‘যদি তুমি আমাদের সঙ্গে না থাকো, তাহলে তুমি আমাদের শত্রু’। এটি শুধু রাজনৈতিক বার্তা নয়, বরং একধরনের বৈশ্বিক দম্ভ ও আধিপত্যবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।
অর্থনৈতিক দুর্বলতা, নেতৃত্বের দৈন্য এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব যুক্তরাষ্ট্রকে এমন এক আগ্রাসী ভূমিকা নিতে বাধ্য করেছে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে ইউক্রেন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে চলছে অস্থিরতা, সংঘাত ও মানবিক বিপর্যয়। শান্তি যেন এখন শুধুই এক কৌশলগত বিলাসিতা।
মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ—মানব ইতিহাসের এই তিন মহাশত্রুর বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম এবং বিজ্ঞানের সাহায্যে মানবজাতির অগ্রযাত্রা নিঃসন্দেহে অনন্য এক অধ্যায়। তবে যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে কৌশলগত স্থিতিশীলতা ও টেকসই শান্তির ভিত্তি রচনা করাই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
নইলে ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়া হোমো ইরেক্টাস, হোমো হ্যাবিলিস কিংবা নিয়ান্ডারথালের মতো আমরাও, মানে আধুনিক হোমো স্যাপিয়েন্স একদিন হারিয়ে যেতে পারি সময়ের গর্ভে, অসীম শূন্যতায়।
তুষার কান্তি চাকমা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা